ডিজিটাল সরকারী পরিকাঠামো এবং ভারতের “অল্ট বিগ টেক” বা “বিকল্প বৃহৎ প্রযুক্তি”-র বিপদ

10/06/2024
IiT English Page

বর্তমানে সারা বিশ্বে ডিজিটাল পরিবর্তনের যে সন্ধান চলছে, সেই প্রক্রিয়াটির নতুন সমর্থক হিসেবে ডিজিটাল পাবলিক ইনফ্রাস্ট্রাকচার (ডিপিআই) উঠে এসেছে। ডিপিআই, অর্থাৎ ডিজিটাল পরিচয় ও ডিজিটাল মাধ্যমে অর্থের আদানপ্রদানের মত ক্ষেত্রে সামাজিক স্তরে যে ডিজিটাল উপাদানগুলি কাজ করে, তাকে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য পূরণের জন্য উচ্চ-প্রভাবযুক্ত উদ্যোগ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চিহ্নিত করেছে। “অগ্রণী” বা “ ফার্স্ট-মুভার” দেশগুলি এবং দাতা গোষ্ঠীগুলি ৫০-ইন-৫ প্রচারণার মত উদ্যোগের মাধ্যমে ডিপিআই ব্যবস্থা ব্যবহার করতে উৎসাহ দেওয়ার লক্ষ্য নিয়েছে। এই প্রচারণাটির উদ্দেশ্য হল, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে (২০২৮ সাল নাগাদ) ৫০টি দেশে ডিপিআই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে উৎসাহ দেওয়া। এর জন্য যে সব যন্ত্রপাতি ও নিয়মাবলী সহ পুস্তিকার প্রয়োজন, সেগুলি প্রচুর পরিমাণে ও খুবই সহজে পাওয়া যায়।   

ডিপিআই ব্যবস্থার শুরুতেই যে দেশগুলি তা গ্রহণ করেছিল, তার মধ্যে একজন ও এই ব্যবস্থার সোচ্চার সমর্থক হিসেবে, ভারত এই কাহিনীতে যথেষ্ট বড় একটি ভূমিকা পালন করেছে। ২০২৩ সালের জি২০ সমাবেশে ভারতের সভাপতির পদলাভের ঘটনাটি বিশ্বের নেতৃস্থানীয় অর্থনীতিগুলিকে জাগিয়ে তুলেছে। এবং এর ফলে, এই দেশগুলি ডিপিআই-এর তাৎপর্য এবং সহনশীলতা, উদ্ভাবন এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের মত বিষয়গুলির লালনের ক্ষেত্রে ডিপিআই-এর ভূমিকার বিষয়ে ঐক্যমত হয়েছে। এই প্রেক্ষিতে, ডিজিটাল সনাক্তিকরণের জন্য ভারতে যে আধার ব্যবহৃত হচ্ছে এবং ইউনাইটেড পেমেন্টস ইন্টারফেজ (ইউপিআই) ও সম্প্রতি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ডেটা পরিচালনার জন্য যে অ্যাকাউন্ট অ্যাগ্রেগেটর কাঠামোর প্রয়োগ হচ্ছে, সেই উদ্যোগগুলির বিষয়ে ভারতের অভিজ্ঞতাকেই ডিপিআই-এর ব্যবহার হিসেবে বর্ণনা করা হয়। “মুক্ত” অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রামিং ইন্টেরফেজের (এপিআই) প্রমিতকরণের ধারনাকে ঘিরে এই রকম একগুচ্ছ মাধ্যমকে সম্মিলিতভাবে “ইন্ডিয়া স্ট্যাক” হিসেবে বর্ণনা করা হয়। 

