যে ব্যাঙ্গালোরের পরিচয় ছিল এমন এক শহর হিসাবে যেখানে সারা বিশ্ব থেকে ব্যাকএন্ড টেকনোলজির কাজ এসে পৌছয়, শিল্পোদ্যোগী ও রাজ্যসরকারের কর্মচারীদের হাতে এই নগর পরিণত হয়েছে স্টার্টআপ ও উদ্ভাবনের কেন্দ্রে। যে যে পরিসর ও চর্চাগুলির মধ্যে দিয়ে এই "স্টার্টআপ নগরী" উঠে এসেছে, ২০১২ সাল থেকে আমি সেগুলিকে অনুসরণ করছি। নাগরিকদের শিল্পোদ্যোগী করে তোলার একটি মুখ্য উপায় হল মহিলাদের শিল্পোদ্যোক্তা হিসাবে গড়ে তোলার উপর বিশেষ মনোযোগ দেওয়া। মহিলা শিল্পোদ্যোগীদের যোগাযোগ ও পরিচয় বাড়ানো বা নেটওয়ার্কিং জন্য সমাবেশ, টেকনোলজির বিষয়ে গুগলের দ্বারা সংগঠিত বিশেষ অধিবেশন, ইন্ডিয়ান ইনস্টিট্যুট অফ ম্যানেজমেন্ট (ব্যাঙ্গালোর)-এর প্রশিক্ষণ কার্যক্রম এবং পরামর্শদাতাদের অসংগঠিত দলের মত বিভিন্ন প্রকল্প আছে। তার পরেও যতজন মহিলা শিল্পোদ্যোগী সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে তাঁদের মধ্যে অনেকেই কেন পর্যাপ্ত আর্থিক সহায়তা পান না বা শিল্পোদ্যোগী হিসাবে স্বীকৃত নন?
"উন্নয়নের লিঙ্গভিত্তিক ক্রম" বা জেন্ডার অর্ডার যা নতুন সহস্রাব্দ অবধি পৌঁছে গেছে সে বিষয়ে লেখার সময় ইউসিএলএ-র অধ্যাপক অন্যন্যা রায় উল্লেখ করেন যে, নব্য উদারপন্থী আদর্শ ও সংযমের রাজনীতি যে উদারনৈতিক ব্যক্তিত্বকে জায়গা দেয় তা দারিদ্রের অস্তিত্বকে স্বীকার করে ও তাকে নিয়ে কাজ করতে চায়। অলাভজন প্রতিষ্ঠান বা নন-প্রফিটের ইস্তাহারের মলাটে তৃতীয় বিশ্বের চরম দুর্দশাগ্রস্ত মহিলাদের ছবির জায়গায় নিয়েছে বিশ্বব্যাপী উন্নয়নের মাধ্যমে ক্ষমতাপ্রাপ্ত এক নাগরিক। এই নারী শিল্পোদ্যোগী ও কাজের জগতে তাঁর ভূমিকা সক্রিয়। তাঁর সম্প্রদায়ের উন্নতির জন্য তিনি মাইক্রোফাইনান্স থেকে ঋণ নিতে পারেন। এছাড়াও তিনি আন্তর্জাতিক মাইক্রোফাইনান্স গোষ্ঠী কিভার ওয়েবসাইটে নিজেকে আকর্ষণীয়ভাবে চিত্রিতও করতে পারেন। মহিলাদের শিল্পোদ্যোগী করে তোলার উপর এই মনোযোগ মূল্য নির্মাণ করে, দারিদ্র দূর করে, নীতির নারীকরণকে চিহ্নিত করে। রায় লেখেন যে, বিশ্বব্যাপী উন্নয়নের এই পর্যায়ে "নারীকেন্দ্রিক নীতির মাধ্যমে উন্নয়ন যে রাস্তায় কাজ করে তা সামাজিক অনুকৃতি বা সোশ্যাল রিপ্রোডাকশানের ক্ষেত্রে পরম্পরাগত লিঙ্গ ভূমিকা বজায় রাখতে সাহায্য করে।" কি ভাবে এই "উন্নয়নের লিঙ্গভিত্তিক ক্রম" স্টার্টআপ পুঁজিবাদের প্রতিযোগিতামূলক শিল্পোদ্যোগী বিশ্বকে গড়ে তোলে তা ব্যাঙ্গালোরে আমার গবেষণার কাজ চলাকালীন আমি চাক্ষুষ দেখেছি। মহিলারা শিল্পোদ্যোক্তা হয়ে উঠবেন এমন এক সমাজব্যবস্থার মধ্যে যা তারপরেও তাঁদের ঘরের কাজ, বর্ণ ও শ্রেণীর বারংবার নির্মাণ, এবং নিজেদের পরিবারকে বিদ্যালয় ও কর্মক্ষেত্রের জন্য প্রস্তুত করে যাবেন।
পুরুষকেন্দ্রিক কাঠামোতে মহিলাদের খাপ খাওয়ান
