১৯৯৮ সালে ভারতের পারমাণবিক পরীক্ষা নিয়ে জাপান তীব্র সমালোচনা করে ও ভারতের উপর কঠিন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। যদিও ভারত ও জাপানের কূটনৈতিক সম্পর্ক ১৯৫২ সালেই প্রতিষ্ঠিত হয়, কিন্তু সেই সম্পর্ক গতি পায় কোল্ড ওয়ার বা স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে এবং ভারতের এই পারমাণবিক পরীক্ষাগুলি সেই অপরিপক্ক সম্পর্কে খুবই খারাপভাবে ধাক্কা দিয়েছে। তার পর গঙ্গায় অনেক জল গড়িয়ে গেছে, এবং ২০০০ সালে জাপানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইয়োশিরো মোরির ভারতে আগমনের পর, এই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক খুব শীঘ্রই আবার সামনের দিকে এগোতে থাকে।
পঁচিশ বছর পরে, জানুয়ারী মাসে সংঘটিত ভারত-জাপান বীর গার্ডিয়ান ২০২৩ বায়ুসেনা মহড়াটি দুই দেশের দিক থেকেই এই জাতীয় পদক্ষেপের প্রথম উদাহরণ। ২০১৯ সালে ভারতীয় এবং জাপানি বায়ুসেনা ভারতের মাটিতে যৌথ মহড়ার পরিচালনা করে, কিন্তু সেই মহড়ার মনোযোগ ছিল, যুদ্ধের উপর নয়, বরং সৈন্যযোজনা এবং যুদ্ধকৌশলগত আন্তঃকার্যক্ষমতার উপর। ভারতীয় বায়ুসেনা (আইএএফ) একশ পঞ্চাশজন সেনা সহ, চারটি সু-৩০এমকেআই এবং একটি আইএল-৭৮ মিড-এয়ার রিফ্যুয়েলার এবং জাপান বায়ু প্রতিরক্ষা শক্তি (জেএএসডিএফ) চারটি এফ-১৫ এবং চারটি এফ-২ যুদ্ধবিমান এই কাজের জন্য নিয়োগ করে। জেএএসডিএফ-এর পক্ষ থেকে একটি বিবৃতিতে জানান হয় যে, এই মহড়ার উদ্দেশ্য ছিল “পারস্পরিক বোঝাপড়াকে উৎসাহদান ও প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত সহযোগিতাকে আরও দৃঢ় করা এবং জেএএসডিএফ-এর যুদ্ধকৌশল সংক্রান্ত দক্ষতাকে আরও বাড়িয়ে তোলা।”
এই পদক্ষেপ জাপানের জন্য কতটা ঝুঁকিবহুল
প্রথমত, জাপানের ক্ষেত্রে এই অনুশীলনগুলি ছিল চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করার মতই একটি বিষয়, কারণ অতীতে জাপান এই রকম বায়ুযুদ্ধের যৌথ মহড়া দিয়েছে ইউএস, ইউকে, অস্ট্রেলিয়া এবং জার্মানি (এগুলি পাশ্চাত্য মিত্রশক্তির অংশ, ভারত যা নয়)
দ্বিতীয়ত, এই অনুশীলনগুলির ফলে রাশিয়ার নির্মিত যে এসইউ-৩০এমকেআই যুদ্ধবিমানটি বর্তমানে ব্যবহার করে, জেএএসডিএফ সেটির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। চীনের হাতেও অনেকগুলি রুশ যুদ্ধবিমান আছে, আর তাই বেইজিং বারংবার এই বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে চলেছে যে, ভারত যেএসইউ-৩০ এমকেআই বিমানগুলি এই মহড়ায় ব্যবহার করেছে সেগুলি চীন যা ব্যবহার করে, সেগুলির থেকে আলাদাঃ এসইউ-৩০এমকেকে, এসইউ-৩০এমকে২, এসইউ-৩৫, জে-১১, জে-১৫ আর জে-১৬ (এগুলি সবই রুশ এসইউ-২৭ থেকে উদ্ভূত) ।
তৃতীয়ত, রাশিয়া, চীন ও উত্তর কোরিয়ার দিক থেকে জাপান অনেক রকমের সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত হওয়ার অর্থ, ওই দেশগুলি থেকে যে সম্ভাব্য বিপদ আসতে পারে, জাপান সেগুলির উপর মনোযোগ দিতে পারবে। সম্প্রতি, টোকিও একটি নতুন জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলের পরিকল্পনা করেছে, যার উদ্দেশ্য, ২০২৭ সালের মধ্যে তার নিরাপত্তা সংক্রান্ত খরচ বেড়ে দেশের মোট আভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপির দুই শতাংশ হবে। ২০২৩ অর্থনৈতিক বছরে, টোকিওর নিরাপত্তা সংক্রান্ত খরচ বেড়ে হবে ৬.৮ ট্রিলিয়ন ইয়েন, যা গত বছরের থেকে ১.৪ ট্রিলিয়ন ইয়েন বেশি।
