পৃথিবীর অন্যান্য অনেক দেশের মতই, ইউএস আর ভারত কোভিড-19 অতিমারী প্রতিরোধের লড়াইতে সামিল হয়েছে। গত বছর, নিউ ইয়র্কের মত অনেক শহরই অতিমারীর ভয়াবহতম আক্রমণে আন্দোলিত হচ্ছিল। এই বছরের শুরুতে কোভিডের প্রাণঘাতী দ্বিতীয় ঢেউ ভারতে আছড়ে পড়ে। দেশের রাজধানী দিল্লীসহ, দেশের অনেক অংশই তুমুল অক্সিজেনের ঘাটতির মুখোমুখি হয়। এমন একটা সময়ও এসেছে যখন এি দেশে একদিনে চার লক্ষের বেশি সংক্রমণের ঘটনাও ঘটেছে।
সম্প্রতি, এই অতিমারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইউএস এবং ভারত নিজেদের মধ্যে সহযোগিতার ভাব দ্রুত বাড়িয়ে তুলেছে। লক্ষণীয় বিষয় হল, বাইডেন প্রশাসন যখন দায়িত্বে আসে, তখন অনেকেরই ধারণা হয়েছিল যে, বিশেষত ইউএসের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মধ্যে যে সৌহার্দ্য ছিল তার পর, দুই দেশের সরকারের মধ্যে যে সম্পর্ক ছিল তা নষ্ট হয়ে যাবে। সৌভাগ্যক্রমে, এই ধরনের কোন সমস্যা তৈরি হয় নি।
সহযোগিতার একটি দীর্ঘ ইতিহাস
স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে, দুই দেশের মধ্যে একটি সুদীর্ঘ সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্কের ইতিহাস আছে। ইউএসএআইডি, এইচএইচএস, সিডিসি, এফডিএ এবং এনআইএইচ-এর মত সংস্থাগুলি গত সত্তর বছর ধরে “ভারতের দুর্বলতম গোষ্ঠীগুলির স্বাস্থ্যের উন্নতি এবং এই দেশের জনগণের হিতের জন্য ভারতীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে একযোগে কাজ করে চলেছে”। এছাড়া আছে ভিএপি বা ইন্ডো-ইউএস ভ্যাক্সিন অ্যাকশান প্রোগ্রাম যা কিনা এনআইএইচ, ভারতীয় জৈব প্রযুক্তি বিভাগ বা ইন্ডিয়ান ডিপার্টমেন্ট অফ বায়োটেকনোলজি (ডিবিটি) আর ভারতীয় চিকিৎসা গবেষণা পরিষদ বা ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ (আইসিএমআর)-এর পারস্পরিক সহযোগিতায় ত্রিশ বছরের বেশি সময় ধরে চলা কর্মসূচী।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ট্রাম্প যখন ভারতে এসেছিলেন, সেই সময় দুই দেশ একটি যুগ্ম বিবৃতি প্রকাশ করে। এই বিবৃতিতে বলা হয়, “বিশ্বব্যাপী অভিনব কোভিড-19 সংক্রমণের মত অন্যান্য রোগের প্রাদুর্ভাবের প্রতিরোধ, সনাক্তকরণ এবং প্রতিক্রিয়া জানানোর যে প্রক্রিয়া চলছে তার সমর্থনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প রোগের প্রকোপ প্রতিরোধ, আগাম রোগ সনাক্তকরণ এবং দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানানোর যে সফল প্রচেষ্টা শুরু করেছেন তা চালিয়ে যাওয়ার প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ”। কিন্তু, প্রয়োজনের সময় দেখা গেল যে পরিস্থিতি আসলে একেবারেই অন্য রকম এবং ভারত সরকার, কেন্দ্র এবং রাজ্য দুই স্তরেই, অসতর্ক অবস্থাতেই রয়ে গেছে।
মনে রাখা দরকার যে, দ্বিতীয় ঢেউ এই দেশে আছড়ে পড়ার আগেই, “ভ্যাক্সিন মৈত্রী” পরিকল্পনার পরিচালনায় ভারত অন্যান্য দেশে টিকা সরবরাহ করছিল। অনেক দেশ এই কর্মসূচীর দ্বারা উপকৃত হলেও পরে ভারতেই টিকার ঘাটতি শুরু হলে তা প্রবল সমালোচনার মুখোমুখি হয়।
