ভারত-অস্ট্রেলিয়া সম্পর্কঃ আর অবহেলিত নয়

19/06/2023
IiT English Page

ভারত-অস্ট্রেলিয়া সম্পর্ক বহু যুগ ধরেই স্বাভাবিক কিন্তু অবহেলিত বলে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। স্বাভাবিক, কারণ অনুমান করা হয় যে, দুটি দেশই একই রকমের সাধারণ গণতান্ত্রিক মানে নিশ্বাস করে এবং সাংস্কৃতিক সাধনার অনুসরণ করে –  যার উঠে এসেছে একই ধরনের ঔপনিবেশিকতার ইতিহাস থেকে। অবহেলিত, কারণ ভিন্ন ভিন্ন পররাষ্ট্র নীতি, যা শুরু হয় স্নায়ুযুদ্ধের সময়, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারত জোট-নিরপেক্ষ অবস্থান নেয় এবং অস্ট্রেলিয়া জোট বাঁধার সিদ্ধান্ত নেয়। সত্যি বলতে কি, কোনও সম্পর্ক নির্মাণের জন্য “ক্রিকেট, কারি ও কমনওয়েলথ” অত্যন্ত অগভীর একটি ভিত্তি। এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলে, অস্ট্রেলিয়া ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজার জন্য অ্যাংলো-স্যাক্সন আধিপত্যের একটি উপ-সাম্রাজ্যবাদী ধারক। পরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার স্তরিত বিন্যাসের সমালোচনা করে ও, বিশেষ করে জওহরলাল নেহরুর ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদের মতবাদের উপর ভিত্তি করে, ভারতীয় সভ্যতার কৈবল্যবাদের ধারণাকে প্রচার করে। স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে, অস্ট্রেলিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মৈত্রীবন্ধন ও অ্যাংলোস্ফিয়ারের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ থাকে এবং ভারত তার কৌশলগত স্বশাসনের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে যায়। ১৯৯০-এর দশকে ভারতের অর্থনীতির উদারীকরণ ঘটলেও, তার উন্নয়ন চালিত হয়েছে পরিষেবা ক্ষেত্রের হাতে আর, প্রধানত সম্পদ ও শিক্ষা বিষয়ক পরিষেবা, বিশেষ করে চিনে, রপ্তানির মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়া অর্থনীতি এগিয়েছে। এর অর্থ, ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে খুবই কম অর্থনৈতিক পরিপূরক আছে, যার মাধ্যমে তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক গভীরতর হতে পারে    

গত পাঁচ বছরে, যদিও, চিনের সঙ্গে উত্তেজনা বেড়ে চলার কারণে, পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে। ২০১৭ সাল থেকে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে চিনের সম্পর্কের দ্রুত অবনতি হতে শুরু করে। অস্ট্রেলিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলে, যাকে অস্ট্রেলিয়া নিজের “প্রভাবের ক্ষেত্র” বলে মনে করে, সেখানে চিনের “হস্তক্ষেপ”-এর বিপদ নিয়ে নীতিনির্ধারকরা আরও বেশি করে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এর ফলাফল হল, ব্যাপকহারে এমন সমস্ত জাতীয় নিরাপত্তামূলক আইন নির্মাণ যা চিনের প্রভাব হ্রাস করার নামে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক অধিকার খর্ব করে, অস্ট্রেলিয়ায় চিনের বিনিয়োগ নিয়ন্ত্রণ করা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মৈত্রীবন্ধন দৃঢ় করা এবং জাপান ও ভারতের মত দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্ক গভীরতর করার আকাঙ্খা। অস্ট্রেলিয়া-চিন সম্পর্কে ক্ষয় হতে থাকার সঙ্গে সঙ্গে, চিন পূর্ববর্তী উদারপন্থী-জাতীয়তাবাদী জোট সরকারের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক “স্থগিতাবস্থা” ঘোষণা করে, কিছু কৃষি সংক্রান্ত পণ্যের আমদানিতে নিয়ন্ত্রণ আনে এবং চিনের ছাত্রছাত্রীদের অস্ট্রেলিয়ায় পড়তে যেতে নিরুৎসাহ করে। এই কারণে, অস্ট্রেলিয়া তার বাজারকে চিনের থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায় ও তাকে বহুমুখী করার উপর জোর দিতে শুরু করে।      