চতুর্থত, জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে যেমন বলেছেন, জাপানের ফ্রি অ্যান্ড ওপেন ইন্দো-প্যাসিফিক ভিশনের ক্ষেত্রে ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। জিবুতিতে জাপান প্রতিরক্ষা শক্তি (জেএসডিএফ)-এর একটি ঘাঁটি আছে এবং এই অঞ্চল নিয়ে জাপানের যে পরিকল্পনাগুলি আছে সেগুলির ক্ষেত্রে, ভারত তার অবস্থানের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারত ও জাপান অ্যাকুইজিশান অ্যান্ড ক্রস-সার্ভিসিং এগ্রিমেন্ট (এসিএসএ)-তে সই করে, যার ফলে “জাপান ও ভারতের প্রতিরক্ষা বাহিনীর মধ্যে সরবরাহ ও পরিষেবার ব্যবস্থা মসৃণ ও দ্রুততর হয়।” লজিস্টিক এক্সচেঞ্জ মেমোরেন্ডাম অফ এগ্রিমেন্ট (এলইএমওএ), যা ভারত ও ইউএস একযোগে সই করেছিল, সেরকম চুক্তির সঙ্গে এই চুক্তিটি বেশ খাপ খেয়েছে।
এই পদক্ষেপটি ভারতের পক্ষে কতটা লাভজনক?
প্রথমত, এই মহড়াগুলির মাধ্যমে ভারত তার সীমানার বাইরে নিজের ক্ষমতা প্রদর্শনের সুযোগ পেয়েছে। নতুন দিল্লি কোয়াড্রিল্যাটারাল সিকিওরিটি ডায়লগের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার এবং দেশের সীমান্ত নিয়ে চীনের সঙ্গে ভারতের একটি দীর্ঘকালীন দ্বন্দ্ব চলছে। ২০২০ সালে হিমালয়ের বরফের রাজ্যে ভারত ও চীনের সামরিক বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ বাধে এবং পঁয়তাল্লিশ বছরের মধ্যে প্রথমবার দুই পক্ষের সেনাই হতাহত হন। দি গ্লোবাল টাইমস এই বীর গার্ডিয়ান অনুশীলনগুলিকে লক্ষ্য করেছে এবং তাদের মতে, “তাইওয়ান প্রশ্নে যখন জাপান সামরিকভাবে হস্তক্ষেপ করার পরিকল্পনা করছে এবং ভারত চীনের সঙ্গে সীমান্ত দ্বন্দ্বে জড়িত, তখন চীনকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ইউএস তার ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য জাপান এবং ভারতকে প্রলুব্ধ করছে।”
দ্বিতীয়ত, ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং ইউএস মালাবার নৌপ্রশিক্ষণের অংশ। ২০২২ সালে প্রথমবার জাপানও এমআইএলএএন মহড়ায় (ভারতীয় নৌবাহিনীর দ্বারা সংগঠিত একটি বহুজাতিক অনুশীলন)-এ অংশ নেয়।
তৃতীয়ত, বীর গার্ডিয়ান ২০২৩ মহড়া সমস্ত দিক থেকেই ভারত ও জপানের মধ্যে একটি পূর্নাঙ্গ সহযোগিতার চূড়ান্ত বিন্দুকে চিহ্নিত করে। দুই দেশের নৌবহর জেআইএমএক্স নামক যৌথ অনুশীলন এবং ভারতের সামরিক বাহিনী ও জাপান ভূখণ্ড প্রতিরক্ষা শক্তি (জেজিএসডিএফ) একত্রে ধর্ম গার্ডিয়ান অনুশীলনটি পরিচালনা করছে।
চতুর্থত, গত বছর থেকে এ বছর অনেক বদল এসেছে। শোনা যায় যে, গত বছর নতুন দিল্লি জাপানের নিরাপত্তা বাহিনীর একটি বিমানকে ইউক্রেন যাওয়ার পথে ভারতে অবস্থিত একটি ইউনাইটেড নেশনস হাই কমিশনার ফর রিফিউজিস (ইউএনএইচআর)-র গুদাম থেকে রসদ তোলার অনুমতি দেয় নি। সম্ভবত এর কারণ হল, ভারত রাশিয়ার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে কোনও সমস্যা তৈরি করতে চায় নি (যদিও পরে একটি জাপানি বাণিজ্যিক বিমানকে ওই রসদ তোলার অনুমতি দেওয়া হয়)।
ভবিষ্যতের সমস্যা
জাপান-ভারতের নিরাপত্তা-সংক্রান্ত সম্পর্কের ক্ষেত্রে এখনও কিছু ভবিষ্যৎ সমস্যা আছে। দুই দেশের উচ্চতর স্তর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করা সত্ত্বেও, ভারতকে জাপানের যে শিনমায়য়া ইউএস-২আই সামুদ্রিক অনুসন্ধানকারী বিমানপোত সরবরাহ করার প্রস্তাবিত চুক্তিটি বাস্তবায়িত হয় নি। এছাড়াও, রাশিয়া ইউক্রেনকে আক্রমণ করার পরেও ভারত যখন রাশিয়ার সমালোচনা করা থেকে সম্পূর্ণ বিরত ছিল, জাপান তখন পশ্চিমী দেশগুলিকে সমর্থন করতে শুরু করে। অন্যদিকে, জাপান আবার রাশিয়া থেকে কম দামে তেল কিনেই চলেছে।
