২০০৩ সালে সারা বিশ্বে বিক্রি হওয়া প্রতি পাঁচটি যানের মধ্যে একটি যে বৈদ্যুতিক যান বা ইলেক্ট্রিক ভিহেকলস (ইভি), তা থেকেই বোঝা যায় যে এই যানের ব্যবহার এখন মূলধারায় ঢুকে পড়েছে। ২০২৪ সালের প্রথম তিনমাসের মধ্যে সারা বিশ্বের ইভি-র বিক্রি অন্যান্য বছরের তুলনায় পঁচিশ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল, যা ২০২২ সালের সমতুল্য। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি হিসেব করে দেখেছে যে, ২০২৪ সালে সারা বিশ্বে যে নতুন যানগুলি বিক্রি হয়েছিল, তার মধ্যে চিনে ৪৫ শতাংশ, ইউরোপে ২৫ শতাংশ ও আমেরিকায় ১১ শতাংশের বেশি বৈদ্যুতিক যান ছিল। ২০২৪ সালের জানুয়ারী থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত গোটা পৃথিবীতে বিক্রীত ১৫.২ বিলিয়ন ইভি-র মধ্যে ৯.৭ বিলিয়নই বিক্রি হয়েছিল চিনে, এবং ওই সময়ের মধ্যে চিনই বৈদ্যুতিক যান বিক্রিতে সারা বিশ্বে প্রথম ছিল। ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডেও বৈদ্যুতিক যানের ব্যবহারও যথাক্রমে ১৫ শতাংশ ও ১০ শতাংশে পৌঁছে গেছে। সুবিধাপূর্ণ নীতির কারণে ব্রাজিল (তিন শতাংশ), ইন্দোনেশিয়া (দুই শতাংশ) এবং মালেশিয়ার (দুই শতাংশ) মত উদীয়মান বাজারে যথেষ্ট সম্ভাবনা দেখা গেছে। তবে, ইভি ক্রয়ের পর আর্থিক উৎসাহদানের ব্যবস্থাটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে এই শিল্পের অগ্রগতিতে কিছুটা হলেও ভাঁটা পড়েছে।
সামান্য দুই শতাংশ বাজারের অংশ সহ, ভারত দেশজ বৈদ্যুতিক যান ও ব্যাটারি তৈরির জন্য প্রোডাকশান লিঙ্কড ইন্সেনটিভ (পিএলআই) স্কিমের উপর নির্ভর করে। ভারত বৈদ্যুতিক যান ব্যবহার শুরু করেছে মোটরবাইক ও স্কুটারের মত দুই চাকার যান দিয়ে, যা অন্য দেশে ঘটে নি। এই প্রবন্ধে আমরা চিন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশে বৈদ্যুতিক যান ব্যবহার বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করব, ও তার পাশাপাশি ভারতের বৈদ্যুতিক গতিশীলতার চিত্রের উপর নির্ধারিত নীতির প্রভাব ঠিক কি, তা পরীক্ষা করে দেখব। যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটা সত্ত্বেও, বৈদ্যুতিক যান ইভি বাস্তুতন্ত্রের সম্পূর্ণ উন্নয়নের উপর নীতির কার্যকারিতা ও অধিষ্ঠিত শূন্যস্থানকে সম্বোধন করা প্রয়োজন।
ভারতের নীতি