২০২০ সালে চিন ও ভারতের সৈন্যবাহিনীর মধ্যে, দুই দেশের মধ্যে বিতর্কিত সীমান্ত নিয়ে সংঘর্ষ ঘটে যাতে, ১৯৭৫ সালের পর প্রথমবার, সৈন্যক্ষয় হয় এবং তার পর থেকেই ভারতের সঙ্গে চিনের সম্পর্কেও অবনতি ঘটে। ২০২১ এবং ২০২২ সালে আরও কয়েকটি ছোটোখাটো সংঘর্ষ ঘটে এবং শুধুমাত্র মৌখিক আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। স্থানীয় শিল্পের জন্য প্রেরণাদায়ক প্রকল্প, শুল্ক, মাসুলহীন প্রতিবন্ধক, চিনের কিছু প্রযুক্তির উপর নিষেধাজ্ঞা এবং ভারতে চিনের বিনিয়োগের সীমিতকরণ ইত্যাদি পদক্ষেপের মাধ্যমে ভোগ্যপণ্য এবং উৎপাদনের উপাদানের জন্য চিনের উপর নির্ভরশীলতা কমানোর প্রচেষ্টা চলছে। 

ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে চিনের সম্পর্ক তিক্ত হওয়ার সমাপতনটি এই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক গভীরতর হওয়ার প্রেরণা যুগিয়েছিল। ২০২০ সালে, দুই দেশ একটি কমপ্রিহেনসিভ স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ ঘোষণা করে এবং মালাবার নৌবহর অনুশীলনে অংশগ্রহণ করার যে দীর্ঘকালীন ইচ্ছা অস্ট্রেলিয়ার ছিল, তা অবশেষে পূরণ হয়েছে এবং এই বছর অস্ট্রেলিয়া এই অনুশীলন কার্যক্রমের পরিচালনাও করেছে। এখন অস্ট্রেলিয়া ভারতকে “শীর্ষ শ্রেণী”-র নিরাপত্তা অংশীদারের স্তরে উন্নীত করেছে এবং একটি দীর্ঘ-বিলম্বিত অর্থনৈতিক চুক্তির বিষয়ে আলোচনা ত্বরান্বিত হয়েছে। এর ফলে গত বছর একটি অন্তর্বর্তী চুক্তি সাক্ষরিত হয়। অস্ট্রেলিয়া তো সব সময়ই একটি গভীরতর সম্পর্কের উৎসাহী পক্ষপাতী ছিল, এবং ভারতও এখন অনেক বেশী আগ্রহী হয়ে উঠেছে। যার ফলে দেখা গেছে যে, অস্ট্রেলিয়ার মন্ত্রীস্তরের সদস্যদের ভারতে আগমনের সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রাখতে, ভারতও ২০২২ সালে অসংখ্য মন্ত্রীকে অস্ট্রেলিয়ায় পাঠিয়েছে।   

