কোসি-মেচী সংযুক্তিকরণ প্রকল্পটি কার উপকারে আসবে?

11/04/2022
IiT English Page

২০১৮ সালে, অন্তর্দেশীয় জলপথের নতুন সংযুক্তিকরণের বিষয়ে ভারত ও নেপালের যুগ্ম ঘোষণার পরেই, বিশেষ করে কোসি ও গণ্ডক নদী এবং বিহারের গঙ্গার মত নদীর যে জলপথগুলিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে কি ভাবে সেগুলির উন্নয়ন করা হয়, তা বোঝার জন্য মন্থন অধ্যয়ন কেন্দ্রের গবেষণাকারীদের একটি দলের সঙ্গে আমি বিহার ও নেপালে গিয়েছিলাম। নদীখাতের পরিবর্তন ও স্থানান্তরের সঙ্গে জড়িত বৈশিষ্ট এবং সমস্যাগুলি নিয়ে তদন্ত করা, নৌবহনযোগ্য নদীখাতের সর্বত্র সমান গভীরতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে যে সমস্যার মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা আছে এবং অতিরিক্ত পলি জমলে তা তুলে আনার প্রক্রিয়ার মত বাহ্যিক হস্তক্ষেপের যে প্রভাব পরিবেশের উপর পড়ে, সে বিষয়ে একটি প্রকল্পের উপর আমরা কাজ করছিলাম। 

হনুমান নগর ব্যারেজের লক আর গেটগুলি পেরনোর সময় নেপাল থেকে আগত বদ্রীজি, যিনি আমাদের পূর্ব কোসি খাল এবং নদীর জল নিকাশের জন্য ব্যবহৃত সাইফনগুলি দেখাচ্ছিলেন, তাঁর সঙ্গে কথা বলি। তিনি আমাদের জানান যে, এই অংশে মাটির নিচে তিনটি ও মাটির উপরে একটি সাইফন আছে। “মাটির উপরের সাইফনটি তৈরি হওয়ার পরেই কাজ করা বন্ধ করে দেয়। কারণ এটিকে নদীর উপরিতল থেকে অনেক উঁচুতে বসান হয়েছে”। কি ভাবে খালের রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে জল জমার মত নানা সমস্যা শুরু হয়েছে, যার ফলে খালের ডানদিকের অংশের চাষাবাদ প্রভাবিত হয়েছে সে বিষয়েও তিনি অনেকক্ষণ ধরে আলোচনা করেন।   

বদ্রীজির এই উদ্বেগকে প্রতিফলিত করে এমন সাহিত্য ও কন্ঠস্বরের একটি ক্রমবর্ধমান সংগ্রহ তৈরি হচ্ছে যা ভারতের নদী সংযোগ প্রকল্পগুলির প্রতিকূল প্রভাবকে জনসমক্ষে তুলে ধরছে। জল উদ্বৃত্ত হয় এমন জায়গা থেকে জলের ঘাটতি আছে এমন জায়গায় জলের যোগান দেওয়ার বন্দোবস্তের উপর ভিত্তি করে জল শক্তি মন্ত্রকের অধীনস্থ জাতীয় জল উন্নয়ন সংস্থা বা ন্যাশনাল ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি (এনডাবলিউডিএ) অনেকগুলি আন্তঃরাজ্য নদী সংযুক্তিকরণ প্রকল্পের প্রস্তাব করেছে। এর পাশাপাশি, এই মন্ত্রক আন্তঃরাজ্য প্রকল্পের কথাও ঘোষণা করেছে। কেন-বেতোয়া নদী সংযুক্তিকরণ প্রকল্পের পর, এই প্রস্তাবনাগুলির মধ্যে যেটি সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে সেটি হল কোসি-মেচী সংযুক্তিকরণ প্রকল্প। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য হল প্রতি বছর বন্যা ও জল জমার মত সমস্যায় জর্জরিত উত্তর বিহারে বর্ষাকালে জলসেচের ব্যবস্থা করা।      