চীনের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে কারবার করার ক্ষেত্রেও জাপান ও ভারতের মধ্যে পার্থক্য আছে। ভারতের যেমন চীনের সঙ্গে দেশের সীমান্ত নিয়ে সমস্যা আছে জাপানের ক্ষেত্রে তা সমুদ্র নিয়ে। তাই ভারতের মনোযোগ যেমন ভূখণ্ডের উপর, জাপানের তেমনই সামুদ্রিক এলাকায়। এর সঙ্গে সঙ্গে, ভারত ও চীনের মধ্যে সত্যি সত্যিই একটি যুদ্ধ হয়েছে (১৯৬২ সালে), যা জাপান-চীন সম্পর্কের ক্ষেত্রে ঘটে নি। জাপানের ক্ষেত্রে, উত্তর কোরিয়ার উপর চীনের প্রভাব আছে। তাই, উত্তর কোরিয়া সংক্রান্ত বিশৃঙ্খলার সমাধানের একটি অঙ্গ হল বেইজিং। ফলত, টোকিও সরাসরি বেইজিং-এর সঙ্গে কোনও রকম সমস্যায় জড়িয়ে পড়া নিয়ে সতর্ক থাকে। অন্য দিকে, ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়গুলির ক্ষেত্রে চীনের খুব বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পারে না।
এর পাশাপাশি, জাপান ও ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ নয় এবং প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের (এবং স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হওয়ার) আগে পর্যন্ত এই দুই দেশ দুটি পৃথক শিবিরের অংশ ছিল। নতুন দিল্লি সব সময়ই জোটে অবিশ্বাসী, এবং খুব সম্প্রতি, পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে, বহুদেশীয় জোটের অংশ হতে পছন্দ করতে শুরু করেছে। এর বিপরীতে, জাপান ইউএস এবং পশ্চিমের অন্যান্য রাষ্ট্রকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে এসেছে। উল্লেখযোগ্য, এখনও নতুন দিল্লির সঙ্গে রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ সামরিক সম্পর্ক বজায় আছে।
সম্মুখের পন্থা
স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকেই ভারত ও জাপানের পারস্পরিক সহযোগিতার সম্পর্ক খুবই দ্রুত ঘনিষ্ঠতর হয়ে উঠেছে। দুটি দেশই চীনের নেতৃত্বে পরিচালিত বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)-এর সঙ্গে যুক্ত হয় নি এবং তার বিকল্প একটি পরিকাঠামোগত বিকাশের পরিকল্পনা সরবরাহ করার চেষ্টা করছে। জাপান, অন্যান্য জি৭ দেশের সঙ্গে, বিল্ড ব্যাক বেটার ওয়ার্ল্ড (বি৩ডাবলইউ) নামের একটি উদ্যোগের অংশ, যা “উন্নয়নশীল দেশগুলির চল্লিশ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি পরিকাঠামোগত চাহিদাকে হ্রাস করার কাজে সাহায্য করার জন্য মুখ্য গণতন্ত্রবাদী দেশগুলির নেতৃত্বে উন্নত গুণগত মান দ্বারা চালিত, উচ্চমানের, এবং স্বচ্ছ পরিকাঠামো নির্ভর একটি অংশীদারিত্ব-নির্ভর উদ্যোগ।”
সামরিক দ্রব্যাদির ক্রেতা হিসেবে ক্ষেত্রে ভারত প্রথম সারিতে আছে। টোকিওতে সংঘটিত গতবারের ২+২ আলোচনায় (ভারত ও জাপানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর মধ্যে), ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী “জাপানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রীকে ভারতের ডিফেন্স করিডরে বিনিয়োগের সুযোগগুলিকে বিবেচনা করতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।” ভারত-জাপান বীর গার্ডিয়ান প্রশিক্ষণ ২০২৩ সফলভাবে শেষ হওয়ার অর্থ ১৯৯৮ সালের পরের পঁচিশ বছরে, ভারত জাপান প্রতিরক্ষা সম্পর্কের চাকাটির একটি পূর্ণ আবর্তন ঘটছে মনে হয়। যেমন বলা হয়, সময় এক সুদক্ষ সমতাসাধক।