এই দুই দেশের জন্যই কোয়াড একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বহুমুখী সহযোগিতামুলক প্রক্রিয়া হয়ে উঠেছে। আগে ভারত, অস্ট্রেলিয়া, জাপান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জোট কোনও রকম যৌথ বিবৃতি দেওয়া এড়িয়ে যেত এবং মূখ্য বহুপাক্ষিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণের সময়, এই দেশগুলি নিজেদের বৈঠকগুলি সম্পন্ন করতেন। ভারত, যে কিনা বহু দিন ধরেই কোয়াড রাষ্ট্রগুলির মধ্যে সব চেয়ে সতর্ক বলে পরিচিত, সে তার কোয়াড সংক্রান্ত প্রেস রিলিজে নিরাপত্তা বা চিনের বিষয়ে কোনও রকম ইঙ্গিত দেওয়া এড়িয়ে চলত। তবে, ২০২১ সাল থেকেই সরকারের পক্ষ থেকে যুগ্ম কোয়াড বিবৃতি প্রচার করা হচ্ছে। এই বিবৃতিগুলি পরিকাঠামো নির্মাণ এবং জটিল প্রযুক্তির মত বিষয় সহ বিস্তৃত কার্যক্রমের বর্ণনা করে, কিন্তু তার পাশাপাশি দক্ষিণ ও পূর্ব চীন সাগরের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে, যা পরোক্ষভাবে চিনের কাজকর্ম ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতিও ইঙ্গিত করে। দ্বিপাক্ষিক স্তরেও, সেমিকন্ডাক্টারের মত জটিল প্রযুক্তির বিশ্বস্ত ও স্বচ্ছ সরবরাহ শৃঙ্খল তৈরির জন্য অস্ট্রেলিয়া ভারতকে তার অংশীদার হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এই পদক্ষেপ ই-কমার্স ও এআই-এর মত উদীয়মান সেক্টরের প্রযুক্তিগুলির বিশ্বব্যাপী নিয়ন্ত্রণকে রূপদান করছে এবং চিকিৎসা সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি ও টীকার মত বিষয়গুলির ক্ষেত্রে যৌথ উদ্ভাবনের পরিকল্পনাকে অনুসরণ করছে।    

দুই দেশের জনগণের মধ্যে সংযোগও আরও জোরাল হয়েছে। ভারত এখন অস্ট্রেলিয়ার অভিবাসী ও আন্তর্জাতিক ছাত্রছাত্রীদের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎস। ডিকিন বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় যে ভারতে তার ক্যাম্পাস স্থাপন করতে চলেছে। একটি নতুন লেবার মোবিলিটি অ্যাকর্ডের সাহায্যে ছাত্র, গবেষক, স্নাতক ও ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের আদান-প্রদানের প্রক্রিয়াকে সহজ করার চেষ্টা চলছে। তার উপর, অস্ট্রেলিয়ার রাজনৈতিক নেতা, প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মধ্যে এখন বেশ কিছু সংখ্যক “ভারতের উৎসাহী সমর্থক” আছেন, যাঁরা চিনের তীব্র সমালোচনা করেন এবং ভারতকে, আইন-নির্ভর বিন্যাসের ধারক হিসেবে অঙ্গীকারবদ্ধ ও সমতূল্য অভিন্ন গণতান্ত্রিক মূল্যে বিশ্বাসী, সমমনস্ক অংশীদার প্রচার করেন। এমনকি, ভারতকে “সুদীর্ঘ ইতিহাস ও অগ্রসর সভ্যতাকেন্দ্রিক জ্ঞান” ধারণ করে এমন এক “উন্নত সভ্যতাকেন্দ্রিক শক্তি” হিসেবে ভারত সরকারের সাড়ম্বর বর্ণনাকেও অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী পেনি ওং সাগ্রহে গ্রহণ করেছেন। হিন্দু জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিকোণের দ্বারা বদলাতে থাকা এই বর্ণনা অনুযায়ী, ভারত মূলত একটি হিন্দু সভ্যতা এবং মুসলিমরা একটি আক্রমণাত্মক এবং পরপীড়ক শক্তি। ভারত সরকারের প্রভাব বিস্তারকারী অভিযানগুলি, প্রশংসাসূচক ব্যক্তিগতকৃত চিঠি এবং রাইসিনা সংলাপে নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে ছবি তোলার সুযোগ দেওয়া প্রভৃতি পদক্ষেপের মাধ্যমে ভারতের উৎসাহী সমর্থকদের নিশানা করছে। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্টনি অ্যালবানিজ যখন দিল্লীতে আসেন, তখন তাঁকে নায়কের অভ্যর্থনা দেওয়া হয় ও তাঁকে নরেন্দ্র মোদী ক্রিকেট স্টেডিয়ামে নিয়ে যাওয়া হয় রথে করে – এই রথ এমন একটি পরিবহন, হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে যার বেদনাদায়ক তাৎপর্য আছে। সিডনিতে ওভারসিজ ফ্রেন্ডস অফ দ্য বিজেপির দ্বারা সংগঠিত একটি অনুষ্ঠানে, যার সঙ্গে ভারতীয় রাজনৈতিক সমাবেশের মিল ছিল, সেখানে মোদীকে ‘দ্য বস’ বলে অভ্যর্থনা জানানোর সময় অ্যালবানিজ একটি কমলা রঙের টাই পরেছিলেন। এই বিশেষ রংটি শাসকদল ভারতীয় জনতা দল (বিজেপি) ও জঙ্গি হিন্দু জাতীয়তাবাদের সঙ্গে জড়িত। 

