জি২০, বিআরআইসিএস এবং গ্লোবাল সাউথের নেতৃত্বের জন্য ভারতের অন্বেষণ

05/08/2024
IiT English Page

ক্ষমতা দখলের জন্য ক্রমবর্ধমান শত্রুতার মধ্যেই, ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে ২০২৩ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত অনুষ্ঠিত জি২০ অধিবেশনে ভারতের নেতৃত্ব, তার কূটনৈতিক কুশলতার একটি পরীক্ষা হয়ে ওঠে। পশ্চিম ও রাশিয়ার মধ্যে একটি তিক্ত বিভাজনের উপস্থিতি সত্ত্বেও, ভারত কি সফলভাবে এই রকম একটি অধিবেশনকে সংগঠিত করতে এবং একটি যুগ্ম বিবৃতি দান নিশ্চিত করতে এবং তার পাশাপাশি উন্নত ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলির মধ্যে যে ফাঁক, তাকে পূরণ করতে পারবে? এবং এইগুলি চলাকালীন, ভারত কি তার আন্তর্জাতিক অবস্থানের উন্নতি করতে সক্ষম হবে, নাকি নিজেই এই কলহে জড়িয়ে পড়বে? এ বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছনো না গেলেও, সংখ্যাগরিষ্ঠের মতে, এই দুই ক্ষেত্রেই ভারত সফল। জি২০ অধিবেশনে ভারতের সাফল্য আরেকটি বহুপাক্ষিক সম্মেলন, বিআরআইসিএস, যেখানে ভারতের একটি মুখ্য ভূমিকা আছে, তার প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। গত বছর থেকেই উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যে এই সম্মেলনের বিষয়ে হঠাৎ আগ্রহ বেড়ে যেতে দেখা গেছে, যা থেকে বোঝা যায় যে এই দেশগুলি পাশ্চাত্যের আধিপত্যময় মঞ্চগুলির বিকল্প চাইছে। তবে, কোনও রকম আনুষ্ঠানিক আলোচ্যসূচির অনুপস্থিতি ও বিশেষ করে, চিন ও ভারতের মধ্যে বিদ্যমান উত্তেজনার কারণ, বিআরআইসিএস-এর সম্প্রসারণ, তার ভবিষ্যত বাস্তবোপযোগিতা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি করেছে। জি২০ ও বিআরআইসিএস-এর বিষয়ে ভারতের কোন পন্থা নিচ্ছে ও তার অভিপ্রায় কি তা আমরা কিভাবে বুঝব, এবং বহুপাক্ষিক কূটনৈতিক পদক্ষেপ জন্য নতুন দিল্লির বৃহত্তর পরিকাঠামোর অন্দরে এই দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিন্যাসকে আমরা কিভাবে স্থাপন করব?   

ঐতিহাসিকভাবে, এই দুই বিন্যাসের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক পরস্পর বিজড়িত। দুটি সংগঠনই মোটামুটি একই সময়ে – একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে – প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রথমদিকে, জি২০ নিয়ে ভারত সন্দিহান ছিল এবং এই বিন্যাসের মধ্যে তার ভূমিকা ঠিক কি, সে বিষয়ে অনিশ্চিত ছিল। যদিও, গুরুতর আর্থিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাগুলির সম্পর্কে প্রতিক্রিয়ার সমন্বয়সাধন করতে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতিগুলিকে অনুমোদন দেবে, এমন একটি আন্তঃসরকারি সম্মেলন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত জি২০-কে গ্লোবাল নর্থ ও গ্লোবাল সাউথের মধ্যে একটি সেতু হিসেবে তুলে ধরা হলেও, ভারতের আশঙ্কা ছিল যে, বেশি প্রভাবপূর্ণ দেশগুলি গ্লোবাল সাউথের সদস্য দেশগুলিকে কনিষ্ঠ অংশীদার হিসেবে দেখবে। বিআরআইসিএস, অন্যদিকে, অ-পাশ্চাত্য দেশগুলি সহ এমন একটি পরস্পর নির্ভরশীল গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে, যা পরবর্তী বছরগুলিতে প্রচুর অর্থনৈতিক বিকাশের মুখ দেখতে প্রস্তুত হচ্ছে। ভারত, পশ্চিমের দেশগুলির নেতৃত্বে চালিত বিন্যাসকে প্রশ্ন করার মধ্যে দিয়ে গ্লোবাল সাউথের মতবাদকে সমর্থন করার ঐতিহাসিক উত্তরাধিকারকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে বলে বিআরআইসিএস-এর অ-পশ্চিমী চরিত্র এই দেশের কাছে অনেক বেশি আকর্ষণীয় ছিল।   

