ভারতীয় সামরিকবাহিনীর পরিবর্তনঃ আগামীদিনের সমস্যা

25/04/2022
IiT English Page

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদের শুরুতে, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পুনর্গঠনের জন্য একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী পদক্ষেপ নেন। যে প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধান বা চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ (সিডিএস) পদের প্রথম ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক ছিলেন প্রয়াত জেনারেল বিপিন রাওয়াত, সেই পদটি সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে সরকার বর্তমানে ভারতের সামরিক বাহিনীতে যে বদলগুলি আনছেন তা, তর্কসাপেক্ষে, স্বাধীনতা-পরবর্তী কালের সর্ববৃহৎ পরিবর্তন। এই উদ্যোগের কেন্দ্রে আছে সেনাবাহিনীগুলির সমন্বয়করণ সংক্রান্ত বিতর্ক। এই সমন্বয়সাধন হল এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে ফৌজ, বায়ুসেনা এবং নৌসেনা আলাদাভাবে নিজেদের কর্তব্য পালন করার বদলে যৌথভাবে দেশের প্রতিরক্ষার কাজে অংশ নেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মত অধিকাংশ বড় সামরিক বাহিনীর ক্ষেত্রে এই জাতীয় একীভবন ঘটেছে। এত জটিল একটি প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যম্ভাবী কিছু সমস্যা তৈরি হয়। তবে, জটিলতম সমস্যাটি হল একক পরিষেবা থেকে যুগ্ম পরিষেবার অভিমুখে যাওয়ার ক্ষেত্রে তৈরি হওয়া প্রতিকূলতা।  

মোদীর সিডিএস তৈরি করার এই সিদ্ধান্ত একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনার পাশাপাশি এই বিষয়কে কেন্দ্র করে ভারতের সামরিক বাহিনীর ভিতরেই বিতর্ক শুরু হয়েছে। আরেকটি আনুষঙ্গিক বিতর্কের বিষয় হল সিডিএসের সুনির্দিষ্ট ভূমিকা। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসের একটি মন্তব্যে সরকার স্পষ্টতই ইঙ্গিত করেন যে “যাতে নিরপেক্ষভাবে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে পরামর্শ দিতে পারে সেজন্য” সিডিএস কোনরকম সামরিক নিয়ন্ত্রণ অনুশীলন করবে না। এর অর্থ, সিডিএস নেতৃত্ব শৃঙ্খলের অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে না। যেকোন সামরিকবাহিনীর ক্ষমতার বিন্যাসের ক্ষেত্রে, ব্যাটেলিয়ন বা ফৌজে তার সমতুল্য অঙ্গ, বায়ু সেনাতে স্কোয়াড্রন এবং নৌসেনার ক্ষেত্রে জাহাজ থেকে শুরু হয়ে এই শৃঙ্খল সংগঠনের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছয়। ভারতের ক্ষেত্রে তা এই তিন বিভাগের সর্বোচ্চ প্রধানদের পর্যায়ে গিয়ে শেষ হয়। কিন্তু, যেমন পরিকল্পনা ও ঘোষণা করা হয়েছে, সমন্বিত সদর দপ্তর (যেখানে তিনটি বাহিনীর প্রতিনিধিরাই থাকবেন) তৈরি হলে কোন একজন প্রধান সেগুলি পরিচালনার দায়িত্বে থাকবেন না। এবং যে সিডিএস এই তিনটি বাহিনীর প্রতিনিধি হিসেবে থাকবেন তিনি তাঁদের উপর কোন সামরিক নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগ করবেন না। এই সাংগঠনিক বন্দোবস্তে, সামরিক অধিনায়করা কিভাবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন? 

সেনাবাহিনীর সমন্বিত পরিকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে ভারতীয় সামরিকবাহিনী তুলনামূলকভাবে দেরীতেই প্রবেশ করেছে। তিনটি বিভাগ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব মাত্র একজন – এক্ষেত্রে সিডিএসের হাতে – তুলে দেওয়া নিয়ে সংশয় ছিল। বারংবার সুপারিশ করা সত্ত্বেও গত কয়েক দশক ধরে যে এই পদে কাউকে নিয়োগ করা হচ্ছে না তার মুখ্য কারণ এই সংশয়। বর্তমান সরকার অবশেষে একজন সিডিএস নিয়োগ করে সফলভাবে এই আপত্তি খণ্ডন করেছেন। তবে, একজন সিডিএসের কার্যকারিতাকে পরিষ্কারভাবে বোঝানর জন্য সরকারের কাছে দুটি বিকল্প থাকলেও এখনও তা বেশ অস্পষ্ট।   