ন্যাশনাল মিশন ফর ইলেক্ট্রিক মোবিলিটি (এনএমইএম)-এর পৃষ্ঠপোষকতায় ভারতের জাতীয় স্তরের ইভি-কেন্দ্রিক পরিকাঠামো, যানবাহন সংক্রান্ত টেঁকসই প্রযুক্তির উন্নতিসাধনের কাজটি করে। ফাস্টার অ্যাডপশান অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং অফ (হাইব্রিড অ্যান্ড) ইলেক্ট্রিক ভিহেকলস ইন ইন্ডিয়া (ফেম) স্কিমটিও এর মধ্যে আছে। ফেম ১ (২০১৫)-এর উদ্দেশ্য ছিল বৈদ্যুতিক দুই চাকা ও তিন চাকার গাড়ি (যেমন অটো-রিক্সা), বাস, হাইব্রিড যানের উপর ভর্তুকি দিয়ে ইভি ব্যবহারে উৎসাহ দান এবং ফেম ২ (২০১৯)-র ক্ষেত্রে ভর্তুকি প্রাপ্ত ইভি-র জন্য চার্জ দেওয়ার জায়গা তৈরিতে সাহায্য করা ও বৃহত্তর স্থানীয় প্রয়োজনের উপর মনোযোগ দেওয়ার মাধ্যমে পরিকাঠামোগত উন্নয়নের উপর মনোযোগ স্থানান্তরিত হয়। এই ক্ষেত্রের আরেকটি ভিত্তিপ্রস্তর হল প্রোডাকশান লিঙ্কড ইনসেন্টিভ (পিএলআই) স্কিম, যার উদ্দেশ্য ভর্তুকি দানের মাধ্যমে অ্যাডভান্সড সেল কেমিস্ট্রি (এসিসি) ও ইভি-র অন্যান্য যন্ত্রাংশের দেশের অভ্যন্তরেই নির্মাণের কাজকে আরও জোরদার করা, যাতে ওইগুলিকে আমদানি করতে না হয়। সরকার ও পর্যবেক্ষক উভয়েই ফেম ১ ও ফেম ২-কে সফল বলে বর্ণনা করেছেন। ফেম ৩-র চালু হওয়ার কথা ছিল ২০২৪ সালে, এবং ফেম ২-এর ভুলত্রুটিগুলিকে সেই সুযোগে শুধরে নেওয়ারও কথা ছিল। অন্যদিকে, পিএলআই স্কিম, তার সঙ্গে ইতিমধ্যে জড়িত যে চদ্দটি সেক্টর আছে, তার বেশি যাওয়ার সম্ভাবনা নেই, এবং এর কিছুটা বদলের সম্ভাবনাও আছে।
এই পদক্ষেপগুলিকে পরিপূরণের জন্য, সরকারের পক্ষ থেকে ইভি-র জন্য ধার্য গুডজ অ্যান্ড সার্ভিস ট্যাক্স (জিএসটি) বারো শতাংশ থেকে পাঁচ শতাংশে নামানো হয়েছে, ইভি-র জন্য অনুমতিপত্রের প্রয়োজন হয় না ও ইভি-র চার্জ করার জায়গায় বিদ্যুৎকে পরিষেবা হিসেবে বিক্রয় করা হয়। বাজেটে বৈদ্যুতিক যান ক্রয়ের জন্য গৃহীত ঋণের উপর অতিরিক্ত আয়কর ছাড় দেওয়ার ব্যবস্থাটিও এই যান ক্রয় করতে সম্ভাব্য ক্রেতাদের উৎসাহ যোগায়। হাইওয়ের প্রতি ২৫ কিলোমিটার অন্তর বৈদ্যুতিক যানে চার্জ দেওয়ার ঘাঁটির ব্যবস্থা করলে আয়করে ছাড় পাওয়া জাতীয় বৈদ্যুতিক যান চার্জের পরিকাঠামোগত উন্নয়নে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।
বিভিন্ন রাজ্য সরকারও বৈদ্যুতিক যান ব্যবহারে উৎসাহ দানের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁরা নিজের নিজের রাজ্যের জন্য উপযুক্ত নানা নীতি, যেমন ক্রেতাকে বৈদ্যুতিক যান ক্রয়ে প্রভাবিত করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া, গবেষণা ও উন্নয়ন (আরঅ্যান্ডডি) সহায়তা, শ্রমের ক্ষেত্রে আর্থিক উৎসাহ দান, এবং পরিকাঠামোগত বিকাশ ইত্যাদি তৈরি করছেন। কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র ও তামিলনাড়ুর মত রাজ্য, যেগুলি বৈদ্যুতিক যানের নিবন্ধীকরণে প্রথম সারিতে আছে, সেগুলি বিনিয়োগ ও স্থানীয় ইভি বাস্তুতন্ত্রের উন্নতিবিধানের জন্য সর্বাঙ্গীণ নীতির প্রচলন করেছেন।
অন্য দেশে প্রচলিত নীতি
