ভারতের “আঞ্চলিকতার গহ্বর” ঠিক কতখানি বিস্তৃত?

23/11/2020
IiT English Page

গ্রামীণ ভারতের একদম প্রাথমিক স্তরের ছাত্র যার এখানকার জটিল সামাজিক প্রতিষ্ঠান নিয়ে শুধুমাত্র খানিকটা ভাসা ভাসা জ্ঞান আছে সে পর্যন্ত যে প্রচলিত বিষয়টি নিয়ে অনেক কথা বলতে পারবে সেটি হল, জাতি ও ধর্মের উপর ভিত্তি করে বসতি অঞ্চলের প্রায় নিখুঁত বিভাজন। প্রাথমিক পরিচয়দানকারী বইগুলি কৃষিনির্ভর ভারতের সামাজিক জীবনের অত্যাবশ্যক উপাদান হিসেবে স্থানভিত্তিক বিভাজনকে অবিস্মরণীয় করে তুলেছে। ভারতের গ্রামকে আঞ্চলিকতার গহ্বর বা সঙ্কীর্ণ মানসিকতার ঘাঁটি হিসাবে আম্বেদকরের যে সুবিদিত বর্ণনা তা আসলে ভারতের গ্রামের এই স্থানভিত্তিক বিভাজনের রেওয়াজকেই আংশিকভাবে বিদ্রূপ করে।

নকশা ১: আম্মিনাভাবি, ধারওয়াড জেলা, সি. ১৯৫০. (স্প্যাট আর লিয়ারমন্থের মূল নকশা থেকে লেখকদের দ্বারা ডিজিটাইজ্‌ড ও পরিমার্জিত), ১৯৫৪, পৃ. ২০০)

গ্রামীণ ভারতে বসতি অঞ্চল শুধুমাত্র বিভাজিতই থাকে না, তার পাশাপাশি জাতি পরিচয়ের উপর নির্ভর করে সামাজিক শ্রেণীর মর্যাদাভিত্তিক ক্রমবিন্যাস বা হায়ার্কিকাল অর্ডারকেও এই বিভাজনের মধ্যে দিয়ে কিভাবে প্রতিবিম্বিত করে সেই ঘটনাকে সুদীর্ঘ সময় ধরে পরিচালিত নানা বিশদ নৃতাত্ত্বিক গবেষণার মধ্যে দিয়ে নথিভুক্ত করা হয়েছে। নকশা ১-এ দেখা যাচ্ছে কর্নাটকের ধারওয়াড জেলার উপকন্ঠে অবস্থিত আম্মিনাভাবির বসতি অঞ্চলের নানা বিভাজন। স্প্যাট আর লিয়ারমন্থ (১৯৫৪) গ্রামীণ ভারতে প্রচলিত বাসস্থানের বিভাজনের আদর্শ উদাহরণ হিসাবে এই নকশাটিকে জনসাধারণের মধ্যে জনপ্রিয় করে তোলেন। এই বিস্তৃত গ্রামে দলিত (আগেকার ‘অস্পৃশ্য’ জাতিগোষ্ঠী যাঁদের মূল নকশায় ‘হরিজন’ হিসাবে দেখানো হয়েছে) শ্রেণীকে গ্রামের প্রান্তে ঠেলে দেওয়া হয়েছে বলে দেখা যায়। নকশায় আরো দেখা যাচ্ছে যে তলোয়ার, পশুপালক, রজকের মত অন্যান্য শ্রমজীবী জাতিকেও গ্রামের প্রান্তে নির্বাসিত করা হয়েছে। গ্রামপ্রধান এবং তাঁর জ্ঞাতি ও আত্মীয়স্বজন গ্রামের সবচেয়ে ভালো অংশে একটি প্রাসাদের মত “খামার বাড়িতে” বাস করেন।

সারা ভারত জুড়ে থাকা আম্মিনাভাবিবাসীদের বিশদে বর্ণনা করে মানচিত্র তৈরি করার চর্চা ক্রমশ বেড়ে চললেও গ্রামীণ ভারতের বিভাজনের মাত্রা ঠিক কতটা তার কোন সুসম্বদ্ধ পরিমাপ এখনো পর্যন্ত হয় নি। তার ফলাফল হিসাবে, গ্রামীণ রাজনৈতিক অর্থনীতির পরিমাণ-সংক্রান্ত চর্চা একটি গুরুত্বপূর্ণ “অনুপস্থিত পরিবর্তনশীল উপাদান” দ্বারা সীমাবদ্ধ। আন্তঃগ্রামীণ বিভাজনের বিস্তার কতটা তা এখনো অজানা থাকলেও ভারতের জাতীয় আদমশুমারির দ্বারা নথিভুক্ত তথ্য থেকে জানা যায় যে দেশ জুড়ে বাছাই করা জেলাগুলিতে দেখা গেছে যে সেখানকার বাসিন্দারা ছোট ছোট পাড়ায় ভাগ হয়ে বাস করেন। 

