কোভিড-19 রোগের দ্বিতীয় ঢেউ ভারতকে ছারখার করে দিয়েছে এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থা ধ্বসে পড়েছে। এমনকি, যে তুলনামূলকভাবে উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণী আগে বিশ্বমানের বেসরকারী চিকিৎসার সুযোগ পেতেন তাঁরাও এই অব্যবস্থার মুখোমুখি হয়েছেন। হাসপাতালের বিছানা, অক্সিজেন আর জীবনদায়ী ওষুধের মত প্রাথমিক পরিষেবা সরবরাহ মারাত্মকভাবে কমে গিয়েছিল। সরকারী হিসাবে তিন লাখের বেশি মানুষ এই সময় প্রাণ হারান, কিন্তু বেসরকারী হিসাব অনুযায়ী মৃতের সংখ্যা ত্রিশ থেকে চল্লিশ লাখের মধ্যে। এই সময়, প্রধানত স্বাস্থ্যব্যবস্থার দিকের সমস্ত দেশের মনোযোগ থাকলেও, একই সঙ্গে, দ্বিতীয় ঢেউ-এর কারণে তৈরি হওয়া অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের দিকেও তাকানো এবং প্রথম ঢেউ-এর পর যে সংকট দেখা দিয়েছে তার থেকে শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন।
গত বছরে ভারতে কোভিড-19 সংক্রমণের যে প্রথম ঢেউ এসেছিল, স্বাস্থ্যের প্রেক্ষিতে তার প্রভাব তুলনামূলকভাবে অনেকটাই হাল্কা হলেও, লকডাউন এবং সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া আটকাতে যে পদক্ষেপগুলি নেওয়া হয়েছিল তার ফলাফল হিসাবে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে মে মাসের মধ্যে যে দেশজোড়া লকডাউন চলে তার ফলে দশ কোটি কর্মী তাঁদের জীবিকা হারান। ২০২০-র শেষের দিকে অর্থনীতিনির্ভর কাজকর্ম শুরু হলেও, এই সংকটের প্রতিক্রিয়া এতই তীব্র ছিল যে দেড় কোটি শ্রমিক কর্মহীন অবস্থায় থেকে যান এবং শ্রমের বাজার ও পারিবারিক আয়ের ক্ষেত্রে, অর্থনীতি মাত্র আংশিকভাবে ঠিক হয়। ২০২০ সালের অক্টোবর মাসের মরশুমভিত্তিক পরিবর্তনশীল মাথাপিছু আয় ২০২০-র ফেব্রুয়ারী মাসের থেকে ষোল শতাংশ কম ছিল।
“স্টেট অফ ওয়ার্কিং ইন্ডিয়া: ওয়ান ইয়ার অফ কোভিড-19” নামে আজিম প্রেমজী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২১ সালের মে মাসের বিবৃতিটিতে প্রথম ঢেউ-এর কথা মাথায় রেখে চাকরী, আয়, বৈষম্য এবং দারিদ্রের উপর অতিমারীর প্রভাব নথিভুক্ত করা হয়। প্রথম ঢেউ-এর পর সাহায্য দানের জন্য যে নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল সেগুলির কার্যকারিতাও এই বিবৃতিতে খতিয়ে দেখা হয়। ভারতীয় অর্থনীতি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র বা সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি (সিএমআইই)-এর দ্বারা পরিচালিত কর্মসংস্থান ও উপার্জনের বিষয়ে জাতীয়স্তরে ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বমূলক পারিবারিক সমীক্ষার মাসিক তালিকা থেকে পাওয়া তথ্য এই বিবৃতিতে ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়াও, প্রথম ঢেউ-এর পর সাহায্য যোগানের জন্য নেওয়া উপায়গুলির প্রভাব নিয়ে কাজ করেছে এমন আরো দুটি সমীক্ষার সাহায্যও নেওয়া হয়।
প্রথম ঢেউ-এর প্রভাব পুরুষ কর্মীদের চেয়েও বেশি তীব্রভাবে পড়েছে মহিলাদের কর্মসংস্থানের উপর। ২০২০-র লকডাউন এবং তার পরবর্তী মাসগুলিতে একষট্টি শতাংশ নাগরিক নিজেদের জীবিকা অর্জনের উপায় বজায় রাখতে পেরেছেন, আঠাশ শতাংশ কর্মহীন হলেও বছর শেষ হওয়ার আগেই আবার কাজ পেয়ে গিয়েছেন। সাত শতাংশ কাজ হারানোর পর এই বছরের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত আবার কাজ পান নি। লকডাউন চলাকালীন, এই একই সময়ের মধ্যে, মাত্র উনিশ শতাংশ মহিলা কাজে টিঁকে থাকতে পেরেছেন, সাতচল্লিশ শতাংশ মহিলা স্থায়ীভাবে কর্মহীন হন। তাঁরা এমনকি ২০২০-র শেষের দিকেও আর কাজে ফিরতে পারেন নি।