বৃহত্তর সামাজিক পরিকাঠামোকে না বদলিয়ে মহিলাদের ক্ষমতায়নের উপর জোর দেওয়ার ঘটনাটি দুই ভাবে কাজ করে। প্রথমত, অর্থসাহায্যের জন্য মহিলারা স্টার্টআপের পুরুষতান্ত্রিক জগতে প্রতিযোগিতায় নামতে বাধ্য হন। উদাহরণ হিসাবে একটি ঘটনার উল্লেখ করা যায়। ব্যাঙ্গালোরের একটি স্টার্টআপ উৎসবে আমি শিল্পোদ্যোগীদের পরিকল্পনার আদান প্রদান বা পিচিং বিষয়ক একটি অধিবেশনে উপস্থিত ছিলাম যেখানে শিল্পোদ্যোগীরা এক দল আর্থিক সাহায্যদাতাকে নিজেদের প্রতিষ্ঠান ও পরিকল্পনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন।
মহিলারা তাঁদের বক্তব্য রাখার জন্য উঠছিলেন - শিশুদের জন্য অঙ্কের খেলা, কাজের জগতে যাঁরা ফিরে যেতে চান তাঁদের জন্য মানব সম্পদ বিষয়ক পরামর্শদানের উদ্যোগ, পার্টির জন্য নানা খেলা। তার উত্তরে তাঁরা ওই সাহায্যকারীদের দিক থেকে কবোষ্ণ প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হন। তাঁদের বলা হয় "যে চাহিদা ইতিমধ্যেই আছে তার জন্য উদ্ভাবনের প্রয়োজন নেই। চাহিদা ও আকাঙ্খা তৈরি করতে হবে!" আর্থিক সাহায্যকারীরা এমন প্রকল্প খুঁজছিলেন যা দ্রুত বাড়বে, প্রভূত সাফল্য পাবে এবং তারা এতটাই জোরদার প্রচার চালাবে যাতে প্রতিষ্ঠিত বাজারকে যোগান দেওয়ার বদলে সেগুলির নিজস্ব বাজার তৈরি হয়।
মহিলারা নিরলসভাবে মন্তব্যগুলি লিখে নিয়েছেন এবং নিজেদের পরিকল্পনাকে ঢেলে সাজিয়েছেন। কিন্তু সমস্যা তাঁদের পরিকল্পনা নিয়ে নয়। সমস্যা হল যে, স্টার্টআপ শিল্পোদ্যোগের জগত পুরুষকেন্দ্রিক। তার প্রয়োজন উদ্ভাবনের পরিসরে চলিষ্ণুতা, নেটওয়ার্কিং এবং অবসর যা এই স্টার্টআপ জগতকে তৈরি করে। উদ্ভাবনের পরীক্ষাগারেই হক বা পরিকল্পনা বর্ণনার বৈঠকে, সব সময়ই যে প্রশ্নগুলি উঠে এসেছে সেগুলি হল কি ভাবে পরিকল্পনার আরও প্রসারিত হবে, শিল্পোদ্যোগীরা তাঁদের ব্যবসায় কতটা সময় দিতে পারবেন। এদিকে এই দুই ক্ষেত্রের জন্যই মহিলা শিল্পোদ্যোগীদের হাতে সময় লক্ষণীয়ভাবে কম। সন্ধ্যেবেলায় যে নেটওয়ার্কিং অধিবেশনের আয়োজন হয়েছিল তার আগেই তাঁরা দ্রুত বাড়ি ফিরে যাচ্ছিলেন। ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা করা প্রয়োজন আর তাছাড়াও ব্যবসায়িক সহকর্মীদের সঙ্গে অদ্ভুত সময়ে কাজ করতে হবে যাতে তাঁরা তাঁদের বিষমকামী মধ্যবিত্ত অণু পরিবারের দাবী মিটিয়ে যেতে পারেন।
এই প্রেক্ষিতে যখন "মহিলা শিল্পোদ্যোগ" উঠে আসে তখন তা যে সমাজব্যবস্থা মহিলাদের সময় এবং কর্মশক্তি দাবী করে তাকে বদলানর চেষ্টা করে না। তার প্রচেষ্টা বরং তাঁদের এমন একটি পুরুষকেন্দ্রিক কাঠামোতে খাপ খাইয়ে নেওয়া যা নিরন্তর সময়, শিল্পোদ্যোগের নানা পরিসরে গমনাগমনের সুযোগ এবং একটি ব্যবসার প্রসারের জন্য সুদীর্ঘ সময় দেওয়ার অঙ্গীকার করার দাবী করে। একটি গোল ছিদ্রে একটি চৌকো পেরেককে বসার চেষ্টা করার মতই, মহিলাদের শিল্পোদ্যোগকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না কারণ মহিলাদের শিল্পোদ্যোক্তা হিসাবে স্বীকৃতিই দেওয়া হয় না। আর্থিক সাহায্যদাতাদের কাছে তাঁদের মূল পরিচয় গৃহিণী হিসাবে যাঁদের প্রাথমিক আনুগত্য গার্হস্থ্য পরিসরেই।