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চিন ও ইওরোপীয় ইউনিয়নের মত মুখ্য অর্থনীতিগুলি যে ধরণের নীতি চালু করেছে, তার থেকে বিশ্ব জুড়ে ইভি ব্যবহারের দিকে সরে যাওয়ার ঘটনাটি স্পষ্ট। আমেরিকার ইনফ্লেশান রিডাকশান অ্যাক্ট (আইআরএ), চিনের নিউ এনার্জি ভিহেকল (এনইভি) এবং ইইউ-এর নেট-জিরো অ্যাক্ট (এনযিআইএ) ইত্যাদির মত নীতি থেকে বোঝা যায় যে, প্রায় সারা পৃথিবীই পরিচ্ছন্ন শক্তি ব্যবহার ও বৈদ্যুতিক গতিশীলতার অভিমুখে যাত্রা শুরু করেছে এবং সঙ্গে সঙ্গে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও প্রতিযোগিতার জন্য বিচিত্র কৌশল ও প্রভাবের প্রদর্শন করছে। প্রতিটি অঞ্চলের প্রচলিত পন্থার সঙ্গে ওই অঞ্চলের নিজস্ব ও বিশিষ্ট অগ্রাধিকার সংযুক্ত থাকলেও, যে বিষয়গুলি সব অঞ্চলের ক্ষেত্রেই দেখা যায়, সেগুলি হল আর্থিক সহায়তা, পরিকাঠামোগত উন্নয়ন ও কৌশলগত বাণিজ্যিক নীতি।
বৈদ্যুতিক যান ব্যবহারে অনুপ্রেরণা দানের উদ্দেশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে করপোরেট অ্যাভারেজ ফুয়েল ইকোনমি (সিএএফই) মানদণ্ডের মত আমেরিকার উদ্দেশ্যসাধনের উপায় হিসেবে ব্যবহৃত নীতি, ও তার পাশাপাশি একটি জাতীয় স্তরের ভর্তুকি প্রকল্প আছে। দেশীয় বৈদ্যুতিক যান নির্মাণের উপর জোর দিয়ে, আইআরএ, পরিবেশ ও পরিচ্ছন্ন শক্তির ক্ষেত্রে ৩৭০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। নিজেকে সুরক্ষিত রাখার জন্য, ২০২৪ সালের মে মাস থেকে চিনে নির্মিত বৈদ্যুতিক যানের উপর একশ শতাংশ রপ্তানী শুল্কের মত যে সমস্ত পদক্ষেপ আমেরিকা নিয়েছে, তার থেকেই বৈদ্যুতিক যান তৈরির বিশ্ববাজারে এই দেশের প্রতিযোগিতা-মূলক অবস্থানকে আরও দৃঢ় করেছে। তবে, আমেরিকার বর্তমান রাষ্ট্রপতি চালনায় নতুন সরকার আইআরএ ভেঙে ফেলতে উঠে পড়ে লেগেছে।
এনযিআইএ-এর উদ্দেশ্য হল এর নেট-জিরো শিল্পের ভিত্তির প্রতিযোগিতাকে উন্নততর করা, বিশেষ করে ব্যাটারি আর স্টোরেজ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে। ইইউ-এর বাইরে যে দেশগুলি আছে, তাদের সম্পদের উপর নির্ভরশীলতা কমাতে ইউরোপীয়ান র ম্যাটেরিয়াল অ্যাক্ট-এর দ্বারা সমর্থিত এনযিআইএ,সরবরাহ শৃঙ্খলগুলিকে দখল করে ও বিবিধ অংশীদারিত্ব তৈরি করে। চিনের অন্যায্য ভর্তুকি আর অতি-প্রতিযোগিতা-মূলক ব্যবহার নিয়ে দুশ্চিন্তার কথা উল্লেখ করে, ইইউ চিনে নির্মিত বৈদ্যুতিক যানের উপর শুল্কও ধার্য করে।
চিনের এনইভি নীতি, বৈদ্যুতায়নের ক্ষেত্রে নেতৃত্বের স্থান অধিকারের জন্য অপরিহার্য। সুপ্রচুর ভর্তুকি, ব্যাটারির প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ এবং নিয়ন্ত্রক নির্দেশিকা দ্বারা চিহ্নিত এই নীতিটি লিথিয়াম ব্যাটারি সরবরাহ শৃঙ্খলের একটা বেশ বড় অংশকে দখল করে রেখেছে।
