২০১৪ সালের মে মাসের ভারতীয় বিধানসভায় তাঁর প্রথম বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যে কোনো রকমের হিংস্রতার হাত থেকে মহিলা ও বালিকাদের সুরক্ষার জন্য রাজনীতিবিদদের একত্রে কাজ করার উপর জোর দেন। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে তাঁর প্রথম ভাষণে পুরুষ সন্তানকে ভদ্রতা ও শিষ্টতার শিক্ষা দিতে ব্যর্থ বলে বাবা-মায়েদের সমালোচনা করার মধ্যে দিয়েও মোদী সেই একই বার্তার পুনরাবৃত্তি করেন। ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) যে যে রাজ্যে সরকার চালায় সেখানে বিশেষ প্রতিরক্ষা বিভাগের সাহায্যে জনসমক্ষে মহিলাদের উপর নিগ্রহ কমানর জন্য নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। প্রকাশ্য জনপথে নারী নিগ্রহ নিয়ন্ত্রণের এই প্রচেষ্টার কারণ কী?
প্রকাশ্য জনপথে মহিলাদের উপর হওয়া নিগ্রহের ঘটনার উপর মনোযোগ দিয়ে এবং একটি স্পষ্টতই রাজনীতিকৃত পুলিশবাহিনীর সাহায্যে এই জাতীয় ঘটনাকে নিয়ন্ত্রণ করার বন্দোবস্ত করে বিজেপি অনেকগুলি নিজস্ব রাজনৈতিক লক্ষ্যকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। প্রথমত, মহিলাদের চলাফেরা ও প্রকাশ্য জায়গায় তাঁদের সুরক্ষার মত জরুরি বিষয়কে সম্বোধন করে এই দলটি মহিলা ভোটদাতাদের আহ্বান জানাচ্ছেন। দ্বিতীয়ত, এইভাবে তাঁরা মহিলাদের নিজের বাড়ি ও চাকরির পরিসরের চেনা পুরুষদের হাতে নিগৃহীত হওয়ার বিষয়টিকে সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে, শুধুমাত্র অচেনা পুরুষের হাতে মহিলাদের নিগ্রহের ঘটনাগুলির উপর জোর দিচ্ছেন। পরিশেষে, এই পদক্ষেপটির জন্য পুলিশবাহিনীর মত এমন একটি প্রতিষ্ঠানকে কাজে লাগান হচ্ছে যাকে রাজনৈতিক দলটি সহজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। যার ফলে নিগ্রহের বিশেষ কিছু দৃষ্টান্তকে চিহ্নিত করার ও শাস্তিদানের ব্যবস্থা করার ক্ষমতা বিজেপি ও তার সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংগঠনের হাতেই থেকে যায়।
একটি অসম্ভাব্য জোট
প্রকাশ্য জনপথে মহিলাদের নিগৃহীত হওয়ার বিষয়টিকে নিয়ন্ত্রণের জন্য বিজেপির এই প্রচেষ্টা বিভ্রান্তিজনক। বিষয়টি নিয়ে বিজেপির যে উৎসাহ দেখা যাচ্ছে তা দলটির লিঙ্গভিত্তিক ইতিহাস ও কর্মপন্থার মূল উপাদানগুলির সরাসরি বিরোধিতা করে বসে। ঐতিহ্যগতভাবে, বিজেপি এমন একটি রাজনৈতিক দল যা তৈরি হয়েছিল পুরুষদের হাতে এবং পুরুষদের জন্য। পুরুষ ভোটদাতা ও রাজনৈতিক পদ অধিকারের জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করেন এমন পুরুষ কর্মীদের কাছে এই দলটি প্রাধান্য পায়। এই রকম একটি পুরুষতান্ত্রিক রাজনৈতিক ভিত্তি ও নেতৃত্বের কাঠামো যে দলের, তারা হঠাৎ প্রকাশ্য স্থানে মহিলাদের সুরক্ষা নিয়ে এত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে কেন তা ঠিক পরিষ্কার নয়।