এনডাবলিউডিএ, জাতীয় দৃষ্টিকোণ পরিকল্পনা বা ন্যাশনাল পার্সপেক্টিভ প্ল্যানের অধীনে ত্রিশটি মুখ্য নদী সংযোগকারী খালের প্রস্তাব রাখে। এই ত্রিশটির মধ্যে ষোলটি উপদ্বীপীয় নদী এবং বাকি চৌদ্দটি হিমালয়াঞ্চলের নদীর সঙ্গে জড়িত (তার মধ্যে ছ’টি সরাসরি বিহারের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়)। ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে নদী সংযুক্তকরণ প্রকল্পের বিশেষ পারিষদীয় অধিবেশন বা স্পেশাল কমিটি মিটিং অফ রিভার লিঙ্কিং প্রকল্পে বিহার সরকারের জলসম্পদ বিভাগ মন্ত্রক এই ধরনের প্রকল্পের আওতাকে আরও প্রসারিত করে বিহারের ক্ষুদ্রতর নদীগুলিকেও যুক্ত করার সম্ভাবনাকে খতিয়ে দেখার জন্য এনডাবলিউডিএ-কে অনুরোধ জানান। বিহারের নদী সংযুক্তিকরণ প্রকল্পগুলির মধ্যে কোসি-মেচী প্রকল্পটিকে ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে বিনিয়োগ ছাড়পত্র বা ইনভেস্টমেন্ট ক্লিয়ারেন্স ও পরিবেশগত ছাড়পত্র বা এনভায়রনমেন্টাল ক্লিয়ারেন্স দেওয়া হয়েছে। ২০১৯-এর এই অধিবেশন চলাকালীন, কেন-বেতোয়া সংযুক্তি প্রকল্পের মত, এই প্রকল্পকেও জাতীয় মর্যাদা দেওয়ার জন্য মুখ্যমন্ত্রী অনুরোধ জানান। 

কোসি নদীর জলের উদ্বৃত্ত অংশকে হনুমান নগর ব্যারেজের মাধ্যমে একটি ১১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ খাল দিয়ে মহানন্দা অববাহিকার মেচী নদীতে ঘুরিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে কোসি-মেচী প্রকল্পটির পরিকল্পনা করা হয়েছে। বর্ষাকালে এই জলকে আরারিয়া, পূর্ণিয়া, কাটিহার ও কৃষাণগঞ্জ জেলার খারিফ শস্য চাষের সময় ব্যবহার করা হবে। বর্ষাকাল বাদে অন্যান্য সময় রবি শস্য চাষের কাজে এই জল ব্যবহারের সুযোগ সপ্তকোশী হাই ড্যামের নির্মাণের উপর নির্ভর করছে এবং এখনও পর্যন্ত তা কোসি-মেচী প্রকল্পের অংশ নয়। কোসি নব নির্মাণ মঞ্চ আন্দোলনের একজন সদস্য মহেন্দ্র যাদব বলেন, কোন এক দিন সপ্তকোশী হাই ড্যাম তৈরি হবে এই কাল্পনিক অবস্থার উপর কোসি-মেচী প্রকল্পটি দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর মতে, কোসি এবং মহানন্দা, এমনকি মহানন্দার উপনদী মেচী – পরিবেশগতভাবে একই মণ্ডলভূক্ত। তাই কোসি নদীতে বৃষ্টি বা বন্যা হলে, সেই একই বর্ষা বা বন্যা দুই একদিনের মধ্যে মেচী বা মহানন্দায় পৌঁছে যায়। বর্ষাকালে দুই অববাহিকাতেই বৃষ্টির জল পাওয়া যায় বলে সেই সময় অতিরিক্ত  জলের কোন প্রয়োজনই নেই। যদি কোসি-মেচী প্রকল্প সত্যিই সেচ প্রকল্প হত, তাহলে তার সাহায্যে রাষ্ট্র রবি শস্য চাষের সময় জলের ঘাটতি সংক্রান্ত সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করত।   