যেহেতু, ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চিন ও দক্ষিণ আফ্রিকা, বিআরআইসিএস-এর এই পাঁচ সদস্য দেশ, যেহেতু, এক সময় জি২০-এর অংশ ছিল, সেহেতু সেগুলি সংগঠনের বৃহত্তর বিন্যাসের মধ্যে থেকেও একটি জোট হিসেবে কাজ করতে পারৎ। এর মানে, বিআরআইসিএস সদস্য, যারা পশ্চিমের দেশগুলির সঙ্গে সহযোগিতা ও তার পাশাপাশি ওই দেশগুলিকে প্রতিহতও করতে পারবে, তাদের কাছে জি২০ আদতে ছিল ভবিষ্যৎ ঝুঁকি ও বিপদ সামলানর মঞ্চ। এইভাবে, তাদের অস্তিত্বের প্রথম কয়েক বছরে, বিআরআইসিএস যৌথভাবে জি২০ মঞ্চকে ব্যবহার করে ব্রেটন উডস প্রক্রিয়া, যা বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে আর্থিক সম্পর্ককে পরিচালনা করে, তার সংশোধনের জন্য আওয়াজ তুলেছে এবং বিশ্বজোড়া বৈষম্যের সমস্যাকে সকলের সামনে তুলে ধরেছে। কিন্তু, জি২০-তে পশ্চিমের দেশগুলির যে জোট আছে, তা তাদের আবেদনকে অগ্রাহ্য করে। জি২০-র ভিতরেই এই দুই অংশের মধ্যে একটি ফাটল তৈরি হয়েছিল বলে মনে হয়, এবং এই সময়ই বিআরআইসিএস-এর সদস্যরা এমন একটি বিকল্প আর্থনৈতিক সংগঠনের কথা ভাবতে শুরু করে, যা উন্নয়নশীল দেশগুলির প্রয়োজনের সঙ্গে মানানসই হবে। বিআরআইসিএস এবং অন্যান্য উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের পরিকাঠামোগত উন্নয়ন ও দীর্ঘস্থায়ী বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ সহজলভ্য করতে, ২০১৪ সালে, নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক (এনডিবি)-এর প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং সেই কাজে ভারতের একটি মুখ্য ভূমিকা ছিল।

বিআরআইসিএস-এর জোটবদ্ধ যাত্রায় এনডিবি একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হলেও, এর প্রয়োগসংক্রান্ত নীতি ও নিয়োগের বিষয়ে আন্তঃদলীয় মতবিরোধ শুরু হতে খুব বেশি দিন লাগে নি। বিআরআইসিএস-এর আসল উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বর্থনীতির একটি পক্ষপাতশূন্য বিন্যাসের প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক সহযোগিতার বৃদ্ধি ও সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়ান। কিন্তু, ভারত ও চিনের মধ্যে ২০১৭ সাল থেকে সীমান্ত নিয়ে চলতে থাকা দ্বন্দ্ব, প্রথমে ক্রিমিয়া ও পরে ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক কার্যকলাপের কারণে এই গোষ্ঠীর মধ্যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা তৈরি হওয়ায় এই উদ্দেশ্যের সাধন উল্লেখযোগ্যভাবে ব্যাহত হয়। বৃহত্তর অর্থনৈতিক পদক্ষেপ, পশ্চিমী অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার উপর নির্ভরশীলতা কমান, এবং বিশ্বের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের সামনে একটি ঐক্যবদ্ধ রূপ হাজির করতে হলে, বিআরআইসিএস-এর দিক থেকে সহযোগিতামূলক কাজকর্মের সাফল্যের জন্য যে বিশ্বাস ও ঐক্যের প্রয়োজন, এই বিবাদের ফলে তা দুর্বল হয়ে পড়ে। উপরন্তু, রাজনৈতিক মান, দেশের আভ্যন্তরীণ শাসন-সংক্রান্ত বিন্যাস এবং অর্থনৈতিক স্বার্থের দিক থেকে কোনও রকম সংহতির ভিত্তিগত অনুপস্থিতির পাশাপাশি প্রতিযোগী ভূ-রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার মত বিষয়গুলিও বিআরআইসিএস-এর কার্যকারিতাকে হ্রাস করে। বিআরআইসিএস-এর গুরুত্ব যখন থেকে কমতে শুরু করে, তার সঙ্গে সঙ্গেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে ভারত আবার বহুপাক্ষিকতার উপর মনোযোগ দিতে শুরু করে। গুরুত্বের এই পূনর্নবীকরণের কেন্দ্রে রয়েছে জি২০। জি২০-র বিষয়ে ভারতের প্রারম্ভিক সংশয় আশায় পরিণত হয় ও বিশ্বব্যাপী বিভেদের সময় জি২০-কে ভারতের নেতৃত্বদানের ক্ষমতাকে প্রমাণ করার মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করার প্রচেষ্টা শুরু হয়।   

