গত দশক জুড়েই, আরও দক্ষভাবে বিতরণ করার উদ্দেশ্য নিয়ে, ভারতের জনকল্যাণমূলক কার্যক্রমগুলি বিস্তার লাভ করছে। মূলত, এর অর্থ হল যে, কোনও একটি জনকল্যাণমূলক কার্যক্রমের লাস্ট মিনিট ডেলিভারি বা এই সুবিধাকে গ্রহীতার হাতে পৌঁছে দেওয়ার শেষ ধাপটির উন্নতিসাধনের জন্য রাজনীতিবিদরা প্রযুক্তি-সক্ষম সমাধানের উপায় সন্ধান করছেন, যাতে কোনও রকম বিভ্রাট, গোপনীয়তা এবং পক্ষপাতের ঘটনা না ঘটে। দি ইকনোমিস্ট হিসেব দিয়েছে যে, প্রায় তিনশটি পরিকল্পনা, যা ৯৫০ বিলিয়ন মানুষের উপকারে আসে, এই “হাই-টেক জনকল্যাণমূলক নিরাপত্তা জাল”-টির অন্তর্গত। এই গ্রহীতাদের মধ্যে অধিকাংশই দরিদ্র এবং সরকারী ব্যয়ের তিন শতাংশ জিডিপি বা স্থূল আভ্যন্তরীণ উৎপাদনের খতিয়ান দেয়। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বিশ্বাস করেন যে, নিয়মের উপর নির্ভরশীলতা, সরাসরি হস্তান্তরের সুযোগ এবং জিএএম (জন ধন ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, আধার বায়োমেট্রিক সনাক্তকরণের পদ্ধতি, এবং মোবাইল ফোন)-এর ব্যবহারের উপর জোর দেওয়ার মাধ্যমে এই “নব্য জনকল্যাণবাদ” রাজনৈতিক দলগুলির জন্য ভোট ও রাজনৈতিক সমর্থন জয় করতে সক্ষম হয়েছে।
কিন্তু, অনেকেই যেমন ধরে নেন যে, সুদক্ষ কল্যাণবাদ রাজনৈতিক সাফল্য এনে দেয়, তা কি সত্য? জনকল্যাণমূলক পরিকল্পনার প্রভাব দুটি পরস্পর-সংযুক্ত প্রশ্নের উপর নির্ভর করেঃ রাজনীতিবিদরা যে সুযোগ সুবিধাগুলি দিয়ে থাকেন, তার জন্য কি ভোটদাতারা তাঁদের পুরস্কৃত করেন? এবং ঠিক কোন ভাবে এই সুবিধাগুলি তাঁদের হাতে পৌঁছচ্ছে, তা নিয়ে ভোটদাতারা কি খুব মাথা ঘামান? অন্যভাবে বলতে গেলে, দুর্নীতি ও পক্ষপাত কমাতে সক্ষম হয় এমন দক্ষ বাস্তবায়নকে কি ভোটদাতারা পুরস্কৃত করেন?