জনপথে মহিলাদের অধিকারের উপর মনোযোগ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আবার মোদী সরকার গৃহের পরিসরে মহিলাদের অধিকার খর্ব করে চলেছেন। ক্ষমতায় আসার পর থেকেই এই সরকার বারংবার ভারতীয় দণ্ড বিধির ৪৯৮এ ধারা, যার সাহায্যে গার্হস্থ্য হিংসাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে অনুমোদন করা যায়, তাকে আক্রমণ করে চলেছে। ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক, মহিলারা এই ৪৯৮এ ধারার অপব্যবহার করতে পারেন বলে দাবী করে, বিচারালয়ের বাইরেই আলোচনার মাধ্যমে এই জাতীয় অভিযোগের সমাধান করারর জন্য আইন প্রণয়ন এবং “মিথ্যা” অভিযোগের ক্ষেত্রে জরিমানা বৃদ্ধি করার প্রস্তাব করেছে। গার্হস্থ্য হিংসা নিয়ে আমার আগের গবেষণা এবং প্রথম সারির আইনজীবি ও আইন বিশেষজ্ঞদের গবেষণা থেকে স্পষ্ট হয় যে, গার্হস্থ্য হিংসার বিরুদ্ধে নিজেদের অধিকার আদায় করতে মহিলাদের এমনিতেই যথেষ্ট বাধার সম্মুখীন হতে হয় এবং সামান্যতম সাফল্যের জন্যও বহু ধরনের সাংগঠনিক সহায়তা নিতে হয় তাঁদের। গার্হস্থ্য হিংসার বিষয়ে মহিলাদের অসত্য উক্তি করার সম্ভাবনা সংক্রান্ত কাল্পনিক আখ্যান নির্মাণ, বিচারব্যবস্থার বাইরে সমস্যার নিষ্পত্তি করাকে উৎসাহ দান এবং অভিযোগ জানানোর আর্থিক মূল্য বাড়ানোর মাধ্যমে, ইতিমধ্যেই অত্যন্ত কঠিন এই আইনি ক্ষেত্রটিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের প্রস্তাবিত সংশোধনটি আরও ভীতিপ্রদ করে তুলছে।
বিজেপি রাজনীতিবিদ ও বিজেপি-সংশ্লিষ্ট স্বেচ্ছাসেবক সংস্থাগুলি অসংখ্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় মুসলিম মহিলা ও বালিকাদের উপর যৌন নির্যাতন চালিয়েছে। এর মধ্যে আছে ১৯৯২ সালের বাবরি মসজিদ দাঙ্গা, ২০০২ সালে মোদী যখন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন গুজরাট দাঙ্গা, এবং ২০১৩ সালের মুজফফরনগরের দাঙ্গা যখন অন্তত পঞ্চাশজন মুসলিম মহিলা হিন্দু পুরুষদের হাতে গণধর্ষণের শিকার হন। এই হিংস্র ঘটনাগুলির মধ্যে অধিকাংশই প্রকাশ্য জনপথেই ঘটেছে, সেই জনপথ যা বিজেপি এখন লোক দেখানর জন্য নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে।
এই প্রেক্ষাপটে, গুজরাট, হরিয়ানা এবং উত্তর প্রদেশ (ইউপি) – এই তিনটি বিজেপি শাসিত রাজ্যই যৌন নিগ্রহের ঘটনা কমানর জন্য বিশেষ প্রতিরক্ষা বিভাগের প্রচলন করেছে। নিগ্রহকে প্রকাশ্য ও গণপরিসরের সমস্যা বলেই সংজ্ঞায়িত করা হয়ে থাকে। অ্যান্টি-রোমিও স্কোয়াড (ইউপি ও গুজরাট) এবং অপারেশান দুর্গা (হরিয়ানা) প্রমোদোদ্যান এবং পরিবহনের কেন্দ্রগুলিতে টহল দিয়ে বেড়ায় এবং “ইভ-টিজার” এবং “রোমিও” অর্থাৎ যে পুরুষরা মেয়েদের অনুসরণ করে, গায়ে হাত দেয় বা তাদের উদ্দেশ্যে অশ্লীল মন্তব্য করে তাদের গ্রেফতার ও জরিমানা করে। পিওএসএইচ অর্থাৎ ভারতে প্রচলিত ২০১৩ সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট অফ উওমেন অ্যাট ওয়ার্কপ্লেস বিধিটি এই দলগুলি জারী করে না।