২০২১-এর এপ্রিল মাসের শেষের দিকে যখন সারা ভারতের হাসপাতালগুলিতে অক্সিজেনের তুমুল ঘাটতি দেখা দিয়েছিল তখন ইউএস প্রতিশ্রুতি দেয় যে, “আগামী দিনে আমাদের অংশীদার দেশ ভারতকে একশ মিলিয়ন ডলারের প্রয়োজনীয় জিনিস সরবরাহ করা হবে”। এর সঙ্গে সঙ্গে, কোরোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে দুই দেশে সরকারী স্তরে যোগাযোগ ছাড়াও ভারত ও ইউএসের মধ্যে সহযোগিতার আরো নানা পথ আছে। সেগুলির মধ্যে একটি হল কোয়াড (বা কোয়াড্রিল্যাটারাল সিকিউরিটি ডায়ালগ) যার সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া ও জাপানও জড়িত আছে।
২০২১-এর মার্চ মাসে কোয়াডের সদস্য দেশগুলির নেতৃবৃন্দ একত্রিত হয়ে কোরোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে একসাথে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁদের কথায়, “আমাদের জনগণের স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তার প্রতি অবিচলিত দৃষ্টি রাখার পাশাপাশি আমরা বুঝতে পারছি যে, যতদিন এই অতিমারী ছড়াতে থাকবে ততদিন আমাদের মধ্যে কেউই নিরাপদ নয়। তাই আমরা ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে টিকা পাওয়ার উপায় সহজ ও পক্ষপাতশূন্য করার ব্যবস্থা অভেদ্য করার জন্য পরস্পরের সহযোগিতা করব। এর জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশান ও কোভ্যাক্সের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখা হবে”। তবে, বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, কোরোনাভাইরাস অতিমারীর সঙ্গে যে লড়াই চলছে তাতে কোয়াডের সদস্য দেশগুলি নিজেরাই যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত।
এর মধ্যেই, ইউএসের বেসরকারী সংস্থাগুলিও এই কঠিন সময়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। বোয়িং এবং মাস্টারকার্ড মত সংস্থা যেমন প্রত্যেকে দশ মিলিয়ন ইউএস ডলারের আর্থিক সহায়তার প্যাকেজের কথা ঘোষণা করেছে, গুগল আঠেরো মিলিয়ন ইউএস ডলারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। নানা জায়গায় কোভিড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করতে এই অর্থ ব্যবহার করা হয়েছে । যেমন, বেঙ্গালুরুতে বোইং-এর আর্থিক সহায়তায় তৈরি হাসপাতাল। এছাড়াও, অ্যামাজন ভারতের বিভিন্ন জায়গায় হাসপাতালের সহায়তা এবং অন্যান্য কোভিড-19 রোগের সেবাকেন্দ্রগুলির জন্য পাঁচ মিলিয়নের বেশি মূল্যের জটিল চিকিৎসার যন্ত্রপাতি পাঠিয়েছে।
ইউএস চেম্বার্স অফ কমার্সের সঙ্গে ইউএস ইন্ডিয়া বিজনেস কাউন্সিল ও ইউএস ইন্ডিয়া স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড পার্টনারশিপ ফোরামের মত ইউএসের কর্পোরেট ক্ষেত্রও এই কাজে হাত লাগিয়েছে। এদের লক্ষ্য ছিল, কোভিড-19 অতিমারীকে প্রতিরোধ করতে সমবেতভাবে "চল্লিশজন শীর্ষস্থানীয় সিএও একটি বিশ্বব্যাপী বিশেষ কর্মীদল গঠন করবেন যা বিশেষ করে ভারত এবং সাধারণভাবে অন্যান্য দেশকে সাহায্য করবে”। ভারতকে “জটিল চিকিৎসার যন্ত্রপাতি, টিকা, অক্সিজেন ও অন্যান্য জীবনদায়ী সহায়তা”, যেমন অক্সিজেন কনসেনট্রেটর, অক্সিজেন সিলিন্ডার ও টেস্ট কিট সরবরাহ করাই তাঁদের মূল উদ্দেশ্য ছিল।
কাজটি কী সফল হয়েছে?