একমাত্র কোসি-মেচী প্রকল্পের প্রকাশ্য শুনানীর নথিটিই এই প্রকল্পের থেকে উপকৃত জেলাগুলির বাসিন্দাদের উদ্বেগগুলিকে লিপিবদ্ধ করেছে এবং যে অঞ্চলগুলি বর্ষাকালে প্রাকৃতিকভাবেই জল পায়, সেখানে আরো জল পৌঁছে দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে দুশ্চিন্তাও এই নথিতেই দেখা যায়ঃ অনেক স্থানীয় বাসিন্দাই ভয় পাচ্ছেন যে, এই অতিরিক্ত জলের কারণে বন্যা ও জলমগ্নতার সমস্যা বেড়ে যেতে পারে, যার ফলে চাষের জমি ধ্বংস হবে।

এই প্রকল্পের যুক্তিহীনতাই একমাত্র সমস্যা নয়। বলা হচ্ছে যে, পরিবেশের উপর এই প্রকল্পটির কোন প্রতিকূল প্রভাব নেই, বরং বিহারের অধিবাসীদের জন্য এর প্রভাব ইতিবাচক। তবে, ইআইএ-র বিবৃতিতে অনেকগুলি গুরুতর ফাঁক দেখা যায়। 

প্রথমে, যে নদী, ছোট নদী এবং জলপ্রবাহ এই প্রকল্পের দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে সেগুলির সংখ্যার দিকে তাকান যাক। পুর্ব কোসি খালের প্রধান শাখাকে সম্প্রসারিত ও পুনর্নিমিত করে, তার মাধ্যমে কোসির জলকে হনুমান নগর ব্যারেজ থেকে মেচী নদীতে নিয়ে যাওয়া হবে। পূর্ব কোসি খালের বর্তমান ৪১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যকে বাড়ানর জন্য ভারত-নেপাল সীমান্তের কাছে ৭৬ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি নতুন খাল সংযোজিত হবে। এর পাশাপাশি, চৌদ্দটি সাইফন জলাধার, নয়টি খাল সাইফন, দশটি ক্রস রেগুলেটর, সাতাশটি হেড রেগুলেটর, নয়টি পাইপ কালভার্ট, তেতাল্লিশটি রোড ব্রিজ, একটি সেটলিং বেসিন ও আটটি এসকেপ খালের নির্মাণও এই প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত। এই খালটি, যার কেবলমাত্র দুটি নদীকে যুক্ত করার কথা ছিল, তার প্রবাহপথে আরও তেরটি নদী পড়বেঃ পারমান, তেহরি, লোহান্দ্রা, ভালুয়া, বকরা, ঘাঘী, পাহারা, নোনা, রাতুয়া, কাওয়াল এবং কাঁকাই। এই খালটি আরও ছোট ছোট জলপ্রবাহের স্বাভাবিক আচরণে হস্তক্ষেপ করতেও পারে, কিন্তু ইআইএ-র যে বিবৃতির উপর ভিত্তি করে এই প্রকল্পটি পরিবেশগত ছাড়পত্র পেয়েছে সেই বিবৃতি অনুযায়ী, প্রকল্পটি চলাকালীনই একমাত্র এই সমস্যাগুলি সামনে উঠে আসবে। তখন হয় এগুলির প্রবাহ ঘুরিয়ে দিয়ে অথবা সংযুক্ত জননিষ্কাশন প্রণালী নির্মাণ করে এই গৌণ জলপ্রবাহ সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান করা হবে। তবে বলা যেতে পারে যে, যে সমস্যার কথা উল্লেখ করা হয় না, তাকে সঠিকভাবে সম্বোধনও করা হয় না।    

দ্বিতীয়ত, এই প্রকল্পটি এবং এর পরিবেশসংক্রান্ত ব্যবস্থাপনা থেকে নদীখাতে পলি জমা বা নদী সংলগ্ন যে এলাকায় প্রাকৃতিকভাবে জল সংগৃহীত হয় বা ক্যাচমেন্ট সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে না। উত্তর বিহারের যে কোন নদী সংযুক্তিকরণ প্রকল্পের টিঁকে থাকার জন্য এই দুটিই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইআইএ-র বিবৃতিটি এমনকি এও স্বীকার করে যে, এই প্রকল্পটি শুধুমাত্র খালের সংযোগের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য এবং তার ফলে, উপযুক্ত তহবিল এবং ব্যবস্থাপনার অভাবে পলি জমা আটকাতে কোন রকম পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে বাধা তৈরি হয়।