ভারতের আন্তঃগ্রামীণ বাসস্থানের বিভাজনের মাত্রাকে পরিমাপ করার জন্য এই প্রথম একটি বেশ বড় আকারের প্রকল্প চলছে এবং আমাদের এই সারাংশটি সেই প্রকল্পেরই খুঁজে বের করা প্রাথমিক তথ্যগুলি থেকে তৈরি। আন্তঃগ্রামীণ বসতি অঞ্চলের এই বিভাজনকে পরিমাপের জন্য আমরা ২০১৫ সালে কর্ণাটক রাজ্যসরকার পরিচালিত শুমারি থেকে পাওয়া মাইক্রোডেটা ব্যবহার করেছি। কর্নাটক সরকার ১৯৩১ সাল থেকেই জরিপের মাধ্যমে বিশদে জাতি ও ধর্ম সংক্রান্ত তথ্যগুলিকে হিসাব ও সংকলন করেছেন এবং তাঁরাই প্রথম এমন একটি মাইক্রোডেটার ভান্ডারকে উপস্থাপনা করেছেন যার সাহায্যে আন্তঃগ্রামীণ বসতি অঞ্চলের বিভাজনের বৈশিষ্ট পরিমাপ করা সম্ভব। কর্ণাটকের ২৬,০০০টি গ্রামের সমস্ত অধিবাসীর (আন্দাজ ৩.৬৫ কোটি) জন্ম, মৃত্যু, রোগ তথা রোগ থেকে মৃত্যুর হিসাব বা ডেমোগ্রাফিক তথ্য এই ভাণ্ডারে আছে। 

আমরা এই আন্তঃগ্রামীণ বাসস্থানের বিভাজনকে পরিমাপ করার জন্য একটি গ্রামে যেভাবে গৃহস্থবাড়িগুলির বাস্তবিক স্থানভিত্তিক বন্টনের সঙ্গে এমন একটি কাল্পনিক উদাহরণের সঙ্গে তুলনা করেছি যেখানে বাড়িগুলি গ্রাম জুড়ে কোনো নিয়ম ছাড়াই এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে আছে। আমরা কিভাবে আন্তঃগ্রামীণ বসতিস্থলের বিভাজনকে পরিমাপ করছি তা নকশা ২-তে দেখানো হয়েছে। কর্ণাটক সরকারের তথ্যভান্ডারে নথিভুক্ত একটি বাস্তবিক গ্রাম্যপল্লীকে এই নকশাটির প্যানেল এ অংশে দেখানো হয়েছে। এই গ্রামের চল্লিশটি পরিবার চারটি ভিন্ন জাতিভুক্ত। প্যানেল বি-তে সেগুলিই আবার এলোমেলোভাবে সাজানো হয়েছে বলে দেখানো হয়েছে। আন্তঃগ্রামীণ বাসস্থানের বিভাজনকে নির্ণয় করতে আমরা শুধু বাস্তবের গ্রামটিতে “রান” বা “নিরবিচ্ছিন্ন ক্রমে” সাজানো বাড়ি যেগুলি একই সামাজিক পরিচয় বহন করে সেগুলির সঙ্গে বাড়িগুলির ওই কাল্পনিক এলোমেলো বন্টনের সঙ্গে তুলনা করলাম।

গ্রামের অসংখ্য জাতি আর ধর্মের হিসাব করার জন্য আমরা “নিরবিচ্ছিন্ন ক্রম নিরীক্ষা” বা “রান টেস্ট” পদ্ধতিকে দুই-এর অধিক ক্ষেত্রে প্রয়োগ করলাম। এর আগে এই সুপ্রতিষ্ঠিত পদ্ধতিটিকে রাস্তাঘাটে ছোট ছোট স্তরে যে বিভাজন বা মাইক্রো-সেগ্রিগেশানের অনুশীলন করা হয় সেগুলির পরিমাপের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। বাস্তবের গ্রামটিতে নয়টি “নিরবিচ্ছিন্ন ক্রম” আছে এবং ওই চল্লিশটি বাড়িকে এলোমেলোভাবে সাজালে একুশটি প্রত্যাশিত নিরবিচ্ছিন্ন ক্রম পাওয়া যায়। কাল্পনিক এলোমেলো বন্টনের তুলনায় বাস্তব গ্রামের নিরবিচ্ছন্ন ক্রমের সংখ্যা যত কম হবে বিভাজনের মাত্রা তত বেশি হবে। 