নকশা ১: পুরুষের তুলনায় কর্মরত মহিলাদের কাজ হারানোর এবং আবার কাজে ফিরতে না পারার সম্ভাবনা বেশি।

তথ্যসূত্রঃ স্টেট অফ ওয়ার্কিং ইন্ডিয়া ২০২১
কোভিড-19 অতিমারীর প্রথম বছর চাকরীর ক্ষেত্রে অসংগঠিতকরণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। ২০২০ সালের শেষের দিকে সংগঠিত ক্ষেত্রের বেতনভুক্ কর্মীদের প্রায় অর্ধেক, হয় স্বনির্ভর (ত্রিশ শতাংশ), অনিয়মিত (দশ শতাংশ) বা অসংগঠিত বেতন উপার্জনকারী (নয় শতাংশ) হিসাবে অসংগঠিত কাজের দিকে চলে যান। গত বছর দেখা গেছে যে, কৃষি, নির্মাণ এবং ছোট কারবারের মত বৃত্তিগুলি আয়ের গুরুত্বপূর্ণ বিকল্প উপায় হিসাবে উঠে এসেছে। তবে দ্বিতীয় ঢেউ-এর পর, এই ক্ষেত্রগুলিও কাজ ও উপার্জনের জন্য মরিয়া শ্রমিকদের আরেকটি স্রোতকে স্থান দিতে অক্ষম হয়ে পড়তে পারে।
অতিমারীর ফলে, বিশেষ করে দরিদ্র পরিবারগুলি, বেশ কয়েক পা পিছিয়ে গেছেন। কোভিড-19 পূর্ববর্তী মাসগুলির সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে যে, ২০২০ সালের মার্চ থেকে অক্টোবরের মধ্যে উপার্জন কমে গেছে এবং এই হ্রাসের পরিমাণ ক্রমশ বেড়ে গেছে। নিচের পার্সেন্টাইলের পরিবারগুলির ক্ষেত্রে এই উপার্জনের হ্রাস অনেক বেশি এবং উপরের পার্সেন্টাইলের পরিবারগুলির ক্ষেত্রে তা খানিকটা কম। তবে, এঁদের মধ্যে সব চেয়ে উপরের স্তরের যাঁরা আছেন তাঁদের ক্ষেত্রে পরে তা সামান্য বেড়েছে। নিচের দশ শতাংশের স্তরে অবস্থান যে পরিবারের, এই সময় তাঁরা ১৫,৭০০ টাকা হারিয়েছেন। অর্থাৎ, সাধারণত দুই মাসে তাঁরা যা আয় করেন তার চেয়েও বেশি হারিয়েছেন।
নকশা ২: দরিদ্র পরিবারগুলির উপার্জনই তুলনামূলকভাবে বেশি কমেছে

তথ্যসূত্র ও টীকা: কর্মরত ভারতের অবস্থা, এগুলি গ্রোথ ইনসিডেন্স কার্ভস যেখানে কোভিড-19 অতিমারীর আগের আট মাসে (জুলাই ২০১৯ - ফেব্রুয়ারি ২০২০) প্রতিটি পার্সেন্টাইলের যে মরশুমভিত্তিক পরিবর্তনশীল আয় ছিল তার সঙ্গে কোভিড-19 আক্রমণের প্রথম আট মাসের (মার্চ-অক্টোবর ২০২০) আয়ের তুলনা করা দেখানো হচ্ছে। বিশদে জানতে বিবৃতির টীকার অংশটি দেখুন।
অতিমারীর কারণে, ন্যূনতম মজুরিতে (গ্রামাঞ্চলে মাথাপিছু ১০৭ টাকা এবং শহরাঞ্চলে মাথাপিছু ১২০ টাকা) কাজ করেন এমন শ্রমিকের সংখ্যা অনেকটাই বেড়ে গেছে। প্রথম ঢেউ-এর সময় এই সংখ্যা তেইশ কোটি বেড়েছে। অতিমারী না ঘটলে এই ধরনের শ্রমিকের সংখ্যা পাঁচ কোটির বেশিই কমত।
নকশা ৩: অতিমারী শুরু হওয়ার পর থেকে দারিদ্র প্রচণ্ড বেড়ে যেতে দেখা গেছে।

এই সংকটের সঙ্গে যুঝতে পরিবারগুলি বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করছেন। তাঁরা দৈনিক খাদ্যের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছেন, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও অন্যান্য সম্পদ বিক্রি করে দিচ্ছেন আর বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় ও মহাজনের কাছ থেকে টাকা ধার করছেন। আজিম প্রেমজী ইউনিভার্সিটি কোভিড লাইভলিহুড ফোন সার্ভে একটি ভয়াবহ তথ্য জানিয়েছেন। এই সার্ভের বিবৃতি অনুযায়ী, নব্বই শতাংশ উত্তরদাতা জানিয়েছেন যে, তাঁদের খাবারের পরিমাণ কমাতে হয়েছে। আরো ভয়ংকর ব্যাপার, কুড়ি শতাংশ জানিয়েছেন যে লকডাউনের ছয় মাস পরও তাঁরা তাঁদের খাদ্যের পরিমাণ বাড়াতে পারেন নি।
