অর্থনৈতিক বাজারে একটি দেশের মূলধন বৃদ্ধি করার ক্ষমতা তার উপলব্ধ ঋণ গ্রহণের যোগ্যতার সঙ্গে যুক্ত এবং এই ক্ষমতা একটি গুরুত্বপূর্ণ অথচ অপরীক্ষিত বিষয় যা ওই দেশের আর্থিক ও সামাজিক সম্ভাবনাকে নির্ধারণ করে। কোনও দেশের ঋণযোগ্যতা নির্ধারণের জন্য বিনিয়োগকারীরা সাধারণত ক্রেডিট রেটিং-এর উপর নির্ভর করেন। যদি একটি দেশের ক্রেডিট রেটিং তার ক্রেডিট ফান্ডামেন্টালগুলির থেকে কম হয়, যেমন ভারতের সঙ্গে ঘটেছে বলে আমরা জানি, তবে তার অবশ্যম্ভাবী ফলাফল উচ্চতর বরোয়িং কস্ট, যার কারণে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিকাঠামো এবং আবহাওয়ার স্থিতিশীলতার মত ক্ষেত্রে সরকারী ব্যয়ের জন্য কম আর্থিক পরিসর বাকি থাকে।
ক্রেডিট রেটিং করে যে সংস্থাগুলি, সেগুলি একটি দেশের মান নির্ধারণ করে এএএ (উচ্চতম রেটিং) থেকে ডি (নিম্নতম রেটিং) পর্যন্ত। ২০০৬ সাল থেকে ফিচ-এর দ্বারা ও ২০০৭ সাল থেকে এসঅ্যান্ডপি-র দ্বারা ভারতের জন্য নির্ধারিত মূল্য অপরিবর্তনীয়ভাবে বিবিবি- এই আটকে আছে, যা “ইনভেস্টমেন্ট গ্রেড রেটিং”-এর ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন মান (সারণী ১ ও ২ দেখুন) এবং “নন-ইনভেস্টমেন্ট গ্রেড রেটিং”, যা প্রধানত অনুমানমূলক ও ঋণশোধের প্রত্যাশা যার থেকে কমই, তার থেকে মাত্র এক ধাপ উপরে। মুডি’জ-এর করা মূল্য নির্ণয়ের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। ২০১৭ থেকে ২০২০ সাল – এই তিন বছর মুডি’জ ভারতের মান এক ধাপ বাড়িয়ে বিবিবি করলেও, তারপরই তাকে আবার বিবিবি- এ ফিরিয়ে আনে।
ভারতের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক কর্মক্ষমতা বিবেচনা করলে মনে হতে পারে যে, বিগত প্রায় দুই দশক ধরে যে ভারতের ঋণ গ্রহণের যোগ্যতা একই জায়গায় আটকে আছে, তা বিভ্রান্তিজনক। এখানে আমরা, ২০০৬ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ভারতের অর্থনৈতিক ও রাজস্বঘটিত গতিপথের পরিমাপ করে বোঝার চেষ্টা করব যে, ভারতের ক্রেডিট রেটিং-এর উন্নতি সম্ভব কিনা।
মান-নির্ণায়ক সংস্থাগুলি মতে, ক্রেডিট রেটিং তুলনামূলক মর্যাদাক্রমের ঝুঁকির কথা প্রকাশ করে। এর অর্থ একটি দেশের ক্রেডিট রেটিং অন্যান্য দেশের সাপেক্ষে নির্ণিত হয়। তাই আমরা ভারতের (২০০৬ সাল থেকে) অর্থনৈতিক ও রাজস্বঘটিত গতিপথকে গ্রুপ অফ টুয়েন্টি (জি২০) – বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বেপূর্ণ অর্থনীতি সম্পন্ন দেশ জোট যার সদস্য – তার সাপেক্ষে বিচার করব। জি২০-তে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ, যাদের ক্রেডিট রেটিং এএএ থেকে শুরু করে সিসি পর্যন্ত বিস্তৃত, সেরকম সব দেশই আছে, তাই তুলনা করার জন্য এই যৌথটিই সবচেয়ে উপযুক্ত।

অর্থনৈতিক গতিপথঃ অন্যান্য জি২০ দেশের সাপেক্ষে