“স্ট্যাক ইজ দ্য নিউ ব্ল্যাক?” এভোলিউশন অ্যান্ড আউটকামস অফ দি ‘ইন্ডিয়া-স্ট্যাকিফিকেশন’ প্রসেস” নামে সাম্প্রতিক একটি গবেষণাপত্রে ইন্ডিয়া স্ট্যাক, যা একটি শিল্পের থিঙ্ক ট্যাঙ্কদের কল্পনা হিসেবে এককালে শুরু হয়েশেষ পর্যন্ত ভারতের ডিজিটাল পরিবর্তনের সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতার ক্রমবিকাশকে অনুসরণ করেছি। সাধারণভাবে, এই স্ট্যাকে চারটি স্তর আছে বলা হয়। এই চারটি স্তর হল, উপস্থিতি-হীন, কাগজ-হীন, অর্থ-হীন, এবং সম্মতি, এবং প্রতিটি স্তরেই একাধিক ডিপিআই সমাধানের উপস্থিতি দেখা যায়। উপরে যে উদাহরণগুলির উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলি ছাড়াও, ইন্ডিয়াস্ট্যাক.গ্লোবাল, যা ডিপিআই-এর আন্তর্জাতিকীকরণের জন্য ভারতের ভাষণের একটি অংশ, সেটি দীক্ষা (অনলাইন শিক্ষাদানের মাধ্যম), ডিজিলকার (নথির শংসাপত্রদান ও ব্যবস্থাপনা) এবং আরোগ্যসেতুর (কোভিডের ছোঁয়াচের চিহ্ন সন্ধান) মত অ্যাপ্লিকেশনকে ইন্ডিয়া স্ট্যাকের কয়েকটি উপাদান হিসেবে তালিকাভুক্ত করে।   

ডিপিআই নিয়ে বিশ্বজনীন আলোচনা এই ধরণের মাধ্যমের নকশায় অন্তর্ভুক্তি, নিরাপত্তা, সহনশীলতা, আস্থা এবং দায়িত্ববোধের প্রত্যাশাকে সামনে তুলে ধরে। এই মানগুলির (এবং সেগুলির পরিতুষ্টির মূল্যায়ন) বিশদ ব্যাখ্যান, যদিও, অধিকাংশ সময়ই কোনও রকম স্বাধীন নিয়ন্ত্রণকারীর তদারকি ছাড়াই দেশের আভ্যন্তরীণ বাস্তবায়নকারী সংস্থার হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। ভারতের ক্ষেত্রে, ডিজিটাল পরিকাঠামোর বিস্তারের জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলপ্রয়োগ নাগরিকদের পক্ষে সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে বলে দেখা যাচ্ছে। যাঁদের আধার নেইসরকারের নির্দেশে, তাঁদের পরিষেবা ও জনকল্যাণমূলক সহায়তা দান বন্ধ করতে দেওয়া থেকে শুরু করে আয়ুষ্মান ভারত ডিজিটাল মিশনের (এবিডিএম) অধীনে নতুন ডিজিটাল স্বাস্থ্য পরিচয়পত্রের জন্য আবেদন করতে বাধ্য করার জন্য পঞ্চায়েতকর্মী ও কম্যুনিটি স্বাস্থ্যকর্মীদের দ্বারা পরিচালিত প্রচারণা পর্যন্ত বিভিন্ন উদাহরণের কথা উল্লেখ করা যায়।       

আধার, এবিডিএম, আরোগ্য সেতু এবং ডিজিলকারের মত প্রকল্প একটা নির্দিষ্ট ধরণের ডিপিআই-ভিত্তিক প্রশাসনের আদর্শ, যেখানে এই পরিকাঠামো সরাসরি সরকারের মালিকানাধীন এবং তার দ্বারা পরিচালিত। এই জাতীয় প্রকল্পে বেসরকারী ক্ষেত্র একমাত্র তখনই প্রবেশ করে যখন প্রযুক্তিগত উন্নয়ন প্রক্রিয়ার জন্য বাছাই করা ব্যক্তি ও ব্যবসার সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি হয় ও এই প্রক্রিয়াগুলির ব্যবহারকারী হিসেবে তাদের নিয়োগ করা হয়। যেমন, অর্থের লেনদেন ভিত্তিক ব্যবসাগুলির দ্বারা আপনার ক্রেতাকে জানুন বা নো-ইয়োর-কাস্টমার সমীক্ষার জন্য আধার-নির্ভর প্রমাণীকরণের এপিআই ব্যবহার বা এবিডিএমের আনুকূল্যে হাসপাতাল ও রোগনির্ণয় কেন্দ্রগুলির মধ্যে তথ্যের আদানপ্রদান সম্ভব হওয়ার প্রস্তাব 

