ভারতের সরকারী ঋণহ্রাসের গঠনতন্ত্র

01/08/2022
IiT English Page

২০২০ সালে ভারতের সভরেন ডেট বা সার্বভৌম ঋণ অর্থাৎ দেশের সরকার যত পরিমাণ অর্থ ঋণ হিসেবে নিয়েছে তা নজিরবিহীন উচ্চতায় পৌঁছে গেছে। এর কারণ অংশত কোভিড-19 অতিমারী প্রকোপ কমাতে নেওয়া পদক্ষেপগুলির পাশাপাশি মোট আভ্যন্তরীণ উৎপাদন কমে যাওয়া এবং সুদের উচ্চহার। অনেকের মতে, সুদের হার কম হলে উচ্চমাত্রায় ঋণ আসলে তেমন উদ্বেগের বিষয় নয়। কিন্তু অত্যাধিক সার্বভৌম ঋণ যে অর্থনীতির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে তার অনেক প্রমাণ পাওয়া যায়।  


এই প্রেক্ষাপটে, আমরা ভারতের সাম্প্রতিক সার্বভৌম ঋণ ও ফিসক্যাল ডেফিজিট সংক্রান্ত সাজিয়ে তোলা তথ্যগুলিকে নথিবদ্ধ করব এবং নিম্নলিখিত প্রশ্নগুলি তুলে ধরব: ভারতের এই উচ্চহারের ঋণের জন্য কি মূল্য দিতে হয়? এর কোন ভাল দিক আছে কি? ভবিষ্যতে কি ঘটতে চলেছে? আমরা ভারতসহ অন্যান্য দেশের ঋণের পরিমাণের “স্ফীতি”, “স্থিতি” এবং “হ্রাস” পর্যায়ের আগে এবং পরের ম্যাক্রোইকোনমিক বা সামষ্টিক অর্থনৈতিক ফলাফলকে বিশ্লেষণ করব। এবং এই বিশ্লেষণের সাহায্যে আমরা জানতে চাইব যে, এই অতিমারী-পরবর্তী আরোগ্যের সময়ে ভারতের ভিন্ন ভিন্ন বিকল্প নীতি এবং সমন্বয়সাধনের প্রক্রিয়ার উপর এই স্ফীতি ও হ্রাসের বিষয়ে অতীতের অভিজ্ঞতা কোন আলোকপাত করতে পারে কিনা।

ভারতের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে যে, কোভিড মহামারীর কারণে দেশের ঋণের পরিমাণ যেভাবে অত্যাধিক মাত্রায় বেড়ে গেছে সেই পরিমাণ বৃদ্ধি আগে কখনও ঘটে নি। কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গেই গড়পড়তা উদীয়মান বাজার বা ইমার্জিং মার্কেট (ইএম) অর্থনীতির তুলনায় এই স্থীতির পরিমাণ অনেকটাই বেশী। এই ঋণস্থীতি প্রক্রিয়ার চালকগুলিও এবার অন্য ধরনের। ভারতে ঋণের পরিমাণ কমানর ক্ষেত্রে মুদ্রাস্ফীতির অবদান থাকলেও, গড় ইএম-এর সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে, রাজস্ব সম্প্রসারণ ও উৎপাদনে ধস – উভয়েই এ ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে।     

সার্বভৌম ঋণের উচ্চহার সত্ত্বেও, ভারতের জন্য এর কিছু ভাল দিকও আছে।, সার্বভৌম ঋণের কতটা অংশ বাইরের দেশগুলির হাতে তা থেকে, এই গবেষণাপত্রের মতে, ভবিষ্যতের সম্ভাব্য ক্ষতির পূর্বাভাস পাওয়া যেতে পারে, এবং ভারতের ক্ষেত্রে এই পরিমাণ অনেকটাই কম। তার উপর, সারা বিশ্বেই ঋণ স্ফীতির পরেই আসে পুনর্বিন্যাস বা ঋণ পরিশোধে অক্ষমতার পর্যায়, যা ভারতের ক্ষেত্রে এখনও পর্যন্ত ঘটে নি। তাছাড়াও, ভারতে দীর্ঘস্থায়ী বাস্তব মূল্যের হার কম যা মধ্যবিন্দুস্থিত ইএম-এর সঙ্গে তুলনাযোগ্য। এই কথা বলার পরেও, আমরা দেখতে পাই যে প্রতিটি দেশের অবস্থাই ভিন্ন। গত দশকে ভারত পঁচিশতম পার্সেন্টাইলের কাছাকাছি ছিল এবং এখন তা মধ্যম বিন্দুতে পৌঁছে গেছে।

আমরা উচ্চমাত্রার ঋণের প্রকৃত মূল্য নথিবদ্ধ করি। এই প্রকৃত মূল্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হল, সুদের অসম্ভব উচ্চ হারের কারণে পরিত্যক্ত সম্পদ, যা কোভিডের সময় ছিল সামগ্রিক রাজস্বের প্রায় ত্রিশ শতাংশ। ভারতের জন্য এই সংখ্যাটি সাধারণ ইএম-এর তুলনায় প্রায় তিন গুণ বেশি।


