তরল সম্পদঃ দুর্মূল্য ও অবমূল্যায়িত

29/08/2022
IiT English Page

বহু যুগ ধরেই বৃষ্টি, নদী, উপকূল এবং সমুদ্র আমাদের সমাজকে রূপ দিয়েছে। শাস্ত্রীয় পুরাকাল থেকে শুরু করে আব্রাহামীয় ধর্ম ও প্রাচীন মেসোপটেমিয়া থেকে পাওয়া কাহিনীগুলি, জল কিভাবে ইতিহাসের গতি বদলে দিয়েছে সে কথা বলে। ভারতে, “বর্ষার কঠোর পরীক্ষা”, জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে যে আর্দ্রতাবাহী বায়ু, যা দেশের আশি শতাংশ বৃষ্টিপাতের কারণ, তার বার্ষিক ক্রীড়া আবহমানকাল ধরে শৈশব থেকে শুরু করে সংস্কৃতি ও বাণিজ্যের মত সবকিছুকেই প্রভাবিত করেছে। বৃষ্টিপাতের পরিবর্তনশীলতা নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে সবচেয়ে প্রথম লিখিত বর্ণনাগুলির মধ্যে কয়েকটি খৃস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে লিখিত কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র নামক প্রাচীন গ্রন্থে পাওয়া যায়। কিভাবে বর্ষাকালের বৃষ্টিপাতের ধরন আন্দাজ করা যায় এবং সেই অনুযায়ী জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনা যায় তা নিয়ে সেখানে আলোচনা করা হয়েছে। বৃষ্টিপাতের পরিবর্তনশীলতা কোন নতুন ঘটনা না হলেও, জলবায়ু পরিবর্তন বা সারা বিশ্বে অথবা আঞ্চলিকভাবে জলবায়ুর চরিত্রে সুবিশাল পরিবর্তন আসার ফলে বৃষ্টিপাতের ক্ষেত্রে যে বদল এসেছে তার তীব্রতার বিষয়টি নতুন।  

অনেক সময়ই বলা হয় যে, জলবায়ু পরিবর্তন যেন একটি হিংস্র হাঙর, জল যার দাঁত। জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারটিকে সবচেয়ে গভীরভাবে বোঝা যায় জলের মধ্যে দিয়ে। জলের তাপমাত্রা বেড়ে গেলে তার ফলাফল খরা, বন্যা ও বৃষ্টিপাতের বর্ধমান পরিবর্তনশীলতা। প্রতিবার বৈশ্বিক উষ্ণায়নের মাত্রা বৃদ্ধির পরেই জলের সঙ্গে জড়িত বিপদের সম্ভাবনা আরও প্রবল হয়ে ওঠে। একটি উষ্ণতর জলবায়ু কি কি বিপদ ডেকে আনবে সে বিষয়ে উদ্বেগ যত বাড়বে, অত্যাধিক জল না অত্যল্প জল, এই গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাটি ততই নীতি বিষয়ক আলোচনার কেন্দ্রে থেকে যাবে। বর্ষার ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকে গেলেও এবং বিজ্ঞানের হাত ধরে জলবায়ুর নবতম নকশা নির্মিত হলেও, বৃষ্টির পরিবর্তনশীলতার ঘটনাটি ঘটছে এবং ভবিষ্যতেও যে ঘটবে সে বিষয়ে বিজ্ঞানীরা একমত।    

ভারত ইতিমধ্যেই দীর্ঘ শুখা মরশুম এবং তার মধ্যেই বিক্ষিপ্ত বৃষ্টিপাতের সংঘর্ষ, যে বদলটি অনেক সময়ই এক মাসের সময়সীমার মধ্যে ঘটছে, তার সাক্ষী হচ্ছে। এই বছরের জুন মাসে আসাম তীব্র খরার আঘাতে ধুঁকছিল, কিন্তু তার এক সপ্তাহের মধ্যেই সেখানে হঠাৎ প্রবল বৃষ্টিপাত শুরু হয়, যার ফলাফল এক বিধ্বংসী বন্যা। জলবায়ু পরিবর্তনের হাত ধরে এই জাতীয় সমাপতনের মিশ্র বিপদের বারংবার হআনা দেওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যেতে পারে বলে ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি)-এর সাম্প্রতিকতম বিবৃতিটি সতর্ক করেছে। 