দ্বিতীয় আদর্শে, সরকার ডিপিআই-এর প্রচারক বা অনুমোদক হিসেবে কাজ করেন, কিন্ত এ ক্ষেত্রে একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন শিল্পের অধীনস্থ করপোরেট এই ডিপিআই-এর মালিক। উদাহরণ হিসেবে, দি ন্যাশনাল পেমেন্টস করপোরেশান অফ ইন্ডিয়া (এনপিসিআই), যা ইউপিআই সহ অন্যান্য অনেক অর্থ-পরিশোধ প্রক্রিয়ার স্বত্বাধিকারী, তার কথা উল্লেখ করা যায়। এনপিসিআই-এর শেয়ার পাবলিক সেক্টর আন্ডারটেকিং বা সরকারী মালিকানাধীন কর্পোরেশন সহ নানা  ব্যাঙ্ক ও অর্থের লেনদেনকারী সংস্থার দ্বারা নির্মিত একটি গোষ্ঠীর হাতে আছে, কিন্তু সরকার নিজে একজন শেয়ারহোল্ডার নন। দেশে ই-কমার্সকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য তৈরি করা ওপেন নেটওয়ার্ক ফর ডিজিটাল কমার্স (ওএনডিসি) এই একই আদর্শ অনুসরণ করে। বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রকের দ্বারা প্রচারিত হলেও, ওএনডিসি আসলে নানা বেসরকারী সংস্থার যৌথ মালিকানাধীন, যা আসলে ব্যাঙ্ক ও  অন্যান্য অর্থের লেনদেন-কেন্দ্রিক সংগঠনের সম্মেলনে নির্মিত একটি গোষ্ঠী। প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য হিসেবে পণ্যের গুণমান নির্ধারক ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও একটি ডিজিটাল সমাধানকারী সংস্থা এই সম্মিলনে অঙ্গ। 

২০১১ সালে, ইন্ডিয়া স্ট্যাকের প্রবক্তা নন্দন নিলেকানির নেতৃত্বে, টেকনোলজিকাল অ্যাডভাইসরি গ্রুপ ফর ইউনিক প্রোজেক্টস-এর (টিএজিইউপি) থেকে “জনকল্যাণের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণ করবে এমন বেসরকারী সংস্থ”-র হাতে ডিজিটাল পরিকাঠামোর মালিকানা তুলে দেওয়ার পরিকল্পনাটি উঠে আসে। এনপিসিআই ও ওএনডিসি-র জনকল্যাণমূলক উদ্দেশ্যের পর জোর দেওয়ার অনেকগুলি পন্থার মধ্যে একটি হল “লাভের জন্য নয়” এমন একটি কাঠামো গ্রহণ করা। এই “লাভের জন্য নয়” বিষয়টির অর্থ হল, এই সংস্থাগুলি যা রোজগার করবে, তা সদস্যদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা করা যাবে না, এই লাভের অর্থ, বরং, ওই সংস্থার কাজকর্মের জন্য পুনরায় বিনিয়োগ করা হবে। শেয়ারহোল্ডারদের ভাগের মুনাফা যে শুধু এইভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় তা নয়, মালিকানার এই আদর্শে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কাজটি অনেক দক্ষভাবেও হয়, এবং নিয়োগ ও ক্রয়ের প্রক্রিয়া, সরকারী সংগঠনের থেকে অনেক বেশি নমনীয় হয়। তবে, এই সুবিধারগুলির পাশাপাশি কিছু অসুবিধাও আছে এবং তা হল তুমুল প্রতিযোগিতা এবং পরিচালনা-কেন্দ্রিক সমস্যা যা আদতে এই পরিকাঠামোরই ফলাফল। 

