২০২১ সালে কোভিড-১৯ অতিমারীর প্রভাব যখন তীব্রতম, যখন ভারতে দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা উচ্চতম এবং ভারত ও চিনের মাঝখানের বিতর্কিত সীমান্ত নিয়ে লড়াইয়ের কারণে দুই দেশের সম্পর্ক আরও জীর্ণ হয়ে উঠেছে, তখনই চাইনিজ কম্যুনিস্ট পার্টি (সিসিপি) তার ওয়াইবো অ্যাকাউন্টে ভারতে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার চিতার একটি ছবি ও চিনের রকেট উৎক্ষেপণের ছবিটি পাশাপাশি রেখে একটি উপহাসমূলক পোস্ট দেয়। এই পোস্টের বর্ণনায় লেখা ছিল, “চিনে যেভাবে আগুন জ্বালান হয় বনাম ভারতে যেভাবে আগুন জ্বালান হয়” (চিত্র ১ দেখুন)। আশ্চর্যজনকভাবে, সিসিপি-এর এই পোস্টটি নিয়ে চিনের নাগরিকদের মধ্যে প্রবল নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, এবং পোস্টটিকে দ্রুত মুছে দিয়ে ভারতের প্রতি চিনের সমর্থন ঘোষণা করা হয়। ভারতের জনগণের প্রতি এই সহমর্মিতার বার্তার পিছনে আছে চিনে আমির খানের তুমুল জনপ্রিয়তা। ওয়েবো ব্যবহারকারীরা লক্ষ্য করেন যে, কোভিডের প্রকোপ শুরু হওয়ার প্রাথমিক পর্বে যাঁরা প্রথম চিনের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন, আমির খান ছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন। ভারতের সমস্ত নাগরিক এবং আমির খান, যিনি এই ঘটনার মাত্র কয়েক মাস আগেই কোভিডে আক্রান্ত হয়েছিলেন, তাঁদের প্রতি জিহু (চিনের রেডিট)-এর মত সামাজিক মঞ্চের উপভোক্তারা গভীর সহানুভূতি জানিয়ে আশা করেছেন, “আমির খান দ্রুত আরোগ্য লাভ করবেন এবং ১.৩ মিলিয়ন ভারতবাসী যত শীঘ্র সম্ভব কোভিডের টিকা নিয়ে যৌথভাবে রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা পাবেন।” এর থেকেই, অতিমারীর পরবর্তী অধ্যায়ে দর্শকদের সহানুভূতিকে রূপদানের ক্ষেত্রে আমির খানের ভূমিকা ঠিক কতটা গভীর তা বোঝা যায়।
চিত্র ১: উৎস: বিবিসি, মে, ২০২১
খানের তারকা-সুলভ খ্যাতি, যার প্রভাব রাষ্ট্রের সংকীর্ণ ভৌগলিক সীমানাকে অতিক্রম করে যায়, তা চিনে যে অনুগ্র ক্ষমতার নির্মাণ করেছে উপরের উদ্ধৃতিটি থেকেই স্পষ্ট। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জোসেফ নাই প্রথম এই “অনুগ্র ক্ষমতার ধারণা”-র উপস্থাপনা করেন এবং এর অর্থ, তাঁর ব্যাখ্যা অনুযায়ী, বিদেশীদের চোখে নিজের দেশকে ইতিবাচক আলোয় উপস্থিত করার জন্য মিডিয়া, পণ্য ও অন্যান্য উপায়ে আকর্ষণের নির্মাণ করা। এই আকর্ষণ নির্মাণের প্রতিক্রিয়া, গতানুগতিক দিক থেকে দেখলে, রাষ্ট্র-কেন্দ্রিক বা অন্তত, রাষ্ট্রের দ্বারা প্রবর্তিত। আমি বলতে চাই, সাংস্কৃতিক কূটনীতির বৃহত্তর পরিসরে, তারকারা, যাঁরা অভিনেতা হিসেবে রাষ্ট্রযন্ত্রের অধীনস্থ নন, তাঁরা রাষ্ট্রের পরিসীমা অতিক্রম করতে সক্ষম। তাই, চিনে খানের প্রভাব বিশেষভাবে স্মরণীয়, কারণ তাঁর তারকা-সুলভ উপস্থিতি ভারত ও চিন উভয়ের রাষ্ট্র-কেন্দ্রিক প্রচেষ্টার উর্ধ্বে অবস্থান করে।