জলের ক্রমবর্ধমান পরিবর্তনশীলতা – অত্যাধিক বা অত্যল্প – জনগোষ্ঠীর উপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে এবং ভারতের কৃষিখামার, ব্যবসা বাণিজ্য এবং পরিবারগুলি যে সমস্ত বিপদের মুখোমুখি হয়েছে তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎসগুলির মধ্যে একটি। প্লাবন বা উর্ধ্বগামী জলস্তরের মত গভীরভাবে প্রভাবশালী ঘটনাগুলি গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামো ধ্বংস করতে পারে, বাড়িঘরের ক্ষতি করতে পারে এবং জলের কাছাকাছি থাকেন যাঁরা সেই অসংখ্য মানুষের জীবিকা অর্জনের পথে বিপর্যয় আনতে পারে। নতুন কিছু তথ্য থেকে জানা যায় যে, উনচল্লিশ কোটি ভারতীয় বা প্রতি দশজনে একজন এমন জায়গায় বাস করেন যেখানে একশ বছরে একবার ঘটে এমন ভয়ংকর বন্যার সম্ভাবনা খুব বেশি। এই ধরনের বন্যার ফলে জলস্তর স্বাভাবিকের থেকে অন্তত আধ ফুট বেশি বেড়ে যেতে পারে, যার অর্থ এমন এক ভয়াবহ বন্যা যা গুরুতর ক্ষয়ক্ষতি কারণ হতে পারে। কিন্তু এর প্রভাব সবার উপর এক রকম নয়। ৬.৫ কোটি মানুষ যাঁদের বন্যাক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি তাঁরা তীব্র দারিদ্রের মধ্যে বসবাস করেন (অর্থাৎ, তাঁদের দৈনিক খরচের পরিমাণ ১.৯০ ডলারেরও কম) এবং টিঁকে থাকার, বন্যার আঘাত সামলে ওঠার বা অন্য কোথাও চলের যাওয়ার ক্ষমতা তাঁদের সীমিত। তাই, অত্যন্ত দরিদ্র যাঁরা, তাঁদের জীবন, জীবিকা ও কল্যাণের উপর বন্যার প্রভাব সবচেয়ে বেশি। বন্যার মত একটি সর্বনাশা ঘটনার পাশাপাশি, নির্দিষ্ট অঞ্চলভিত্তিক এবং বন্যার তুলনায় কম দ্রুত পদক্ষেপে ছড়াতে থাকা খরা আসলে এমন এক বিপর্যয় যা খুব ধীর গতিতে উদ্ঘাটিত হয়। অনাবৃষ্টির কারণে বাণিজ্য ও শহরের উৎপাদনশীলতা বাধা পায়, জঙ্গলের ধ্বংস আরও ত্বরান্বিত হয় এবং জনস্বাস্থ্য ও কৃষিকাজের প্রক্রিয়া বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়ে।     