বাজার-সম্পর্কিত প্রেক্ষিতে ভারতের ডিপিআই সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা থেকে দুই ধরনের প্রতিযোগিতা-মূলক প্রভাব তৈরি করেছে। ইতিবাচক হিসেবে ব্যাপকভাবে প্রচারিত প্রথম প্রভাবটি হল, সিস্টেমের অংশীদারদের মধ্যে আন্তঃকার্যক্ষমতার মাধ্যমে প্রতিযোগিতা সম্ভব করা। এই আন্তঃকার্যক্ষমতার কারণেই আইসিআইসিআই ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট আছে এমন একজন গুগলপে-র মাধ্যমে এসবিআই-তে অ্যাকাউন্ট আছে এমন একজন পেটিএম ব্যবহারকারীকে মুহূর্তের মধ্যে অর্থ পাঠাতে সক্ষম হন। একইভাবে, ওএনডিসি এমনভাবে ই-কমার্স মান-শৃঙ্খলকে অসংখ্য ক্ষুদ্রতর লেনদেনে বিভক্ত করতে চাইছে, যা বিভিন্ন ধরনের অংশীদারের দ্বারা সঞ্চালিত হতে পারে। এই পদক্ষেপের উদ্দেশ্য হল, অ্যামাজন ও ফ্লিপকার্টের মত নির্দিষ্ট নেটওয়ার্কের যে কুঠুরিতে ব্যবহারকারীদের আটকে রাখার প্রচেষ্টা চলে, তাকে ভেঙে ফেলা, এবং তা করার সময় আন্তঃকার্যক্ষমতা ও প্রতিযোগিতাকে সহজতর করে তোলা

তবে, ডিপিআই-এর বিস্তারের অভিজ্ঞতা থেকেই দ্বিতীয় প্রশ্নটি উঠে আসে। এই যে হস্তক্ষেপগুলি প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে এত প্ররোচনা দেয়, তা কি, অবকাঠামোগত একাধিপত্যের কারণে, সেই প্রতিযোগিতারই ক্ষতি করছে না? এই বিষয়ে আলোচনাগুলি ২০২২ সালে আমি আমার একটি গবেষণাপত্রের উপর ভিত্তি করে তৈরি করেছি। এই গবেষণাপত্রে আমি বলেছি যে, ভারতের ডিজিটাল পরিকাঠামোগত নির্বাচনগুলি থেকে বোঝা যায় যে একটি নতুন ধরনের “অল্ট বিগ টেক” বা “বিকল্প বৃহৎ প্রযুক্তি”-র উত্থান হচ্ছে। এই পরিকাঠামো, তাদের ডেটা সংগ্রহের সুবিধা, গেটকিপিং বা তথ্যের সঞ্চলনের আগে সেগুলিকে শোধনের কাজ, যে প্রযুক্তিগত আদর্শকে সমস্ত নেটওয়ার্ক অংশীদারদেরই অনুসরণ করতে হবে, তাকে নিয়ন্ত্রণ করার মত সব বিষয়ের উপরেই রাষ্ট্র-পোষিত একাধিপত্যের ধারনাকে তুলে ধরতে এই পরিভাষাটিকে গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি উপাদানবৃহৎ প্রযুক্তিগত শিল্প থেকে যে সমস্যাগুলি উঠে আসে সেগুলিকে মনে করায়, যদিও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যের দিক থেকে দেখলে, এই দুটি গোষ্ঠীই সম্পূর্ণ আলাদা।       

টিএজিইউপি পরিষদ লক্ষ্য করেছেন যে, ডিজিটাল পরিকাঠামোর চালক, যেগুলিকে তাঁরা জাতীয় ন্যাশনাল ইউটিলিটি বলে অভিহিত করেছেন, সেগুলি “পূর্বের নিমজ্জিত ব্যয় বা সাঙ্ক কস্ট, ইকোনমিজ অফ স্কেল (কোনও সংস্থার উৎপাদন বেড়ে গেলে, পণ্যের প্রতি এককের পিছনে ব্যয় কমে যায়) এবং আশেপাশের ইকোসিস্টেম থেকে গড়ে ওঠা নেটওয়ার্ক এক্সটার্নালিটি (কোনও পণ্যের চাহিদার বাড়ছে কিনা, তা নির্ভর করে ওই পণ্য ক্রয় করার চাহিদা বাড়ছে কিনা তার উপর) প্রভৃতির কারণে সহজাত একাধিপত্য হিসেবে কাজ করে। সেই অনুযায়ী, এই পরিষদ আন্তঃকার্যক্ষমতা যুক্ত একাধিক প্রতিযোগী তথ্য ইউটিলিটির ভূমিকাকে স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন। কিন্তু ডিপিআই প্রয়োগের রিয়েলপলিটিকই যে আসলে এই ঘটনাকে সম্ভব হতে দেয় না, তা এনপিসিআই-এর বিপরীতে একটি প্রতিযোগী অস্তিত্বকে উপস্থিত করতে অকৃতকার্য হওয়ার ঘটনা থেকেই স্পষ্ট হয়েছে। 