প্রথম বিকল্পটি অনুযায়ী, নেতৃত্ব শৃঙ্খলের অংশ না হয়ে, সিডিএস শুধুমাত্র পরামর্শদাতার ভূমিকা নেবেন।  এক্ষেত্রে, যে যুগ্ম উচ্চতম পরিকাঠামোটি তৈরি হবে (প্রস্তাবিত যুগ্ম থিয়েটার কম্যান্ড) তা প্রতিরক্ষামন্ত্রীর কাছে জবাবদিহি করবে। অনেকটা এইভাবেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সামরিক বাহিনী পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত। এই ক্ষেত্রে, জয়েন্ট চিফস অফ স্টাফ কমিটি (সিডিএসের পরিপূরক পদাধিকারিক) শুধুমাত্র আন্তঃসংযোগের ব্যবস্থাপনা ও পরামর্শদানের দায়িত্বে থাকেন।    

দ্বিতীয় বিকল্পটি হল, সিডিএস এবং বিভাগীয় প্রধানদের এই নেতৃত্ব শৃঙ্খলের আওতায় আনা যাতে সিডিএসের পরিচালনায় তাঁরা যৌথ আদেশদাতা হিসেবে কাজ করতে পারেন। ভারতের প্রেক্ষিতে চিফ অফ স্টাফ কমিটি (সিওএসসি) নামের এই গোষ্ঠী তখন বেসামরিক নেতৃত্ব ও অধস্তন সামরিক অধিনায়কদের মধ্যস্ততাকারীতে পরিণত হয়। সিডিএসের কাছে যে তাঁর নির্দিষ্ট দায়িত্ব সম্বন্ধে স্পষ্ট নির্দেশাবলী আছে এবং তার বাস্তবায়ন তাঁরই দায়িত্ব তা এইভাবে নিশ্চিত করা যাবে। তবে, এই পদক্ষেপটি ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে সরকার যা নির্দেশিকা জারি করেন তার সম্পূর্ণ বিপরীতে যায়।  

দুটি কারণে, অন্তত আশু ভবিষ্যতের জন্য, সিডিএসে নেতৃত্বে ক্ষমতাপ্রাপ্ত একটি সিওএসসি ভারতের জন্য অনেক বেশি উপযুক্ত। প্রথমত, সামরিকবাহিনীর সমন্বয়ের যে প্রক্রিয়া এই মুহূর্তে চলছে তার ফলে যে পরিস্থিতি তৈরি হবে তা স্বাভাবিক অবস্থায় পৌঁছনোর আগে তুমুল মতভেদের সম্ভাবনা আছে। এই জন্য অতীতে যা ছিল তার থেকে অনেক বেশী পরিমণে পেশাদারী তত্ত্বাবধানের প্রয়োজন। যখন এই নবনির্মিত সমন্বিত পরিকাঠামো পরিণত অবস্থায় পৌঁছবে তখন সিডিএস ও সিওএসসির হাতে ব্যবস্থাপনা ও পরামর্শদাতার দায়িত্ব দেওয়া যায় কিনা ভেবে দেখা যাবে। দ্বিতীয়ত, এই রকম ধাপে ধাপে এগোলে এই দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত ব্যবস্থা থেকে নতুন অবস্থায় পরিবর্তনের ঘটনাটি অনেক মসৃণভাবে হবে, বিশেষ করে এই সময় যখন পাকিস্তান আর চীনের সঙ্গে অমীমাংসিত সীমান্ত নিয়ে ভারত গুরুতর সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে।    

যদি একজন সিডিএসের পরিচালনায় সিওএসসি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব নেয়, তাহলে এত বছর ধরে সামরিক কর্তব্যগুলির মধ্যে যে স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখা হয়েছে ও সাগ্রহে রক্ষা করা হয়েছে, তাকে সমন্বিত করা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সৈন্যদের মধ্যে একেবারে বুনিয়াদি স্তর থেকে শুরু করে সক্রিয় কাজের অন্যান্য এলাকা পর্যন্ত নানা স্তরে এই বিষয়টি প্রযোজ্য। এই পৃথকীকরণ শুরু হয় সৈন্য, নৌসেনা এবং বায়ুসেনার নিয়োগের সময় প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতার স্তর থেকেই। ফৌজে সৈনিকদের এখনও দশম শ্রেণীর শেষ পরীক্ষা পাশ করার পর নিয়োগ করা হয় আর নৌসেনা ও বায়ুসেনার প্রার্থীদের যোগ্যতা অঙ্ক ও ফিজিক্স নিয়ে দ্বাদশ শ্রেণী পাশ। কাজের সময়ও এই ধরণের আরও পার্থক্য দেখা যায়। যেমন, জাহাজে নির্দেশ ও বিভিন্ন কাজ ব্যাখ্যার জন্য ব্যবহৃত পরিভাষার জন্য ইংরাজি ব্যবহার করা হয়। অন্যদিকে, ফৌজে অসংখ্য অন্যান্য ভাষাভাষী থাকলেও সৈন্যদের সঙ্গে সাধারণত হিন্দিতেই কথা বলা হয়।  