চিনের দর্শকদের সামনে খানের ছবি থ্রি ইডিয়টস বেআইনি প্রদর্শনীর পর খান ওই দেশে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ২০১০ সালে হং কং ফিল্ম ফেস্টিভালে ছবিটি প্রথম দেখান হয় এবং তার পরই জনমুখে এই ছবির প্রচার হওয়ার পর সেটি বেজিং ফিল্ম ফেস্টিভালেও দেখান হয়। বেআইনি নেটওয়ার্কে ছবিটির তুমুল প্রচার হওয়ার পর অবশেষে ওই সংস্করণটি সিনেমা হলেও মুক্তি পায়। খান ও আরও অনেকের কানে এই খবরটি পৌছনর পর, তাঁদেরই চেষ্টায় ছবিটি চিনে আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তি পায় এবং উচ্চ প্রশংসিত হয়। তবে, খান শুধুমাত্র একটি সমসাময়িক উদাহরণ। এই প্রেক্ষিতে আমরা অমিতাভ বচ্চনের নাম উল্লেখ করত পারি। আফগানিস্তানে খুদাগাওয়া ছবির শুটিঙের সময় তাঁর বিস্ময়জনক তারকা-খ্যাতির কারণে মুজাহিদিনদের সঙ্গে লড়াইতে সাময়িক বিরতি দেওয়া হয়। উল্লেখযোগ্য শাহ রুখ খানেরও নাম, জার্মান রাষ্ট্রদূত মাইকেল স্টেইনার (২০১২-১৫) যাঁর ছবির “কাল হো না হো” গানটির পুনরাভিনয় করেন। ভারতের চলচ্চিত্র অভিনেতারা অনেক দিন ধরেই সাংস্কৃতিক কূটনীতির শীর্ষে অবস্থান করে আসছেন এবং অনুগ্র ক্ষমতার চালনাপথ হিসেবে কাজ করছেন। তাই প্রশ্ন উঠতে পারে যে, রাষ্ট্রের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়াও এই রকম ঘটনা আদৌ সম্ভব হয় কি করে?
আমার নেটওয়ার্কড বলিউডঃ হাউ স্টার পাওয়ার গ্লোবালাইজড হিন্দি সিনেমা নামক বইটিতে আমি বলেছি যে, কয়েকজন বিশিষ্ট পুরুষ অভিনেতার হাতে স্টার স্যুইচিং পাওয়ার থাকে। একে আমি এইভাবে সংজ্ঞায়িত করি – কিছু তারকার, তাঁদের নিজস্ব বৃত্তের বাইরে বেরিয়ে এমন সব জায়গায় তাঁরা সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হন যেখানে আগে তাঁদের কোনও রকম সংস্রব ছিল না। এর ফলে আজারবাইজান থেকে জার্মানি পর্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের পরিসরে তারা হিন্দি চলচ্চিত্রের নতুন বাজার তৈরি করেন। স্যুইচ-এর এই রূপকটি এই প্রেক্ষিতে কার্যকারী, কারণ এর সাহায্যে আমরা কল্পনা করে নিতে পারি, একটি সার্কিটের মধ্যে দিয়ে বিদ্যুতের দ্রুত গুঞ্জনের মতই, তারকারা নতুন সম্পর্ক ও নেটওয়ার্ককে উদ্ভাসিত করতে পারেন।
স্টার স্যুইচিং পাওয়ারের দুটি কেন্দ্রীয় উপাদান থাকে। প্রথমটি হল, সাধারণভাবে আবেগকে অনুপ্রাণিত করার ক্ষমতা, যার অর্থ পর্দার জন্য নির্মিত ব্যক্তিত্ব এবং পর্দার বাইরের ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে একজন তারকার আমাদের আবেগাপ্লুত করার ক্ষমতা। আমরা এই ধরনের ক্ষমতার সঙ্গেই বেশি পরিচিত এবং একেই আমরা তারকা-সুলভ খ্যাতি বলে চিহ্নিত করে থাকি। স্টার স্যুইচিং পাওয়ারের দ্বিতীয় উপাদানটি হল একটি সরাসরি ও কার্যকর ক্ষমতা যা মুষ্টিমেয় কয়েকজন, মূলত পুরুষ, তারকার আয়ত্তে থাকে। ওই তারকার আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও