মূলধনে ভারতের অধিকারজনিত সমস্যা

17/01/2022
IiT English Page

ভারতের ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর জন্য এই দশকটি একটি অস্থির সময় ছিল। ভারতে ব্যবসা করার বেশ কিছু নকশা যা উদারীকরণ-পরবর্তী সময়ে উদ্ভাবিত হয়েছিল, সেগুলি গুরুতরভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে।  এর সঙ্গে সঙ্গেই, ত্রিশ বছরেরও বেশি আগে ভারতের অর্থনীতি বিশ্বের সামনে তার দরজা খুলে দেওয়ার পর পরই যে ব্যবসায়ীদের ভাগ্য ফিরেছিল তাঁদের মধ্যে অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হন। হাই নেট ওয়ার্থ বা বিনিয়োগের জন্য পাঁচ কোটির বেশি উদ্বৃত্ত অর্থ  সহ ব্যক্তিদের দেশত্যাগের হার এবং আয়করের কারণে ও সম্পদ রক্ষার জন্য বিকল্প নাগরিকত্ব ও বসবাসের অনুমতি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা বহু দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরে উঠে গেছে  যা কোভিড 19 এবং তার সঙ্গে জড়িত যাতায়াতের সমস্যার ফলে বরং বেড়ে গেছে। অন্য দিকে, ভারতের স্টার্টআপ ইউনিকর্ন বা ব্যক্তিগত মালিকানায় একশ কোটির বেশি মূল্যের স্টার্টআপগুলির প্রতিনিধিত্বে একটি নতুন শিল্পোদ্যোগীর শ্রেণীকে উঠে আসতে এবং তার পাশাপাশি, কিছু বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর অর্থনৈতিক ভাগ্যের হঠাৎ স্ফীতিকেও আমরা দেখেছি। যখন প্রতি মাসেই বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর বিভিন্ন অধিগ্রহণের তালিকা (স্টার্টআপ, দেউলিয়া ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, পরিকাঠামোকেন্দ্রিক সম্পদ, নতুন চুক্তি ইত্যাদি) খবরের শিরোনাম হয়ে ওঠে, তখন ভারতের নানা শিল্পের ক্ষেত্রেই ক্যাপিটাল কনসেন্ট্রেশান এই নব্য উদারীকরণ-পরবর্তী সময়ের সর্বোচ্চ শীর্ষে উঠছে। যাঁরা প্রতিযোগিতা ও প্রবল আলোড়ন তৈরিতে বিশ্বাসী, তাঁদের জন্য এই অবস্থাটি একটি বিপদসূচক ঘন্টার মত, উদারীকরণের পরের কয়েক দশক ধরে সমস্ত অর্থনীতি জুড়ে শিল্পোদ্যোগের উৎসাহ ঘিরে যে উত্তেজনা দেখা গেছিল বর্তমান অবস্থা তার সম্পূর্ণ বিপরীতে। তবে, বাকিরা ভরসা করে আছেন শিল্পের আয়তন এবং পণ্য উৎপাদনের সর্বনিম্ন সম্ভাব্য মূল্যের মধ্যে সম্পর্ক বা ইকোনমিজ অফ স্কেলের মধ্যে দিয়ে জাতীয় স্তরে জয় হচ্ছে যাঁদের তাঁদের উপর। এই বাকিদের জন্য এই অবস্থাটি একটি প্রয়োজনীয় সংহতিকরণ, সৃজনশীল ধ্বংসের যে অনিবার্য চক্রটি আছে তার বিনাশক দিকটি।  