এখনও পর্যন্ত একমাত্র এনপিসিআই-ই একমাত্র রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (আরবিআই) অনুমোদিত সংস্থা যা অর্থ লেনদেনের জন্য একটি সর্বাঙ্গীণ সংগঠন হিসেবে কাজ করে। আরবিআই ২০১৯ সালে এনপিসিআই-এর এক বা একাধিক প্রতিযোগী তৈরি করার সিন্ধান্ত নেয়। অর্থের লেনদেনের বিষয়টি একটি মাত্র সংস্থার উপর কেন্দ্রীভূত হলে পদ্ধতিগত ও ক্রিয়াশীলতাগত ঝুঁকি দেখা দিতে পারে ও একাধিপত্যের প্রবণতাও তৈরি হতে পারে। আরবিআই-এর পরিকল্পনাটির উদ্দেশ্য ছিল এই সমস্যাগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করা। কিন্তু, পাঁচ বছর হয়ে গেছে, আরবিআই এখনও এই পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করে উঠতে পারে নি। আরবিআই এর কারণ হিসেবে জানিয়েছে যে, তারা এই নিয়ে যতগুলি আবেদনপত্র পেয়েছে তার কোনটিই যথেষ্ট সৃজনশীল ছিল না, তাই তারা আর এ বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করছে না। কিন্তু দেশের নাগরিকরা এই অনিচ্ছার আরও অনেক কারণ দর্শিয়েছেন। তাঁদের মতে, এনপিসিআই-এর ক্ষমতাকে ঝুঁকিতে ফেলা থেকে শুরু করে ডিজিটাল লেনদেনের ক্ষেত্রে বৃহৎ প্রযুক্তির উপস্থিতি পর্যন্ত অনেক কিছুই এই প্রতিরোধের পটভূমি হতে পারে।           

ইউপিআই-এর ক্ষেত্রে এনপিসিআই সত্যিই বহু মাইলফলক ছুঁয়েছে। জনপ্রিয়তা ও লেনদেনের সংখ্যার নিরিখে এই পদ্ধতিটির খুবই দ্রুত ও তুমুল বৃদ্ধি হয়েছে। পুনরাবৃত্ত আর্থিক লেনদেনের নির্দেশ বা রেকারিং পেমেন্ট ম্যান্ডেট (অর্থাৎ নির্দিষ্ট সময় অন্তর যে আর্থিক লেনদেন ঘটে থাকে, যেমনের বিদ্যুতের বিল) এনপিসিআই-এর মালিকানাধীন রুপে ক্রেডিট কার্ডের সঙ্গে আন্তঃকার্যক্ষমতার মত অনেক নতুন উপাদানও উঠে এসেছে। অধিকন্তু, গুগল পে-র সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সাম্প্রতিক ঘটনাটি সহ, দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশের লেনদেন প্রক্রিয়ার সঙ্গে ইউপিআই-এর একীভবনের মত উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে।   

তা সত্ত্বেও, ইউপিআই-কেই ভারতের আর্থিক লেনদেন প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে উদ্ভাবনের চূড়ান্ত বিন্দু ভাবলে ভুল হবে। গ্রামাঞ্চলে জনপ্রিয়তা লাভ, ভোক্তা-প্রতারণা, ব্যাঙ্কের সার্ভারের কর্মক্ষমতায় ঘাটতি, নেটওয়ার্কের সমস্যা এবং সর্বোপরি, পণ্যে নতুনত্ব আনার মত অনেক বিষয়েই এখনও বহু কাজ বাকি। এই ফাঁকগুলিকে ভরাট করার জন্য ইউপিআই-এর মধ্যে যে প্রতিযোগিতা-পূর্ণ শক্তি আছে, সেগুলিকে এনপিসিআই-এর আধিপত্যের সঙ্গে কার্যকর প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব সহ সহাবস্থান করতে হবে। 