বৃষ্টিপাতের এই রকম পরিবর্তনশীলতার স্থায়িত্ব ও মাত্রার অনিশ্চয়তার কারণে এই ঘটনার সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে নানা বিষয়ে বদল আনার প্রচেষ্টা অনেক সময়ই বিভিন্ন দীর্ঘস্থায়ী ঝোঁকে অভ্যস্থ হওয়ার থেকে অনেক বেশি কঠিন। তাই, জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে অধিকাংশ দেশের পরিকল্পনাতেই যে জলসম্পদকে অভিযোজনের তালিকায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে রাখা হয়েছে তা আশ্চর্যজনক নয়। সাম্প্রতিকতম আইপিসিসি বিবৃতি অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলার জন্য যে কৌশলগুলি নেওয়া হয়েছে তার অধিকাংশই তৈরি হয়েছে কৃষিশিল্পের কথা মাথায় রেখে, কারণ সারা বিশ্বে যত পরিমাণে জল খরচ হয় তার আশি থেকে নব্বই শতাংশ চাষের কাজেই ব্যবহৃত হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলায় যে কৌশলগুলি মোটামুটি সমস্ত দেশই গ্রহণ করেছে তার মধ্যে একটি হল সেচ ব্যবস্থা, ফসল ফলানর জন্য প্রয়োজনীয় জলসম্পদের কৌশলগত সংরক্ষণ ও ব্যবহার। বৃষ্টিপাতের ক্রমবর্ধমান পরিবর্তনশীলতা ও বাড়তে থাকা উষ্ণতা থেকে তৈরি হওয়া কষ্ট ও অনিশ্চয়তার হাত থেকে ফসল বাঁচানর ক্ষেত্রে এই প্রচেষ্টাগুলি প্রতিবন্ধক হিসেবে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ভারতে এর সব থেকে স্পষ্ট উদাহরণ হল, ভৌমজলকে সেচের কাজে ব্যবহার করা। এই জাতীয় সেচব্যবস্থা ভূতলের উপরিস্থিত জলের মাধ্যমে সেচব্যবস্থাকে ছাপিয়ে গেছে এবং গত পঞ্চাশ বছরে এর ব্যবহারে বৃদ্ধি ঘটেছে পাঁচশ শতাংশ। এই মুহুর্তে সেচের কাজে সব চেয়ে বেশি ভৌমজল ব্যবহার করে যে দেশগুলি, ভারত তার মধ্যে অন্যতম। কৃষিখামারগুলি তার ফলে অত্যন্ত উপকৃত হয়েছে। কিন্তু এর শেষ কোথায় এবং আর কত দিন ভৌমজলের ব্যবহার চালিয়ে যাওয়া যেতে পারে?   

