অলীক মানচিত্রের সন্ধানে

11/10/2021
IiT English Page

দেশভাগ বিষয়টির দোষগুণ নিয়ে এ বছর আবার নতুন করে চিন্তাভাবনা শুরু হতে দেখা গেছে। প্যালেস্টাইন আর আয়ারল্যান্ড, ভারত ও পাকিস্তান বিভাজনের সঙ্গে জড়িত দেশভাগ সংক্রান্ত ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে দেশবিভাগের প্রণালীর গুণমান এবং তার নিষ্পত্তি নিয়ে গত কয়েক মাস ধরে আরো বেশি গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ভারতের জন্য, বিশেষ করে বর্তমানে যেভাবে দেশভাগের স্মৃতিকে রাজনৈতিক লড়াইয়ের হাতিয়ার করে তোলা হচ্ছে তার পরিপ্রেক্ষিতে, এই দুই দেশ থেকে যে শিক্ষা পাওয়া যায় তা মূল্যবান হয়ে ওঠা উচিত। 

১৯৯৮ সালে, একটি সুদীর্ঘ প্রাদেশিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের মধ্যেই বিভিন্ন অংশীদার একত্রে উত্তর আয়ারল্যান্ড চুক্তি বা নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড প্রোটোকলে স্বাক্ষর করেন, যা প্রায় একশ বছরের পুরনো দেশভাগ সদৃশ বিবাদের অবসান করে ওই অঞ্চলে স্থিতি ও শান্তি ফিরিয়ে এনেছে। এখন, ব্রেক্সিটের সঙ্গে আইরিশ প্রশ্নটি জড়িয়ে গেছে।তার ফলে, গত দুই দশকে এই অঞ্চলে হিংস্রতা এবং বিশৃঙ্খলার ঘটনা কমতে শুরু করলেও আবার তার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।  

আইরিশ শান্তি প্রক্রিয়া একটি সংঘবদ্ধ আদর্শকে কল্পনা করে যার বৈশিষ্ট্য দেশের সীমানার শিথিলকরণ এবং একটি ইউরোপীয় চুক্তির কাঠামোর অধীনে একটি রাজনৈতিক চুক্তির উপর ন্যস্ত পরিকাঠামোর দ্বারা দেশ শাসন। ভারতীয় দর্শক, যাঁদের প্রতিটি ধারাবাহিক সরকার গত সাত দশকের অনেকটা অংশ জুড়ে শোচনীয়ভাবে মোটামুটি তুলনীয় এক অধরা সমাধানের সন্ধানে ব্যস্ত থেকেছেন তাঁদের কাছে, ইউকেতে ব্রেক্সিট ভোটের পর যেভাবে এই সমস্যার মীমাংসা করা হয়েছে তা সত্যিই বিস্ময়কর।   

ব্রেক্সিট সমাধানের অর্থ হল, ইউকের আভ্যন্তরীণ শুল্ক সীমানাকে একতরফাভাবে পিছিয়ে আইরিশ সাগরের দিকে টেনে নেওয়া। এই কাজটি অনেক দিক থেকেই দেশের সীমানাকে একতরফাভাবে বদলে দিয়েছে। এর ফলে আরো যা ঘটেছে তা হল, রিপাবলিকের সংখ্যাগরিষ্ঠদের দলে ভারি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেবে বলে উত্তর আয়ারল্যান্ডের প্রোটেস্ট্যান্ট সম্প্রদায়ের মধ্যে ভয় দেখা দিয়েছে। বিরোধিতা ও আন্তঃসাম্প্রদায়িক বৈরভাবও বেড়ে গেছে, যা এক কঠিন লড়াইয়ের পর পাওয়া দেশভাগ সংক্রান্ত সমস্যার সমাধানকে নষ্ট করে দিচ্ছে। এর উল্লেখ করে, অনেক ভাষ্যকারএখনই হিংসাত্মক ঘটনার সম্ভাবনা সম্পর্কে সতর্ক করছেন।          

