ভারতের কোভিড-19 অতিমারীর দ্বিতীয় ঢেউ-এর প্রকোপ বৃদ্ধির বিশ্বব্যাপী প্রভাব

16/08/2021
IiT English Page

২০২১-এর মার্চ মাসে ভারতে কোভিড-19 অতিমারীর ভয়াবহ দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছিল। ২০২১-এর জুনের মধ্যেই এই রোগে ১.৯ কোটির বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন এবং ২৪০,০০০ জনের মৃত্যু হয়েছে (সরকারী হিসাব অনুযায়ী) । অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করেন যে, ভারতের ইন্টিগ্রেটেড ডিজিজ সার্ভেলেন্স প্রোগ্রাম (আইডিএসপি) যা তথ্য পাওয়ার জন্য নানা ল্যাবরেটরি এবং হাসপাতালের বিবৃতির উপর নির্ভর করে, সেই কর্মসূচীটি অসুস্থতা ও মৃত্যুর ঘটনাগুলির তীব্রতাকে অনেকটাই ছোট করে দেখেছে। এই ঘটনা ঘটেছে বিশেষ করে সেই সময় যখন দ্বিতীয় ঢেউ-এর প্রভাব সবচেয়ে জোরালো ছিল ও চিকিৎসার জায়গাগুলি অতিরিক্ত রোগীর চাপে বেসামাল হয়ে পড়েছিল। একই সঙ্গে হাসপাতালের বাইরেও প্রচুর মানুষের মৃত্যু হচ্ছিল। মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা সরকারী হিসাবের চেয়ে তিন থেকে দশ গুণ বেশি বলে অনুমান করা হয়েছে।       

আমরা এখন জানি যে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টই অতিমারীর দ্বিতীয় ঢেউকে ইন্ধন যুগিয়েছে। ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে কোভিড-19 রোগের ভ্যারিয়েন্টগুলির উপর নজরদারি ও সেগুলিকে আগাম চিহ্নিত করার জন্য ইন্ডিয়ান সার্স কোভ-2 জেনোমিকস কনসর্টিয়াম (আইএনএসএসিওজি) প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু ভারতে সংগৃহীত নমুনাগুলির মধ্যে খুব কম সংখ্যকেরই পরীক্ষা করা হয়েছে এবং এই বিশ্লেষণ থেকে যা পাওয়া গেছে সেই তথ্য ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয় নি। ভারতীয় বৈজ্ঞানিকরা এই নতুন ভ্যারিয়েন্ট সম্পর্কে সতর্কবার্তা দেওয়ার জন্য মার্চের শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করেন আর ততদিনে ডেল্টা সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়েছে। 

এই ভ্যারিয়েন্টরা কিভাবে উঠে আসে এবং এদের গুরুত্ব কি? সার্স কোভ-2 ভাইরাস যখন একজন নতুন আশ্রয়দাতার শরীরে ঢোকে তখন এই ভাইরাস নিজের প্রতিরূপ তৈরি করে, অর্থাৎ নিজেকে অনুকরণে প্রতিচ্ছায়া তৈরি করে। এই প্রতিরূপ তৈরির সময় যে ভুলগুলি হয় সেগুলির কারণে এই ভাইরাসগুলির মধ্যে রূপান্তর ঘটে। এই রূপান্তরই নতুন ভাইরাসগুলিকে তাদের জনক থেকে আলাদা করে। আরো বেশি সংখ্যক মানুষের মধ্যে সংক্রমণ ঘটার সঙ্গে সঙ্গে এই রূপান্তরগুলি একত্রিত হতে থাকে ও ক্রমশ ভিন্ন ভিন্ন আচরণসহ আরো নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্টের গঠন হয়। যেকোন সময়ে শত শত ভ্যারিয়েন্ট সক্রিয় থাকে। যে পরিব্যক্তিগুলির কারণে তাদের জনক ভাইরাস থেকে এগুলির টিঁকে থাকার ক্ষমতা অনেক বেশি এবং অবশেষে, অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টদের হারিয়ে সবচেয়ে শক্তিশালী সক্রিয় ভাইরাস হয়ে ওঠে। যে ভ্যারিয়েন্ট খুব সহজে ছড়িয়ে পড়ে তার সংক্রমণের তীব্রতা অনেক বেশি। এগুলি টিকা বা আগের সংক্রমণের কারণে যে সুরক্ষাকবচ তৈরি হয় তা এড়িয়ে যায়, চিকিৎসাপ্রণালী এর বিরুদ্ধে কম কাজ করে বা এই রোগের লক্ষণ নির্ণয়ের প্রচলিত উপায়গুলি এই ভাইরাসকে সহজে চিহ্নিত করতে পারে না। এই ধরনের ভাইরাসকে ভ্যারিয়েন্ট অফ কনসার্ন বলে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা অনেক বেশি এবং সেই সংক্রমণের তীব্রতাও অনেক বেশি। টিকা আর কিছু মোনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি চিকিৎসা এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে খুব কার্যকারী নয়। এই কারণে, একটি ভ্যারিয়েন্ট অফ কনসার্ন বলে শ্রেণীবদ্ধ করার মাপকাঠির অনেকগুলিই এই ভ্যারিয়েন্টটি পূরণ করে।   