অভিজ্ঞতাজাত ও পরিসংখ্যানকেন্দ্রিক বিশ্লেষণ সামগ্রিক প্রভাবের উপর কিছু আলোকপাত করতে পারে। গত চল্লিশ বছরের তথ্যের উপর ভিত্তি করে, সহগবেষক পরিচালিত আমার একটি গবেষণার সময় আমি আবহাওয়া ও জলসেচের প্রভাবকেন্দ্রিক একটি ইকোনমেট্রিক নকশা তৈরি করেছি। এই নকশার সাহায্যে অতীতে যা ধরনের জলসেচ প্রণালী ব্যবহারের ঝোঁক দেখা যেত, ফলনের উপর তার প্রভাবের বিষয়টির মূল্যায়ন করি। এই দেশে কৃষির কাজে ব্যবহারের জন্য জলসেচের দাবি যে বেড়ে চলেছে তার প্রধান কারণ হল গম যা একটি ওয়াটার-ইনটেনসিভ বা চাষের জন্য প্রচুর জল লাগে এমন একটি ফসল। সারা বিশ্বের প্রয়োজনীয় গমের তের শতাংশ ভারতই সরবরাহ করে এবং দেশবাসীর প্রয়োজনীয় সামগ্রিক ক্যালোরির অর্ধেকই আসে দানাশস্য থেকে। ফলাফল থেকে দেখা যায় যে, সেচব্যবস্থার উত্থানের সঙ্গে ভারতের একটি প্রধানতম ফসল হিসেবে গমের উত্থান অঙ্গাঙ্গীওভাবে জড়িত। সেচব্যবস্থা খরার প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং ফসলের তাপ সংবেদনশীলতাও লাঘব করেছে। দেখা গেছে যে, গত চার দশকে যদি জলসেচের ব্যবহার না হত, তবে জাতীয় ফলন তের শতাংশ কম হত। তবে, এই সুবিধা ভবিষ্যতেও পাওয়া যাবে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। গত কয়েক বছরে সেচপ্রক্রিয়ার বিস্তারের কম হচ্ছে এবং ক্রমবর্ধমান উষ্ণতা ও খরার নেতিবাচক প্রভাব বেড়েই চলেছে। এর থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, যে কৌশল অতীতে কাজে লেগেছে তা ভবিষ্যতে কার্যকর নাও হতে পারে। এই বিপরীতমুখী পরিবর্তনের একটি কারণ হল, অতীতে এই সাফল্য এসেছিল ভৌমজলের সঞ্চয়কে পীড়ন করে। ভৌমজলের সাহায্যে সেচের হারে বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে প্রচুর পরিমাণে জল নিষ্কাশিত হয়েছে, যার ফলে এই ভূগর্ভস্থ জলের স্তর অনেক নেমে গেছে। যখন ভৌমজলের স্তর অনেক নীচে নেমে যায়, তখন পাম্পের সাহায্যে জল তোলার খরচ এবং জলের কুয়ো গভীর করার ব্যয়সাধ্য প্রক্রিয়ার কারণে ভৌমজলের নিষ্কাশন প্রক্রিয়ায় বাধা আসতে পারে। ভূগর্ভস্ত জলের উপর নির্ভরশীলতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই জলের সঞ্চয় কমে আসছে। এর ফলে, ভবিষ্যতে এই জল ব্যবহারকারীদের উপর খরা ও তাপের প্রভাব আজকের তুলনায় তীব্রতর হবে। ভৌমজলস্তরে ক্ষয় ধরার কারণে গোটা দেশের ফলনের পরিমাণ কুড়ি শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে এবং এই শতকের মাঝামাঝি, যখন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আরও তীব্রভাবে অনুভাব করা যাবে, তখন ভৌমজল  ব্যবহারের উপায় না থাকলে বার্ষিক ফসল উৎপাদনের হার আঠাশ শতাংশ পর্যন্ত ও শুষ্ক মরসুমের ফসল উৎপাদনের হার একান্ন শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। এর ফলে, খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষকদের জীবনধারণ এবং কল্যাণের উপায় সবই বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে। ভৌমজলের সঞ্চয় কমে যেতে থাকলে শুখা মরসুমে, যখন জলের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি, তখন নদীর জলও শুকিয়ে যেতে শুরু করে, কারণ, ভৌমজলাধার বা অ্যাকুইফার থেকে প্রবাহিত জল বা বেসফ্লো-ই নিত্যবহ নদীগুলিতে জলসরবরাহ করে। আপাতবিরোধী শোনালেও এ কথা সত্যি, যে সম্পদগুলি অতীতে জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কার তীব্রতা কমিয়েছে, ভবিষ্যতে সেগুলিই আবার সেই পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবকে আরও বড় ও জোরালো করে তুলতে পারে।   

এর কারণটি উনবিংশ শতাব্দীর ফরাসী অর্থনীতিবিদ জাঁ ব্যাপ্তিস্তের কাছে পরিচিতই ছিল। তিনি “জোগানই চাহিদাকে তৈরি করে” – এই প্রস্তাবনাকে জনপ্রিয় করেছিলেন। এক্ষেত্রে এর অর্থ হল, জল যদি সস্তায় মেলে, তবে তা অবাধে ব্যবহৃত হবে। কিছু অনুর্বর অঞ্চলে বিনামূল্যে বা সস্তায় পাওয়া সেচের জল একটি প্রাচুর্যের বিভ্রম নির্মাণ করে। এই কারণে ওই সমস্ত অঞ্চলে ধান, গম, আখ আর তুলোর মত ফসল, যেগুলির ফলনের জন্য প্রচুর জল লাগে এবং তার ফলে, এই ধরনের জায়গার জন্য একেবারেই অনুপযুক্ত শস্যের চাষ শুরু হয়। তাই, যখন তাপমাত্রার বৃদ্ধি হয় এবং বৃষ্টিপাতে পরিবর্তন আসে তখন জলের এই অস্বাভাবিক চাহিদা মেটান সম্ভব হয় না ও সেই কারণে শস্যের উৎপাদনশীলতা সামঞ্জস্যহীনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ঘটনার ফলশ্রুতি হল, যে সম্পদের ভারসাম্য ইতিমধ্যেই একটি অত্যন্ত সূক্ষ্ম রেখার উপর দাঁড়িয়ে আছে সেটি আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এবং খরা ও উষ্ণতার থেকে সুরক্ষা কমে যায়। 