অনেক সময়ই, শাসনপদ্ধতিতে সংশোধন এনে গোপনীয়তা ও পক্ষপাতের ঘটনা হ্রাস করে চুরি ও দুর্নীতি কমানর চেষ্টা করা হয়। এই ধরনের প্রচেষ্টা ধরেই নেয় যে, জনগণ দুর্নীতিকে ঘৃণা করেন। অথচ, পরিবার, আত্মীয়স্বজন ও নিজের জাতির সদস্যদের কাছ থেকে ক্রমাগত পক্ষপাতদুষ্ট সুবিধা প্রত্যাশা করার এবং রাষ্ট্রের কাছ থেকে সুবিধা চুরি করার অসংখ্য উদাহরণ আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতাতেই আছে। কাতিয়াবাজ ছবিটির মত নানা চলচ্চিত্রে এই দ্বিতীয় ঘটনাটির কৌতুকপূর্ণ চিত্রায়ন দেখা যায়। প্রথমটি, অর্থাৎ পক্ষপাতের বিষয়টি আমাদের দেশের জাতি-ভিত্তিক রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রশ্নাতীতভাবে দেখা যায়। আমার দুই বছরের ফিল্ডওয়ার্কের অভিজ্ঞতায়, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ ও সাধারণ ভোটদাতাদের অনেক সময়ই এই প্রত্যাশাকে “ইনি আমাদেরই একজন, আমাদের জন্য কিছু করবেনই” বলে বর্ণনা করতে শুনেছি। একজন রাজনীতিবিদ যেমন এই মনোভাবের সংক্ষিপ্তসার করেছেন এইভাবে, “জাতির স্বার্থ ব্যক্তির নিজের বস্তুগত স্বার্থের সঙ্গে জড়িত।”
তাহলে, এই কার্যকর বাস্তবায়ন এবং জাতিগত, রাজনৈতিক এবং ভৌগলিক দিক থেকে পক্ষপাতের নানা উদাহরণের মধ্যে যে আপস ঘটে, তার পরিপ্রেক্ষিতে ভোটদাতারা ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে আছেন? আমার বক্তব্য হল, আমার গবেষণার থেকে প্রমাণ পেয়েছি যে, ভালভাবে সম্পাদিত কাজকে ভারতের ভোটদাতারা পুরস্কৃত করেন, কিন্ত কার্যকারী বাস্তবায়নের চেয়ে ফলাফলের উপরেই তাঁরা অনেক বেশি মনোযোগ দিয়ে থাকেন। ভোটদাতারা দক্ষতার উপর খুবই সামান্যই গুরুত্ব আরোপ করেন। আমাদের খবরের কাগজগুলি যে ছবিই আঁকুক না কেন, শাসনব্যবস্থায় সংশোধন (বিশেষত, উত্তমতর বাস্তবায়ন)-এর জন্য ভোটদাতাদের আগ্রহ খুবই সীমিত বলে মনে হয়।
বন্টনসংক্রান্ত নীতির বিষয়ে বিবিধ গবেষণা
এই প্রশ্নগুলিকে সম্বোধন করার জন্য আমি একটি অনলাইন সমীক্ষা (১,০৪৭ জন ভোটদাতাদের মধ্যে) এবং সিভোটার ইন্ডিয়ার মাধ্যমে জাতীয় স্তরে বারোটি ভাষায় একটি দূরভাষ সমীক্ষা (৫,৩৫০ জনের মধ্যে) পরিচালনা করি। প্রতিটি সমীক্ষাতেই, হয় ভারপ্রাপ্ত শাসকদলের কাজকর্মের বিষয়ে নেতিবাচক তথ্য এবং এই সরকারের দ্বারা চালিত কোনও একটি জনকল্যাণমূলক পরিকল্পনা সম্পর্কে ইতিবাচক তথ্য অথবা দুর্নীতির ঘটনা কমানর জন্য সরকার যে পদক্ষেপগুলি নিয়েছেন, তার উপর জোর দেয় এমন একটি জনকল্যাণমূলক পরিকল্পনার বিষয়ে ইতিবাচক তথ্য পাঠ করার জন্য ভোটদাতাদের এলোমেলোভাবে নির্বাচন করা হয়।