ব্যক্তিগত ক্ষমতায়নের উপর মনোযোগ
"মহিলা শিল্পোদ্যোগ"-এর সর্বজনীন প্রশ্নকে একটি চ্যালেঞ্জ হিসাবে নেওয়ার দ্বিতীয় পন্থাটি হল বিশেষ প্রশিক্ষণ ও পরামর্শদান। যেমন, এই প্রসিদ্ধ আইআইএমটি শুধুমাত্র মহিলা শিল্পোদ্যোগীদের জন্য প্রশিক্ষণ প্রকল্প পরিচালনা করে থাকে। গোল্ডম্যান স্যাকসে একটি আন্তর্জাতিক প্রকল্প আছে। এই অনলাইন কোর্সটি মহিলাদের হাতে "ব্যবসার প্রসারের জন্য নানা চাহিদাকে সফলভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য যে সব প্রয়োগিক অস্ত্র এবং জ্ঞান প্রয়োজন" সেগুলি তুলে দেয়। এখানে শিল্পোদ্যোগীরা নিজেদের দক্ষতা তৈরি করতে এবং বারংবার তার উন্নতি করার একটি খুবই নমনীয় সুযোগ পাচ্ছেন যা নব্য উদারপন্থী অর্থনীতির একটি প্রধান অঙ্গ। এই জাতীয় অর্থনীতি অনুযায়ী, ক্রমাগত পরিবর্তনশীল বাজারের জন্য আমাদের সর্বদা প্রস্তুত থাকতে হবে। অংশগ্রহণকারীরা তাঁদের বিষয় বেছে নেওয়ার পর এমন আরো কিছু বিকল্প বেছে নিতে পারেন যা তাঁরা তাঁদের নির্দিষ্ট অবস্থান ও পরিকল্পনার ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে পারবেন। যেমন ধরা যাক, "ব্যবসার প্রসার" বা "গ্রো ইওর বিজনেস" মডিউলে যারা অংশ নেবেন (বিনামূল্য) তাঁরা একটি ভালো সুযোগকে চিহ্নিত করা, প্রসারের সুযোগ বেছে নেওয়া এবং কারা তাঁর সবচেয়ে কাছাকাছি আছেন তা মানচিত্রে সূচিত করার মত জিনিসগুলি শিখতে পারেন। প্রতিটি মডিউলে নতুন বিষয় এবং সেগুলিকে ক্রমশ বেড়ে চলা নতুন চিন্তাভাবনার উপর প্রয়োগ করার উপায় শেখার সুযোগ আছে ব্যবহারকারীর।
যদি স্টার্টআপ ধনতন্ত্রের প্রতিযোগিতামূলক পুরুষকেন্দ্রিক জগত মহিলাদের শিল্পোদ্যোগী হিসাবে স্বীকৃতি না দেয়, তাহলে কেবলমাত্র মহিলা সদস্যদের গোষ্ঠীগুলির বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রকল্পগুলি ব্যক্তিগত ক্ষমতায়ন ও দক্ষতার উপর জোর দেয়। যে বৃহত্তর পরিকাঠামোর ভিতরে মহিলারা শিল্পোদ্যোক্তা হিসাবে স্বীকৃতি বা আর্থিক সহায়তা পাওয়ার চেষ্টা করেন তাকে এই মহিলাকেন্দ্রিক গোষ্ঠীগুলিও অবহেলা করে। নানা প্রকল্প পরিচালিত হয় মহিলাদের মধ্যে পারস্পরিক সংযোগ বাড়াতে এবং অন্যান্য উচ্চাভিলাষী মহিলাদের শিল্পোদ্যোগের বিষয়টি শেখানর উপায় তৈরি করার জন্য। ব্যাঙ্গালোরের গবেষণার সময় আমি মহিলাদের একটি অসংগঠিত নেটওয়ার্কিং গোষ্ঠীর সঙ্গে দেখা করি। এই দলটি নিজেদের জন্য অনুরূপ প্রশিক্ষণ সভার আয়োজন করে। একটি