তৃতীয়ত, ইআইএ-র বিবৃতিটি দাবি করে যে কোসি-মেচী প্রকল্পের কারণে সংলগ্ন অঞ্চলের বাসিন্দারা বাস্তুচ্যুত বা অন্য কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না এবং তাই, পুনর্বাসনের প্রয়োজনীয়তা বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, জনগোষ্ঠীর উপর এই প্রকল্পের কোন প্রভাবই পড়বে না। একই ইআইএ বিবৃতি অনুযায়ী এই প্রকল্পটির জন্য ১,৩৯৬.৮১ এইচএ (৩,৪৫০ একর) জমি প্রয়োজন যার মধ্যে ৬৩২.২৩ এইচএ (১,৫৬০ একর) জমি ইতিমধ্যেই সংগ্রহ করা হয়েছে। এছাড়াও, শাখাখাল ও শাখানদীর জন্য ৭৬৪.৫৮ এইচএ (১,৮৯০ একর) জমি দরকার। ফলত, এই জমির সঙ্গে জড়িত যে জনগোষ্ঠীর ছিন্নমূল হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে পুনর্বাসন বা ক্ষতিপূরণ প্রয়োজন, তাঁদের অবস্থান অনিশ্চিত হয়ে আছে।

পরিশেষে, নিম্নমুখী জলপ্রবাহের উপর এই প্রকল্পের কি প্রভাব পড়বে তার মূল্যায়ন করা যাবে প্রকল্পটি শুরু হওয়ার পাঁচ বছর পর। এনভায়রনমেন্ট ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্টের আদত উদ্দেশ্য ছিল প্রকল্পটি বিকাশের আগেই সম্ভাব্য প্রভাবের মূল্যায়ন করা এবং তার বাস্তবায়নের সময় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনা ও সমস্যা সমাধানের পদক্ষেপের খতিয়ান করা। 

কোসি-মেচী প্রকল্পকে সবুজ সংকেত দেওয়া হলেও, জমি, জল, পলি ও অন্যান্য অবক্ষেপণ এবং ক্ষতিপূরণের বিষয়ে পূর্ব-মূল্যায়ন এখনও বাকি আছে। এত তাড়াহুড়োর কারণ সম্পর্কে আলোচনা করার সময়, যাদব পূর্ব কোসি খালের বর্তমান সমস্যা নিয়ে ক্ষেদ প্রকাশ করেন ও দাবী করেন যে, এই প্রকল্প আদতে ঠিক যতটুকু ব্যবহার করা হবে, সেই অনুযায়ী তার সুবিশাল সম্ভাবনাকে সংশোধন (হ্রাস) করা হয়েছে। কোসি-মেচী প্রকল্প নিয়ে কথা বলার সময়ও তিনি একই রকম হতাশ। “এই প্রকল্প জল-সরবরাহের জন্য নয়, বন্যা থেকে নিরাপত্তা দেওয়া জন্য নয়, এমনকি এই প্রকল্প একটি নদী সংযুক্তিকরণ পরিকল্পনাও নয়”, তাঁর মতে, যাঁরা এই খাল নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত একমাত্র তাঁদেরই এই প্রকল্প থেকে কোন রকম ফায়দা হবে”।

আভলি ভার্মা

Author

আভলি ভার্মা মন্থন অধ্যয়ন কেন্দ্রের একজন গবেষক। তিনি ইন্ডিয়ান ইনস্টিট্যুট অফ টেকনোলজি, বম্বে থেকে এম.ফিল করেছেন এবং ভারতের নদীর ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান পরিকাঠামোগত হস্তক্ষেপ নিয়ে চর্চা করেন। 

(Bangla Translation by Sritama Halder)
অনুবাদঃ শ্রীতমা হালদার