ভারত যে জি২০-কে সাগ্রহে গ্রহণ করেছিল, তা প্রণালীগত ক্ষেত্রে এবং, সঙ্গে সঙ্গে, দেশের আভ্যন্তরীণ স্তরে কার্যশীল নানা উপাদানের মধ্যে দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। প্রণালীগত স্তরের মুখ্যতম চালক হল চিনের উত্থান ও তার পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চিনের মধ্যে মেরুকরণ, যা বহুপাক্ষিকতার পরিকাঠামোকে দুর্বল করে দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্কীর্ণ মনোভাবের প্রভাবে, বিশ্বনায়কের পদ অধিকার করে রাখার প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনাগ্রহ যে শূন্যস্থান তৈরি করেছে, তা পূরণ করতে চিন প্রস্তুত। বস্তুগত ক্ষমতায় প্রভূত বিকাশের কারণে ভারতও বুঝতে পেরেছে যে, বহুপাক্ষিক সংগঠনের অন্দরে প্রভাব বৃদ্ধি করার সুযোগ তার সামনে এসেছে। বহুপাক্ষিক পরিকাঠামোটি পুরোপুরি চিনের হাতে চলে যাওয়াকে প্রতিহত করার প্রয়োজনীয়তা ভারত অনুভব করে। এর ফলশ্রুতি হিসেবে, যেহেতু দুই দেশই চিনের ক্রমবর্ধমান শক্তির বিরুদ্ধে একটা ধরনের ভারসাম্য রক্ষা করতে চায়, তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে কৌশলগত মৈত্রীর বন্ধন দৃঢ়তর হয়ে ওঠে। এই জোট স্পষ্ট হয় স্বাধীন ও মুক্ত  ইন্দো-প্যাসিফিক সুনিশ্চিত করে যে কোয়াড, তা সহ বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক সমাবেশে এই দুই দেশের একত্র উপস্থিতি। জি২০ অধিবেশনে গ্লোবাল নর্থ ও গ্লোবাল সাউথের মধ্যে সংহতি আনায় সাহায্য করে, বহুপাক্ষিকতার সমস্যার মধ্যে দিয়ে পৃথিবীকে চালনা করে নিয়ে যাওয়ার মত অবস্থায় ভারত আছে বলেই এই দেশ মনে করে। 