চলচ্চিত্রশিল্পে তাঁর প্রভাবের পাশাপাশি তাঁর সামাজিক অবস্থান, লিঙ্গ ও জাতিপরিচয় থেকে এই ক্ষমতার উদ্ভব ও প্রচারিত হয়। সহজভাবে বলতে গেলে, উচ্চ সামাজিক শ্রেণি ও যে লিঙ্গপরিচয় ভিত্তিক সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক যে সম্পর্কগুলি তাঁদের আয়ত্তে থাকে, তার পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়ী, প্রয়োজক, এবং বড় প্রযোজনা সংস্থার মালিক হিসেবে যে শিল্পকেন্দ্রিক ও সমাজতাত্ত্বিক প্রত্যক্ষ ক্ষমতাকে এই কার্যকারী ক্ষমতা বর্ণনা করে। আবেগ-সম্বন্ধীয় ও কার্যকারী ক্ষমতা একত্রে মিলে একজন তারকাকে একটি “স্যুইচ”-এ পরিণত করে এবং নতুন সম্পর্ক তৈরি করে, যার সাহায্যে চলচ্চিত্র-নির্মাণ শিল্প তার বর্তমান প্রভাবাধীন শিল্প ও ভূ-রাজনৈতিক পরিসরের উর্ধ্বে গিয়ে ভারতীয় চলচ্চিত্রশিল্পের গতানুগতিক বাজারের বাইরের নতুন ক্ষেত্রে পা রাখতে পারে।
যেমন, শাহ রুখ খান (বা, ভক্তদের কাছে, এসআরকে) হলেন এমন একজন পুরুষ তারকা, ভক্তদের মধ্যে আবেগের উদ্রেকের ক্ষমতা যাঁর অতুলনীয়। এবং এছাড়াও, তিনি রেড চিলিজ, যা বলিউডের সবচেয়ে বড় প্রযোজনা সংস্থা মধ্যে একটি, তার মালিকও। রেড চিলিজের মাধ্যমে তাঁর ছবি কাল হো না হো -কে জার্মান টিভি চ্যানেলে আরটিএল২-তে মুক্তি পায়। এরপরেই, জার্মানিতে, যা বলিউডের চলচ্চিত্রের জন্য এতদিন একটি অনাবিষ্কৃত ক্ষেত্র ছিল, খানের অনলাইন ভক্তকুল তৈরি হয় যাঁরা একটি অনলাইন ফোরাম চালু করেন, যার ফলশ্রুতি শুধু একটি খানের জন্যই নিবেদিত একটি পত্রিকা। ভক্তদের এই প্রচেষ্টার ফলশ্রুতি একটি সম্পূর্ণ পরিষেবাদায়ি বলিউড-কেন্দ্রিক সংগঠন যা বর্তমানে নানা পত্রপত্রিকা প্রকাশ করে এবং পডকাস্ট ও চলচ্চিত্র নিয়ে নানা অনুষ্ঠানের পরিচালনা করে। এসআরকে-র স্টার স্যুইচিং পাওয়ারের মাধ্যমে, ভারতীয় চলচ্চিত্রশিল্পের বাকিদের জন্য, রাষ্ট্রের দিক থেকে কোনও রকম সুচিন্তিত প্রচেষ্টা ছাড়াই, জার্মানি নতুন একটি বাজার হিসেবে উঠে এসেছে। এই ঘটনাটিরই ফলাফল “কাল হো না হো” গানের সঙ্গে জার্মান রাষ্ট্রদূতের নাচ, প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সলমন খুরশিদ যাতে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
একটি নতুন সার্কিটকে চালু ও আলোকিত করার ধারণাটি বহুস্তরীয় ও বিবিধ অর্থের নির্মাণ করে থাকে, কারণ, এই উপমাটি ইঙ্গিত দেয় যে, এই সম্পর্কগুলির মধ্যে অন্তত কয়েকটির ফলাফল আগে থেকে পুরোপুরি অনুমান করা না গেলেও এবং এগুলির প্রভাবের সরাসরি পরিমাপ করা কঠিন হলেও, প্রতিটি ক্ষেত্রেই এর অবধারিত ফলশ্রুতি হিসেবে একজন পুরুষ মহাতারকা নতুন সম্পর্ক তৈরিতে সক্ষম অনুঘটক ও স্যুইচে পরিণত হন। এইভাবে, বলিউড তারকারা দুই ধরনের ক্ষমতাকে একত্রে আনেন। প্রথমটি তাঁদের তারকা-সুলভ সুবিশাল ব্যক্তিত্ব যে অনুভূতির জন্ম দেয়, তার থেকে উঠে আসে, এবং দ্বিতীয়টি নতুন সম্পর্ক নির্মাণের ক্ষমতাসম্পন্ন সুবৃহৎ প্রযোজনা সংস্থার মালিক হিসেবে তাঁরা যে সংগঠন তৈরি করেন সেগুলির মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এর ফলশ্রুতি, ভারতে এবং আফগানিস্তান, রাশিয়া ও অন্যান্য দেশের প্রবাসী ভারতীয় ও অভারতীয় দর্শকদের মধ্যে তাঁদের প্রভাব চরম মাত্রায় পৌঁছয়।