চিন তার যানবাহন শিল্পের উন্নতি ও বায়ুদূষণের সঙ্গে লড়াই করাকে যে অগ্রাধিকার দেয়, তা বৈদ্যুতিক যান নির্মাণের ক্ষেত্রে চিনের আধিপত্যের সঙ্গে মিলে যায়। বর্তমানে, চিন বৈদ্যুতিক যানের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যাটারি ও সৌর প্যানেল নির্মাণের ক্ষেত্রে নেতৃত্বের স্থান দখল করে ফেলেছে। ব্যক্তিগত ইলেক্ট্রনিক দ্রব্য তৈরি করার সময়, লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি নিয়ে চিন যে বিশেষ জ্ঞান ইতিমধ্যেই অর্জন করেছে, ইভি বাজারে নিজের অবস্থানকে দৃঢ় করতে, ওই জ্ঞানকে সে নিজের সুবিধার জন্য ব্যবহার করছে।
কিছু দেশে এমন নীতি নির্মিত হয়েছে, যার সাহায্যে বৈদ্যুতিক যান ক্রয়ে আর্থিক সহায়তা প্রদান এবং চার্জ দেওয়ার পরিকাঠামো চালু করা হয়েছে। কয়েকটি দেশে আবার ইন্টারনাল কম্বাশ্চন ইঞ্জিন সহ গাড়ি বিক্রির সময় ভর্তুকি দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সরাসরি সহায়তা দেওয়ার পদক্ষেপগুলির মধ্যে আছে বৈদ্যুতিক যান ক্রয়ের সময় ভর্তুকি দান, আমদানি কর মকুব এবং ক্রয়ের সময় ও ব্যবহৃত হওয়ার সময় প্রদত্ত করে ছাড়। সৌদি আরব ও দক্ষিণ আফ্রিকা বাদে অন্যান্য জি২০ দেশ বৈদ্যুতিক যান শিল্পে সহায়তা দেওয়ার জন্য নানা পন্থা অবলম্বন করেছে। যেমন ফান্স আর ইটালি “ম্যালাস” প্রক্রিয়া অবলম্বন করে, অর্থাৎ এই দেশগুলিতে উচ্চ মাত্রায় কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গত হয় যে ধরণের গাড়িতে, সেগুলির উপর উচ্চহারে কর ধার্য করা হয়।
নির্ধারিত নীতির কার্যকারিতা ও সমস্যা
ব্রাজিল, ভারত বা দক্ষিণ আফ্রিকার মত দেশগুলি কি চিনের সবুজ শিল্প নীতিকে অনুসরণ করতে পারবে? এই তিনটি উদীয়মান অর্থনীতির যানবাহন শিল্পের পরিকাঠামো, দেশের আভ্যন্তরীণ পূর্বশর্ত, নীতি এবং উদ্যোগ সংক্রান্ত প্রতিক্রিয়া এবং প্রারম্ভিক শিল্পকেন্দ্রিক উন্নয়নের ফলাফল সম্পূর্ণ ভিন্ন।
ভারতে ফেম এবং বিভিন্ন স্থানীয় উদ্যোগ, চার্জ দেওয়ার পরিকাঠামো এবং টাটা মোটরস-এর মত দেশজ বৈদ্যুতিক যান নির্মাতাদের উত্থানে সহায়তা করেছে। ভারতের যেহেতু নিজস্ব গাড়ির ব্র্যান্ড আছে, তাই এই দেশের ইভি-র সরবরাহ শৃঙ্খলে বিনিয়োগের পরিমাণ ব্রাজিল, এবং বিশেষ করে, দক্ষিণ আফ্রিকার থেকে অনেক বেশি। চিনের তুলনায় ভারতীয় বৈদ্যুতিক যানের বাজার অনেকটাই ছোটঃ ২০১৯ সালে চিনে যেখানে ২৫০ মিলিয়ন ইভি বিক্রয় হয়েছে, ভারতে, ওই বছরই, সেখানে মাত্র ০.৬ মিলিয়ন বিক্রি হয়েছে। ভারত যে উদ্যোগগুলি নিয়েছে বলে উপরে বর্ণনা করা হয়েছে, সেগুলি অবশ্যই ইভি শিল্পে উন্নতি আনতে সাহায্য করেছে, কিন্তু ইভি বাস্তুতন্ত্রের সম্পূর্ণ উন্নয়নের জন্য সেই উদ্যোগগুলি আদৌ যথেষ্ট কিনা, সে বিষয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