ইউপি থেকে যে বিস্তারিত তথ্যগুলি পাওয়া যায় তা থেকে এই দলগুলির কাজের একটা ধারণা করা যায়। ২০১৭ সালে যখন ইউপি-র মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ প্রথমবার অ্যান্ট-রোমিও স্কোয়াডের কথা উল্লেখ করেন, তখন হিন্দু মহিলাদের জন্য মুসলিম পুরুষরা ঠিক কতটা বিপজ্জনক সেই আখ্যান দিয়েই তাঁর প্রচারণার ইস্তাহার ভরা ছিল। ২০১৭ সালের মার্চ মাস থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত অ্যান্টি-রোমিও স্কোয়াড ১৪,৪৫৪ জন পুরুষকে গ্রেফতার করেছে। সঙ্গে সঙ্গে, মুক্তিপণের জন্য জুলুম, ওঠবোস, মাথার চুল কামিয়ে দেওয়া ও মুখে কালি মাখিয়ে দেওয়ার মত জনসমক্ষে অপমানের মত অসংখ্য আইন-বহির্ভূত পদক্ষেপও এই স্কোয়াড নিয়েছে।
কর্মকর্তারা সম্ভাব্য “রোমিওদের” চিহ্নিত করেন তাদের পোষাকআশাকের ধরণ থেকে ইঙ্গিত নিয়েঃ তাঁরা “কালা চশমা” (কালো রোদচশমা) পরেন এবং এঁদের “জামার উপরের তিনটে বোতাম খোলা থাকে”। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) মত বিজেপি-সংশ্লিষ্ট সংগঠন, পুলিশের সঙ্গে মিলিতভাবেই এই আইন-বহির্ভূত শাস্তিদানের কাজটি করে বলে শোনা যায়। বিজেপির প্রতিদ্বন্দী রাজনৈতিক দলের সদস্য, সমাজের নিচুতলার গোষ্ঠীদের (মুসলিম ও শ্রমজীবি পুরুষ) লক্ষ্য করে এবং নীতি পুলিশের ভূমিকায় এই দলগুলি সমকামিতা, বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক, অসবর্ণ বিবাহ, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী নারী ও পুরুষের মধ্যে যৌন সম্পর্ককে নিশানা করে বলে সমালোচকরা এই স্কোয়াডকে অভিযুক্ত করেছেন।
প্রকাশ্য জনপথে নিগ্রহের ঘটনা নিয়ন্ত্রণের রাজনীতি
আবারও, বিজেপি প্রকাশ্যে মহিলাদের নিগ্রহের ঘটনা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে কেন? প্রথমত, প্রকাশ্য জনপথে নিগৃহীত হওয়ার ঘটনা ভারতের মহিলাদের জীবনের একটি সুতীব্র সমস্যা, এবং এই জাতীয় ঘটনা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে দিয়ে রাজনৈতিক দল হিসেবে মহিলাদের অধিকারের সমর্থক বলে বিজেপি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। ভারতের প্রধান মহানগরগুলিতে করা সমীক্ষা থেকে জানা যায় যে, মহিলারা পথেঘাটে সুরক্ষিত বোধ করেন না। কলকাতায় মেয়েরা রাত্রে বাইরে না যাওয়ারই চেষ্টা করেন এবং ফাঁকা রাস্তা এড়িয়ে চলেন। মুম্বাইতে একানব্বই শতাংশ মহিলা রাস্তায় অনিরাপদ বোধ করেন এবং দিল্লিতে পঁচানব্বই শতাংশ মহিলা বলেছেন যে, নিগৃহীত হওয়ার ভয়ে তাঁদের চলাফেরা সীমাবদ্ধ। নিরাপত্তা নিয়ে মেয়েদের উদ্বেগ উঠে আসে নিগ্রহের ঘটনার উচ্চহার থেকে। দিল্লীর উত্তরদাতাদের মধ্যে চল্লিশ শতাংশ জানিয়েছেন যে তাঁরা শারীরিক বা মৌখিকভাবে নিগৃহীত হয়েছেন এবং মুম্বাইতে এই সংখ্যা আশি শতাংশের উপরে।
২০১২ সালে দিল্লীতে যখন জ্যোতি সিং পান্ডেকে একটি চলন্ত বাসের মধ্যে গণধর্ষণ ও খুন করা হয় তখন সমাজকর্মীরা প্রকাশ্য ও জনপরিসরকে মহিলাদের জন্য সুরক্ষিত করতে গভীর রাত্রে রাস্তায় হাঁটার ব্যবস্থা করেন, পার্কে ঘুমোন এবং পথে পথে “ইতস্তত ঘুরে বেড়ান”। এর সঙ্গে সঙ্গেই নারীবাদী দলগুলি দাবী করেন যে রাজনীতিবিদরা তাঁদের প্রচারে জনসুরক্ষার বিষয়টিকে যুক্ত করেন। এই উদ্বেগগুলিকে সম্বোধন করে বিজেপি এমন একটা সময় মহিলা ভোটারদের কাছে আবেদন রাখেন যখন নির্বাচনের সময় মহিলা ভোটারদের উপস্থিতির হার উর্ধ্বগামী। এই নির্দিষ্ট নীতির উপর