২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসের শুরুতে, নারিকুরাভার (যে নামটি বদলে নারিকোরাভান করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে) ও কুরুভিক্কান সম্প্রদায় দুটিকে তপসিলি উপজাতি বা শিডিউল্ড ট্রাইব (এসটি) মর্যাদা দেওয়ার পক্ষে লোকসভা ও রাজ্যসভা ভোট দিয়েছে। ২০২৩-এর ২ জানুয়ারীতে রাষ্ট্রপতির সম্মতি লাভ করা এই প্রস্তাবনাটিকে নারিকুরাভার গোষ্ঠীর জয় হিসেবে দেখা হচ্ছে। তাঁদের কথায়, “এই প্রথম আমাদের কোন অনুরোধকে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দেওয়া হয়েছে এবং সংসদের দুটি আইনসভাতেই তা গৃহীত হয়েছে। যে রাজনীতিবিদরা এই বিষয়ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাঁদের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। এ বিষয়ে সাধারণ জনগণ ও রাজনীতিবিদ, সকলেই একমত যে, এই পদক্ষেপটি সমগ্র [নারিকুরাভার] গোষ্ঠীর কল্যাণের জন্য প্রয়োজন ছিল।”
নারিকুরাভাররা প্রধানত তামিলনাড়ুতে বসবাসকারী একটি আধা-যাযাবর গোষ্ঠী। পুঁতি বানানোর দক্ষতার কারণে তাঁদের “পুঁতি মানুষ” বলা হয়ে থাকে এবং মন্দিরের সামনে বা উৎসব পার্বণের সময় তাঁরা এই পুঁতিগুলি বিক্রি করেন। জঙ্গল বিষয়ে গভীর জ্ঞান, অস্ত্রের দক্ষ ব্যবহার এবং বহু দূর পর্যন্ত পর্যটনের ক্ষমতার কারণে নারিকুরাভার গোষ্ঠী নিজেদের শিকারী বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন। তাঁদের অতীত নিয়ে তাঁরা গর্বিত ও তাঁদের পূর্বপুরুষরা কি ভাবে ভারতের উত্তর দিক থেকে দক্ষিণ অঞ্চলে চলে আসেন সে বিষয়ে তাঁরা গল্প বলেন। দক্ষিণ ভারতে এসে, বহু পরিবর্তন সত্ত্বেও, তাঁরা তাঁদের যাযাবর জীবনযাত্রাকে ধরে রাখতে পেরেছিলেন।
সমস্যা শুরু হয় যখন অতীত তাঁদের বর্তমানের দৈনন্দিনতার সঙ্গে মিলে যায়। নারিকুরাভারদের অনেক সময়ই সমাজের প্রান্তে ঠেলে দেওয়া হয় এবং স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সংগঠিত কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে তাঁদের সুযোগ সীমাবদ্ধ। গোষ্ঠীর সামগ্রিক লড়াই অনেক সময়ই ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত বিদ্বেষের মুখোমুখি হয়, যা তাঁদের আরও প্রান্তিকীকরণের দিকে নিয়ে যায়।
গত ষাট বছর ধরে, নারিকুরুভার গোষ্ঠী, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে, এমন একটি পন্থার কল্পনা করে এসেছেন যা তাঁদের দারিদ্র দূর করবে এবং প্রাথমিক নাগরিক অধিকারগুলি লাভের সুযোগ করে দেবে। তাঁদের এই ভয়াবহ অবস্থাকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রথম পদক্ষেপ যে আইনী মর্যাদা পাওয়া তা তাঁরা চিহ্নিত করেছেন; নাগরিক অধিকার এবং আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় থাকার সুযোগ পাওয়ার পথটিকে বর্তমানের সংরক্ষণ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করে।
এখনও পর্যন্ত নারিকুরাভার গোষ্ঠীকে অতি অনগ্রসর শ্রেণী বা মোস্ট ব্যাকওয়ার্ড ক্লাস (এমবিসি) বলে চিহ্নিত করা হলেও, এই মর্যাদা তাঁদের শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সীমিত সুযোগই দিয়েছে। “ওরা আমাদের এই নাম দিয়েছিল,” রাজাশেখরন, তেত্রিশ বছর বয়সী, অত্যন্ত উচ্চশিক্ষিত একজন নারিকুরাভার নেতা যিনি নিজের সম্প্রদায়ের জীবনের মান উন্নত করার জন্য অক্লান্তভাবে কাজ করে চলেছেন, তিনি বলেন। তিনি নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই জানেন শিক্ষা ঠিক কতটা সুযোগ তৈরি করে এবং তিনি নিশ্চিত যে, নারিকুরাভার গোষ্ঠীর নবীন প্রজন্ম যখন আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ পাবে, একমাত্র তখনই তারা তাদের সম্প্রদায়ের ভবিষ্যতে বদল আনতে সক্ষম হবে।