জলসম্পদে বিনিয়োগের ঘটনাটিও অসাম্যকে অনিচ্ছাকৃতভাবে বাড়িয়ে তোলে। ২০১৫ সাল থেকেই মহারাষ্ট্রের খরাপ্রবণ অঞ্চলে প্লাস্টিকের পরত দেওয়া কৃষিকাজের জন্য ব্যবহৃত পুকুরের সংখ্যা  খুবই দ্রুত বেড়েছে। যদিও, বৃষ্টির জল সংগ্রহ বা রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং-এ উৎসাহ দিয়ে স্মলহোল্ডার কৃষিকাজকে খরা থেকে সুরক্ষিত করাই এর উদ্দেশ্য ছিল, প্রাথমিক গবেষণা থেকে জানা যায় যে, উচ্চমূল্যের ও খুব বেশি জল লাগে এমন শস্যের উৎপাদন আরও জোরদার ও বিস্তৃত করার উদ্দেশ্যে ভৌমজল নিষ্কাশন করে ওই পুকুরগুলি ভর্তি করার জন্য কৃষকদের প্রণোদিত করা হচ্ছে। এর ফলে, আরও বেশি করে ভূগর্ভস্থ জল নিষ্কাশিত হচ্ছে এবং কৃষকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাচ্ছে। তার উপর, উচ্চ তাপমাত্রার কারণে অনেক পুকুরের জলই বাষ্প হয়ে উড়ে যায়। কৃষি, জলপান ও গৃহস্থালীর নানা কাজে ব্যবহৃত জল ছাড়াও, প্রায় ৮১,২৪৭ কিউবিক মিটার (মোটামুটি ৩২.৫-টি অলিম্পিকে প্রতিযোগিতার সাঁতারের পুকুরে যতটা জল ধরে) এক মাসে বাষ্পীভূত হয়ে যেতে পারে। চাষের কাজের জন্য ধনী কৃষকদের যেহেতু নিজস্ব পুকুর থাকে, তাই ভূগর্ভস্থ জল ব্যবহারের সুযোগ কমা এবং জলের সামগ্রিক ঘাটতি বাড়ার ফলে এই অনিচ্ছাকৃত প্রভাবগুলি দরিদ্র কৃষকদেরই সরাসরি আঘাত করে।      