তবুও, বেশ কিছু তাৎপর্যপূর্ণ সমস্যা বাকি আছে। উন্নততর অস্ত্রের জন্য রাশিয়ার উপর ভারত নির্ভরশীল এবং সেই জন্য, রাশিয়ার প্রতি অস্ট্রেলিয়ার অবিশ্বাস এবং রাশিয়া ও পাশ্চাত্য অস্ত্র প্রক্রিয়ার আন্তঃসংযোগের কারণে, অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ভারতের নিরাপত্তা সংক্রান্ত সহযোগিতার প্রসারকে সীমিত করবে। ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার যুদ্ধের শুরু থেকেই ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার “স্বতন্ত্র ও বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত অংশীদারিত্ব” আরও জোরাল হয়েছে। ইউক্রেনের উপর রাশিয়ার আক্রমণকে ধিক্কার জানাতে ভারত অস্বীকার করেছে, রাশিয়া থেকে শক্তি কেনার পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে, প্রযুক্তি ও উৎপাদন সংক্রান্ত সরবরাহ শৃঙ্খলের সংযোগকে গভীরতর করার উদ্দেশ্যে রাশিয়ার সঙ্গে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির বিষয়েও ভারত আলোচনা শুরু করেছে। এর পাশাপাশি, ব্যাঙ্কের অর্থের লেনদেন সহজতর করতে এবং রাশিয়ার ব্যাঙ্কগুলির উপর পাশ্চাত্যের নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে যেতে, ভারত রাশিয়ার আর্থিক বার্তা আদানপ্রদান প্রক্রিয়াটি গ্রহণ করছে।  

ভারত-অস্ট্রেলিয়ার অর্থনৈতিক সম্পর্ক সংকীর্ণই রয়ে গেছে এবং এই সম্পর্ক কয়লা রপ্তানির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ভারতীয় সংস্থাই অস্ট্রেলিয়ার খনিশিল্পের প্রধান বিনিয়োগকারী। এই সংস্থাগুলির উদ্দেশ্য হল বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রসারের জন্য একটি ভারত-নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খলে অস্ট্রেলিয়াকে একীভূত করা। নতুন কয়লা প্রকল্পে বিনিয়োগকারী ও ঋণদাতাদের অভাবে এই পরিকল্পনাগুলি নিষ্ফল অবস্থাতেই রয়ে গেছে। কুইন্সল্যান্ডের গ্যালিলি বেসিনে ভারতীয় সংস্থা জিভিকে হ্যানককের পরিকল্পিত বৃহদায়তন খনিগুলি এখন নিষ্ক্রিয় অবস্থায় রয়েছে, এবং একই অঞ্চলে আদানির কারমাইকেল খনি, প্রাথমিকভাবে যত কয়লা উৎপাদন করবে বলে ভাবা হয়েছিল, তার মাত্র ছয় ভাগের এক ভাগ উৎপাদন করছে।