যদিও কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার নানা রকম সাহায্যদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, কিন্তু যাঁদের সহায়তার প্রয়োজন সেই অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল জনগোষ্ঠীর একটা ছোট অংশের কাছে সেই সাহায্য গিয়ে পৌঁছেছে। সাহায্যদানের দুটি মুখ্য পদক্ষেপ ছিল, পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম (পিডিএস) অধীনে অতিরিক্ত খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ করার এবং যে মহিলাদের জন-ধন অ্যাকাউন্ট আছে, তিন মাস ধরে প্রতি মাসে তাঁদের পাঁচশ টাকা করে দেওয়ার ব্যবস্থা করা। যে টাকা দেওয়া হয়েছিল তার পরিমাণ খুবই অল্প কারণ, নিচের স্তরের ডিসাইলে যে পরিবারগুলি আছেন তাঁরা ২০২০-র মার্চ-অক্টোবরের মধ্যে ১৫,৭০০ টাকা হারিয়েছেন। এছাড়াও, এই অর্থদান কর্মসূচীর পাল্লা খুবই সীমিত; আর্থিকভাবে দুর্বল পরিবারগুলির মধ্যে মাত্র পঞ্চাশ শতাংশের এই কার্যক্রমের জন্য নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতা ছিল।
প্রথম ঢেউ-এর অনুসরণ করে উপস্থিত হওয়া দ্বিতীয় ঢেউ-এর ধাক্কা অর্থনৈতিক দিক থেকে আরো বেশি বিধ্বংসী হবে। প্রথমটির সময়ই অসংখ্য পরিবারের সঞ্চয় এবং এই সংকটের মোকাবিলার অন্যান্য উপায়ে ক্ষয় ধরেছে। এক বছরের কম সময়ের মধ্যেই আরো একটি অর্থনৈতিক ধাক্কার আঘাত থেকে পরিবারগুলিকে বাঁচাতে প্রয়োজন সরকারের কাছ থেকে অতিরিক্ত সহায়তা। বিবৃতিটিতে নিম্নলিখিত জরুরী পদক্ষেপগুলি নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে: বিন্যামূল্যে খাদ্যসামগ্রী দানের কার্যক্রমটিকে অন্তত ২০২১-এর শেষ পর্যন্ত চালিয়ে নিয়ে যাওয়া (যা ইতিমধ্যেই আংশিকভাবে শুরু হোয়ে গেছে); যতগুলি আর্থিকভাবে দুর্বল পরিবারকে উপস্থিত ডিজিটাল পরিকাঠামোর আওতায় আনা সম্ভব সেগুলিকে তিন মাস ধরে প্রতিমাসে পাঁচ হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়া; গ্রামাঞ্চলে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের যে সরকারী কর্মসূচী আছে সেগুলির সম্প্রসারণ এবং এই ধরনের কাজের মজুরি বাড়িয়ে রাজ্যের ন্যূনতম মজুরির হারের সমান করা; শহরাঞ্চলের সব চেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জায়গাগুলিতে একটি করে পরীক্ষামূলক কর্মসংস্থান কার্যক্রম চালু করা। সম্ভব হলে এই কার্যক্রমের লক্ষ্য হবেন মহিলা কর্মীরা।
ঠিক সময়ে পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হওয়ায় ফলে বহু বছরের প্রচেষ্টায় দারিদ্রের নিম্নতম ধাপে যে অগ্রগতিটুকু অর্জন করা গেছিল তার পুরোটাই নষ্ট হয়েছে। দারিদ্রের বৃদ্ধির পাশাপাশি সঞ্চয় ও উৎপাদনক্ষম সম্পদের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার ধাক্কায় অসংখ্য পরিবার প্রবল দারিদ্রের জালে আটকা পড়ে যেতে পারেন। যার ফলাফল পুষ্টি ও শিক্ষায় ঘাটতি। এছাড়াও, যেহেতু বিশাল সংখ্যক মহিলা কর্মী ক্রমাগত শ্রমের বাজার থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন তাই, কাজের জায়গায় ইতিমধ্যেই যে লিঙ্গবৈষম্য দেখা যায় তার অবস্থা আরো খারাপ হয়ে চলেছে। অল্পবয়সী কর্মীরা কয়েক বছরের কাজের অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের সুযোগ হারাবেন, যা তাঁদের উপার্জন ও সৃজনশীল উৎপাদন ক্ষমতায় সুদীর্ঘ প্রভাব ফেলতে পারে। সহজভাবে বলতে গেলে, এই ধরনের প্রাথমিক নিরাপত্তা সরবরাহের ব্যবস্থা চালু হতে যদি আরো সময় লাগে তাহলে এই মুহূর্তে এই দেশের অধিকাংশ মানুষ যে কঠিন অবস্থাকে জয় করার চেষ্টা করছেন বা হার মেনে নিচ্ছেন তা শুধু আরো দীর্ঘায়তই হবে না। বরং এর ফলাফল হিসাবে আরো অসংখ্য নেতিবাচক ঘটনার সুদূর প্রসারী ঢেউ দেখা দেবে।