পুরুষ মহাতারকাদের এই স্যুইচিং পাওয়ারই বলিউডের বিশ্বায়নের প্রধান অবলম্বন হয়ে উঠেছে, তার কারণ অংশত, স্বাধীনতার পর থেকে জনপ্রিয় ছবি ও চলচ্চিত্র-নির্মাণ শিল্পের প্রতি ভারতীয় রাষ্ট্রের উদাসীনতা। ভারতীয় চলচ্চিত্রের বিষয়ে পণ্ডিত অরুণা বাসুদেবের ভাষায়, রাষ্ট্র ও সাংস্কৃতিক অভিজাত শ্রেণী মূলধারার চলচ্চিত্রকে, মোটামুটি ভালভাবে ব্যাখ্যা করতে হলে, প্রাকৃতজনের বিনোদন এবং, তাচ্ছিল্য করতে হলে, “একটি পরিহারযোগ্য সামাজিক বিপর্যয়” হিসেবে দেখেন। এই প্রেক্ষিতে, তারকা ব্যবসা উদ্যোক্তারা রাষ্ট্র ও চলচ্চিত্রশিল্পের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে উপস্থিত থেকে সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও কূটনৈতিক প্রেক্ষিতে, তাঁদের স্যুইচিং পাওয়ারকে রাষ্ট্রের কাছ থেকে কার্যসিদ্ধির উপায় হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। ভারতীয় কূটনৈতিক বৃত্তের কথোপকথনে, ধ্রুপদী ভারতীয় নৃত্য ও সঙ্গীতের তুলনায় চলচ্চিত্রকে আমজনতার ভোগের উপযুক্ত একটি নিম্নস্তরীয় সংস্কৃতি হিসেবে দেখতেন। তাই, অন্য দেশের সঙ্গে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের দায়িত্বে যে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ কালচারাল রিলেশন্স (আইসিসিআর) নামক সংগঠনটি সরকার ১৯৫০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন, সেটি প্রাথমিকভাবে ধ্রুপদী নৃত্য ও বাদ্যকে বর্ণনা করার জন্য “উচ্চমার্গীয় সংস্কৃতি” – এই শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করতে পছন্দ করত।
ভারতের ক্ষেত্রে, তারকা এবং ছবি, বিশেষ করে মূলধারার ছবি, কূটনৈতিক আদানপ্রদানের আওতার বাইরেই থেকে যায়। অন্যদিকে, চিন বা রাশিয়াতে রাষ্ট্রীয় অনুদানে বা সহায়তায় ছবি তৈরি হয় এবং সেগুলিকে নিজেদের আদর্শগত বা রাজনৈতিক আখ্যান প্রচারের জন্য ব্যবহার করা হয়, বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা দক্ষিণ কোরিয়ার মত দেশগুলি অনুগ্র ক্ষমতার প্রচারের জন্য তাদের জনপ্রিয় বিনোদনশিল্পের উপর নির্ভর করে এবং, অংশত, অন্যান্য উৎপাদনযোগ্য পণ্যের সঙ্গে একত্রে, চলচ্চিত্র শিল্পকে যথেষ্ট সহায়তা দান করে। ইউনেস্কো-র প্রথম দিককার সমীক্ষাগুলির কথা মনে করা যাক। সেগুলি মার্কিন টিভির অনুষ্ঠানগুলির (বিশেষ করে বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান) বাকি বিশ্বে একমুখী প্রচারের স্রোতকে চিহ্নিত করে। এই স্রোতের মূল প্রোথিত আছে মার্কিনি টিভির সহজলভ্যতায় যা জন এফ. কেনেডির রপ্তানি নীতির কারণে