বিভাজনের মাধ্যমে প্রতিনিধিত্ব নির্মাণের ধারণাঃ ভারতের বিচারব্যবস্থায় গোষ্ঠীভিত্তিক বিন্যাস

01/02/2021
IiT English Page

প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে ঠিক কিভাবে সাজালে সমাজের দুর্বল গোষ্ঠীগুলির স্বার্থকে সবচেয়ে ভালোভাবে জায়গা দেওয়া যায়? সমাজ বিজ্ঞান বহু দিন ধরেই এই প্রশ্নটি নিয়ে মাথা ঘামালেও এ সম্বন্ধে যা গবেষণা হয়েছে তার অনেকটা অংশই সংরক্ষণের একটি সুনির্দিষ্ট বিন্যাসকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। তবে, রাজনীতিশিক্ষা বা বেসরকারী সংস্থা যাই হোক না কেন, বাধ্যতামূলক সংরক্ষণ শুধুমাত্র এক ধরনের প্রতিনিধিত্বকেই জায়গা দেয়। এই জাতীয় অন্তর্ভুক্তি সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলিকে অধিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলিতে প্রবেশের অধিকার দিলেও, উচ্চতর স্তরের ক্ষেত্রে এই প্রতিনিধিত্ব যথেষ্ট কম এবং অনেক সময়ই তা কেবল কাগজপত্রে লেখা বর্ণনাতেই আটকে থাকে। এইভাবেই সমাজের মূলধারা এই গোষ্ঠীর মানুষের স্বার্থকে প্রান্তে ঠেলে রাখে।

তবে, শুধুমাত্র অন্তর্ভুক্তিমূলক নয়বিভাজনের উপর ভিত্তি করেও প্রতিনিধিত্ব সম্ভব এবং এর পাশাপাশি, কোন গোষ্ঠীকে উপস্থাপনা করার আরো যে বিভিন্ন ধরনের উপায় আছে যেগুলি নিয়ে খুব বেশি তাত্ত্বিক আলোচনা হয় নি। এই ধরনের প্রতিনিধিত্বের নকশায়, রাষ্ট্র এমন একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ভিত্তিক পদ্ধতি চালু করে তার ফলে প্রান্তবাসী গোষ্ঠীগুলি সম্পূর্ণভাবেই নিজের নিজের সম্প্রদায় পরিচিতি অনুযায়ী জায়গা পান। যেমন, রাজনীতির ক্ষেত্রে দেখা যায়, (সম্মিলিত ভোটদাতাদের বদলে) পৃথক ভোটার দল তৈরিযাতে (ক) বিশেষ সম্প্রদায়ের জন্য আসন সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে এবং (কেবলমাত্র সংখ্যালঘু ভোটদাতারাই এই আসনগুলিতে ভোট দিতে পারেন। মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য ১৯০৯ সালে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়, এবং পরবর্তীকালে অন্যান্য সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর নেতারা নিম্মবর্ণের ক্ষমতায়ন ও সামাজিক উন্নতির হাতিয়ার হিসাবে এই নীতি ব্যবহারের সমর্থনে এগিয়ে আসেন।