নকশা ২: ওয়াল্ড-উল্‌ফোউইটজ্‌ মাইক্রো সেগ্রিগেশান। প্যানেল সি-তে আম্মিনাভাবির চিত্রে আন্তঃবিবাহকারী জাতি ও ধর্ম গোষ্ঠীর আটটি প্রশাসনিক মানচিত্র পরিকল্পনা ব্যবহার করা হয়েছে। প্যানেল এ ও বি-তে হাল্লি জেলার আন্তঃবিবাহকারী জাতি ও ধর্ম গোষ্ঠীর ব্যবহার করা হয়েছে। তিনটি প্যানেলের প্রতিটি চতুষ্কোণ একেকটি বাড়ির প্রতিরূপ। আম্মিনাভাবি গ্রিডের ২,৫০০টি বাড়িকে সারিবদ্ধভাবে দেখানো হয়েছে। লেখকদের নিজস্ব হিসাব (কর্ণাটক সরকারের থেকে প্রাপ্ত তথ্য) ।  

নকশা ২-এর প্যানেল সি-তে কর্ণাটক সরকারের নথিকৃত ২০১৫ সালের আম্মিনাভাবিতে বাড়ির স্থানভিত্তিক বন্টন দেখানো হয়েছে (আমরা জাতিপরিচয়ভিত্তিক ৮টি প্রশাসনিক মানচিত্র পরিকল্পনা দেখিয়েছি) । আম্মিনাভাবি, এই মুহুর্তে, নগর হিসাবে চিহ্নিত হওয়ার মুখে। তা সত্ত্বেও, গ্রামীণ ভারতের স্থানভিত্তিক বিভাজনের আদর্শ উদাহরণ হিসাবে পরিচিত হওয়ার সত্তর বছর পরেও, আম্মিনাভাবির স্থানভিত্তিক ডেমোগ্রাফির কোন পরিবর্তন হয় নি। 

আমাদের আন্তঃগ্রামীণ বিভাজন সূচকের মান ০-১ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে যেখানে ০-এর অর্থ সম্পূর্ণ একাত্মীকরণ এবং ১-এর অর্থ চূড়ান্ত বিভাজন। কর্ণাটকের সমস্ত গ্রামের জাতি, আদমশুমারি নির্ধারিত গোষ্ঠীর পাশাপাশি ধর্ম পরিচয়ভিত্তিক আন্তঃগ্রামীণ (ক্ষুদ্র বা মাইক্রো) বিভাজন পদ্ধতির বিন্যাস দেখানো হয়েছে নকশা ৩-এ। তফসিলি জাতি ও উপজাতি এবং অন্যান্য (আদমশুমারি নির্ধারিত) গোষ্ঠীর মধ্যে উচ্চ মাত্রার বিভাজন থেকে বোঝা যায় যে বিশেষত ‘স্পৃশ্য’ ও ‘অস্পৃশ্য’ জাতির মধ্যে টানা গণ্ডীটি কতখানি প্রবল। এই বিষয়টি বুঝতে নকশা ৩-এর আম্মিনাভাবির উদাহরণের উল্লেখ করা যেতে পারে। এই নকশায় দেখা যাচ্ছে যে, আম্মিনাভাবি গ্রামের আন্তঃগ্রামীণ বিভাজনের মান প্রায় .৫৫। কর্ণাটকের আন্তঃগ্রামীণ বিভাজনের মাত্রা আমেরিকার দক্ষিণে কালো-সাদা বিভাজনের চেয়ে অনেক বেশি। এই সাদা-কালোর বিভাজন আজ পর্যন্ত আমেরিকার এই অঞ্চলের আবাসনের বন্টন পরিকল্পনাকে প্রভাবিত করে চলেছে।  

গ্রামীণ কর্ণাটকে জাতি, আদমশুমারি নির্ধারিত এবং ধর্মীয় গোষ্ঠীর ক্ষুদ্র স্তরের বা মাইক্রো (আন্তঃগ্রামীণ) বিভাজন। ০-এর অর্থ সম্পূর্ণ একাত্মীকরণ এবং ১-এর অর্থ চূড়ান্ত বিভাজন। ভারথি ইত্যাদি থেকে পাওয়া নকশার অনুলিপি (২০২০) । 

