ভারত সরকার লোকসভা নির্বাচন এবং সমস্ত রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন একই দিনে ফেলার প্রস্তাব রেখেছে। যদিও, নীতি আয়োগ এবং দ্য ল কমিশন অফ ইন্ডিয়ার মত যুক্তরাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলি এই “এক দেশ, এক নির্বাচন” নীতির সপক্ষে, তা সত্ত্বেও মিডিয়ায় এই নীতিকে ঘিরে বিলক্ষণ বিতর্ক ও আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে। এই প্রস্তাবের পিছনে মূল যুক্তি হল যে, রাজস্ববিভাগের জন্য নির্বাচন অত্যন্ত ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে, এবং একাধিক নির্বাচন হলে প্রশাসকরা তার ব্যবস্থাপনাতেই ব্যস্ত থাকেন বলে দেশশাসন প্রক্রিয়ায় নিরন্তর সমস্যা দেখা দিতে থাকে। অন্যদিকে, কয়েকজন বিশ্লেষক ইঙ্গিত করেছেন যে, সমস্ত নির্বাচন প্রক্রিয়া যুগপৎভাবে ঘটলে, জাতীয় স্তরের নির্বাচন, রাজ্যস্তরের নির্বাচনকে আচ্ছন্ন করে ফেলতে পারে। এর ফলে এই দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ার আশংকা আছে।
এই বিতর্কে আমাদের গবেষণা একটি আরো প্রাথমিক প্রশ্ন যোগ করেছে: সমাপতিত নির্বাচন কি ভোটদাতাদের আচরণকে প্রভাবিত করে? এই প্রশ্নের উত্তর যদি সদর্থক হয়, তাহলে তা কি নির্বাচনের ফলাফলকে লক্ষণীয়ভাবে বদলে দেয়? আমাদের যুক্তি যে, ভোটদাতারা যখন একাধিক নির্বাচনে এক সময়ে ভোট দেন তখন প্রতিটি স্তরে ঠিক কোন কোন প্রার্থীকে ভোট দেবেন যুগপৎ সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় যুক্তিবুদ্ধির দিক থেকে তাঁরা একটি কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হন। পরিণামে, ভোটদাতা কি ভাবে ভোট দিচ্ছেন তা প্রভাবিত হতে পারে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, একসঙ্গে একাধিক নির্বাচনের মুখোমুখি হলে, কোন ভোটার একজন প্রার্থীর নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্য (যেমন, তাঁরা কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত বা তাঁদের জাতি বা ধর্মীয় পরিচয় কি) মাথায় রেখে বা আরো সঙ্কীর্ণ নীতির পথ নিয়ে অনেক সহজে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে পারেন। সমস্ত ধরনের নির্বাচন প্রক্রিয়া একসঙ্গে ঘটলে, ভোটদাতাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়ার উপর এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবের প্রতিফলন নির্বাচনের ফলাফলেও দেখা যাবে।