আজকাল, নির্বাচনের ক্ষেত্রে আলাদা বা সম্প্রদায়ভিত্তিক প্রতিনিধিত্বের ধারণা প্রায় লোপ পেলেও, বিচারব্যবস্থার ক্ষেত্রে এই ধারণার অনেক বেশি প্রয়োগ হচ্ছে। তার ফলে এই বিকল্প নকশাটির স্বপক্ষে ও বিপক্ষের যুক্তিগুলিকে বুঝে ব্যাখ্যা করার মত আধুনিক উদাহরণ আমাদের হাতে আছে। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগের শেষের দিকে, ব্রাজিল ও ভারতসহ গ্লোবাল সাউথের দেশগুলিতে অপরাধের ক্ষেত্রে পুরোপুরি মহিলা পরিচালিত প্রতিষ্ঠান চালু করার মধ্যে দিয়ে ক্ষমতায়নের হাতিয়ার হিসাবে বিভাজনকে ব্যবহারের ধারণাকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছিল। তার ফলে ক) বিশেষ গোষ্ঠী দ্বারা পরিচালিত পুলিশ থানা প্রতিষ্ঠিত হয় খ) একমাত্র ওই নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর সদস্যরাই যাতে এই সংস্থাগুলি থেকে পরিষেবা পেতে পারেন তার ব্যবস্থা করা হয়। ভারতে শুধুমাত্র সবচেয়ে বেশী সংখ্যক মহিলা পরিচালিত থানাই যে না আছে তা নয়, তার পাশাপাশি মহিলাকেন্দ্রিক বিচারালয়, তপশিলী জাতি ও উপজাতি জন্য থানা (একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের জন্য ও তাদের দ্বারা পরিচালিত), এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এইভাবে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার পিছনে যে ধারণাটি কাজ করে তা হল যে, সংরক্ষণ ও সর্ববর্গীয় প্রতিনিধিত্ব নির্মাণের প্রচেষ্টার পরেও সংখ্যাগুরুর হাতে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী বিভিন্ন ধরনের বঞ্চনার শিকার হতে পারে। তাই, তত্ত্বের দিক থেকে দেখলে, আইনানুগভাবে বা প্রাতিষ্ঠানিক স্তরে গোষ্ঠীগুলিকে বিচ্ছিন্ন করে, তাদের জন্য নিজস্ব প্রতিষ্ঠান অথবা “এনক্লেভ” বা “নির্দিষ্ট নিরাপদ স্থান” নির্মাণ করলে, পরিষেবা দেওয়া সহজতর হবে শুধু নয়, তার পাশাপাশি বৈষম্য ও পক্ষপাতদুষ্ট ব্যবহারের হাত থেকেও তাঁরা মুক্তি পাবেন। 

আমার কিছু গবেষণাপত্রে আমি এই বিভাজনের মধ্যে দিয়ে প্রতিনিধিত্বের ধারণার আনুষঙ্গিক খুঁটিনাটি নিয়ে অনুসন্ধান করেছি। উত্তর ভারতের মহিলা থানার প্রেক্ষিতে আমি এই গবেষণা চালিয়েছি। আমার প্রথম সমীক্ষায় আমি দেখিয়েছি, কি ভাবে আলাদা প্রতিনিধিত্বের নকশার ভিতরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিভাজন ঘটে। সংখ্যালঘু প্রশাসন ও লিঙ্গ ভাবনার এই পৃথকীকরণ থেকে, বিশেষত পরম্পরাগত সামাজিক নিয়মকানুনের পরিবেশে, এমন ঘটনা ঘটতে পারে যা একেবারেই পরিকল্পনার বাইরে।  মাইক্রো লেভেল বা ক্ষুদ্র স্তর থেকে পাওয়া অপরাধসংক্রান্ত তথ্য এবং অন্যান্য তথ্যের উৎস ব্যবহার করে আমি দেখানোর চেষ্টা করেছি যে শুধুমাত্র মহিলাকেন্দ্রিক সংস্থা প্রতিষ্ঠার ফলে অন্যান্য প্রতিষ্ঠান (যেমন, গতানুগতিক পুলিশ থানাগুলি) তাদের হাতে আসা অভিযোগগুলিকে ওই মহিলানির্ভর থানার দায়িত্ত্বে পাঠিয়ে দিতে চাইতে পারে, যার ফলে লিঙ্গসংক্রান্ত বিষয়গুলি “মূলধারার” শৃঙ্খলাব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে প্রান্তে সরে যাবে।  তার উপরে, যদি মহিলা প্রশাসকদের শুধুমাত্র এই ধরনের লিঙ্গভিত্তিক কাজই দেওয়া হয় তাহলে তা তাঁদের অন্যান্য কাজের ক্ষমতা (যেমন, খুন বা অপহরণ জাতীয় অপরাধের তদন্ত) বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। এ বিষয়ে আমার অভিমত হল, “নির্দিষ্ট নিরাপদ স্থান” তৈরির ফলে, আপাতবিরোধীভাবে, একটি পুংশাসিত এক্তিয়ারের ক্ষেত্র তৈরি হবে আর মহিলাকেন্দ্রিক সংস্থাগুলিকে ওই ক্ষেত্রের প্রেক্ষিতেই বিচার করা হবে এবং তার ফলে গোষ্ঠীভিত্তিক বৈষম্য আরো বেড়ে যাবে। 