লক্ষ্যস্থির রেখে এগিয়ে চলার কর্মপন্থাটি দেখা যাচ্ছে সফল হয়েছে। ২০২২ সালের যে বিধানসভা নির্বাচনে এই দলটি জয়ী হয় সেবার প্রথম, চারটি রাজ্যেই মহিলারা পুরুষদের চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যায় বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন। অনেক মহিলাই ইঙ্গিত করেছেন যে, জনপরিসরে কঠোরভাবে আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার পদক্ষেপ নিয়েছে বলেই তাঁরা বিজেপিকে সমর্থন করেছেন।
যদিও প্রকাশ্য জনপথে নিগৃহীত হওয়ার ঘটনা মহিলাদের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা, কিন্তু তা সত্ত্বেও সেইদিকে বিজেপির মনোযোগকে আক্ষরিক অর্থে না নেওয়াই ভাল। প্রকাশ্যে নিগৃহের অভিজ্ঞতাই ভারতের মহিলাদের জীবনের একমাত্র লিঙ্গভিত্তিক হিংস্রতার ঘটনা নয়। তিরিশ শতাংশেরও বেশি ভারতীয় মহিলা ও বালিকারা গার্হস্থ্য হিংসার শিকার। কম মজুরির কাজে এবং অসংগঠিত কর্মক্ষেত্রে, বিশেষ করে কারখানা, গার্হস্থ্য শ্রম এবং নির্মাণকার্যের সঙ্গে জড়িত মহিলারা কর্মক্ষেত্রে যৌন নিপীড়নের শিকার হতে পারেন। প্রকাশ্য জনপথে ঘটা নিগ্রহের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করার সঙ্গে সঙ্গে কর্মস্থলে নিপীড়ন এবং গার্হস্থ্য হিংসার ক্ষেত্রে মহিলাদের অধিকার কেড়ে নেওয়ার মধ্যে দিয়ে লিঙ্গভিত্তিক দুর্বল অবস্থানের গুরুত্বপূর্ণ প্রাতিষ্ঠানিক কেন্দ্রগুলিকে লঘু করে তুলছে। এই রকম এক ধরণের হিংস্রতাকে সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে দেওয়া কিন্তু আরেক এক ধরণের হিংসার উপর অতিরিক্ত মনোযোগ দেওয়ার এই অসামঞ্জস্যতার একটি ব্যাখ্যা চাওয়া আশু প্রয়োজন।
জনপথে ঘটা নিগ্রহের ঘটনা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করার সুবিধা হল, এই প্রচেষ্টার ফলে রাজনৈতিক দলটিকে কর্মস্থান ও গৃহের মত তুলনামূলকভাবে অগম্য পরিসর নিয়ে সতর্কতা অবলম্বন না করলেও চলে। যে সামাজিক মর্যাদাক্রম (মালিক ও শ্রমিকের মধ্যে এবং স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে) কর্মস্থল ও গৃহকে অবয়ব দেয় তাকে এই পদক্ষেপ অক্ষতই রাখে। এবং সঙ্গে সঙ্গে, একমাত্র অচেনা পুরুষ এবং রাস্তাঘাটে যে ছেলেরা ঘোরাঘুরি করেন ও সময় কাটান তাঁদের হাতেই মহিলাদের ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি – এই মনগড়া আখ্যানটি অক্ষুণ্ণ অবস্থাতেই থেকে যায়। ভারতের মত যে দেশে সবর্ণ বিবাহের প্রথা বৈবাহিক আর আত্মীয়তার সম্পর্ককে অবয়ব দেয় এবং যে দেশের “জনপথ” অনেক সময়ই দরিদ্র, নিম্নবর্ণ এবং মুসলিম পুরুষের উপস্থিতিতে ভরা, সে দেশের গৃহের বাইরের গণ পরিসরে মহিলারা যে কল্পিত বিপদের সম্মুখীন হতে পারেন তা লক্ষনীয়ভাবে, শ্রেণী, বর্ণ এবং ধর্মকেন্দ্রিক সম্পর্কের সঙ্গে জড়িত। এই ক্ষেত্রে, গার্হস্থ্য ও কর্মক্ষেত্রে হিংসার বিষয়ে বিজেপির মতামত অন্যান্য জাতীয়তাবাদী দলের কন্ঠস্বরেরই প্রতিধ্বনি। এরা প্রত্যেকেই সামাজিক প্রতিরূপ এবং নৈতিক সামাজিকীকরণের পরিসর হিসেবে ঐতিহ্যগত পারিবারিক বন্ধনকে রক্ষা করে এবং তার পাশাপাশি, মহিলাদের মঙ্গলের পক্ষে অচেনা পুরুষরা কি বিপদ ডেকে আনতে পারে তার দিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