কৃষিক্ষেত্রে বাজারকে সহজগম্য করতে তার উদারীকরণের বিষয়ে ভারতের অনিচ্ছা এবং শ্রমিকদের যথেষ্ট সক্রিয়তার বিষয়ে অস্ট্রেলিয়ার অসম্মতি, একটি সম্পূর্ণ রূপে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করছে। ভিসা নিয়ে প্রতারণার ঘটনা ও ভিসা প্রক্রিয়াকে ঢেলে সাজানর পরিকল্পনার পর থেকে, অস্ট্রেলিয়ায় পড়তে ইচ্ছুক ছাত্রছাত্রীর স্রোতকে হয়ত সঙ্কুচিত করা হবে।     

যদিও প্রযুক্তিকেন্দ্রিক সহযোগিতার উপর সমস্ত প্রত্যাশা কেন্দ্রীভূত হয়েছে, মুক্ত বাজার ও আইপি সুরক্ষা প্রতি দায়বদ্ধ ও ডিজিটাল স্বৈরাচারের বিষয়ে উদ্বিগ্ন অস্ট্রেলিয়া এবং অন্যান্য কোয়াড রাষ্ট্রগুলির বিপরীতে ভারতের তথ্য স্থানীয়করণ এবং টেকনো-স্বৈরাচারের মত প্রযুক্তিকেন্দ্রিক নীতিগুলি, সোশ্যাল মিডিয়া সেন্সরশিপ এবং ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট ইত্যাদি পন্থার সাহায্যে, টেকনো-জাতীয়তাবাদের অভিমুখী। এর ফলশ্রুতি হিসেবে, জি২০ ওসাকা ডিক্লেরেশান অন ডিজিটাল ইকোনমি ও দ্য ডিক্লেরেশান অন দা ফিউচার অফ দ্য ইন্টারনেট, যা তথ্যের অবাধ প্রবাহকে নিশ্চিত করার চেষ্টা করে, সেগুলির মত বহুমুখী বিশ্বজনীন প্রযুক্তি পরিচালনাকেন্দ্রিক উদ্যোগকে ভারত প্রত্যাখ্যান করেছে।    