সম্ভব হয়। এর ফলে, বাকি বিশ্বে হলিউড প্রযোজিত টিভি ও চলচ্চিত্র শিল্পকে মার্কিন অর্থনৈতিক স্বার্থের স্বাভাবিক বিস্তার এবং রপ্তানির পরিমাণ বৃদ্ধি করার উপায় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ডালাস (১৯৭৮-১৯৯১)-এর মত টিভি অনুষ্ঠানগুলি মার্কিনি সাংস্কৃতিক আধিপত্যের উদাহরণ হয়ে ওঠে। এর বিপরীতে, মূলধারার চলচ্চিত্রশিল্প এবং ভক্তদের চিত্ত আকর্ষণকারী, উদ্যোগী তারকাদের মাধ্যমে ভারতের অনুগ্র ক্ষমতার যে নির্মাণ নিতান্তই আকস্মিক, এমনকি, বলতে গেলে ঘটনাচক্রে সম্ভব হয়েছে বলেই মনে হয়।
এর ব্যাখ্যা হিসেবে বলা যায়, ১০৫০ সালের পয়লা এপ্রিল যখন চিনের সঙ্গে ভারত, এশিয়ার প্রথম দেশ যা কম্যুনিস্ট/সমাজতান্ত্রিক নয় - প্রথম কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। কূটনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর বোন বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিতকে চিনে ভারতের এই সাংস্কৃতিক ও সৌহার্দ্যমূলক দৌত্যের নেতৃত্বের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই দৌত্য একটি সঙ্কটের জন্ম দেয়। পণ্ডিতের ভাষায়, “চিনের আধিকারিকরা বারংবার ভারতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার বিষয়ে একটি পূর্ণ দৈর্ঘের ছবি দেখার প্রবল ইচ্ছা জানিয়েছেন।” মাও-এর কাছে চলচ্চিত্রের কার্যকারিতা সম্পূর্ণ ভিন্ন বলে, চলচ্চিত্রের উপর এই বিশেষ ইচ্ছাটির অর্থ জটিল ও বহুস্তরীয় এবং সেটিকে সাবধানে পরীক্ষা ও বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। মাও-এর কাছে চলচ্চিত্রের প্রতীকতা আদতে শিক্ষাদান, নির্দিষ্ট মতবাদে উদ্বুদ্ধ করা ও রাজনৈতিক অতিকথন নির্মাণের মাধ্যম। ভারতের আধিককারিকদের পক্ষে একটি উপযুক্ত ছবি খুঁজে বের করা খুবই কঠিন হয়ে পড়ে, কারণ তাঁরা জনপ্রিয় হিন্দি ছবিগুলিকে “অনুপযুক্ত” ও “সমাজের তলানি” বলে বর্ণনা করেন (ভারতীয় চলচ্চিত্রের বিষয়ে রাষ্ট্রের অনুভব এবং মতামত নিয়ে চলচ্চিত্র সমালোচক অরুণা বাসুদেব এবং চন্দনা দাশগুপ্ত তাঁদের লেখায় আরও বিশদে আলোচনা করেছেন) । অবশেষে, রাজ কাপুরের আওয়ারা এবং ভি. সান্তারামের মারাঠি ছবি অমর ভোপালি ছবিদুটিকে বাছাই হয়। এই বিশেষ সাংস্কৃতিক বিনিময়টি একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা, কারণ আওয়ারা পরবর্তীকালে মাও-এর অন্যতম প্রিয় ছবি বলে প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে, পরে ভারত ও চিনের মধ্যে সমস্যা শুরু হওয়ায়, এই চমকপ্রদ ঘটনাটি স্বল্পস্থায়ী বলে প্রমাণিত হয়।