পরিশেষে, নিগ্রহ-বিরোধী নীতিগুলির প্রচলন করার জন্য দুর্নীতিগ্রস্ত, অতিরিক্ত কাজের ভারে ভারাক্রান্ত ও গভীরভাবে রাজনীতিকৃত পুলিশবাহিনীকে ব্যবহার করে, বিজেপি এমন একটি সংগঠনকে সংহত করে যা রাজনৈতিক চাপের মুখে নত হতে প্রস্তুত এবং তার ফলে সহজেই নিয়ন্ত্রিত হয়। পুলিশের যে কোন পদে চাকরি পাওয়া, চাকরিস্থল বাছাই এবং পদোন্নতির সুযোগ সবই থাকে একটি রাজ্যের সরকারের অর্থাৎ, যে দল সেই রাজ্যে ক্ষমতায় আছে তার হাতে। বিজেপির রাজনীতিবিদরা এবং বিজেপির সঙ্গে সংযুক্ত সদস্যদলগুলি তাই পুলিশবাহিনীকে সতর্কভাবে কাজে লাগিয়ে কোন কাজকে নিগৃহ বলা যেতে পারে এবং কিভাবে নিগ্রহের ঘটনাকে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে তা ঠিক করতে পারে।
ইউপি-র পুলিশবাহিনী ও শুধুমাত্র পুরুষ সদস্য সহ হিন্দু জাতীয়তাবাদী আধাসামরিক সংগঠনগুলির একজোটে কাজ করা ও আইন-বহির্ভূত শাস্তির বিষয়ে পাওয়া অসংখ্য বিবৃতি এক্ষেত্রে অনেক কিছুরই ইঙ্গিত দেয়। এর সঙ্গে সঙ্গে, অনেক বিবৃতিতেই দেখা যায় যে প্রতিরক্ষা দলগুলি নীতি পুলিশের ভূমিকা নিয়ে গণপরিসরে সমকামিতার অস্তিত্ব মুছে দেওয়ার প্রচেষ্টা করছে এবং ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক শ্রেণীর নারী ও পুরুষের মধ্যে যৌন সম্পর্ক স্থাপনে বাধা দিচ্ছে। গুজরাটের অ্যান্টি-রোমিও স্কোয়াডের হাতে পুরুষ ও মহিলা, যাঁদের আবার “রোমিও” এবং “জুলিয়েট” নামে ডাকা হয়, উভয়েই গ্রেফতার হয়েছেন। রোমিও এবং জুলিয়েট আদতে এমন দুটি কাল্পনিক চরিত্র যাঁরা প্রতিদ্বন্দী দলের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও পারস্পরিক সম্মতিতেই সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন। যৌন হ্যানস্থা, যা কিনা একটি সম্মতিহীন হিংসাত্মক আচরণ, তার সঙ্গে এই নামদুটির কোন সম্পর্কই নেই। বরং যৌন নিপীড়ন জড়িয়ে আছে সামাজিক গণ্ডীকে উল্লঙ্ঘন করে এমন যৌন সম্পর্কের সঙ্গে।
জনপথে ঘটা নিগ্রহকে নিয়ন্ত্রণ করে বিজেপি বৈধতার ছদ্মবেশ এবং নমনীয় আইনি প্রতিষ্ঠানগুলিকে ব্যবহার করে বিষমকামিতা ও শ্রেনী, বর্ণ ও ধর্মকেন্দ্রিক সামাজিক মর্যাদাক্রমের ধারণাকে চাপিয়ে দিতে পারে। এবং এই নিয়ন্ত্রণের কারণে গৃহ ও কর্মক্ষেত্রে ঘটা হিংসার থেকে মনোযোগ সরে যাবে, যার ফলে পারিবারিক জীবনের পবিত্রতা নিশ্চিত হবে এবং আবদ্ধ ও অগম্য পরিসরকে নিয়ন্ত্রণের ঝামেলা থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। পরিশেষে, জনপরিসরে মহিলাদের সুরক্ষার মত একটি অত্যন্ত বাস্তব উদ্বেগকে সম্বোধনের অছিলায় বিজেপি এই তার নিজস্ব কার্যাবলীগুলিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। প্রকাশ্য জনপথে নিগৃহীত হওয়ার বিষয়টি এই রাজনৈতিক দলের হাতে এমন একটি অস্ত্র হাতে তুলে দিয়েছে যার সাহায্যে একদিকে মেয়েদের অধিকারের আওতা বাড়িয়ে নেওয়া গেলেও, তার পাশাপাশি পশ্চাদমুখী সামাজিক সম্পর্কগুলিকেও সুনিশ্চিত করা যায়।