ভারতের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির প্রাথমিক চালক হিসাবে পাবলিক সেক্টর ব্যাংকিং (পিএসবি)-র পতন এই কাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। এখনও ভারতের বৃহত্তম ঋণদাতা হওয়া সত্ত্বেও, নন-পারফর্মিং অ্যাসেট (এনপিএ) বা যে ঋণের আসল বা সুদ দীর্ঘকাল ধরে অনাদায়ী অবস্থায় আছে তার সুদীর্ঘ ছায়ার নিচে পিএসবি-র ডুবতে থাকা  বাজার শেয়ার, ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষেত্রে (বিশেষ করে শিল্প ও পরিকাঠামোর জন্য প্রয়োজনীয় ঋণের ক্ষেত্রে) পুরো প্রতিষ্ঠানের অন্তর্নিহিত বিতৃষ্ণা, পাবলিক মার্কেট নিয়ে অবিশ্বাস (স্টকের দ্রুত পড়তে থাকা মূল্য), এবং রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক পরিকাঠামোর হস্তক্ষেপে এড়িয়ে নিজেদের স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা নিয়ে গভীর সন্দেহ ইত্যাদি সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। পেন্সন তহবিল, সভরেন ওয়েলথ ফান্ড বা রাষ্ট্রের অধীনস্থ তহবিল যা স্টক, বন্ড, ভূসম্পত্তি, সোনারূপো জাতীয় মূল্যবান ধাতু ও অন্যান্য বিকল্প বিষয়ের মত আসল ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করে, ব্যক্তিগত ইকুইটি লগ্নীকারী, বহুজাতিক বাণিজ্যিক সংস্থা ও বহুপাক্ষিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া সস্তা পুঁজিতে যখন দুনিয়া ভরে গেছে তখন ভারতের অনেক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানই পিএসবি-র থেকে ঋণ গ্রহণের কাঠামো থেকে বেরিয়ে যাওয়াকেই বেছে নিচ্ছে। পিএসবি-র ঋণে অনেক সময়ই রাজনৈতিক অর্থের ছায়া থাকে এবং ভারতের বৃহত্তম ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলি তাই সেদিকে আর না গিয়ে নানা বিদেশী সংস্থা থেকে মূলধন তুলছে ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী বাণিজ্যিক গাঁটছড়া বাঁধছে। নতুন অর্থনীতি ও ছোট ব্যবসা খুব কমই পিএসবি ব্যবহারের সুযোগ পায়; গত কয়েক দশকের মধ্যে পিএসবির আঞ্চলিক শাখা স্তরে ঋণদানের ব্যবস্থা প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে এবং স্টার্ট আপে বিনিয়োগ করার বা মাইক্রো, স্মল ও মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ (এমএসএমই) - এর আন্তঃসম্পর্কের জটিল জালের উপর বড় সংখ্যার বাজি রাখার কথা বিবেচনা করা পিএসবিগুলির কাছে একটি সুদীর্ঘ ও কঠিন লড়াই। যখন পিএসবিগুলি নন-ব্যাঙ্কিং ফিনান্সিয়াল কোম্পানি (এনবিএফসি)-র মাধ্যমে মধ্যস্থতাকারীর সাহায্যে ঋণদানের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করে তখন, দুর্ভাগ্যবশত, কেন্দ্রীভূতভাবে অন-লেন্ডিং বা এই ধরণের ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা আবার তৃতীয় পক্ষকে ধার দেওয়ার মত ঘটনা ঘটছিল (যেমন, ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিজিং অ্যান্ড ফিনান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড) যার ক্ষত এখনও টাটকা। মূলত বড় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে ঋণ দিতে অভ্যস্ত পিএসবি মূলধন পাওয়ার ক্ষেত্রে যে শূন্যস্থান রেখে গেছে তা অংশত কিন্তু অনুপযুক্তভাবে পূরণ করেছে সমবায়, আঞ্চলিক ব্যাংক, ক্ষুদ্র ফিনান্স ব্যাংক, ক্ষুদ্রতর এনবিএফ, ফিনটেক শিল্পোদ্যোগ এবং বলাই বাহুল্য, অন্যান্য অসংঠিত ফিনান্স প্রতিষ্ঠানের মত অর্থনীতির ক্ষেত্রে ছোট খেলোয়াড়রা। পিএসবির কাছে এখনও হয়ত বিনিয়োগের জন্য সুবিশাল আমানত আছে, কিন্তু এই মুহূর্তে, ঋণ নেওয়া বা টাকা তোলার জন্য ঋণদাতা হিসাবে ভারতের অনেক বড় ব্যবসাই আর পিএসবিগুলিকে বিবেচনা করছে না। 