ভর্তুকির একটি জটিল জালের কারণে তৈরি হওয়া উদ্দীপনার কারণে এই প্রতিক্রিয়াগুলিকে আরও তীব্র হয়ে পড়ে। বীজ, সার, চাষের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, শ্রম ইত্যাদির জন্য ভর্তুকি বা ইনপুট সাবসিডি আর কৃষিজাত দ্রব্যাদির জন্য প্রয়োজনীয় ভর্তুকি বা আউটপুট সাবসিডি - ধার্য মূল্যে কৃষি সংক্রান্ত দ্রব্যাদির নিশ্চিত প্রাপ্তি যা দেশের পাবলিক ডিসট্রিবিউশান সিসটেমকে জোরদার করে – কৃষিক্ষেত্রে ফলন ও বিনিয়োগের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে। ভৌমজল নিষ্কাশন জন্য ব্যবহৃত প্রধানতম আউটপুট হল বিদ্যুতের জন্য ভর্তুকি, যার হার জোগানের গড় ব্যয়ের প্রায় পঁচাশি শতাংশ এবং ভূগর্ভস্থ জল তুলে আনার ক্ষেত্রে একটি মুখ্য ভূমিকা পালন করে। বিনামূল্যে অথবা বিদ্যুতের মাসুলের একটি বিশেষ হারের কারণে প্রচুর জলের প্রয়োজন এমন ফসলের মূল্য, এবং তার ফলে ওই ফসল চাষ হয় যে অঞ্চলগুলিতে সেগুলিরও দাম অনেক বেড়ে গেছে। ধান ও গম জাতীয় শস্যের জন্য সর্বনিম্ন সহায়তা মূল্যের মত আউটপুট ভর্তুকি পাওয়া যায় বলে, এমন কি যে সব অঞ্চল এই ধরনের ফসলের বাড়বৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত নয় সেখানেও এগুলি চাষের ঝোঁক বেড়ে যাতে দেখা যায়।         

অনেক বেশি বিচক্ষণ পন্থা হল, জলবায়ুগত সংঘাতের সামনে অসুরক্ষিত হয়ে পড়বে এমন শস্যচাষে ভর্তুকি দেওয়ার বদলে, স্থানীয় পরিবেশের উপযুক্ত ফসল ফলানতে উৎসাহিত করা। তার ছাড়াও, বিভিন্ন গোষ্ঠীকে আঘাত থেকে বাঁচানর জন্য অনুপূরক সমাধানে বিনিয়োগ করা, - যেমন, নানা নদী ও জলাশয়ের জলবিভাজিকা এবং অরণ্য রক্ষা এবং পরিবেশের প্রতি সংবেদনশীল পদ্ধতির সাহায্যে ভূমি ব্যবস্থাপনার চর্চা করা প্রভৃতি। এগুলির মধ্যে যে কোন একটি সমাধানে বিনিয়োগ না করে, সমস্ত সমাধান একসঙ্গে প্রয়োগ করলে জলের প্রবাহ বৃদ্ধি পেতে পারে এবং শস্যের উৎপাদনশীলতা আর রোজগারের ক্ষেত্রে অনেক বেশি উপকার হতে পারে।  

তবে পরিবর্তন অনেক সময়ই কঠিন হয়ে দেখা দেয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভাল উদ্দেশ্যে করা বিনিয়োগ যা স্বল্পকালীন সমাধান দেয়, তা পরবর্তিকালে ব্যয়বহুল লক-ইন এফেক্ট এবং পাথ ডিপেন্ডেন্স তৈরি হয়। যার ফলে কোন রকম সংশোধনমূলক পদক্ষেপ জটিল ও ব্যয়সাধ্য হয়ে পড়ে। এই রকম তীব্র পরিবর্তনের মুখোমুখি হওয়ার পর, দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের কার্যকারিতা পরীক্ষা করার জন্য কর্মপন্থা নির্ধারণের উপর মনোযোগ দেওয়া দরকার। এখনও পর্যন্ত, সমাধানগুলি কিছু অংশে অসম্পূর্ণ অবস্থাতেই আছে, কারণ প্রচলিত পন্থাগুলি জলচক্রের ধারণা এবং জলাশয় থেকে জল প্রবাহিত হয়ে কৃষি, বাণিজ্য, নগর ও গৃহস্থালীতে ভিন্ন ভিন্ন ব্যবহারকারী কাছে পৌঁছন এবং সেখান থেকে আবার উৎসে ফিরে আসা পর্যন্ত এই চক্রের প্রতিটি পর্যায়ে জলের ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের প্রতি মনোযোগ দেয় না।     