নমিনাল টার্মে দেখলে, ২০০৬ সালে ভারত ত্রয়োদশ বৃহত্তম অর্থনীতি থেকে উন্নীত হয়ে ২০২৩ সালে পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হয়, যার ফলে ভারতই এখন একমাত্র দেশ এ+ রেটিং এর ঠিক নিচের ধাপে আছে, এমন শীর্ষস্থানীয় পাঁচটি দেশের মধ্যে একটি, এবং একই সঙ্গে, এই দেশ সর্বনিম্ন ইনভেস্টমেন্ট গ্রেডের অধিকারী (নকশা ১ দেখুন)।

রাজস্বসংক্রান্ত গতিপথঃ অন্যান্য জি২০ দেশের সাপেক্ষে
ভারতের দ্রুতবর্ধমান অর্থনৈতিক ক্ষমতাকে স্বীকার করলেও, মূল্য-নির্ণায়ক সংস্থাগুলির বক্তব্য যে, ভারতের ক্ষেত্রে তাঁদের ক্রেডিট রেটিং মূলত বাধা পায় ভারতের দুর্বল রাজস্বসংক্রান্ত মানের কারণে, অর্থাৎ ভারতের সঙ্গে সমান স্তরে আছে এমন দেশগুলির তুলনায় ভারতের ঋণের পরিমাণ এবং ঋণ পরিষেবার মূল্য অনেক বেশি।

উৎসঃ এসঅ্যান্ডপি (মে ২০২৩); মুডি’জ (অক্টোবর ২০২৪); ফিচ (আগস্ট ২০২৪)
উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, ২০২২ সালের তথ্য (সাম্প্রতিকতম প্রাপ্য তথ্য) অনুযায়ী, ভারতের সাধারণ সরকারী ডেট-টু-জিডিপি (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট বা মোট দেশজ উৎপাদন) অনুপাত ৮১.৭ শতাংশ এবং ইন্টারেস্ট-পেমেন্ট-টু-জিডিপি অনুপাত ৫.২ শতাংশ, যা ইন্দোনেশিয়ার (যার রেট বিবিবি) থেকে অনেকটাই বেশি - যথাক্রমে ৪০ শতাংশ ও দুই শতাংশ। তবে, একটি নির্দিষ্ট সময়ে করা তুলনাটি যা অস্বীকার করে তা হল, ২০০৬ থেকে ২০২২ সালের অন্তর্বর্তী সময়ে ভারতের রাজস্বের পরিমাপ অধিকাংশ জি২০ দেশ, যেগুলিতে একটি বা উভয় ক্ষেত্রেই উচ্চতর বৃদ্ধি দেখা গেছে - সেগুলির তুলনায় অনেক স্থিতিশীল ছিল।
২০০৬ এবং ২০২২ সালের মধ্যবর্তী সময়ে জি২০ দেশগুলির ঋণের বোঝা এবং ঋণ পরিষেবার মূল্যের আপেক্ষিক পরবর্তনকে নকশা ২-তে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই নকশা লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, যেহেতু ভারতের ২০২২ সাল ও ২০০৬ সালের ডেট-টু-জিডিপি প্রায় সমান (১.০৫ গুণ) ছিল, তাই ভারত মধ্যবিন্দুর খুবই কাছাকাছি অবস্থিত। একই জিনিস দেখা যায় ইন্টারেস্ট-পেমেন্টস-টু-জিডিপি-র ক্ষেত্রে (২০০৬ সালে ০.৯৭ গুণ)। এর তুলনায়, অধিকাংশ জি২০ দেশের ঋণের অনুপাত অনেক বেশি (নিচের ডানদিকের চতুষ্কোণ) বা ঋণ পরিষেবা (উপরের বামদিকের চতুষ্কোণ) বা উভয়ত (উপরের ডানদিকের চতুষ্কোণ)। উভয় ক্ষেত্রে নিম্ন অনুপাত মাত্র তিনটি দেশের (নিচের বামদিকের চতুষ্কোণ) ক্ষেত্রে দেখা যায়।

তবুও, বলা যেতে পারে যে, ২০২২ সালে ভারতের রাজস্বঘটিত পরিমাপকে ২০০৬ সালের সঙ্গে তুলনা করা গেলেও, এই দুই বছরের মধ্যবর্তী সময়ে অনেকটাই অস্থিরতা থাকতে পারে, যার কারণ হতে পারে রাজস্বঘটিত অব্যবস্থাপনা। এই প্রশ্নটিকে পরীক্ষা করার জন্য নকশা ৩-এ জি২০-র কয়েকটি নির্দিষ্ট সদস্য দেশে এই সময়কালের (২০০৬-২২) জিডিপি, মোট সরকারী ঋণ এবং প্রদত্ত সুদের প্রবণতার মধ্যে তুলনা করা হয়েছে।