কেন বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এই ব্যাংকগুলি থেকে সরে এসেছে তার অংশত কারণ পিএসবি কিভাবে ভারতের নতুন দেউলিয়া আইনগুলির প্রয়োগ করেছে। এই দেউলিয়া ঘোষণা করার আইনী প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে একজন আর্থিক দুর্দশাগ্রস্ত প্রোমোটার তাঁর মালিকানার সম্পূর্ণ স্বত্ত্ব হারাবেন। এই জাতীয় ব্যবসা অধিকাংশ সময়েই সামাজিক সুখ্যাতি ও প্রোমোটার, পিএসবি এবং বৃহত্তরভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতার মধ্যের পুঁজিনির্ভর (অনেক সময়ই অনুচিতভাবে পাওয়া) পারস্পরিক সম্পর্কের উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে। অনেক প্রোমোটারই যে ইন্সলভেন্সি অ্যান্ড ব্যাংকরাপ্টসি কোডের সঙ্গে জড়িত নতুন আইনী প্রক্রিয়াগুলিকে দীর্ঘায়ত ও বিপর্যস্ত করতে সমস্ত সম্ভাব্য কৌশল অবলম্বন করেছেন তা একেবারেই আশ্চর্যজনক ঘটনা নয়। কোন রকম ঝুঁকি নিতে গররাজি পিএসবি, যেভাবে যে ঘটনাগুলিতে সন্দেহের অবকাশ আছে সেগুলির ক্ষেত্রেও আইবিসি প্রয়োগ করে তাও খুব একটা সাহায্য করে না। তাছাড়াও মন্দার সময় অন্যান্য ব্যাংক যে উপায়ে এই জাতীয় সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করে যেমন, ঋণগ্রহীতার সঙ্গে আবার আলোচনায় বসা, হেয়ারকাট অর্থাৎ সুদের কিস্তি না দিতে পারলে ঋণ নেওয়ার সময় জামানত হিসাবে রাখা সম্পদকে বাজার মূল্যের থেকে কম মূল্যে বিক্রি করা বা অন্যান্য কম তীব্র পন্থা, তা অনুসরণ করার ইচ্ছা পিএসবিগুলির মধ্যে কমই দেখা যায়। এই নীতিগত পক্ষাঘাত, যা ২০১০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে দেশের আমলাতন্ত্রকে আঘাত করে তা এখন পিএসবিগুলির মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে এবং তার ফলশ্রুতি হিসাবে শিল্পে ঋণদানের পরিমাণ বৃদ্ধি হওয়ার বদলে সর্বকালীন নিম্নতম স্তরে চলে গেছে। ব্যাংকের সহকর্মীদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির পর্ব যখন চলছে তখন উচ্চস্তরের আধিকারিক ও ঋণের খেলাপ করেছেন এমন ব্যক্তিদের অনেক বেশি নিরাপত্তা পেতে দেখে বিপর্যস্ত অনেক মধ্যস্তরের কর্মকর্তাই রাজনীতির গন্ধ মাখা ঋণদান প্রক্রিয়ার খারাপ দিকগুলির দায় নিতে চাইছেন না। তার বদলে তাঁরা বরং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলিকে আইবিসিতে পাঠাতে ও উপভোক্তাকে ঋণ দেওয়ার কাজেই ব্যস্ত থাকছেন এবং কোন শিল্পক্ষেত্রে ঋণদানের বিষয়টিকে ব্যাপকভাবে এড়িয়ে চলছেন। এবং যে ধরনের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে তাঁরা ঋণ দিতে চাইছেন (ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্যিক সংগঠনগুলিকে এবং যাদের ভালো ক্রেডিট রেটিং আছে) তাঁরা সব সময় সেই ঋণ নিতে চাইছেন না।  

এই জটিল ইকোসিস্টেমকে ঠিক করে পিএসবি এবং অর্থনীতির বাজারকে অর্থপূর্ণভাবে সংশোধন করার বদলে বরং পিএসবিগুলিকে একেবারেই বাদ দিয়ে দেওয়ার প্রবণতাকে বাড়তে দেখা যাচ্ছে। ক্ষমতাবান নতুন মধ্যস্থকারীরা হলেন তাঁরাই যাঁরা বিদেশী পুঁজির ভাষায় কথা বলতে পারেন। এঁদের মধ্যে আছেন স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠাতারা যাঁরা তাঁদের ব্যবসার ভবিষ্যত কল্পনাকে বিনিয়োগকারীর কাছে বিক্রি করতে পারেন। আছে নানা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান যেগুলি এফএএএনজি (ফেসবুক, অ্যামাজন, অ্যাপল, নেটফ্লিক্স, গুগল)-র কাছ থেকে মূলধন আকর্ষণ করতে পারে এবং ভারতের অনিশ্চিত বাণিজ্যিক পরিবেশে বিশ্বাসযোগ্য রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের প্রতিশ্রুতি দিতে পারে। এছাড়াও আছে কিছুদিনের মধ্যেই স্টার্টআপ ইউনিকর্নে পরিণত হবে এমন সংগঠন যাদের ইনিশিয়াল পাবলিক অফারিং (আইপিও)-এর মূল্য খানিকটা ব্যক্তিগত ইকুইটির সাহায্যে দ্রুত বাড়িয়ে দেওয়া যায়। আছে রিয়েল এস্টেট সংগঠন যারা ইএসজি তহবিলে টায়ার-১ ভারতের গ্রিন সার্টিফিকেট অর্থাৎ নবায়নযোগ্য শক্তিউৎস থেকে উৎপন্ন বিদ্যুৎশক্তি ব্যবহার করার প্রমাণপত্র সহ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে তৈরি ভবনগুলি নির্মাণের জন্য প্রচুর অর্থের যোগান দিতে পারে। এদের পাশাপাশি পরামর্শদাতা ও বিনিয়োগের সঙ্গে যুক্ত ব্যাংকাররাও আছেন যাঁরা আন্তর্জাতিক পুঁজি ও ভারতীয় ব্যবসাগুলির মধ্যস্ততাকারী হিসাবে কাজ করেন। পুঁজির বিষয়ে মধ্যস্ততা করা ও তাকে নিয়ন্ত্রণ করার কাজ সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু, ব্যাঙ্কিং-এর ক্ষেত্রে কৃতী ব্যক্তিদের মধ্যে একটা বিশাল সংখ্যার নানা ব্যক্তিগত ইকুইটি প্রতিষ্ঠান ও এমএনসিতে পরামর্শদাতা হিসাবে যোগদান থেকেই বোঝা যায় যে, এই ক্ষেত্রে যে সব অভিনেতা ও ফিনান্সিয়াল প্রতিষ্ঠান অংশ নিত তা গত দশকের মধ্যেই ঠিক কতটা নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে। 