যদিও, ভারত তার বৈদ্যুতিক যানের প্রযুক্তিগত উন্নতির জন্য বেশ কিছু গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠা করেছে, কিন্তু তার আকাদেমিক ফলাফল ও পেটেন্ট নেওয়ার পরিমাণ চিন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের থেকে অনেক কম। বহুদিনের প্রতিষ্ঠিত শিল্পে বিঘ্ন আনে এমন একটি নতুন শিল্পের জীবনচক্রের সঙ্গে উদ্ভাবক, প্রথমদিককার ব্যবহারকারী এবং যথাকালে তাঁদের সংখ্যার বৃদ্ধি জড়িত থাকে। সামনের কয়েক বছরের মধ্যে ইভি নির্মাণে যে বৃদ্ধি আসবে বলে আশা করা হচ্ছে, তা থেকে মনে হয় যে, ভারতে ইভি সেক্টর বর্তমানে একটি জটিল মোড়ে পৌঁছেছে। লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি ও ইভি নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসের শুল্কের উপর ছাড়ের মত সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া নানা পদক্ষেপ এই পরিবর্তনকে আরও দ্রুত করতে সাহায্য করবে। এই বছরের বাজেটে পঁচিশটি জটিল আকরিক পদার্থর শুল্ক মকুব করা হয়েছে এবং, এর সঙ্গেই, ক্রিটিকাল মিনারেল মিশনের প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এও পদক্ষেপগুলির সাহায্যে ব্যাটারির উন্নয়ন হওয়া সম্ভব।
ভারতে বিবিধ উৎস থেকে জাত বিদ্যুত সর্বদাই কয়লার উপর নির্ভরশীল, যা বৈদ্যুতিক যান ব্যবহারের ফলে পরিবেশের যে উপকার হয়, তা্কে ব্যাহত করে। এই সমস্যাগুলির সমাধানের জন্য প্রয়োজন নবীকরণযোগ্য শক্তির উপর উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ এবং ভারতের শক্তিক্ষেত্রকে কার্বনমুক্ত করা। একইভাবে, বিকাশের এই গতিবেগকে ধরে রাখার জন্য গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্রের সামর্থ্য বাড়ান এবং চার্জ দেওয়ার সাশ্রয়ী পরিকাঠামোর প্রয়োজন। বিশ্বের প্রেক্ষিতে, বৈদ্যুতিক যানের বাজারে প্রতিযোগিতার তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনাও বেড়ে গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ও ইইউ-তে চিনে নির্মিত বৈদ্যুতিক যানের উপর শুল্ক বাড়ান হয়েছে এবং জটিল আকরিক পদার্থের রপ্তানির উপর চিন যে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, তা থেকেই বোঝা যায় ঠিক কোন বিন্দুতে এসে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক সম্পর্ক ও শিল্পনীতি একত্রিত হচ্ছে।
উপসংহার