দ্বিতীয় সমীক্ষায়, প্রত্যক্ষ বিভাজন (উদাহরণ, নির্দিষ্ট নিরাপদ স্থান তৈরি) এবং পেশাগত বিভাজনের (যেমন, মহিলা পদাধিকারীদের মধ্যে লিঙ্গভিত্তিক কাজের সামঞ্জস্যহীন বন্টন) ফলাফল নিয়ে আরো জানার জন্য আমি উত্তর ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যের থানায় নৃতাত্ত্বিক সমীক্ষা চালিয়েছি। আমি প্রমাণ পেয়েছি যে, শুধুমাত্র মহিলাকেন্দ্রিক থানাগুলিতে অভিযোগকারীনি অবশ্যই অনেক স্বচ্ছন্দে ও নির্ভাবনায় কথা বলার সুযোগ পাচ্ছেন। তবে তার সঙ্গে সঙ্গে এও দেখেছি যে অনেক সময়ই এই সংস্থাগুলি “কাউন্সেলিং” নামের এমন এক ধরনের আটপৌরে ন্যায়বিচারের সঙ্গে জড়িয়ে থাকতে পারে যা লিঙ্গভিত্তিক হিংসার শিকারকে তার আক্রমণকারীর সঙ্গে মিটমাট করে নেওয়ার পরামর্শ দেয়।  অন্যভাবে বলতে গেলে, আইনপ্রয়োগকারী কর্তাদের মাথায় “ন্যায়বিচারের অধিকারের” একদমই নিজস্ব একটি সংজ্ঞা থাকতে পারে এবং শুধুমাত্র লিঙ্গপরিচয়ের উপর ভিত্তি করে প্রশাসনিক ক্ষমতার বিভাজন করলেই যে প্রথাগত বিচারব্যবস্থায় চরম কোন পরিবর্তন আসবে এমন নাও হতে পারে।

তৃতীয় সমীক্ষায়, আমার সহলেখক শ্যারন বার্নহার্ড ও আমি (পেশাগত) বিভাজন কোনভাবে আইনকানুন প্রয়োগের কর্মকর্তাদের প্রভাবিত করে কিনা তা পরীক্ষা করেছি। বিভাজনের মধ্যে দিয়ে প্রতিনিধিত্ব নির্মানের পিছনে একটি কারণ হল, বিশেষত তাঁরা যখন কোন লিঙ্গভিত্তিক প্রশ্নের মুখোমুখি হন সেই সময়গুলিতে ধরেই নেওয়া হয় যে, মহিলারা সমলিঙ্গের প্রশাসনিক কর্মীদের উপর অনেক বেশি বিশ্বাস রাখেন। নিউ দিল্লী টেলিভিশন নামে ভারতের একটি সংবাদ সংস্থার সঙ্গে যুক্ত তথ্যচিত্র নির্মাতাদের সহায়তায় আমরা একটি ভিডিও নির্ভর নিরীক্ষা চালিয়েছি। এতে আমরা দেখিয়েছি যে লিঙ্গনির্ভর অপরাধের তদন্ত করার ক্ষেত্রে উত্তরদাতারা পুরুষ পুলিশের থেকে মহিলা পুলিশদের প্রতি অনেক কম সদয় এবং এই অভ্যাস, বিশেষ করে, মহিলাদের মধ্যেই বেশি। কিছু খবরকে বিশেষভাবে কারসাজি করে বদলে মহারাষ্ট্র রাজ্যের এক হাজারের বেশি নমুনা উত্তরদাতাকে দেখান হয়। এই সংবাদগুলিতে তদন্তকারী আধিকারিকের লিঙ্গ ও এবং তদন্তের বিষয় বদলে দেওয়া হয়েছিল। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, যখন মহিলা উত্তরদাতারা একজন মহিলা পুলিশকে বিয়ের পণ বিষয়ক একটি ঘটনার তদন্ত করতে দেখছেন তখন উল্লেখযোগ্যভাবে, তাঁদের হাতে ওই মহিলা পুলিশের মূল্যায়ন, পুরুষ পুলিশের থেকে অনেক কম অনুকূল হতে পারে। এই জাতীয় ফলাফল থেকে বোঝা যায় যে, একই লিঙ্গ পরিচয় এবং গোষ্ঠী পরিচয়ের উপর ভিত্তি করে কর্মীর দায়িত্ত্ব নির্ধারনের জন্য নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান চালু হওয়া মানেই যে সরকারী কর্মচারীর উপর বিশ্বাস সতঃস্ফূর্তভাবে  বেড়ে যাবে, তা একেবারেই নয়।   