বড় ফিনান্সিয়াল প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে যে আঞ্চলিক ও স্থানীয়ভাবে যে ঋণ দেওয়ার রীতি ছিল তা ধ্বংস হয়ে যাওয়াটাই সম্ভবত এই পরিবর্তনের সব চেয়ে সমস্যাজনক ফলাফল। ২০২০ সালের মার্চ মাসের শেষে, ভারতের দশটি এলাকা দেশের চুয়ান্ন শতাংশ আমানত বিতরণের জন্য দায়ী ছিল। জাতীয়করণের আগে, স্বল্প ঋণগ্রহীতা ও ছোট ব্যবসা, তাদের ঋণ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা ও তা সুদসহ ফেরত দেওয়ার ক্ষমতা সম্বন্ধে বিস্তারিতভাবে জানত বলেই সিন্ডিকেট ব্যাংকের মত ব্যাংকগুলির সুনাম তৈরি হয়েছিল। গত কয়েক দশক ধরে পিএসবিসহ অনেক বড় আকারের ফিনান্সিয়াল প্রতিষ্ঠানই বেশি মূল্যের ঋণের দিকে ছুটছে, যার ফলে তাদের আঞ্চলিক শাখার কাজকর্ম ব্যাহত হয়েছে। শর্ত ও নিয়মাবলীর বিশদ তালিকা, নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনীয় নানা বিষয় এবং বিস্তারিত প্রশাসনিক কাজকর্মের জন্য পিএসবিগুলিতে ঋণ দেওয়ার কাজের পরিচালনা সংক্রান্ত খরচ অনেক বেড়ে গেছে। এই ঘটনাটিও স্বল্প ঋণদানের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার আরেকটি কারণ।     

ব্যাংক-এর কাজের প্রণালী নিয়ে যে বড় প্রশ্নটি উঠে এসেছে তা হল, ভারতের নির্ধারিত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলি কি সত্যিই দেশের সমস্ত প্রান্তের - বড় ও ছোট, সংগঠিত ও অসংগঠিত - সমস্ত ধরণের ব্যবসায়িক সংগঠনকে মূলধনের অধিকার দিচ্ছে? ব্যাংকের কাজকর্মের ডিজিটাইজেশান এবং এনবিএফসি-র জন্য ঋণের ক্ষেত্রে উদারতর নীতির প্রয়োগের ফলে গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন সম্ভব হয়েছে। আয়ফিনান্সের মত স্টার্টআপগুলি স্থানীয় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে বিশেষভাবে লক্ষ্য করে ঋণ দেওয়ার ক্ষেতে বিপ্লব নিয়ে এসেছে। যে ক্ষুদ্রতর ফিনানশিয়াল প্রতিষ্ঠান পরিচিতি ও নিজেদের কাজের অঞ্চল সম্বন্ধে বিস্তারিত জ্ঞানের জন্য এমএসএমই গুলিকে ঋণদানের জন্য অনেক বেশি উপযুক্ত তাদের সঙ্গে একত্রে ঋণদানের বিষয়টিকে অনেক বেসরকারী ব্যাংকই পরীক্ষা করে দেখছে।      কিন্তু ক্ষুদ্রতর ব্যবসাগুলির সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে পিএসবিগুল সম্ভবত এখনও বেশ দ্বিধাগ্রস্থ এবং তারা বড় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে জড়িত এনবিএফসিগুলির সঙ্গেই ব্যাপকভাবে অংশীদারিত্বে যাচ্ছে যা স্বাভাবিকভাবেই উদ্বেগ তৈরি করছে। দেশের ক্ষুদ্র ব্যবসাগুলিকে ঋণ দেওয়ার বিষয়টি শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট ছোট অংশের কাজ হওয়া উচিত নয়; যেমন, একমাত্র নীতিনির্ধারণের সময় স্মল ইন্ডাস্ট্রিজ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার মত সংস্থাগুলির সঙ্গে মাঝে মধ্যে পরামর্শ করা হয়। সমস্ত বড় ব্যাংকের জন্যই এই ছোট ব্যবসায়ীদের ঋণ দেওয়ার কাজটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পারদর্শিতা ছিল এবং সেটাই হওয়া উচিত। তা সত্ত্বেও, গত ত্রিশ বছরে পিএসবির বিবর্তনের পথটি অনেকটাই অন্যদিকে ঘুরে গেছে।  