আইএনএসএসিওজি থেকে পাওয়া সাম্প্রতিকতম তথ্য থেকে জানা যায় যে ভারতে ঘটা কোভিড-19 সংক্রমণের পঁচানব্বই শতাংশেরই কারণ ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। এই ভ্যারিয়েন্ট কেবলমাত্র ভারতের সমস্যা নয়। ৩০ জুন পর্যন্ত ছিয়ানব্বইটি দেশে এই ভ্যারিয়েন্টের অস্তিত্ব সনাক্ত করা গেছে। ইউকে, পর্তুগাল, রাশিয়া, নেপাল এবং ইন্দোনেশিয়ায় কোভিড-19 সংক্রমণের স্ফীতির পিছনে আছে এই ভ্যারিয়েন্ট, যার ফলে নতুনভাবে লকডাউন, পর্যটনে নিষেধাজ্ঞা বা মুখোশ পরার নির্দেশাবলীর প্রচার শুরু হয়েছে। ২০২১-এর ৩১ জুন পর্যন্ত, ইউএসের সংক্রমণের নব্বই শতাংশের কারণ এই ভ্যারিয়েন্ট এবং ইউএসের যে অঞ্চলে টিকা নেওয়ার হার কম সেই সমস্ত অঞ্চলে এর প্রকোপ দেখা গেছে। ডেল্টার বিরুদ্ধে সুরক্ষা দিতে টিকার একটি মাত্রা বা ডোজ পর্যাপ্ত নয়। দুটি ডোজ কঠিন অসুস্থতার বিরুদ্ধে ঠিকঠাক সুরক্ষা দিলেও কম সংক্রমণের ক্ষেত্রে খুব বেশি কার্যকর নয়। কাজেই, টিকা নেওয়ার পরেও কোন ব্যক্তির সংক্রমণের সম্ভাবনা এবং অন্যদের মধ্যেও ছড়িয়ে দিতে পারেন। তার ফলে নতুনভাবে রোগের প্রাদুর্ভাব শুরু হতে পারে। বিশেষ করে, যে সমস্ত দেশে টিকা পাওয়ার সুযোগ কম সেই দেশগুলি অনেক বিপজ্জনক অবস্থায় আছে। এমনকি, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ভারতে আক্রান্তের সংখ্যা কমলেও, এখনো প্রতিদিন পঞ্চাশ হাজারের কাছাকাছি নতুন সংক্রমণের ঘটনা ঘটছে।   

কি ভাবে আমরা এই ভ্যারিয়েন্ট এবং কোভিড-19 অতিমারীর নিয়ে তৈরি যে ভীতি অব্যাহত আছে সেগুলির মুখোমুখি হব? সংক্রমণের ঘটনা যত বেশি হবে, ভাইরাসগুলির মধ্যেও রূপান্তর ঘটে চলবে এবং সঙ্গে সঙ্গে, নতুন ভ্যারিয়েন্ট তৈরির সম্ভাবনাও বেড়ে চলবে। তাই, সর্বত্র সংক্রমণের ঘটনাকে নিয়ন্ত্রণ করাই এই ভ্যারিয়েন্টগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করার একমাত্র উপায়। সংক্রমণের সংখ্যার সঠিক গণনা এবং তথ্যের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে যথেষ্ট পরীক্ষা করার প্রয়োজন, যাতে জনগণ এবং স্বাস্থ্য পরিষেবার কর্তৃপক্ষ এই রোগ প্রশমনের জন্য পদক্ষেপ নিতে পারেন।   

নতুন ভ্যারিয়েন্ট চিহ্নিত করার জন্য পৃথিবী জুড়ে জিনোমিক সার্ভেলেন্স চালিয়ে যাওয়া অত্যাবশ্যক। বৈজ্ঞানিকদের মতে, কোভিড আক্রান্ত রোগীদের যে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে তার মধ্যে অন্তত পাঁচ শতাংশের সিকোয়েন্স করা প্রয়োজন। এই মুহূর্তে শুধুমাত্র ইউকে আর ডেনমার্কে এই হারে সিকোয়েন্সিং সম্ভব হয়েছে। সিকোয়েন্স করার জন্য যতটা ব্যয়বহুল এবং যে ধরনের, যন্ত্রপাতি, বিকারক এবং প্রযুক্তিগত জ্ঞান প্রয়োজন তা নিম্ন ও মধ্যস্তরের আয়ের দেশে সহজলভ্য নয়। যদিও, গত বছরই ভারতে আইএনএসএসিওজি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, প্রয়োজনীয় বিকারক এবং নমুনা সংগ্রহ ও সেগুলির প্রক্রিয়াকরণের জন্য কর্মচারীর অভাবের কারণে সংগৃহীত সার্স-কোভ-2 নমুনার মাত্র ০.০৯ শতাংশের সিকোয়েন্সিং করা গেছে। বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থা এই অভাব পূরণের চেষ্টা করে চলেছে এবং ভারত আর দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য অংশে সিকোয়েন্সিং-এর কাজের গতি বাড়ানোর চেষ্টা করছে।      