একটি বৃহৎ প্রযুক্তির অনুরূপ কার্যকলাপকে যে দৃষ্টিতে সাধারণত দেখা হয়, এনপিসিআই-এর পণ্য-পরিষেবা-অভিজ্ঞতা প্রদানের প্রতিশ্রুতির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারমূলক আচরণের মত কাজ এবং গুগলের মত বাজার-অংশীদারদের সঙ্গে আর্থিক বন্দোবস্তের ঘটনাকেও একই দৃষ্টিতে দেখা প্রয়োজন। এনপিসিআই-এর অন্যান্য বাজার-সংক্রান্ত হস্তক্ষেপের ক্ষেত্রেও এই কথাটি সত্য।  এই বাজার-সংক্রান্ত হস্তক্ষেপের কয়েকটি উদাহরণ হল, ইউপিআই অ্যাপগুলির জন্য মার্কেট ক্যাপ (মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন, অর্থাৎ একটি কোম্পানির বকেয়া শেয়ারের মোট বাজার মূল্য) নির্দিষ্ট করা, যার বাস্তবায়ন অসংখ্যবার পিছিয়েছে এবং একজন নতুন প্রবেশকারী কি গতিতে তাঁর ব্যবসাকে প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন, তা স্থির করা। অধিকন্তু, সরকারের পক্ষ থেকে কোন রকম দায়িত্ব না নেওয়া এবং ন্যাবিচারের অনুপস্থিতি, এই জাতীয় পরিকাঠামোর ন্যায্য ব্যবহারের দাবির বিষয়ে উপর সন্দেহে অবকাশ তৈরি করে। এনপিসিআই-এর মত সংগঠনকে, রাইট টু ইনফর্মেশন অ্যাক্ট, ২০০৫-এর অধীনে স্বচ্ছতাপালনের সরকার-নির্দিষ্ট বাধ্যতার আওতার বাইরে রাখা এই ন্যায়বিচারের অনুপস্থিতির একটি উদাহরণ।     

এই সমস্যাগুলি ঠিক ডিপিআই-এর বেসরকারী মালিকানা সংক্রান্ত নয়। প্রতিযোগিতা, প্রশাসন এবং বিশেষ করে এই ধরনের একাধিপত্যের হাতে লালিত নতুন ক্ষমতার পরিকাঠামোর মধ্যে থেকেও দায় নেওয়ার মনোভাবকে রক্ষা করার মত জোর - এই ধরনের অনেক কিছুর অনুপস্থিতিই আসলে এই সমস্যাগুলির জড়। ডিপিআই-এর সামাজিক সচেতনতা ও প্রতিযোগিতা-পন্থী মনোভাবকে শুধু ধরে না নিয়ে, আইন তৈরি ও চর্চার মধ্যে দিয়ে এই বৈশিষ্ট্যগুলিকে যথাযথভাবে বাস্তবায়িত করতে হবে। দেশের যে সংস্থাগুলি এই বাস্তবায়নকে সম্ভব করে, এই পদক্ষেপগুলির মাধ্যমে বিবেচনা করার দায়িত্ব শুধু তাদের উপরে দিলে হবে না। তার পাশাপাশি যে সব আন্তর্জাতিক সংগঠন ও দাতাগোষ্ঠী ডিপিআই-এর অভিমুখে সারা বিশ্বের এই দ্রুত বেগে অগ্রসর হওয়ায় আরও ইন্ধন জোগাচ্ছে, সেগুলির উপরেও অন্তত আংশিক দায়িত্ব থাকা উচিত। 

স্মৃতি পরসিরা

Author

স্মৃতি পরসিরা একজন আইনজীবী এবং জননীতি বিষয়ক গবেষক। তিনি দিল্লির ইন্ডিয়ান ইনস্টিট্যুট অফ টেকনোলজির অন্তর্গত স্কুল অফ পাবলিক পলিসির পিএইচডি গবেষক।

(Bangla Translation by Sritama Halder)
অনুবাদঃ শ্রীতমা হালদার