২০২৪ সালের প্রথম এগার মাসে, সারা বিশ্বে বিক্রি হওয়া বৈদ্যুতিক ও হাইব্রিড গাড়ির মধ্যে ৭০ শতাংশই হয়েছিল চিনে। ওই একই সময়, চিনে বাণিজ্য থেকে জাত উদ্বৃত্তের পরিমাণ ছিল সর্বাধিক – প্রায় এক ট্রিলিয়ন ডলার। আমেরিকার নতুন সরকার লোহা, ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়াম সহ চিনের নানা পণ্যের উপর যেভাবে উচ্চহারে শুল্ক ধার্য করেছেন, তাকে বলা যায় এই বাজারগুলিকে ঢেলে সাজানোর প্রচেষ্টা। এর আগে, অন্যায্য ভর্তুকি ও অতিরিক্ত প্রতিযোগিতামূলক আচরণের কারণ দেখিয়ে, ইইউ চিনে নির্মিত ইভি-র উপর শুল্ক ধার্য করেছিল। ইইউ, আমেরিকা ও অন্যান্য দেশে চিনের বৈদ্যুতিক যান নিয়ে অন্যান্য উদ্বেগও দেখা যায়। ব্রাজিল, টার্কি, ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার মত দেশের সদ্যোজাত ইভি শিল্প, চিনের আক্রমণের মুখে ধ্বসে পড়তে পারে এই ভয়ে, ওই দেশগুলি চিনের রপ্তানিতে দৃঢ়ভাবে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছে। প্রত্যুত্তরে, চিনও জটিল আকরিক দ্রব্য রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, এবং বর্তমানে ইলেকট্রনিক্স, সৌর প্যানেল ও বৈদ্যুতিক যানের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির রপ্তানিতে কিছু বাধানিষেধও এনেছে।
ফেম ২, পিএলআই প্রকল্প জাতীয় উদ্যোগের মত, বৈদ্যুতিক যান নিয়ে ভারতের নির্ধারিত সমস্ত নীতিতেই সবুজ শক্তিতে পরিবর্তনের প্রচেষ্টাটির ছায়া দেখতে পাওয়া যায় এবং রাজ্যের পক্ষ থেকে আর্থিক উৎসাহদান এই কৌশলের মেরুদণ্ড। তবে, বৈদ্যুতিক যান ব্যবহার শুরু করার সম্পূর্ণ সম্ভাবনাটি বুঝতে হলে, নবজাত ব্যাটারি শিল্প, চার্জের অপর্যাপ্ত সুবিধা এবং কয়লা থেকে বিদ্যুৎ তৈরির মত বিষয়গুলিকে সম্বোধন করা প্রয়োজন। তার উপর, ভারতের ক্রেতারা পণ্যের মূল্য নিয়ে যথেষ্ট সচেতন এবং বৈদ্যুতিক যান সাধারণ গাড়ির থেকে সর্বদাই অনেক বেশি দামি।
বৈদ্যুতিন যান ব্যবহার শুরু করার সম্পূর্ণ সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য, স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ (এসএমই)-এর থেকে সহায়তা পাওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বৈদ্যুতিক যান নির্মাণে প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশের সরবরাহ শৃঙ্খলকে আরও সুদৃঢ় করার জন্য, এই এসএমই, যা ভারতের যানবাহন সেক্টরের বেশ বড় একটা অংশ জুড়ে আছে, তার উদ্দেশ্যে উপযুক্তভাবে নির্মিত আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন। যানবাহন শিল্পের পরিকাঠামোতে ও নীতির পরিবেশের মধ্যে পার্থক্যের কারণে, ব্রাজিল, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার মত উদীয়মান অর্থনীতির পক্ষে