গত দশক ধরে পূর্ণ স্বৈরাচারের দিকে ভারতের স্খলনের ব্যাপক প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও যে ভারতের উৎসাহী সমর্থকরা তাকে একটি প্রাণবন্ত উদারনৈতিক গণতন্ত্র হিসেবে প্রচার করছে, তাতে জ্ঞানীয় অসঙ্গতি বা কগনিটিভ ডিজোনেন্সের বৈশিষ্ট দেখা যায়। এই অসঙ্গতিকে হ্রাস করতে, এই সমর্থকরা কোনও ঘটনা বা ব্যক্তিকে তুচ্ছ করা, ছোট করা, এড়িয়ে যাওয়া এবং ইচ্ছাকৃত অজ্ঞতার মত পন্থা অবলম্বন করেন। যখন, মোদীর মানহানি করা হয়েছে দাবীতে বিরোধী নেতা রাহুল গান্ধীকে শাস্তি দেওয়ার বিষয়ে মন্তব্য করতে বলা হয়, তখন অ্যালবেনিজ ভারতকে পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র বলে ঘোষণা করেন ও ভারতের আভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে অজ্ঞতার ভান করেন। মোদী যখন অস্ট্রেলিয়াতে যান, তখন অ্যালবানিজ ভারতের নিজস্ব আভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন, এবং মোদী, হিন্দু মন্দিরের উপর ভারত-বিরোধী ও খালিস্তানের সমর্থনে দেওয়াল লিখনের কথা উল্লেখ করে বলেন যে, তিনি অ্যালবেনিজের কাছে দাবী জানিয়েছেন এবং তাঁর কাছ থেকে “যাঁরাই কোনও রকম আচরণ বা চিন্তার মধ্যে দিয়ে ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার এই বন্ধুত্বপূর্ণ ও উষ্ণ বন্ধনের ক্ষতি করার চেষ্টা করবেন” তাঁদের বিরুদ্ধে “কঠোর পদক্ষেপ” নেওয়া হবে বলে প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন। হাই কমিশনার ব্যারি ওফ্যারেল ভারতের অ্যাক্টিভিস্ট ও ছাত্রছাত্রীদের গ্রেপ্তারকে তুচ্ছ করেন ও ভারতের বহুমুখী গণতন্ত্র ও বলিষ্ঠ সংগঠনের উচ্চ প্রশংসা করেন, যদিও এই জাতীয় দাবীর বিরুদ্ধে অসংখ্য প্রমাণ দেখা যায়। ভারতের সমর্থকরা, রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে ব্যাপকহারে ক্রমবর্ধমান অপরাধ থেকে দায়মুক্তি ও সহযোগিতার প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও, সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে হিংসার ঘটনাকে সম্বোধন করার সময়, তাঁরা ভারতের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের উপর আস্থা ঘোষণা করেন। তাঁরা দাবী করেন যে, ভারতের জনবৈচিত্রই একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে দীর্ঘসূত্রী ক্ষমতা দখল করা থেকে বিরত করে, যদিও, উচ্চবর্ণের, উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর হিন্দু পুরুষ – এই একটি গোষ্ঠীই বহুদিন ধরে ভারতের রাজনীতি, সংবাদ মাধ্যম, উচ্চশিক্ষা, সিভিল সার্ভিস এবং আদালতের মত ক্ষেত্রগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে এসেছে। এই গোষ্ঠীটিই বিজেপির সমর্থনের কেন্দ্রীয় ভিত্তি ও নেতৃত্বকে গড়ে তোলে, যা সংগঠন ও জনসংস্কৃতিকে এমনভাবে পুনর্নির্মাণ করছে যাতে তাদের হস্তগত ক্ষমতা আরও সুরক্ষিত হয়। ভারতের সমর্থকরা ভারতে বিজেপির হিন্দু জাতীয়তাবাদের গুরুত্বকে ছোট করে দেখে এবং দাবী করে যে, ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণী শাসকদলের মতাদর্শকে সমর্থন করে না। তাঁরা মোদীকে ভোট দেন, কারণ মোদী ভারতকে (আবার) মহান করে তুলবেন বলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। অসংখ্য সমীক্ষার তথ্য ও পাণ্ডিত্যপূর্ণ গবেষণা থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, মধ্যবর্তী ভারতীয় ভোতদাতারা এখন বিজেপির হিন্দুকেন্দ্রিক ও মুসলিমবিরোধী দর্শনকে গ্রহণ করেছেন এবং স্বচ্ছল, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষিত পেশাদার ব্যক্তি সহ মধ্যবিত্ত শ্রেণীও এখন সমাজে এই দর্শনকে সক্রিয়ভাবে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু সেই প্রমাণ সত্ত্বেও তাঁদের এই সমর্থন বজায় থাকে।  

ভারত-অস্ট্রেলিয়া সম্পর্ক এখন আর অবহেলিত না হলেও, এই দুই দেশের ভূ-রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্বার্থের মধ্যে ভিন্নতাকে অতিক্রম করা কঠিন হবে। ভারত-অস্ট্রেলিয়া সম্পর্কের ইতিহাসের একটি দুর্ভাগ্যজনক অধ্যায় হল, এই সম্পর্ককে প্রশমিত করার অত্যুৎসাহে, এই সমর্থকরা সর্বজনীনভাবে সম্মানিত নেতা হিসেবে মোদীর দাবীকে আরও উজ্জ্বল করেন, হিন্দু জাতীয়তাবাদী হিসেবে ভারতের পুনর্গঠন করাকে অনুপ্রেরণা দেন, বিরোধী দলকে ছোট করে চলেন, এবং হিন্দু আধিপত্যবাদী নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্রের আখ্যানকে অনন্ত স্থায়িত্ব দেন।      

প্রিয়া চাকো

Author

প্রিয়া চাকো অ্যাডিলেড বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্স অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ বিভাগের ইন্টারন্যাশনাল পলিটিক্স বিষয়ের সিনিয়র লেকচারার।

(Bangla Translation by Sritama Halder)
অনুবাদঃ শ্রীতমা হালদার