দেশের আভ্যন্তরীণ স্তরে, বিশ্বনেতা হিসেবে ভারতকে রূপায়ণ, ভোটদাতাদের কাছে প্রবলভাবে অনুরণিত হয়, যা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর জনপ্রিয়তাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। জি২০ সফল হয়েছে বিশেষ করে এই দিকটি থেকে। এর কারণ হল, এই সমাবেশে অর্থনৈতিক বিকাশ, বাণিজ্য, আর্থিক স্থিতিশীলতার মত যে বিষয়গুলিকে সম্বোধন করা হয়, ঠিক সেই ক্ষেত্রগুলিতেই ভারত তার প্রভাব বিস্তার করতে আগ্রহী। বিশ্বব্যাপী আর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানে ভারতের নেতৃত্বের অবস্থানকে সাফল্যের সঙ্গে জনসমক্ষে আনার মঞ্চ হিসেবে মোদী জি২০ অধিবেশনকে ব্যবহার করছেন এবং তার ফলে ভারতের বিশ্বব্যাপী উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম এমন একজন শক্তিশালী ও স্বপ্নদর্শী জননায়কের ভাবমূর্তি তুলে ধরে তাঁর ভোটদাতাদের কাছে আবেদনকে তিনি আরও সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করছেন। এই বিশেষ চিত্রটি নির্ভর করে “বিশ্বগুরু” হিসেবে ভারতের সম্পর্কে তৈরি করা ধারণাটির উপর। ঔপনেবিশকতার বিরুদ্ধে ভারতের রুখে দাঁড়ানর ইতিহাস এবং আন্তর্জাতিক স্তরে একটি বিশিষ্ট স্থান পুনরায় দখল করার যে সম্ভাবনা ভারতের আছে, তারই প্রতীক এই তকমাটি। এই আখ্যানের একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক জি২০ অধিবেশনে ভারতের সভাপতিত্ব এবং তা মোদীর দল বিজেপি-র হিন্দু জাতীয়তাবাদী আদর্শের সঙ্গে মানানসই। জি২০ অধিবেশনের সভাপতিত্বকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বে ভারতের মর্যাদা বৃদ্ধি করার প্রচেষ্টাটি সমর্থকদের দিক থেকে উচ্চ প্রশংসা পেলেও, সমালোচকদের মতে, এই পদক্ষেপটির মাধ্যমে দেশের অসংখ্য আভ্যন্তরীণ সমস্যাকে চাপা দেওয়া হচ্ছে এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনের নির্বাচনী কৌশল হিসেবে একে ব্যবহার করাই এই প্রচেষ্টার মূল উদ্দেশ্য। উল্লেখযোগ্য, ২০২৪-এর এই নির্বাচনেই মোদী লাগাতার তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় এসেছেন।   

২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নতুন দিল্লিতে অনুষ্ঠিত জি২০ সম্মেলনটিকে ব্যাপকভাবে সফল বলে গণ্য করা হয়। ভারত, বিশেষ করে উচ্চপ্রশংসিত হয় অন্তর্ভুক্তির পক্ষে সওয়াল করার জন্য, যার ফলশ্রুতি এই অধিবেশনে আফ্রিকান ইউনিয়নের একটি স্থায়ী আসন প্রাপ্তি। জি২০-র অন্দরে ভারতের নবপ্রাপ্ত মর্যাদা কূটনীতির অঙ্কে বিআরআইসিএস-এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। অনেকেই প্রস্তাব দিয়েছেন যে, বিআরআইসিএস যেহেতু রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক কোনও অভীষ্টই সিদ্ধি করছে না, তাই ভারতের উচিত এই সংগঠন পুরোপুরি ছেড়ে দিয়ে, জি২০-র উপর সম্পূর্ণ মনোযোগ দেওয়া। বলাই বাহুল্য, এই পদক্ষেপটি নেওয়া একেবারেই ঠিক হবে না। যদিও ভারত সভাপতি হিসেবে  জি২০-তে একটি সফল বছর কাটিয়েছে, কিন্তু তার জন্য কোনভাবেই বিআরআইসিএস-কে পরিত্যাগ করা তো দূরের কথা, তুচ্ছ করাও ঠিক নয়।       