আমাদের বিশ্লেষণ থেকে এও দেখা যাচ্ছে যে, আন্তঃগ্রামীণ বিভাজনের যে বিস্তার তার সঙ্গে জনতাত্ত্বিক বা ডেমোগ্রাফিক বিভিন্নতাকে পরিমাপের জন্য ব্যবহৃত অন্যান্য যে সূচকগুলির কোন সম্পর্কই নেই। তাই, এই ধরনের বিভাজন গ্রামীণ রাজনৈতিক অর্থনীতির প্রচলিত সংখ্যাবাচক বৈশিষ্টকে প্রভাবিত করতে পারে - এই সম্ভাবনাকে হিসাবের মধ্যে ধরা হচ্ছে না। সীমিতসংখ্যক প্রামাণ্য তথ্য থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, গ্রামীণ রাজনৈতিক অর্থনীতিকে চিহ্নিত করতে আন্তঃগ্রামীণ বিভাজন নিয়ে আলোচনা করতেই হবে। একটি গ্রামের স্থানীয় জলকল্যাণমূলক উপাদানগুলির অবস্থান বা, এমনকি, ভূগর্ভস্থ জলের উৎসের হাইড্রোজিওলজিকাল বন্টনও এই আন্তঃগ্রামীণ বিভাজনের দ্বারা প্রভাবিত হয়। 

গ্রামীণ ভারতের রাজনৈতিক অর্থনীতি ছাড়াও, আধুনিক সমাজ বিজ্ঞান বিষয়টির উদ্ভবের একটি প্রধান কারণ হল “সামাজিক দূরত্বের” পরিমাপ। উদাহরণ হিসাবে, জর্জ সিমেলের বক্তব্যের উল্লেখ করা যায়। তিনি বলেছেন, অপরিচিত ব্যক্তি –এই ধারণাটি, সর্বোপরি, এমন এক প্রচলিত সামাজিক দূরত্বের দ্বারা সৃষ্ট যা স্পষ্টতই স্থানভিত্তিক - “জ্যামিতি” সামাজিক দূরত্বের একটি অত্যাবশ্যক উপাদান। যে সমাজব্যবস্থায় স্পষ্ট মর্যাদাভিত্তিক সামাজিক বিন্যাস দেখা যায়, সেখানে যোগাযোগ ও সংস্কারের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক সিমেলের “জ্যামিতি” দ্বারাই নির্ধারিত হয়। আমাদের বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায় যে, যদি একটি গোষ্ঠীর ভিতরে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ওই গোষ্ঠীর পারস্পরিক যোগাযোগের সঙ্গে জড়িত থাকে তাহলে বসতি অঞ্চলের মধ্যে বিভাজন ওই যোগাযোগের প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

 

এই প্রবন্ধটি “এ পার্মানেন্ট কর্ডন স্যানিটেয়ারঃ ইন্ট্রা-ভিলেজ স্প্যাশিয়াল সেগ্রিগেশান অ্যান্ড সোশাল ডিস্ট্যান্সিং ইন ইন্ডিয়া” নামের আসন্ন কন্টেম্পোরারি সাউথ এশিয়া প্রবন্ধের উপর আধারিত। 

নবীন ভারথি

Author

নবীন ভারথি (naveenb@sas.upenn.edu) সিএএসই-এর পোস্ট ডক্টরাল রিসার্চ ফেলো।

(Bangla Translation by Sritama Halder)
অনুবাদঃ শ্রীতমা হালদার

দীপক মালঘান

Author

দীপক মালঘান (dmalghan@iimb.ac.in) ব্যাঙ্গালোরের সেন্টার ফর পাবলিক পলিসি, ইন্ডিয়ান ইন্সটিট্যুট ফর ম্যানেজমেন্টের অ্যাসোসিয়েট অধ্যাপক।

(Bangla Translation by Sritama Halder)
অনুবাদঃ শ্রীতমা হালদার

আন্দালিব রহমান

Author

আন্দালিব রহমান (ar687@cornell.edu) টাটা-কর্নেল ইন্সটিট্যুট (টিসিআই), কর্নেল ইউনিভার্সিটির পোস্ট ডক্টরাল অ্যাসোসিয়েট। 

(Bangla Translation by Sritama Halder)
অনুবাদঃ শ্রীতমা হালদার