মে মাসে, পূর্ব জেরুজালেমের আকসা মসজিদকে ঘিরে ঘটা হিংসাত্মক ঘটনার ফলে দাঙ্গা শুরু হয় যা চরম মাত্রায় পৌঁছোয় “১১ দিনের যুদ্ধে”। এই যুদ্ধে ইসরায়েল ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের বসতিগুলিকে নিশানা করে, যার ফলে ২৩০ জন প্যালেস্টিনীয়র মৃত্যু হয়। বহু দশক ধরেই ইজরায়েলের সরকার কি ভাবে প্যালিস্টিনীয়দের অবস্থানকে ক্রমশ দুর্বলতর করে তুলেছেন তা সবারই জানা। কিন্তু সেই ঘটনার এই সাম্প্রতিকতম পুনরাবৃত্তির সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার দেশভাগের সঙ্গে সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় বলে তা আরো গভীর বিবেচনার দাবি রাখে।    

পূর্ব জেরুজালেমের বিতর্কিত অঞ্চলে বসবাসকারী তিনশটি পরিবার উচ্ছেদ হওয়ার মুখে, কারণ ওই জমিতে তাঁদের অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তোলার ক্ষমতা ইজরায়েলের আছে। ইজরায়েলের বক্তব্য, ওই অঞ্চল আসলে ইহুদী বাসিন্দাদের অধিকারে। ইজরায়েলী সরকার জানিয়েছেন যে পূর্ব জেরুজালেমের বিক্ষোভকারীরা “জেরুজালেমের হিংসাত্মক ঘটনার আগুনে আহুতি দিতে, স্থাবর সম্পত্তি সংক্রান্ত একটি ব্যক্তিগত সমস্যাকে জাতীয়তাবাদী বিষয়ে পরিণত করে তুলেছে”।  

অন্য কোন রাষ্ট্রের যদি এই অবস্থায় ভারসাম্য আনার ইচ্ছা থেকে থাকে তবে সেই উদ্দেশ্যের প্রতি আবেদন করার ক্ষমতাকে সুনিয়ন্ত্রিতভাবে কমিয়ে দেওয়ার ফলে প্যালিস্টিনীয়ার বাসিন্দাদের হাতে আশ্রয় পাওয়ার বিকল্প অনেকটাই কম। এর ফলে, তাঁদের অবস্থানের দুর্বলতা আরো বেড়ে গেছে। প্রকৃতপক্ষে, বিশেষজ্ঞরা ২০২০ সালে চালু হওয়া “ট্রাম্প শান্তি পরিকল্পনা” বা “ট্রাম্প পিস প্ল্যান”-কে ব্যাপকভাবে সমালোচনা করেছেন। তাঁদের মতে, কি ভাবে প্যালেস্টিনীয়দের একটি বাস্তবসম্মত রাষ্ট্রপরিচিতি দেওয়ার সম্ভাবনাকে ক্রমাগত শেষ করে দেওয়া যেতে পারে, এই পরিকল্পনা হল তারই একটি উদাহরণ।   

 তার উপরে, একটি দ্বি-রাষ্ট্র পরিকাঠামোর অভাবে উদ্বাস্তুদের “ফেরার অধিকার”-কে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি আরো বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। ১৯৪৮-এর “নাকবা”-র সময়ে ঘটা উচ্ছেদ প্রক্রিয়ার বিশেষজ্ঞরা, কি ভাবে সেই বছর, ইজরায়েল প্রতিষ্ঠার পরেই ৭৫০,০০০ প্যালেস্টিনীয়কে ছিন্নমূল করা হয় তার বর্ণনা করেন। এর কারণ, আধাসামরিক বাহিনীর প্রচার করা ধারণা যে, দীর্ঘ মেয়াদী বসবাসের ফলে জাত অধিকার প্যালেস্টিনীয়দের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। এই উচ্ছেদ প্রক্রিয়া ঘটে পুরোদস্তুর হিংসাত্মক ঘটনা বা কানে কানে ক্রমাগত চলতে থাকা প্রচারের মধ্যে দিয়ে। প্যালেস্টিনীয় উদ্বাস্তুদের ইজরায়েলের পুনর্বাসন বা নিজস্ব সম্পত্তি পুনরুদ্ধারের জন্য সেখানে ফিরে যাওয়ার অধিকার আজও বিতর্কিতই রয়ে গেছে।     