যুগপৎভাবে সংঘটিত নির্বাচনে যুক্তি প্রয়োগ করে ভোট প্রদানকারীর উপস্থিতি ও তার তাৎপর্য আমরা পরীক্ষানিরীক্ষার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করতে চাই। ১৯৭৭-২০১৮ সালের মধ্যে সংঘটিত জাতীয় এবং রাজ্যস্তরের নির্বাচন বিশ্লেষণ করে এবং নির্বাচনী চক্রের স্বাভাবিক ক্রমপরিবর্তনকে কাজে লাগিয়ে এই নানা স্তরের নির্বাচনের সমাপতনের প্রভাবকে খতিয়ে দেখতে চাই। আমরা প্রতিটি রাজ্যে যুগপৎভাবে সংঘটিত এবং পৃথকভাবে, কিন্তু ১৮০ দিন তফাতে সংঘটিত জাতীয় এবং রাজ্য নির্বাচনে ভোটদানের আচরণের তুলনা করি। এই তুলনার ফলে আমরা প্রার্থী মনোনয়ন, রাজনৈতিক দলগুলির প্রচার কৌশল জাতীয় উপাদানগুলিকে বাতিল করতে পেরেছি। এই উপাদানগুলি ভোটদাতাদের আচরণে প্রভাব ফেলতে পারে কিন্তু ধরে নেওয়া যেতে পারে যে সেগুলি যুগপৎ বা আলাদা, দুই ধরনের নির্বাচনেই সেগুলি বদলায় না। তবে, এই ১৮০ দিনের ব্যবধান তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। এর চেয়ে বেশি বা কম সময়ের ফারাক হলেও ফলাফল একই থাকে।
ভোটদাতাদের আচরণ বিশ্লেষণ করার জন্য আমরা ১৯৯৬-২০১৮ সালের মধ্যে লোকনীতি, সিএসডিএস দ্বারা পরিচালিত জাতীয় ও রাজ্যস্তরের নির্বাচনের ভোট পরিবর্তী সমীক্ষাগুলিকে ব্যবহার করেছি। এছাড়াও ইলেকশন কমিশন অফ ইন্ডিয়ার থেকে বিশদ নির্বাচন ফলাফলও আমরা ব্যবহার করেছি। এই ফলাফলের সংকলন, সম্পাদনা এবং জনসমক্ষে উপস্থাপনার কাজটি করেছে অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ত্রিবেদী সেন্টার ফর পলিটিকাল ডেটা।
(ক) রাজনৈতিক দলের প্রাধান্য এবং নির্বাচনের ফলাফল
(খ) যুগপৎ বনাম ধারাবাহিকভাবে ঘটিত নির্বাচন
নকশা ১: যুগপৎ সংঘটিত নির্বাচন এবং রাজনৈতিক দলের প্রাধান্য
আমরা শুরু করছি এমন কিছু নজির উপস্থিত করে যা ইঙ্গিত দেয় যে, ভোটদাতারা ঠিক কি ভাবছেন তার প্রভাব নির্বাচনের ফলাফলের উপর পড়তে পারে। নকশা ১: চিত্র (ক)-এর এক্স অক্ষতে দেখানো হয়েছে একটি সংসদীয় নির্বাচনী এলাকায়, সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী উত্তরদাতাদের কত শতাংশ মনে করেন যে তাঁদের ভোটদানের সিদ্ধান্তের পিছনে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল প্রার্থীর রাজনৈতিক দলের পরিচিতি। এর বিপরীতে আমরা চিত্রিত করি গড় সম্ভাবনা যে একই দল দুটি (লোকসভা ও বিধানসভা) আসনেই জয়লাভ করে। এটা নকশা ১ থেকে পরিষ্কার যে এই দুটি ভেরিয়েবল অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত, যা থেকে বোঝা যায় যে রাজনৈতিক দলের প্রাধান্য ও নানা স্তর জুড়ে একই ধরনের নির্বাচনী ফলাফল, এই দুটি ঘটনার মধ্যেই পারষ্পরিক সম্পর্ক আছে।
নির্বাচন-পরবর্তী এই সমীক্ষা ব্যবহার করে আমরা প্রমাণ করেছি যে, সমস্ত স্তরের নির্বাচন একই সময়ে হলে ভোটদাতাদের যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতার উপর চাপ পড়ে। দুটি নির্বাচন ১৮০ দিনের ব্যবধানে হলে এই সমীক্ষার যতজন উত্তরদাতা নির্বাচনের মূল সমস্যাগুলি সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরে “জানি না” প্রতিক্রিয়া দিতে পারেন, নির্বাচন একই সময়ে হলে উত্তরদাতাদের একই