ঋণ করার ফলে উচ্চহারে সুদ দিতে হয় বলে, কোভিডের মত নেতিবাচক অভিঘাতের দরুন, কাউন্টার-সাইক্লিক্যাল ফিসক্যাল পলিসি বা প্রতিষ্ঠিত অর্থনৈতিক কিংবা ব্যবসায়িক চক্রের বিপরীতে গিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে যে পদক্ষেপগুলি নেওয়া হয় তার জন্য প্রয়োজনীয় পুঁজি অনেকটাই কমে যায়। এবং সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মত যে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলিতে ভারত ইতিমধ্যেই অন্যান্য সমকক্ষ দেশের থেকে অনেক কম ব্যয় করে, সেগুলির খাতে স্পষ্টতই অনেক কম সম্পদ ধার্য করা হয়। প্রকৃতপক্ষে, আমাদের বিশ্লেষণ ইঙ্গিত করে যে, ব্যবসায়িক চক্রের উত্থান ও পতন অন্যান্য সমকক্ষ দেশের তুলনায় ভারতের ঋণের বিভিন্ন প্রকরণের একটি ক্ষুদ্রতর অংশকে চিত্রিত করে, যা ঋণের উচ্চহারের কারণে ঘটা কাউন্টার-সাইক্লিক্যাল ফিসক্যাল পলিসিগুলির ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার ধারণাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে। সহজ হিসেবে, ভারতের সুদের হার, অন্যান্য ইম-এর মতই গড়ে দশ শতাংশে নামিয়ে আনতে পারলে ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ছয় থেকে আট ট্রিলিয়ন অতিরিক্ত সম্পদ পাওয়া যাবে। এই সংখ্যাটি কোভিডের আগে শিক্ষাখাতে সরকার সাধারণত যে অর্থ ধার্য করত তার সমান, এবং দেশের স্বাস্থ্যখাতে যা ব্যয় হত তার তিনগুণ।                 

উচ্চ হারের সরকারী ঋণের জন্য আরেকটি যে মূল্য দিতে হয় তা হল সুদের হার এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যয়ের উপর এর প্রভাব। যদিও বাস্তব মূল্যের হার ভারতে অনেকটাই কম এবং মধ্যবিন্দুস্থিত ইএম-এর সমান, আমরা দেখতে পাচ্ছি যে তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেকটাই বেড়ে গেছে এবং ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেলে তার পাশাপাশি তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যাবতীয় ব্যয়ের পরিমাণও বাড়ছে। ভারতের প্রেক্ষিতে এই বাড়ের হার অন্যান্য সাধারণ ইএম-এর তুলনায় বেশি।     


উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, জিডিপির দেনার গড়ে এক শতাংশ বিন্দু বা পার্সেন্টেজ পয়েন্ট (পিপি) বৃদ্ধির কারণে ভারতের দীর্ঘস্থায়ী ঋণ এবং তার সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যয়ের হার ০.১৯ পিপি বেড়ে যায়, যখন একটি মধ্যবিন্দুস্থিত ইএম-এর জন্য এই বৃদ্ধি হয় মাত্র ০.০১ পিপি। অবশেষে, মূল্যনির্ধারক সংস্থার মূল্যায়ণের প্রক্রিয়ার জন্য সরকারী দেনা একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এই সংস্থাগুলির হিসেব অনুযায়ী, অনুরূপভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে এমন সমকক্ষ দেশের তুলনায় ভারতের ধার ও ঘাটতির হার অনেক বেশি।   

এর পরের পদক্ষেপ কি হতে পারে তা বোঝার জন্য ভারতের নিজের ইতিহাস এবং গোটা দেশের অভিজ্ঞতা খতিয়ে দেখতে হবে। ১৯১৩ সাল থেকে ভারতে নয়টি ঋণস্ফীতি, পাঁচটি ঋণহ্রাস এবং ছয়টি ঋণস্থিতির ঘটনা ঘটেছে। ভারতের ঋণবৃদ্ধির ঘটনা সাধারণত শেষ হয় ঋণস্থিতিতে, যেখানে গড় ইএম-এর ক্ষেত্রে পঁচাত্তর শতাংশ ঋণবৃদ্ধির ঘটনাই ঋণহ্রাসে উপনীত হয়েছে। অন্যভাবে বলতে গেলে, ঋণশোধের অক্ষমতা বা পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার মধ্যে না গিয়েই ভারত ধীরে ধীরে ঋণ শোধ করতে পেরেছে। ঋণহ্রাসের সময় প্রতিবারই ভারত ঋণের অনুপাত বছরে দুই পিপি কমেছে, গড় ইএম-এ যার হার দ্বিগুণেরও বেশি।   

আমরা এও দেখতে পাই, ঋণহ্রাসের ঘটনাগুলির সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায় যে, ঋণস্ফীতির এই পর্বগুলির কারণে অর্থনৈতিক বিকাশ এবং সরকারী বিনিয়োগ অনেকটাই কমে যায় অর্থাৎ সামষ্টিক অর্থনীতির অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকে। তার উপর, সারা দেশ থেকে পাওয়া অসংখ্য প্রমাণ থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, ঋণবৃদ্ধির মাত্রা যত বেশি এবং তার প্রভাব যত সময় ধরে চলবে, ঋণস্ফীতিকে ঘিরে উৎপাদনের হার ততই কমে যাবে। 