প্রাতরাশকালীন অধিবেশনে একজন মহিলা একটি দলকে স্প্রেডশীট তৈরি করা শেখান। আরেকটি অধিবেশনে, স্থানীয় মহিলা পরিচালিত ব্যবসাগুলি বিক্রি বাড়াতে, নির্দিষ্ট অঞ্চলে একটি একদিনের পপ-আপের আয়োজন করে। পার্টি বা ডিস্কো নাইটের মত সামাজিক মেলামেশার সময়গুলি নেটওয়ার্কিং-এর সুযোগও দেয়। সর্বত্র যেন অবসর আর কাজ একে অপরের পরিসরে ছড়িয়ে গিয়ে কাজকে পণ্য করে তুলছে যা একজন মহিলা শিল্পোদ্যোগীকে জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রেই একজন শিল্পোদ্যোক্তা করে গড়ে তুলছে।
ধরেই নেওয়া হয় যে, যে মহিলারা এই সংগঠিত ও অসংগঠিত প্রকল্পে অংশগ্রহণ করছেন তাঁদের কাছে শিল্পোদ্যোগের এই বৃহত্তর পৃথিবী যা এই কাজের জন্য সম্পূর্ণ নিবেদিত সময়, কর্মশক্তি ও উপরে ওঠার ক্ষমতা দাবি করে তাতে প্রবেশের রাস্তা আছে। ব্যক্তি নিজেই ক্ষমতাশালী এবং তাঁরা পরস্পরের ক্ষমতায়নে সাহায্য করেন। টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মিশেল মার্ফি, নব্য উদারপন্থার অর্থনীতির অন্তর্গত শিল্পোদ্যোগবাদেকে মানব সম্পদের আবাদ হিসাবে বর্ণনা করেনঃ বিশ্বাস করা হয় যে, আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই সুপ্ত সম্ভাবনা আছে যাকে আরও উন্নত করে অর্থনৈতিক গুণমানের উৎপাদন সম্ভব।
যতক্ষণ না পর্যন্ত মহিলাদের গৃহকর্মকে (সামাজিক অনুকরণের কাজ) শ্রম হিসাবে স্বীকৃতি না দেওয়া হচ্ছে এবং তার জন্য তাঁরা কোন রকম আর্থিক প্রতিদান না পাচ্ছেন ততক্ষণ পর্যন্ত মহিলাদের একটি সুপ্ত শ্রমবাহিনী হিসাবেই দেখা হবে। এই বাহিনীর উন্নতি হলে তবেই তাঁরা অর্থনীতির ক্ষেত্রে মূল্যবান হয়ে উঠবেন। মহিলাদের শিল্পোদ্যোগী করে তোলার এই প্রচেষ্টাকে কি তাঁদের শ্রমের যে রূপগুলি ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত তার মূল্য নির্ধারণ করার দিকে নিয়ে যাওয়া যায়? সেবা, সম্পর্ক ও সামাজিক অনুকৃতির মত শ্রম যে ঠিক কতটা গভীরভাবে লিঙ্গনির্ভর তা কোভিড-19 অতিমারীই স্পষ্ট করেছে। আমার গবেষণার মধ্যে দিয়ে আমি জেনেছি যে, এমন অনেক উপায় আছে যার মাধ্যমে লিঙ্গভিত্তিক শ্রম কিছু শিল্পোদ্যোগীর পৃথিবী বদলে দিতে পারে এমন উদ্ভাবনের স্বপ্নকে তুলে ধরে ও সম্ভব করে এবং বাকিরা তাঁদের স্বপ্নকে দাঁড় করাতে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে বাধ্য হন। এই অসম্ভব অর্থনীতি চড়া মূল্যায়নে অভ্যস্ত ও মানসিকভাবে সম্পূর্ণ শ্রান্তি এনে দেয়। এখানে প্রতিযোগিতার প্রশিক্ষণ না দিয়ে বা শুধু মহিলা সদস্যের দলে তাঁদের ঠেলে না দিয়ে বরং আমাদের উচিত বিভিন্ন ধরনের কাজের গুণগত মানের মাপকাঠিকে এবং নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করার তত্ত্বটিকে কিভাবে বাজারী বিনিময়ের বাইরে কাজে লাগান যায় তার পুনর্মূল্যায়ন করা।