তালিকাগুলি থেকে জানা যায় যে, ভারতের ঋণ ও সুদ প্রদানে বৃদ্ধির হার প্রতি বছরই জিডিপি-র সঙ্গে প্রায় সমান তালে বাড়ছে। চিনের ক্ষেত্রে, ওই একই সময়কালে, ঋণ ও সুদের অর্থ প্রদানের হার জিডিপি-র থেকে দ্রুততর তালে বাড়ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে, ২০০৮ সালের পর থেকে ঋণের বাড় জিডিপি-র থেকে বেশি দ্রুত এবং ২০২১ সালের পর সুদের অর্থ প্রদানের বৃদ্ধির হার জিডিপি-র থেকে বেশি।
অধিকাংশ জি২০ দেশের ঋণের স্তর জিডিপি-র চেয়ে অনেক দ্রুত বেড়েছে। তবে, ২০০৮ সালের গ্লোবাল ফাইনান্সিয়াল ক্রাইসিসের পর উন্নত অর্থনীতি সম্পন্ন দেশগুলি প্রায় শূন্য সুদের হার থেকে উপকৃত হয়েছে, এবং আরও ধার করার জন্য ওই দেশগুলির খরচও তাই অনেক কম হয়েছে। ২০০৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত উন্নত অর্থনৈতিক সম্পন্ন দেশগুলির জন্য, ঋণ ও জিডিপি-র স্তর বেড়ে যেতে থাকলেও, ঋণ পরিষেবার খরচ অনেকটাই কমে যেতে দেখা যায়, যার ফলে ঋণের স্থিতিশীলতার একটা বিভ্রম তৈরি হয়েছিল। ২০২১ সালে সুদের হার বৃদ্ধির চক্রটির কারণে সুদ প্রদানের পরিমাণও বেড়ে যায় ওই দেশগুলিতে, এবং কয়েকটি ক্ষেত্রে, এই পরিমাণ জিডিপি-র-র উন্নতির প্রায় সমান সমান ছিল। এর সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে যে, ভারতের ঋণ পরিষেবার খরচ জিডিপি-কে ছাড়িয়ে যায় নি, যদিও সুদের হার শূন্যের চেয়ে অনেকটাই বেশি ছিল এবং তার ক্রেডিং রেটিং অপরিবর্তিতই থেকে গেছিল।
উন্নত দেশগুলিতে যা ঘটেছিল, অর্থাৎ সুদের হার প্রায় শূন্যে নেমে যাওয়ার মত বিলাসিতা যে ভারত উপভোগ করতে পারে নি শুধু নয়, সঙ্গে সঙ্গে নতুন ঋণের বোঝাও তার উপর চেপেছে। তা সত্ত্বেও, ২০০৮ সালের গ্লোবাল ফাইনান্সিয়াল ক্রাইসিস, ২০১৩ সালের টেপার ট্যান্ট্রাম (কোয়ান্টিটেটিভ ইজিং-এর পদক্ষেপগুলিকে সংক্ষিপ্ত করার উদ্দেশ্যে ইউএস ফেডারাল রিজার্ভ নেওয়া সিদ্ধান্তের ফলে মূলধনের অতিপ্রাচুর্য), এবং ২০২০ সালের কোভিড-১৯ অতিমারীর কারণে ঘটা অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও, ভারত তার বার্ষিক সুদ প্রদানকে তার ঋণ ও জিডিপি-র উন্নতির সঙ্গে আনুপাতিক হারে পরিচালনা করতে পেরেছে। এই ঘটনা একাধিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চক্র জুড়ে অভূতপুর্বভাবে স্থিতিশীল রাজস্বসংক্রান্ত কার্যকলাপের দিকে চিহ্নিত করে।
নকশা ৩: নির্দিষ্ট কয়েকটি দেশের জিডিপি ও ঋণ পরিমাপের গতিপথ

অন্যান্য উপাদান