ভারতের পক্ষে ঠিক কত পরিমাণ ঋণ কমান সম্ভব? এই প্রশ্নের উত্তর জানার একটি পন্থা হল, সুদ পরিশোধের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ এবং বাজেটে যে অতিরিক্ত সম্পদ ধার্য করা হয় তা খতিয়ে দেখা। যেমন, সুদের জন্য প্রদত্ত অর্থের পরিমাণ কমিয়ে ২২ শতাংশ (যা তারপরেও ইএম-এর যা গড়, অর্থাৎ দশ শতাংশ, তার থেকে অনেকটাই বেশি) করার জন্য ধারের অনুপাতকে সত্তর শতাংশে নামিয়ে আনা দরকার। তাহলে তা অনুরূপভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে এমন সমকক্ষ দেশের মধ্যবিন্দুর কাছাকাছি আসবে।   


সম্ভাব্য রাস্তাটি কি এবং সেই পথে পৌঁছতে ঠিক কতটা সময় লাগবে? উৎপাদনের বৃদ্ধির হার যত বেশি এবং ঋণের পরিমাণ যত কম, রাজস্বের নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা ততই কম হবে। সিমুলেশান অনুশীলনগুলি থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, যদি আমরা আইএমএফ ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক (ডব্লিউইও) অনুযায়ী জিডিপি ৭ শতাংশ হারে ও বাস্তব মূল্য ২ শতাংশ হারে বাড়ছে বলে ধরে নি, আগামী দশ বছরে বর্তমান ঋণের পরিমাণকে সত্তর শতাংশে নিয়ে যেতে হলে (এবং সুদের পরিমাণকে মূল রাজস্বের বাইশ শতাংশ হিসেবে হতে হলে) সাধারণ সরকারী প্রাথমিক ও ফিসক্যাল ডেফিজিটকে ১.৭ শতাংশের এবং জিডিপির ৫.৯ শতাংশের কম হতে হবে। ডব্লিউইও-এর মতে, ২০২২-২৩ অর্থনৈতিক বর্ষের প্রাথমিক ও ফিসক্যাল ডেফিজিট, যা কিনা ছিল মোটামুটি হিসেবে যথাক্রমে ৪.৫ শতাংশ ও ৯.৯ শতাংশ, তার সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে এই প্রক্রিয়াটির জন্য প্রচুর সমন্বয়ের প্রয়োজন। গুরুত্বপূর্ণভাবে, আভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধির হার যত বেশি এবং সুদের হার যত কম হবে এই সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তা ততই কমবে। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, নয় শতাংশ বৃদ্ধির হার অথবা শূন্য শতাংশের বাস্তব হারের ফলে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ১.৭ শতাংশের বদলে তিন শতাংশ প্রাথমিক ঘাটতি অনেক বেশি পরিসর তৈরি করবে, কিন্তু ঋণহ্রাসের পরিমাণ একই থাকবে।


যদিও, উপরের গণনাটি নিরবিচ্ছিন্নভাবে প্রাথমিক ও ফিসক্যাল ডেফিজিটকে ধরেই এগোয়, কিছু পরিবর্তনশীল বিশেষত্বকে মেনে নিয়ে ও সমন্বয়ের উপায়গুলিকে মসৃণতর করে নিয়ে আমরা পাঁচ নম্বর নকশায় পরবর্তী পাঁচ বছরে ভারতের ঋণ ও রাজস্ব নিয়ন্ত্রণের বিষয়টির চিত্রিত বিবরণ তুলে ধরেছি। বাস্তবিকই, অন্যান্য  উদীয়মান অর্থনীতিসহ দেশগুলির উদাহরণ থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে অর্থনৈতিক মন্দার বাইরে প্রাথমিক ভারসাম্যের সমন্বয় সত্যই ঋণহ্রাসে সহায়তা করে। এবং, এর পাশাপাশি তা উৎপাদনের জন্যও ক্ষতিকর নয় কারণ মাল্টিপ্লায়ার এফেক্ট বেশি আত্মবিশ্বাসের মত অন্যান্য উৎস থেকে উঠে আসা ইতিবাচক আবেগের ক্ষেত্রে মোটামুটি একটা ভারসাম্য আসে।

প্রাচী মিশ্র

Author

প্রাচী মিশ্র ওয়াশিংটন ডিসির ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ডের গবেষণা বিভাগের সিস্টেমিক ইস্যুজ ডিভিশনের প্রধান। 

(Bangla Translation by Sritama Halder)
অনুবাদঃ শ্রীতমা হালদার

নিখিল প্যাটেল

Author

নিখিল প্যাটেল ওয়াশিংটন ডিসির ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ডের একজন অর্থনীতিবিদ। 

(Bangla Translation by Sritama Halder)
অনুবাদঃ শ্রীতমা হালদার