এই মুহূর্তে বিভিন্ন সুযোগ, অধিকার ও সংরক্ষিত আসনের জন্য, তুলনায় অনেক বেশী ক্ষমতাবান ও সুবিধাসম্পন্ন গোষ্ঠী তাঁদের প্রতিযোগী – যা রাজাশেখরনের মতে একটি অসম প্রতিযোগিতা। তামিলনাড়ুর অন্যান্য অতি অনগ্রসর সম্প্রদায় অনেক বেশী সংগঠিত ও শিক্ষিত এবং তাঁদের হাতে অনেক বেশী আর্থসামাজিক সম্পদ আছে। এই কারণে, এই গোষ্ঠীগুলির কাছে প্রাথমিক অধিকার সহজলভ্য। তাই, রাজাশেখরন ও তাঁর গোষ্ঠী যে আয়াসসাধ্য লড়াইটি অবিরাম করে চলেন, সেই লড়াই সত্ত্বেও তিনি নারিকুরাভার সম্প্রদায়ের আইনী মর্যাদাঅতি অনগ্রসর শ্রেণী থেকে তফসিলি উপজাতিতে পরিবর্তন করার দাবিটির একজন ব্যগ্র সমর্থক।
নারিকুরাভার সম্প্রদায়কে, অন্যান্য সাধারণ আদিবাসী গোষ্ঠীর মত, পরিপাটিভাবে তপসিলি উপজাতি শ্রেণীকরণের মধ্যে ফেলা না। নারিকুরাভাররা, তপসিলি উপজাতির মর্যাদাসম্পন্ন অন্যান্য গোষ্ঠীগুলির মত, পুরুষানুক্রমিক জন্মভূমির দাবি করেন না। তাঁরা যাযাবর হিসেবেই নিজেদের পরিচয় দিয়ে থাকেন এবং যে সম্প্রদায়গুলিকে ঐতিহাসিকভাবে জন্মসূত্রে অপরাধী গোষ্ঠী ভলে চিহ্নিত করা হয়, সেগুলি থেকে নিজেদের আলাদা করার চেষ্টা করেন। তাঁরা অনেক সময়ই কোনও রকম রাজনৈতিক সমর্থন পান না, কারণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা, যতটা সম্ভব বেশী ভোট পাওয়ার স্পৃহার কারণে, এই ক্ষুদ্র সম্প্রদায়কে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন না। এছাড়াও, অন্যান্য তপসিলি উপজাতি, যাঁরা ইতিমধ্যেই অতিব্যবহৃত, সীমিত সম্পদ এবং সংরক্ষিত আসনের অধিকার আরও একটি গোষ্ঠীর সঙ্গে ভাগ করে নিতে চান না, এই সম্প্রদায়কে তাঁদের প্রতিযোগী হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু যখনই এই বিষয়ে আলোচনা করা হয়, তখন নারিকুরাভার সম্প্রদায় উত্তর দেন, “আমাদের এগুলি পাওয়ার দরকার আছে। আমাদের গোষ্ঠী অসম্ভব কষ্টভোগ করে চলেছে।”
তপসিলি উপজাতি পাওয়ার আগে, নারিকুরাভার গোষ্ঠীর কাজকে বহু রাজনৈতিক পথে হাঁটতে হয়েছে। “গত ষাট বছর ধরে এটাই আমাদের স্বপ্ন ছিল,” রাজাশেখরন বলেন। কিন্তু স্বপ্ন থেকে বাস্তবে আইনি স্বীকৃতি পাওয়ার রাজনৈতিক পথটি এবং সেখানে পৌঁছনোর জন্য অনেকগুলি ধাপ পেরিয়ে যেতে হয় (সেগুলি সব সময় যে খুব আনন্দদায়ক বা সহজ তা নয়)। নারিকুরাভার গোষ্ঠীর কর্মীরা সরাসরি মাঠে নেমে, নিজেদের গোষ্ঠীর মধ্যে যে কাজগুলি করছিলেন, তিন দশক আগে সেগুলি একটা স্পষ্ট রাজনৈতিক চেহারা পেতে শুরু করে, যখন এই গোষ্ঠীর নেতারা তামিলনাড়ুর আঞ্চলিক সরকারের কাছে তাঁদের দাবি জানিয়ে আবেদন রাখেন। তখনই তাঁরা আবিষ্কার করেন যে, অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বই তাঁদের উদ্দেশ্যের প্রতি সহানুভূতিশীল। কিন্তু তামিলনাড়ুর রাজনীতি, অন্যান্য জায়গার রাজনীতির মতই, অস্থির। যখন এই রাজ্যের শাসকদলে বদল আসে, নারিকুরাভার গোষ্ঠী তাঁদের সমর্থন হারান। কিন্তু তাঁরা নিজেদের সংকল্প থেকে বিচলিত হন নি। যে রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, তাঁরা তাঁদের কাছেই আপীল করেন ও নিজেদের আবেদন জানান। তাঁরা অসংখ্য চিঠি লেখেন, যার অনেকগুলিরই কোন উত্তর তাঁরা পান নি।