তাত্ত্বিক অবদান ছাড়াও, এই ধরনের নীতির কিছু সম্ভাব্য পরিণতি আছে। এই নীতিগুলির পরিকল্পনা ও প্রতিষ্ঠিত সাংস্কৃতিক আচারআচরণ ও আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে অনেক সময়ই, নানা অপ্রত্যাশিত রাস্তায়, পারস্পরিক যোগাযোগ তৈরি হতে পারে। তাই এগুলি প্রয়োগের সময় এই আচারআচরণ ও কাঠামোগুলিকেও বিবেচনায় আনা প্রয়োজন। যেমন, গোষ্ঠীপরিচয়কেন্দ্রিক সংস্থাগুলিকে বিকল্প সংস্থান হিসাবে পরিকল্পনা করা পরেও যদি ওই সংস্থায় আসা অভিযোগকে অন্যের দায়িত্ত্বে পাঠিয়ে দেওয়ার উপায় থাকে তাহলে বোঝা কঠিন যে এই জাতীয় পরিকল্পনার ফলে সুফল পাওয়ার সুযোগ বেড়ে গেল না কমে গেল।  এছাড়াও, কোন রাজ্যের পরিকাঠামো দুর্বল হলে ওই রাজ্যের আইনরক্ষকরা অনেক সময়ই কর্মীর অভাব এবং অতিরিক্ত দায়িত্ত্বের মত সমস্যার মুখোমুখি হন। যাতে লিঙ্গহিংসার অভিযোগগুলিকে পুলিশকর্মীরা যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে দেখেন তা নিশ্চিত করতে এই সমস্যাগুলির সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। তার উপর, পুলিশী ব্যবস্থার উপসংস্কৃতি বা যে বৃহত্তর আইনী কাঠামোতে কোন বিশেষ বিষয়কে অন্যগুলির চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার অভ্যাস দৃঢ়ভাবে নিহিত, তার ভিতরেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রশাসনিকদের পক্ষপাতদুষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। লিঙ্গ সংবেদনশীলতা এবং অন্যান্য ধরনের প্রশিক্ষণ এই জাতীয় মনোভাব ও আচরণের বদল আনতে পারে। অবশেষে বলা যেতে পারে, আলাদা প্রতিনিধিত্বের নীতি যদি নেওয়া হয়েও থাকে, তবে তা সংরক্ষণের মত সর্ববর্গীয় পরিকল্পনার পরিবর্তে যেন না হয়। যথেষ্ট সংখ্যক মহিলা কর্মী ছাড়াই যদি নিরাপদ স্থান তৈরি করা হয় তবে তা সংখ্যাগুরুর আধিপত্য পূর্ণ সমুদ্রে নগণ্য দ্বীপের মতই হবে এবং তার পাশাপাশি, পুরুষ ও মহিলা প্রশাসকদের মধ্যে আন্তঃগোষ্ঠী যোগাযোগ আরো কমে যাবে।  ইতিমধ্যে সক্রিয় পুলিশ থানায় যথেষ্ট মহিলা কর্মী নিযুক্ত করলে তা কেবল নির্দিষ্ট গোষ্ঠীনির্ভর সংগঠনগুলিকে শুধুমাত্র সমস্ত ধরনের কাজ (লিঙ্গভিত্তিক ও লিঙ্গ নির্বিশেষে) পরিচালনারর ক্ষমতাই দেবে না, তার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পেশাগত বিভাজনের ব্যবস্থাকে ব্যাহতও করতে পারে।  

নির্বিকার জস্‌সল

Author

নির্বিকার জস্‌সল স্ট্যান্ডফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কিং সেন্টার অন গ্লোবাল ডেভেলপমেন্টের একজন পোস্টডক্টরাল ফেলো।

(Bangla Translation by Sritama Halder)
অনুবাদঃ শ্রীতমা হালদার