অর্থনৈতিক কেন্দ্রীভবন বিভিন্ন চেহারা নিয়ে আসেঃ কেবলমাত্র কয়েকটি বাছাই করা ভৌগোলিক অঞ্চলের ক্রেডিট পাওয়ার যোগ্য ব্যবসাকে ঋণ দেওয়া, কারা বিদেশী পুঁজির বাজারের অধিকার পাবে তার গণ্ডি বেঁধে দেওয়া, রাজনৈতিক পরিসরকে অগ্রাধিকার দিতে এই ব্যাংকগুলিকে বাধ্য করা যায় বলে দেশের সিংহভাগ দেনা পিএসবির মাধ্যমে দেওয়ার ব্যবস্থা করা, নিজের রাস্তা তৈরি করার বদলে ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত স্থানীয় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে বহুজাতিক কোম্পানীগুলিকে উৎসাহিত করা। ভারত এই যে কোভিড-19 চরম ক্ষতি ও এবং এনপিএ সংক্রান্ত সংকটের সুদীর্ঘ ছায়া থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে সেই সময়ে দাঁড়িয়ে, দেশীয় ব্যবসাগুলি কি ভাবে ব্যাংক থেকে ঋণ পাবে ব্যবস্থার পুনর্গঠন করার সুযোগ আছে। কিন্তু, ফিসক্যাল স্টিমুলাই, অর্থাৎ বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে সাহায্য করতে সরকারী উদ্যোগে রাজস্ব ও নিয়ন্ত্রণ কমান বা সরকারের ব্যয় বাড়িয়ে দেওয়া নিয়ে বক্তব্য ও এমএসএমই-র বৃদ্ধি এখনও পর্যন্ত দেশীয় ব্যবসাকে টাকা দেওয়ার যে ক্ষমতা ব্যাংকের আছে তার অনেক পিছনে পড়ে আছে। হাতে গোনা কয়েকটি নিগমের মধ্যে অতিরিক্ত কেন্দ্রীভবনের নেতিবাচক প্রভাব থাকতে পারে, বিশেষ করে যখন সেগুলি চিরাচরিত ভ্যালু চেইন বা যে শৃঙ্খলের মাধ্যমে পণ্য ও পরিষেবা সরাসরি উপভোক্তার কাছে পৌঁছে যায় তার শেষে নিজের জায়গা করে নেয় এবং ছোট ব্যবসার কাছ থেকে লাভের অংশ কেড়ে নেয়। নিগমগুলির এই ভূমিকার বিষয়টিকে খুব কমই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। জাপান বা দক্ষিণ কোরিয়ার মত, ভারতেরও উচিত জাতীয় স্তরে একটি সেরা বিজয়ী গোষ্ঠী তৈরি করা। কিন্তু তার বদলে এই দেশ বিপজ্জনকভাবে রাশিয়া বা মেক্সিকোর ছাঁদে তৈরি অভিজাততন্ত্রের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। আমরা শুধু আশা করতে পারি যে এই উদীয়মান অর্থনীতির আবহাওয়াইয়, প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতাবানদের আরো অর্জন ও অধিগ্রহণে ইন্ধন যোগানোর বদলে, সৃজনশীল নবাগতরা বরং তাঁদের সঙ্গে অকৃত্রিম প্রতিযোগিতায় নামবেন।   

রোহিত চন্দ্র

Author

রোহিত চন্দ্র ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি, নিউ দিল্লীর পাবলিক পলিসির সহকারী অধ্যাপক

(Bangla Translation by Sritama Halder)
অনুবাদঃ শ্রীতমা হালদার