যখন তাঁরা তাঁদের আবেদনের উত্তরে কোন প্রতিক্রিয়া পান না, এবং দরজাগুলি তাঁদের মুখের উপর বন্ধই থেকে যায়, তাঁরা বিকল্প পন্থার সন্ধান করতে থাকেন। আঞ্চলিক সরকারের এই নিষ্ক্রিয়তার পর তাঁরা জাতীয় স্তরে তাঁদের দৃষ্টি ঘোরান। ২০১৬ সাল থেকে নারিকুরাভাররা সংগঠিতভাবে দিল্লীতে যাতায়াত করতে শুরু করেন। দিল্লীতে কঠোর আবহাওয়া এবং থাকার জায়গা ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসের অভাব থাকা সত্ত্বেও, তাঁরা যন্তর মন্তরে বসে দীর্ঘ অনশন ধর্মঘট চালিয়ে যান। মিডিয়া এই ধর্মঘটের প্রতি কোনও মনোযোগ না দিলেও, তাঁরা তাঁদের অবস্থানে অনড় থাকেন
যে বিলটি নারিকুরাভার গোষ্ঠীকে (কুরুভিক্কারন সম্প্রদায়সহ) তপসিলি উপজাতির মর্যাদা দেওয়ার প্রস্তাব করে, সেটি অনেকবারই লোকসভায় পৌঁছেছে। ২০১৬ সালে, যখন এটিকে নিয়ে লোকসভায় আলোচনার সময় আসে, ঠিক সেই দিনই, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অপ্রত্যাশিতভাবে নোটবন্দীর কথা ঘোষণা করেন। সারা দেশ যখন এই বিষয়টি নিয়ে উত্তাল, ভারতীয় সংসদের কোনও সদস্যই নারিকুরাভারদের তপসিলি উপজাতি মর্যাদা পাওয়ার বিলটিকে নিয়ে আলোচনা এগোতে চাইছিলেন না।
এই ধাক্কাটি সত্ত্বেও, নারিকুরাভাররা দিল্লী থেকে ফিরে যান এবং তপসিলি উপজাতি মর্যাদা পাওয়া কেন গুরুত্বপূর্ণ, সে বিষয়ে তাঁরা তাঁদের গোষ্ঠীর অন্যান্য সদস্যদের শিক্ষিত করেন। এইবার, তাঁদের রাজনৈতিক প্রচেষ্টা আন্তর্জাতিক মনোযোগ পেতে শুরু করে। গণমাধ্যমের সাহায্যে নারিকুরাভাররা আন্তর্জাতিক সহায়তা প্রার্থনা করেন এবং নিয়মিতভাবে আন্তর্জাতিক পণ্ডিত মহল ও সংগঠনের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিতে শুরু করেন। এইভাবে, তাঁরা নিজেদের জন্য একটি ভিন্ন নাম গড়ে তোলেন – এমন একটি নাম যা তাঁদের নিজেদের প্রচেষ্টায় নির্মিত, কোনও বহিরাগতের আরোপ করা নয়।
এই সমষ্টিগত প্রয়াসের ফলেই, আজ নারিকুরাভার সম্প্রদায় তাঁদের এই নব অর্জিত তপসিলি উপজাতি মর্যাদা উদযাপন করছেন (যা থেকে তাঁদের প্রত্যাশা অনেক উঁচু)। “এই তপসিলি মর্যাদার মাধ্যমে, এত বছরের লড়াইয়ের পর, আমাদের শিক্ষা, কর্মসংস্থানের সুযোগ, জীবনযাত্রা এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয়ের ক্ষেত্রে অনেক উন্নয়ন ঘটবে।” ট্রাইবাল সোসাইটির সম্পাদক তিপ্পান্ন বছর বয়সী অনুরাধা বলেন।
নারিকুরাবার সম্প্রদায়ের এই জয় একটি স্মরণীয় ঘটনা এবং সামাজিক ন্যায় অর্জনের অভিমুখে এগিয়ে চলার পথে তাঁদের দিক থেকে একটি সুবিশাল পদক্ষেপ। এই জয় প্রমাণ করে যে, বিভিন্ন রাজনৈতিক স্তরে নিরলস ও জটিল কৌশল অবলম্বন করে কাজ করে গেলে এক সময় সাফল্য আসবেই। কিন্তু এই জয়ের ঘটনাটি একটি প্রথম পদক্ষেপ মাত্র। অনেক সময়ই ভারতের সংরক্ষণ ব্যবস্থাকে সমস্ত রাজনৈতিক দলই সমালোচনা করেন ও এই ব্যবস্থাকে হয় একেবারে তুলে দেওয়ার বা আরও বিস্তৃত করার কথা বলেন। এ কথা স্পষ্ট যে, সাত দশকের বেশী আগে প্রতিষ্ঠিত এই ব্যবস্থাকে সংশোধন ও পরিবর্তনের প্রয়োজন, যাতে তা বর্তমান ভারতের পরিস্থিতিকে প্রতিফলিত করে। তা হলে যে সমস্যাগুলি উঠে আসে, সেগুলির মুখোমুখি হওয়া যাবে এবং সমস্ত সুবিধাবঞ্চিত সম্প্রদায়ের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক তৎপরতা অর্জনের পন্থার সাফল্য স্বীকৃতি পাবে।