প্রতিক্রিয়া জানানোর সম্ভাবনা দুই গুণ বেড়ে যায়। দুই ধরনের নির্বাচনের প্রচার একসঙ্গে হতে থাকলেও নির্বাচনে তুলে ধরা প্রধান সমস্যাগুলিকে নিয়ে আরো বেশি বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে। তবে, আমাদের আশা যে এই বিভ্রান্তি বেশি হবে মূলত নির্বাচন নিয়ে কম অভিজ্ঞতা আছে এমন ভোটদাতার মধ্যে। কিন্তু, আমরা খুঁজে পাই যে এই বিভ্রান্তি নানান শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং নানা বয়সের ক্ষেত্রে এক। এই পর্যবেক্ষণ আমরা আগে বুদ্ধিবৃত্তির ওপর চাপ পড়ার বিষয়ে যে প্রস্তাবনাটি রেখেছি, তাকেই প্রতিষ্ঠা করে। নকশা ১: চিত্র (খ)-তে দেখা যাচ্ছে, “রাজনৈতিক দলই প্রধান” এই ধারনায় বিশ্বাসী ভোটদাতাদের (অর্থাৎ, যে ভোটদাতাদের মতে রাজনৈতিক দলই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান) অংশটির এমপিরিকাল কিউমুলেটিভ ডিসট্রিবিউশন ফাংশান। এখানে সিঙ্ক=১-এর অর্থ যুগপৎ নির্বাচন এবং সিঙ্ক=০-এর অর্থ আলাদা সময়ে ঘটা নির্বাচন। একই সঙ্গে ঘটা নির্বাচনে এমপিরিকাল কিউমুলেটিভ ডিসট্রিবিউশন ফাংশান যে ডানদিকে সরে যায় তা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এর থেকে বোঝা যায় যে, যুগপৎ নির্বাচনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের প্রাধান্য যথেষ্ট বেড়ে যাচ্ছে। চিত্র (ক)-তে যে নমুনা দেখা যাচ্ছে তা থেকে আমরা ভাবতেই পারি যে, সমস্ত ধরনের নির্বাচন একই সঙ্গে হলে, জাতীয় এবং রাজ্যস্তরের নির্বাচনের ফলাফল একই প্রকৃতির হবে।
আমাদের এই ধারনাকে পরীক্ষা করার জন্য আমরা নির্বাচনের মোট ফলাফলের দিকে তাকাই এবং প্রশ্ন করি যে, সমস্ত স্তরের নির্বাচন একই সময়ে হলে একটি রাজনৈতিক দলই লোকসভা ও বিধানসভা আসনে জয়লাভ করেছে, এই সম্ভাবনায় কোনো বদল দেখা যাবে কিনা। নকশা ২-তে আমরা ভারতের মানচিত্র ব্যবহার করে এই প্রশ্নের উত্তরটিকে ছবির মাধ্যমে দেখিয়েছি। বাঁ দিকের চিত্রে (যুগপৎ নির্বাচন = ০) ভারতের সব নির্বাচনী ক্ষেত্রে আলাদা সময়ে ঘটা নির্বাচনের গড় মান দেখান হচ্ছে এবং ডান দিকের চিত্রে (যুগপৎ নির্বাচন = ১) একই মান দেখান হচ্ছে যুগপৎ নির্বাচনের ক্ষেত্রে। কিছু রাজ্যে ১৯৭৭-২০১৮ সময়কালের মধ্যে যুগপৎ নির্বাচনের ঘটে নি, তাই এই বিশ্লেষণ করার সময় তাদের বিবেচনা করা হচ্ছে না এবং নকশা ২-তে সাদা রঙ ব্যবহার করে তাদের বোঝান হয়েছে। এই দুটি মানচিত্র তুলনা করলে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, যুগপৎ নির্বাচন ঘটলে দুটি স্তরেই একই রাজনৈতিক দলের জেতার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। ডানদিকের চিত্রে (যুগপৎ নির্বাচন) লাল রঙ দিয়ে দেখানো নির্বাচনী ক্ষেত্রের সংখ্যা অনেক বেশী যা থেকে বোঝা যায় যে ওই রাজ্যগুলিতে এই সম্ভাবনা সর্বোচ্চ বন্ধনীতে [০.৬৬,১] অবস্থান করে। তার উপর এই বৃদ্ধির হার পুরো দেশেই সমান, অর্থাৎ দেশের কোন নির্দিষ্ট অঞ্চলে এর প্রভাব কেন্দ্রীভূত হচ্ছে না।