তারকা হিসেবে মিশরে বচ্চনের খ্যাতি, তারকা-প্রভাব এবং সাংস্কৃতিক কূটনীতির বিষয়ে অনুরূপ একটি আখ্যান। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য অংশে, যেখানে ভারতীয় ছবি রাষ্ট্রের প্রভাবহীন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ঘুরপথে পৌঁছয়, তার বিপরীতে মিশরে একটি উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম। এর কারণ, স্নায়ুযুদ্ধের সময়, নেহরু যখন জোটনিরপেক্ষতার জন্য আহ্বান করেন, তখন তাঁর অন্যতম সহযোগী ছিলেন মিশরের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি গামাল আবদেল নাসার, এবং সেই জন্য একটি ভারতীয়-মিশরীয় চলচ্চিত্র সংস্থার (আল-ওয়াইকালা আল-মিশ্রিয়া আল-হিন্দিয়া লি-তজি’ইয়াল-আফ্লাম) সাহায্যে দুই দেশের মধ্যে এক ধরনের আনুষ্ঠানিক চলচ্চিত্র বিনিময়ের ব্যবস্থা ছিল। ১৯৭০ সালে নাসেরের জায়গায় আনোয়ার সাদাত নির্বাচিত হলে, এনএএম-এর বন্ধন থাকা সত্ত্বেও, এই অবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে। মিশর ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে জোটের ফলে ভারতের সঙ্গে মিশরের যে আদর্শগত দূরত্ব তৈরি হয়, তা ছাড়াও সাদাতের বক্তব্য অনুযায়ী, ভারতীয় ছবি স্থানীয় মিশরের শিল্প ও নৈতিক চরিত্রের পক্ষে ক্ষতিকর। বচ্চন ও তাঁর ছবি, যদিও, এর একটি আশ্চর্য ব্যত্যয়। বচ্চনের ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারণে এর পরেও মিশরে তাঁর ছবির প্রদর্শনী চলতেই থাকে। এমনকি, ১৯৯১ সালে বচ্চন যখন মিশর ভ্রমণে যান, তখন তাঁকে অভ্যর্থনা করতে আনোয়ার সাদাতের স্ত্রী জেহান এল-সাদাত নিজে উপস্থিত ছিলেন।
প্রতিটি ক্ষেত্রেই, স্টার স্যুইচিং পাওয়ার রাষ্ট্রযন্ত্রের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে সাহায্য করে এবং, সাংস্কৃতিক কূটনীতির ক্ষেত্রে, রাষ্ট্রের প্রভাবের বাইরে অবস্থিত গুরুত্বপূর্ণ অভিনেতা হয়ে ওঠেন তাঁরা। তাঁদের ভক্তগোষ্ঠী, তারকাদের ছবি থেকে জাত আবেগপূর্ণ আকর্ষণ এবং সম্পর্ক (ভক্তকূলের আবেগকেন্দ্রিক অর্থনীতি)-র মাধ্যমে তারকারা বরাবরই ভারতের সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা এবং অনুগ্র ক্ষমতার নির্মাণ করে এসেছেন। চিনে আমির খান বা অতীতে অন্যান্য তারকাদের প্রতি আবেগপূর্ণ নিবেদন, যাকে আমি স্বতন্ত্র সামাজিক অভিনেতাদের উপর আবেগের বিনিয়োগ বলে থাকি, তা এই আকর্ষণকে আগেও সংজ্ঞায়িত করেছে ও এখনও করে চলেছে। এবং, পাশাপাশি, এমন একটি সাংস্কৃতিক অনুরণন নির্মাণ করেছে যার শিকড় সাধারণের মধ্যে ভাগ করে নেওয়া অভিজ্ঞতা ও ক্রমবর্ধমান বাস্তবের জমিতে প্রোথিত। যেহেতু রাষ্ট্র সরাসরি যুক্ত নয়, তাই চলচ্চিত্রকেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক কূটনীতি, ভারতের সরকারি কূটনীতির ক্ষেত্রে বহিরাগত হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই, ভারত রাষ্ট্র কেন গতি পরিবর্তন করে অতীতের “উচ্চমার্গীয় এবং সংস্কৃতিপূর্ণ” সমান্তরাল আর্ট ফিল্ম বা, আজকের দিনে আগ্রহের প্রদর্শনী এবং ছবি তুলে একটি বিশেষ ভাবমূর্তি তৈরির দিকে কোঁকার পরেও, ভূ-রাজনীতির কাজে কেন জনপ্রিয় মূলধারার চলচ্চিত্রশিল্পকে কৌশলে ব্যবহার করা হয় নি তা জানার কৌতুহল জাগে।