এই প্রক্রিয়াটির ব্যাপ্তি পরীক্ষা করে দেখার নানাবিধ উপায় আছে। কিন্তু, ১৯৫০-এর দশকের প্রথম দিকে ভারত আর পাকিস্তানের যে অবস্থান ছিল তার থেকে উল্লেখযোগ্য শিক্ষা পাওয়া যায়। পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিমবঙ্গে অভিবাসনের অনিয়ন্ত্রিত স্রোত আটতে ভারত ও পাকিস্তান সরকার অনেকগুলি চুক্তি করেন, প্রথমে প্রাদেশিক স্তরে যা পরে ১৯৫০ সালের নেহরু-লিয়াকত চুক্তির মধ্যে দিয়ে চূড়ান্ত রূপ পায়।         

তার উপর, উদ্বাস্তু সম্পত্তির বিষয়ে ভারত আর পাকিস্তানের সরকার এক সঙ্গে কাজ করার চেষ্টা করেছেন। তার কারণ, অংশত, অন্য রাষ্ট্রের ভার বহনের ধাক্কা সামলানোর জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা বেষ্টনীর অভাবের ফলে দেশবিভাগ পরবর্তী সময়ের প্রেক্ষিতে, উদ্বাস্তুদের ফেলে যাওয়া সম্পত্তি বিনা বাধায় বেদখল করার সম্ভাবনা আরো বেড়ে যায়। এই বিষয়টি ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ককে কি ভাবে প্রভাবিত করতে পারে তা সম্যকভাবে বিচার করার কারণেও ১৯৫০-এর দশকে দক্ষিণ এশিয়ায় দেশবিভাগের অংশত ভিন্ন গতিপথ তৈরি হয়েছিল।      

ভারতের দেশভাগ পরবর্তী সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলিতে বাসস্থান পত্তনের ভিত্তি স্থাপনকে প্রশ্ন করার সঙ্গে জড়িত নতুন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতির জন্য দৃষ্টান্ত খোঁজার সময় সরকারের উচিত উত্তর আয়ারল্যান্ড ও প্যালেস্টাইনের ব্যর্থতার গুরুত্বকে বিবেচনা করা। শেষ পর্যন্ত, একটি রাষ্ট্রকে দুর্বল করে তুলতে একটিমাত্র সরকারের একতরফা রায় বা একটি রাষ্ট্রের উপর অন্য একটি রাষ্ট্রের নিজস্ব মতামতকে চাপিয়ে দেওয়ার ফলাফল কখনই স্থায়ী হয় না। এই সমাধানগুলি যা ইঙ্গিত দেয় – অর্থাৎ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকারের মূল্যে জবরদস্তি একটি আঞ্চলিকীকৃত জাতিপরিচয় নির্মাণের আইন-প্রণয়ন – এই পদক্ষেপটিই আসলে সব থেকে বেশি অদূরদর্শী।    

পল্লবী রাঘবন

Author

পল্লবী রাঘবন অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সহকারী অধ্যাপক। ২০২০ সালে সি. হার্স্ট অ্যান্ড কো. (ইউকে) এবং হার্পার কলিন্স থেকে তাঁর বই, অ্যানিমোসিটি অ্যাট বেঃ অ্যান অলটারনেটিভ হিস্ট্রি অফ দ্য ইন্ডিয়া-পাকিস্তান রিলেশানশিপ, ১৯৪৭-১৯৫২ প্রকাশিত হয়েছে।  

(Bangla Translation by Sritama Halder)
অনুবাদঃ শ্রীতমা হালদার