এ কথা সত্যি যে, আন্তঃদলীয় মতানৈক্য এবং ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের মত নানা সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে বিআরআইসিএস। কিন্তু তা সত্ত্বেও, ভারতের বৃহত্তর কৌশলগত পরিকাঠামোর ক্ষেত্রে বিআরআইসিএস একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। গ্লোবাল সাউথের একটি সম্মেলনস্থল হিসেবে বিআরআইসিএস উন্নয়নশীল দেশগুলির স্বার্থ তুলে ধরতে ও অনেক সময়ই পশ্চিমী শক্তি আধিপত্য করে যে বিশ্বপরিচালনার পরিকাঠামোটি, তার সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কথা বলার সুযোগ বিআরআইসিএস ভারতকে যোগান দেয়। টেঁকসই উন্নয়ন ও আর্থিক স্থিতাবস্থা অর্জন করার জন্য বিআরআইসিএস-এর সদস্য রাষ্ট্রগুলি ঠিক কিভাবে নিজেদের সম্পদ একত্রিত করে কাজে লাগাতে পারে, তার উদাহরণ এনডিবি এবং কন্টিনজেন্ট রিজার্ভ অ্যারেঞ্জমেন্ট (সিআরএ)-এর মত উদ্যোগগুলি। জি২০-র মত অন্যান্য বহুপাক্ষিক সংস্থার সম্পূরণ করে বিআরআইসিএস এবং, বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক বিরুদ্ধতার মধ্যেও, ভারত ও চিন যাতে তাদের সাধারণ অর্থনৈতিক এবং উন্নয়নের লক্ষ্য পূরণের জন্য একসঙ্গে কাজ করতে পারে, তার জন্য একটি বিশেষ সুযোগ করে দেয়। এই জন্যই ভারতের পক্ষে বিআরআইসিএস-কে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়, কেননা তা করলে, গ্লোবাল সাউথের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে চিনের দাবি দৃঢ়তর হবে। যেমন, ভারতের আশঙ্কা ছিল যে, চিন হয়ত তার ঘনিষ্ঠ দেশগুলিকে সদস্যপদ দেওয়ার মাধ্যমে বিআরআইসিএস-কে পশ্চিম-বিরোধী ও চিনের সমর্থক একটি বিন্যাসে পরিণত করার চেষ্টা করবে। বিআরআইসিএস-এর সম্প্রসারণকে একটি ভারসাম্যযুক্ত দিকে চালিত করতে ভারতের প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বিআরআইসিএস-এর সমস্ত সদস্য রাষ্ট্রের সঙ্গেই ভারতের সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ এবং ইরান বাদে, মিশর, ইথিওপিয়া, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব এমিরেট – এই বাকি চারটি নতুন সদস্য দেশই এই বিন্যাসের জন্য একটি অতিরিক্ত পশ্চিম-বিরোধী দৃষ্টিকোণকে প্রতিহত করবে বলে আশা করা হয়। অর্থাৎ, প্রথম দিকে ভারত বিআরআইসিএস গ্লোবাল সাউথের সংহতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করলেও, তা থেকে বিবর্ধিত হয়ে, বিআরআইসিএস বর্তমানে পরিণত হয়েছে গ্লোবাল সাউথে চিনের আধিপত্যে রাশ টানার একটি মাধ্যমে।

ঐতিহাসিকভাবে, ভারত নিজেকে গ্লোবাল সাউথের দূত হিসেবে নিজেকে উপস্থিত করে এসেছে। তবে, ইদানীং চিনও নিজের সম্পদ বিনিয়োগ করছে এমন কিছু সংগঠনের প্রতিষ্ঠায়, যাদের মাধ্যমে সে গ্লোবাল সাউথের অধিনায়ক হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে পারবে। সাংহাই কোঅপারেশান অর্গানাইজেশন (এসসিও) এবং এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্ক (এআইআইবি)-র মত বহুপাক্ষিক সংগঠন, যাদের মনোযোগ অ-পাশ্চাত্য রাষ্ট্রগুলির উপর, সেগুলি পরিকাঠামোগত ভাবে চিনের দ্বারা চালিত। অন্যদিকে, বিআরআইসিএস-ই হল একমাত্র মঞ্চ, যার কেন্দ্রে আজও কাজ করে সাম্যতাবাদের নীতি। এইভাবে, যখন ভারত জি২০-তে নিজের অবস্থান দৃঢ় করে চলেছে, তখন গ্লোবাল সাউথে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করতে ও বিশেষ করে চিনের মত অন্যান্য সদস্য দেশগুলির সম্ভাব্য আধিপত্যবাদী আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিহত করার জন্য বিআরআইসিএস-এর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

অভিনন্দন কুমার

Author

অভিনন্দন কুমার ভারতের কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের পিএইচ.ডি গবেষক।। 

(Bangla Translation by Sritama Halder) 
অনুবাদঃ শ্রীতমা হালদার