স্পষ্টতই, কোরোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে এই লড়াইতে, ভারত ও ইউএসের সহযোগিতার বিষয়টি শুরু হতে অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে। এই একযোগে কাজ করার পথে অনেক বাধাবিপত্তিও তৈরি হয়েছিল। প্রথমত, আমেরিকায় তৈরি যে টিকাগুলি ভারতে পাঠান হচ্ছে সেগুলিকে কোনরকম ক্ষয়ক্ষতি থেকে সুরক্ষিত রাখার বিষয়টি। ফাইজার, মডার্না এবং জনসন অ্যান্ড জনসনের মত ইউএসের টিকাপ্রস্তুতকারী সংস্থাগুলি ভারতসরকারের সঙ্গে এই বিষয়ে কথাবার্তা চালালেও এখনো পর্যন্ত এর কোন সমাধান হয় নি। দ্বিতীয়ত, ভারতের ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলির আয়তন এবং আমেরিকার সংস্থাগুলির প্রযুক্তি একসঙ্গে মিলে কাজ করার মধ্যে প্রচুর সম্ভাবনা থাকলেও বিষয়টি এখনো তেমন জনপ্রিয়তা পায় নি। আফ্রিকার কয়েকটি রাষ্ট্রের মত অন্য যেসব দেশ এখনো টিকা পায় নি তাদের জন্য কমমূল্যের টিকা তৈরির জন্য এই সহযোগিতা কাজে লাগত। তৃতীয়ত, এই বছরের শুরুর দিকে ইউএস প্রতিরক্ষা উৎপাদন আইন বা ডিফেন্স প্রোডাকশান অ্যাক্টকে তুলে ধরে ভারতে টিকার কাঁচামাল সরবরাহ করতে অনীহা প্রকাশ করে। এই ঘটনাটি নিয়ে বেশ উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। তবে, পরে এই নিষেধাজ্ঞা উঠিয়েও দেওয়া হয়। এছাড়াও আরো একটি সমস্যা দেখা গিয়েছিল। ভারতের অনেক ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থাই চীন থেকে কাঁচামাল আমদানি করত। চীন-ভারত সম্পর্ক উদ্বেগজনক হয়ে উঠলে এই পরিস্থিতিটি বদলে যায়।
সম্মুখ পন্থা
এই মুহূর্তে নতুন দিল্লীর হাতে চারটি অনুমোদিত টিকা আছেঃ কোভিশিল্ড, কোভ্যাক্সিন এবং স্পুটনিক ভি। এছাড়াও, পরিস্থিতির গুরুত্ব মাথায় রেখে, ভারতীয় ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থা কিপলাকে মডার্না টিকা আমদানি করতে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
অতিমারীর সঙ্গে লড়াই করতে ভারতের সঙ্গে ইউএস সহ অন্য সব দেশের আরো বেশি সহযোগিতা যে অত্যন্ত প্রয়োজন তা খুবই স্পষ্টভাবে বোঝা গেছে। ডেল্টা ও ডেল্টা প্লাসের মত যে ভ্যারিয়েন্টগুলি মাথাচাড়া দিচ্ছে সেগুলি সহ এই ভয়াবহ অতিমারীর সঙ্গে যুদ্ধে জয়ী হতে এখনো অনেক সময় লাগবে। ইউএসের টিকাকরণ কৌশল থেকেও ভারতকে অনেক শিক্ষা নিতে হবে। এই মুহুর্তে ইউএসেতে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষদের মধ্যে প্রায় সাতষট্টি শতাংশ টিকার অন্তত একটি ডোজ পেয়েছেন।
নিউ ইয়র্কের মত শহরের কাছ থেকেও ভারত কিছু জিনিস শিখতে পারে। গত বছর নিউ ইয়র্কের অবস্থা খুবই আশঙ্কাজনক হয়ে উঠলেও এখন তা মোটামুটি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে। নিউ ইয়র্ক সবাইকে কঠোরভাবে গৃহবন্দী থাকার নির্দেশ জারি করে এবং ইউএসের অন্যান্য শহরের তুলনায় এই শহরের ব্যবসাবাণিজ্য অনেক বেশি দিন বন্ধ থাকে। দিল্লী সরকারের মত স্থানীয় প্রশাসন নিউ ইয়র্কের সঙ্গে যুগ্মভাবে কোরোনাভাইরাস পরিস্থিতির পরিচালনা করতে নানা সফল পন্থা গ্রহণ করতে পারে। যেহেতু অনেক বিশেষজ্ঞই ভারতে একটি সম্ভাব্য তৃতীয় ঢেউ সম্পর্কে সতর্ক করছেন, তাই এই শিক্ষাগুলিকে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রোসিডিওর (এসওপি) হিসাবে দ্রুত আত্মস্থ করা প্রয়োজন।
ইউএস থেকে ভারতে যে সমর্থনের জোয়ার শুরু হয়েছে তা সব রাজনৈতিক শিবিরের সমস্ত জায়গা ও দিক থেকেই আসছে। এই জাতীয় সমর্থন আগে ইজরায়েলের মত দেশের জন্যই সংরক্ষিত থাকত। এই খবরকে নিশ্চিতভাবেই স্বাগত জানানো হয়েছে কারণ দুই দেশের মধ্যে কোভিড-19 ক্রমবর্ধমান সহযোগ আসলে অন্যান্য ক্ষেত্রেও সহযোগিতা তৈরির জন্য দৃষ্টান্ত হিসাবে কাজ করছে। তবে, এই সহযোগিতার মনোভাব দৃঢতর হয়ে ওঠার আগেই অনেক দুর্মূল্য সময় ও জীবন নষ্ট হয়েছে। যখন তৃতীয় ঢেউ অন্ধকারের আড়ালে লুকিয়ে অপেক্ষা করছে তখন ভবিষ্যতে এই ঘটনাটি থেকে আমাদের একটি কঠিন শিক্ষা নেওয়া উচিত। যেমন বলা হয়ে থাকে, “যতক্ষণ পর্যন্ত সকলেই সুরক্ষিত হচ্ছেন ততক্ষণ পর্যন্ত কেউই আসলে সুরক্ষিত নয়”।