চিনের সবুজ শিল্পকেন্দ্রিক নীতিগুলিকে অনুসরণ করায় নানা সমস্যা আছে। দক্ষিণ আমেরিকার গাড়ির যন্ত্রাংশ জোড়ার কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে ব্রাজিল, যেখানে একটি সুবিশাল যানবাহন শিল্পের অস্ত্বিত্ব আছে, যা বিদেশী আসল উপকরণ নির্মাণ বা ওরিজিনাল ইক্যুইপমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার (ওইএম)-এর দ্বারা প্রভাবিত। দক্ষিণ আফ্রিকার ক্ষুদ্রতর শিল্পগুলি ইউরোপে রপ্তানির উপর বেশি মনোযোগ দেয় এবং তার জন্য, এই দেশ মূলত আমদানিকৃত উপাদানের সাহায্য নেয় ও দেশজ উদ্ভাবনের উপর যৎসামান্যই নির্ভর করে। এই তিন দেশের মধ্যে, ৭০ শতাংশ রাজস্ব উৎপাদনকারী দেশীয় কারখানাসহ, ভারতেরই সব চেয়ে শক্তিশালী যানবাহনের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানের সেক্টর আছে (প্রাথমিকভাবে আইসিই)।
ভারতে ইভি ব্যবহার শুরু করার গতিপথটি, জটিল আকরিক দ্রব্য, প্রযুক্তি ও অর্থ সাহায্য প্রাপ্তির সুযোগ সহ ভূ-রাজনীতির উপরেও নির্ভর করে। এই পরিবর্তনটি যাতে কার্বনমুক্তকরণের বৃহত্তর লক্ষ্যের সঙ্গে একই সারিতে দাঁড়াতে পারে তা নিশ্চিত করার জন্য নীতি, শিল্প ও আকাদেমিয়া জুড়ে সঙ্ঘবদ্ধ প্রচেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় সম্পদ ও প্রযুক্তি নিশ্চিত করার জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতারও প্রয়োজন। এই প্রশ্নগুলিকে সম্বোধন করতে পারলে, তবেই ভারত নিজেকে বিশ্বজোড়া টেঁকসই চলমানতার প্রতি পরিবর্তনের নেতৃত্বের স্থানে নিজেকে নিয়ে যেতে পারবে।
সারা পৃথিবী জুড়ে বৈদ্যুতিক যানের ভূচিত্রটির বিবর্ধনের সঙ্গে সঙ্গে, ভারতীয় নীতিগুলিকে তাৎক্ষণিক আর্থিক সহায়তা ও দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্যের মধ্যে একটি ভারসাম্য আনতে হবে। চিনের বাজার দখলের কৌশল, আমেরিকার আর্থিক উৎসাহদানের কাঠামো ও ইইউ-এর নিয়ন্ত্রণমূলক পরিকাঠামো থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে, একটি প্রতিযোগিতামূলক ও টেঁকসই ইভি বাস্তুতন্ত্রের নির্মাণের জন্য, ভারত তার নির্ধারিত নীতিগুলির পরিমার্জনা করতে পারে। ভারতের বৈদ্যুতিক সচলতাময় ভবিষ্যতের জন্য, পরিকাঠামোতে কৌশলগত বিনিয়োগ, বিশ্বের অন্যান্য ওইএম-এর সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা এবং স্থানীয় উদ্ভাবনের পৃষ্ঠপোষকতা অতি প্রয়োজন। ভারত যখন তার নির্ধারিত নীতিগুলিকে পরিমার্জনা করে চলবে, তখন অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও পরিবেশের স্থায়িত্বকে সহায়তা দেওয়ার জন্য, এই শিক্ষাগুলিকে কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব হবে।