শেষ পর্যন্ত টিকাকরণই কোভিড-19 প্রতিরোধের একমাত্র রাস্তা হিসাবে বাকি আছে। বিভিন্ন ধরনের কোভিড-19 টিকা আছে যেগুলি ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণের ফলে গুরুতর অসুস্থতা ও মৃত্যু থেকে সুরক্ষা দিতে পারে। তবে, ভারতে টিকাদানের হার লক্ষণীয়ভাবে বেড়ে গেলেও, সমস্ত জনসংখ্যার মধ্যে মাত্র দশ শতাংশের সম্পূর্ণ টিকাকরণ হয়েছে। সারা পৃথিবীতে টিকার লভ্যতার মধ্যে তুমুল অসাম্য দেখা যায়। বিশ্ব জুড়ে টিকার যে তিনশ কোটি ডোজ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে তার প্রায় সত্তর শতাংশই মাত্র ছয়টি দেশ পেয়েছে। নিম্নআয়ের দেশগুলিতে কেবল ০.৩ শতাংশ টিকার ডোজ পৌঁছেছে। বিশেষ করে এই অসাম্যের সমাধান করার জন্যই ধনী সদস্য দেশ এবং কিছু বেসরকারী ও আন্তর্জাতিক সংস্থার আর্থিক সহায়তায় ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে কোভ্যাক্স প্রতিষ্ঠা করা হয়।  কোভ্যাক্সের কার্যসূচী ছিল, মুখ্য টিকা প্রস্তুতকারকদের কাছ থেকে প্রচুর টিকা আগে থেকে কিনে রাখা এবং সেগুলিকে জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিটি দেশে ন্যায্যভাবে বন্টন করা হবে। অনেক পরিমাণে টিকা কিনে রাখার এই কর্মসূচীটির মাধ্যমে যে দামে বড় দেশগুলি টিকা কিনবে সেই দামেই ছোট দেশগুলিও টিকা কিনতে পারবে। কোভ্যাক্সের মাধ্যমে বিশ্বের দরিদ্রতর দেশগুলির বিনামূল্যে টিকা পাওয়ার কথা। কিন্তু, সরবরাহের সমস্যা নিয়ে কোভ্যাক্স অস্থির হয়ে আছে। অনেক ধনী দেশই বিশ্বে যত টিকা মজুত আছে তার থেকে নিজেদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত পরিমাণ কিনে রেখেছে। সিরাম ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া কোভ্যাক্সের অন্যতম প্রধান সরবরাহকারী ছিল। এই ইনস্টিটিউট এখন নিজেদের মজুত টিকার পুরোটাই ভারতের কোভিড-19 সমস্যা সামলাতে কাজে লাগাচ্ছে। ইউএসের মত ধনী দেশ বা ভারত ও চীনের মত দেশ যাদের টিকা তৈরির ক্ষমতা আছে সেই দেশগুলির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে যে, টিকার সব চেয়ে প্রয়োজন যে দেশগুলির তাদের বদলে এরা বেছে বেছে রাজনৈতিক দিক থেকে নিজেদের মিত্র দেশগুলিকে টিকা সরবরাহের প্রস্তাব করছে।   

ডেল্টার মত বিভিন্ন ভ্যারিয়েন্টের বিস্ফোরক বিস্তার থেকে স্পষ্ট হয় যে আমরা সত্যিই একটি বিশ্বজনীন যৌথ। সংক্রামক রোগের বিষ দেশের সীমানা মানে না এবং যতক্ষণ না পর্যন্ত আমরা সবাই নিরাপদ ততক্ষণ কেউই নিরাপদ নয়। ইউএস, ইউকে আর ইজরায়েলের মত দেশে টিকাকরণের হার অনেক বেশি, কিন্তু এখনো পর্যন্ত এই দেশগুলি নিরাপদ নয় কারণ আগে যে ভাইরাস আগে সংক্রমণ ছড়াচ্ছিল সেগুলির বদলে যদি নতুন ভ্যারিয়েন্ট উঠে আসে, তাহলে আবার নতুন করে কোভিড-19 রোগের প্রকোপ শুরু হতে পারে। কোভিড-19 অতিমারীর ফলে মৃত্যুর হার কমাতে এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক সক্রিয়তা পুরোপুরি ফিরিয়ে আনতে রোগপরীক্ষা, চিকিৎসা আর টিকার ন্যায়সঙ্গত বন্টনের ব্যবস্থা সম্ভব করতে হবে। এবং এর জন্য অবশ্যই প্রয়োজন সম্পূর্ণ আন্তর্জাতিক সহযোগিতা। 

প্রিয়া সম্পথকুমার

Author

প্রিয়া সম্পথকুমার মেয়ো ক্লিনিকের ক্রিটিকাল কেয়ার অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজ বিশেষজ্ঞ ও ইন্টার্নিস্ট।

(Bangla Translation by Sritama Halder)
অনুবাদঃ শ্রীতমা হালদার