(ক) যুগপৎ নির্বাচন = ০
(খ) যুগপৎ নির্বাচন = ১
নকশা ২: সম্ভাবনা (একই রাজনৈতিক দল পিসি ও এসিতে জয়লাভ করে)
আমরা দেখি যে, আশ্চর্যজনকভাবে, জাতীয় দলগুলির বদলে, রাজ্যস্তরের ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলিই এই ফলাফলের পিছনে আছে। এছাড়াও, রাজ্যের শাসকদলের ক্ষেত্রেই এই বৃদ্ধি ঘটার সম্ভাবনা বেশি। এর থেকে বোঝা যায় যে, সমস্ত স্তরের নির্বাচন একই সঙ্গে হলে, রাজ্যস্তরের রাজনৈতিক বিষয়গুলির বেশি গুরুত্ব পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। যুগপৎ নির্বাচনে ভোটদাতাদের উপস্থিতি এবং বিন্যাসে কোনো তাৎপর্যপূর্ণ বদল ঘটে, এই সম্ভাবনার কথা আমরা গভীরভাবে পরীক্ষা করে দেখার পর বাতিল করেছি। আমরা দেখেছি যে, দুই স্তরের নির্বাচন এক সময়ে হলে, রাজ্য নির্বাচনে ভোটদাতাদের উপস্থিতির হার না বাড়লেও, জাতীয় স্তরে তা পাঁচ শতাংশ হারে বাড়ে। তবে, বয়স, লিঙ্গ, জাতি এবং শিক্ষার মত ভোটদাতাদের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে উপস্থিতির ক্ষেত্রে কোনো রকম ভিন্নতা চোখে পড়ে নি। এর থেকে বোঝা যায় যে যুগপত নির্বাচন হলে ভোটদাতাদের বিন্যাসে কোনো বদল আসে না। এছাড়াও, এমনও নয় যে নির্বাচনের ফলাফলের পরিবর্তনগুলি কেবলমাত্র সেই সব নির্বাচনী কেন্দ্রে দেখা যাচ্ছে যেখানে ভোটদাতাদের উপস্থিতির হার বেশি। এ থেকে আবারো বোঝা যাচ্ছে যে ভোটদাতাদের উপস্থিতির হারের উপর আমাদের সিদ্ধান্ত নির্ভরশীল নয়। এই সিদ্ধান্তে আসার জন্য আমরা আরো অনেকগুলি বিশেষ কারণকেও বিবেচনা করেছি। তবে, সেগুলিকে সমর্থন করতে পারে এমন কিছু আমরা আমাদের সংগৃহীত তথ্যে পাই নি।
যদি ভারত সরকার এই প্রস্তাবিত “এক দেশ, এক নির্বাচন” নীতি গ্রহণ করেন তাহলে আমাদের গবেষণার ফলাফল গভীরভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। এই পরিবর্তন কেবলমাত্র প্রশাসনিক স্তরেই ঘটবে যার ফলে নির্বাচন পরিচালনার খরচ কমে যাবে এমন কখনই নয়। আজ পর্যন্ত, ভোটদাতারা ঠিক কোন সময়য়ে তাঁদের প্রতিনিধি বেছে নেবেন সেই সময়কে স্বতন্ত্র রাখার ফলেই এই দেশে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে। কিন্তু, যুগপৎভাবে ঘটা নির্বাচনের সময় প্রতিনিধি বাছাই করার সময়, একসাথে দুটি সিদ্ধান্তে আসার সময় তাঁরা সাধারণত প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলির দিকেই নজর রাখেন এবং সেগুলি দুই ক্ষেত্রেই অভিন্ন হয়। এর ফলে, ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতির ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। এর পাশাপাশি, বিকেন্দ্রীকরণও কম ফলপ্রসূ হয়ে যায়।