জলসম্পদকে সাফল্যের সঙ্গে পরিচালনা করার জন্য নীতি ও চর্চাকে এমন এক সমতলে আসতে হবে,যাতে তা জলের ব্যবহারের সম্পূর্ণ শৃঙ্খলে জলের মূল্যকে চিহ্নিত করতে পারার পাশাপাশি, দক্ষতা, ন্যায্যতা ও স্থায়িত্ব - এই প্রতিযোগী অথচ আবশ্যক তিনটি শর্তের মধ্যে ভারসাম্য আনতে পারে। কিন্তু যে কোন শৃঙ্খলের মতই, এর দুর্বলতম অংশটি যতটা ভেদ্য এই শৃঙ্খলটিও ঠিক ততটাই শক্তিশালী। এবং সেটাই জলসম্পদ পরিচালনার বর্তমান উপায়গুলির ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি করছে। ভিন্ন ভিন্ন সেক্টর ও ব্যবহারকারীরা শুধুমাত্র নিজেদের সীমিত অঞ্চলের জলের ব্যবহার নিয়েই ভাবেন এবং সম্পূর্ণ গঠনতন্ত্রের উপর এর প্রভাবকে একেবারেই অবহেলা করেন। জল শক্তি মন্ত্রকের দ্বারা গঠিত, স্বাধীনভাবে কাজ করেন এমন বিশেষজ্ঞদের একটি পরিষদ নতুন যে জাতীয় জল নীতি বা ন্যাশনাল ওয়াটার পলিসির খসড়া তৈরি করেছে তা এই ফাঁকগুলিকে চিহ্নিত করেছে। এই খসড়ায় তাঁরা জলসম্পদের পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি দৃষ্টান্তমূলক পরিবর্তনের প্রস্তাব করেছেন। তাঁরা এমন একটি কৌশলের কথা বলছেন যা জলসম্পদকে দীর্ঘকাল ধরে সুরক্ষিত রাখাবে এবং এমন বিবেচনা এবং ন্যায্যতার সঙ্গে জল ব্যবহার করার কথা বলছেন, যাতে জলসম্পদ সম্পর্কে পরিকল্পনার সময় “অনুশাসন ও নিয়ন্ত্রণ” প্রণালীটির বদলে এমন একটি পন্থার কথা ভাবা হয় যা ভারতে সুবিশাল বৈচিত্রকে সম্মান করে।               

যা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বৃহত্তর অনিশ্চয়তা আনে, সেই জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এগুলি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতিতে নতুন নতুন তথ্য ও পরিবর্তনশীল অবস্থার কথা মাথায় রেখে তৈরি হওয়া অভিযোজনযোগ্য ও নমনীয় সমাধানগুলিকে আরও বেশি মূল্য দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে, আঞ্চলিক ও কেন্দ্রীয় সরকার, নাগরিক সমাজ এবং সমস্ত সেক্টর ও পারিপার্শ্বিকের জল ব্যবহারকারীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল, জলসম্পদ বন্টনকে অগ্রাধিকার ও যে প্রক্রিয়াগুলির মাধ্যমে সকলে ঐক্যমত হবেন সেগুলিকে চিহ্নিত করা। সেই উদ্দেশ্যে প্রয়োজন তাঁদের নিজেদের মধ্যে সুদীর্ঘ সংলাপ ও আলোচনা। জলসম্পদের ক্ষেত্রে ভারতের ভবিষ্যৎকে দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য আমাদের উদ্যমকে দ্বিগুণ করে তুলতে হবে। এই উদ্যমের প্রতিটি বিন্দুই এই ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার কাজে লাগবে।।   

এষা জাভেরী

Author

এষা জাভেরী স্ট্যান্ডফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ফুড সিকিওরিটি অ্যান্ড দি এনভায়রোমেন্টের একজন অ্যাফিলিয়েট স্কলার। 

(Bangla Translation by Sritama Halder)
অনুবাদঃ শ্রীতমা হালদার