এইক্ষেত্রে একটি প্রত্যাশিত সমালোচনা হল যে, অর্থনৈতিক ও রাজস্বসংক্রান্ত বিষয় ছাড়াও, ক্রেডিট রেটিং আরও অন্যান্য অনেক উপাদানের সঙ্গেই জড়িত। যেমন, বহিঃস্থ অভিঘাতের মুখে একটি দেশের দুর্বলতা বা আর্থিক নীতির কার্যকারিতার মত নানা বিষয়গত উপাদানের কথা উল্লেখ করা যায়।
উল্লেখযোগ্য যে, ২০১৫ সালে, ভারত মুদ্রাস্ফীতিকে নিশানা করে এমন একটি পরিকাঠামো নির্মাণ করে, যা আট শতাংশের ঐতিহাসিক গড় (২০০৬-২০১৫) থেকে মুদ্রাস্ফীতিকে কমিয়ে, উত্তর-মুদ্রাস্ফীতির পুরো সময়কালের পাঁচ শতাংশ গড়ে নামিয়ে আনে (২০১৬-২৩)। কারেন্ট-অ্যাকাউন্ট-ডেফিসিট-টু-জিডিপি যেহেতু ২.৪ শতাংশের গড় (২০০৬-১৫) থেকে কমে ১.১ শতাংশ হয়েছে, তাই বহিঃস্থ ঝুঁকির সম্ভাবনাও উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। এই বিষয়টি আরও প্রমাণিত হয় যখন দেখা যায় যে, ২০০৬ সালের সঙ্গে তুলনায় ভারতের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় চার গুণ বেড়ে গেছে এবং ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে ভারতের হাতে ছিল ৭০৪.৯ বিলিয়ন ইউএস ডলার, যা কিনা বিশ্বে চতুর্থ বৃহত্তম সঞ্চয় (স্বাধীন মাননির্ণয়ের পরিভাষায় হিসেব অনুযায়ী, জাপান, স্যুইজারল্যান্ড ও চিনের পরেই) এবং এই পরিমাণের অর্থ দশ বছরের বেশি সময় ধরে আমদানির জন্য যথেষ্ট।
আরেকটি যে বিষয়ের বিবেচনা করা দরকার তা হল, সরকারি ঋণের জন্য কোন মুদ্রার ব্যবহার হচ্ছে। ভারত সরকারের ঋণ মূলত আন্তর্দেশীয় মালিকানাধীন, দীর্ঘস্থায়ী ও ভারতীয় মুদ্রায় নেওয়া (অর্থ মন্ত্রণালয় হিসেব অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুন মাসের শেষ পর্যন্ত ৯৪.৯ শতাংশ), যা ঋণের পরিষেবার ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রা ও সুদের হার সংক্রান্ত ঝুঁকি অনেকটাই কমিয়ে দেয়।
উপসংহার
মান-নির্ণায়ক সংস্থাগুলি ভারতের রাজস্বসংক্রান্ত পরিমাপের মূল্য তুলনামূলকভাবে উচ্চহারে নির্ণয় করলেও, তিনটি রাজনৈতিক চক্র (পাঁচ বছর ব্যাপী) ও দুটি অর্থনৈতিক চক্রসহ (যার মধ্যে আছে তিনটি সঙ্কটকাল) গত উনিশ বছরের মধ্যে ঋণ সংক্রান্ত চাপের কোনও চিহ্ন দেখা যায় নি। একই সঙ্গে, বহিঃস্থ অভিঘাতের মুখে ভেঙে পড়ার মত ঘটনা কম ঘটছে ও তার পাশাপাশি এই দেশের দ্রুত উন্নয়নও ঘটেছে। অথচ, এই সময়কালেই নিম্নতম ইনভেস্টমেন্ট গ্রেডের স্তরে ভারতের যা ক্রেডিট রেটিং, তা অপরিবর্তিতই থেকে গেছে।
ভারতের ক্রেডিট রেটিং-কে উন্নত করার ক্ষেত্রে মান-নির্ণায়ক সংস্থাগুলির অনিচ্ছা ক্রমশ্য দুর্বোধ্য হয়ে উঠছে। এ কথা সত্যি যে, কিছু সমকক্ষ দেশের থেকে ভারতের ঋণের পরিমাণ সত্যি অনেকটা বেশি, কিন্তু গত দুই দশকে ভারতের তুলনামূলক অর্থনৈতিক কার্যকলাপ এবং রাজস্বসংক্রান্ত সংযম কিছুটা অন্তত স্বীকৃতি দাবি করে, যা আদতে ভারতের ক্রেডিট রেটিং-এর উন্নতির পক্ষেই যায়।