উপরন্তু, বহু বছর ধরেই প্রতিটি বিভাগই নিজেদের পরিস্থিতি অনুযায়ী মানব সম্পদের নিজস্ব গণ্ডী নির্মাণ করেছে। বায়ুসেনার যুদ্ধবিমানচালকরা চুয়ান্ন বছর বয়সে অবসর নেন, নৌসেনার আধিকারিকরা ছাপ্পানতে এবং ফৌজের আধিকারিকরা চুয়ান্ন বছরে অবসর গ্রহণ করেন ও তার চার বছর পর আবার তাঁরা কাজে যোগ দিতেপারেন। নৌবাহিনীর যে আধিকারিক ক্যাপ্টেনের (ফৌজে কর্নেলের পদের সমতুল্য) পদে উন্নীত হয়েছেন তিনি সরাসরি কমোডরের (ফৌজে ব্রিগেডিয়ারের পদের সমতুল্য) মর্যাদায় উন্নীত হতে পারেন। বায়ুসেনা বা ফৌজে আবার এই পদ্ধতিটি অনুসরণ করা হয় না। তিনটি বিভাগের বাৎসরিক গোপনীয় বিবৃতির জন্য আলাদা আলাদা রীতি গ্রহণ করা হয়েছে। একটি বিভাগে যে কাজকে অসাধারণ বলে ধরা হয়, হতে পারে অন্য বিভাগেই তাকে কম মূল্য দেওয়া হয় এবং তার ফলে তা বাতিল হওয়ার কারণ হয়ে উঠতে পারে।

দীর্ঘ প্রচেষ্টার মধ্যে দিয়ে এই বিষয়গুলির পাশাপাশি আরও অনেক সমস্যারই সমাধান সম্ভব। কিন্তু যা এই বিভাগগুলিকে পরস্পরের থেকে আলাদা করে তা হল এগুলির নিজস্ব কর্মসংস্কৃতি। যদিও, এই নির্দিষ্ট বিভাজনটি বোঝা সহজ এবং এমনকি কিছু বিশেষ দায়িত্বের ক্ষেত্রে কাম্যইও। কিন্তু, সক্রিয় সামরিক কার্যকলাপের সময়, যখন সাংস্কৃতিক প্রভেদ সামনের সারিতে চলে আসে, তখন এই দিকটি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একজন সৈন্য, যিনি প্রতি-সন্ত্রাসবাদের ধূসর অঞ্চলে কাজ করেছেন তাঁর চিন্তাভাবনা ও কাজকর্ম, যিনি শান্তির সময় নিয়মের বই-এর ভালো-মন্দের ও সাদা-কালোর স্পষ্ট বিভাজন মেনে চলেছেন তাঁর থেকে অবশ্যই আলাদা হবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই জাতীয় জিনিস উচ্চতর পদাধিকারিকদেরও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে, যার ফলে সামরিক কার্যকলাপ এবং, বিস্তৃতভাবে, শান্তির সময়ের নিয়মিত কার্যক্রমের প্রতি এই তিন সামরিক বিভাগের আধিকারিকদের আচরণেও তফাৎ দেখা দিতে শুরু করে। এর অর্থ এই নয় যে কোন পরিকাঠামোগত সমন্বয় এবং তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণভাবে, হৃদয় ও মস্তিষ্কের মিলন এক ধরণের অপচয়। বরং, এই প্রতিকূল অবস্থাগুলি ইঙ্গিত করে যে, সামরিক পরিকাঠামোর সংশোধন ও পুনর্গঠনের উপর জোর দেওয়ার সময় সিদ্ধান্তকারীদের, ও বিশেষ করে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলিকে এই বিষয়গুলি নিয়ে বিবেচনা করতে হবে। 

সিডিএস তৈরির হাত ধরে ভারত তার সামরিকবাহিনী ও প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠানের একটি বহু-বিলম্বিত সমন্বয় প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এই উদ্যোগের সাফল্য অনেকটাই নির্ভর করছে সিডিএস সংক্রান্ত নির্দেশাবলীকে আরও স্পষ্ট করা এবং নিজেরদের বিভাগ-নির্ভর দৃষ্টিভঙ্গী সরিয়ে রেখে সামরিক বাহিনীর হাতে কাজের দায়িত্বগুলি পালনের একটি একক পন্থা নির্ধারণের ক্ষমতা থাকার উপর। ভারতের রাজনীতিবিদদের ভাবা উচিত যে, সিডিএস এবং অন্যান্য সংস্কারসাধন আসলে সামরিকবাহিনীতে পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত পদক্ষেপ নয়, বরং প্রথম ধাপ মাত্র। এই বোধই সম্ভবত এই প্রক্রিয়ার মূল শিক্ষণীয় বিষয়।      

কর্নেল বিবেক চাডা

Author

কর্নেল বিবেক চাডা (অবসরপ্রাপ্ত) মনোহর পারিকর ইনস্টিট্যুট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালিসিসের একজন রিসার্চ ফেলো এবং সিডিএস অ্যান্ড বিয়ন্ডঃ ইন্টিগ্রেশান অফ দি ইন্ডিয়ান আর্মড ফোর্সেস (নলেজ ওয়ার্ল্ড পাবলিশার্স, নতুন দিল্লী, ২০২১) বইটির লেখক।

(Bangla Translation by Sritama Halder)
অনুবাদঃ শ্রীতমা হালদার