নেতিবাচক বর্ণনাগুলি ঐতিহাসিক কর্মহীনতার ঘটনা, জ্বালানীর মূল্যে অতিমাত্রায় স্ফীতি এবং উপার্জনের ক্রমবর্ধমান অসমতার দিকে নির্দেশ করে “ভারতের অর্থনীতির অবস্থা ভালো নয়” – এই তথ্যটির উপর জোর দেয়। অন্যদিকে, কোনও একটি নির্দিষ্ট জনকল্যাণমূলক পরিকল্পনা (উজ্জ্বলা বা প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা) থেকে কতজন ব্যক্তি সুবিধা পেয়েছেন, ইতিবাচক তথ্যগুলি সেই সংখ্যার বর্ণনা করে। সুবিধা লাভের দাবি জাল করার (বায়োমেট্রিক প্রমানীকরণ) সংখ্যা, দুর্নীতি এবং গোপনীয়তার (সুবিধাগুলিকে সরাসরি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পাঠান, সম্পদকে জিওট্যাগ করা ইত্যাদি) ঘটনা হ্রাস করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যে পদক্ষেপগুলি নেওয়া হচ্ছে, সেগুলিকে উল্লেখ করার মাধ্যমে দক্ষতার শর্তটিকেও এই বর্ণনার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে।
এই জাতীয় নকশা প্রতিশ্রুতি দেয় যে, গবেষক যদি আলাদা আলাদা তথ্য পাঠ করার বা শোনার জন্য ভোটদাতাদের এলোমেলোভাবে নির্বাচন করেন, তবে যে দলগুলি তৈরি হবে সেগুলি গড়পড়তাভাবে সমতুল্য এবং তাদের মধ্যে একমাত্র পার্থক্য তৈরি হয় কোন ধরনের তথ্য তাঁরা পড়ছেন বা শুনছেন তার মাধ্যমে। এর ফলে, গবেষক অনেক বেশি প্রত্যয়ের সঙ্গে বলতে পারেন যে, এই ধরনের তথ্যই ভোটদাতাদের রাজনৈতিক পছন্দের মধ্যে পার্থক্যের কারণ, অন্য কোনও উপাদান নয়। এই গবেষণাতে রাজনৈতিক পছন্দের পরিমাপ করার জন্য আমি দুটি পন্থা অবলম্বন করেছিঃ ভোটদাতাদের মোদী সরকারের দ্বারা সম্পাদিত কার্যাবলীকে ০ থেকে ১০-এর মানদণ্ডে (উচ্চতর মানের অর্থ মূল্যায়ন অনেক বেশি অনুকূল) পরিমাপ করতে অনুরোধ করেছি, এবং তাঁদের রাজ্যের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলিকে দশ টাকা করে কাল্পনিকভাবে অনুদান করতে বলেছি (তাঁরা কোনও দলকেই অর্থ দান না করতে পারেন অথবা, দশ টাকাকে দলগুলির মধ্যে ভাগ করে দিতে পারেন) । আমার আগ্রহ ছিল জানার যে, ঠিক কত পরিমাণ অর্থ ধারণাগতভাবে বিজেপিকে “দান” করা হয়েছে।
ভোটদাতারা ফলাফলকে পুরস্কৃত করেন, পরিকল্পনার কার্যকরী বাস্তবায়নকে ততটা নয়
আমি দেখলাম যে, কাজকর্মের বিষয়ে ইতিবাচক তথ্যের প্রেক্ষিতে ভোটদাতাদের পছন্দ বদলায়। বিশেষত, যখন ঐতিহাসিক কর্মহীনতা, ক্রমবর্ধমান অসাম্য ও জ্বালানীর মূল্যবৃদ্ধি বিষয়ে চিন্তা করার জন্য ভোটদাতাদের প্রস্তুত করা হয়েছে, তখন তাঁরা মোদী সরকারের কাজকর্মকে দশের মধ্যে গড়ে ছয় দিয়েছেন। জনকল্যাণমূলক পরিকল্পনাগুলির বিষয়ে জানার পরে তাঁরা সরকারকে আরও একটু বেশি অনুকূলভাবে (দশের মধ্যে সাত) মূল্যায়ন করেছেন; সরকারের মান ১.১৪ বিন্দু বা সম্পূর্ণ মানদণ্ডের প্রায় ১১ পার্সেন্টেজ পয়েন্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। অনুদান দেওয়ার বেলায়, নেতিবাচক তথ্য পাওয়ার পরে ভোটদাতারা বিজেপিকে দশ টাকা থেকে ৩.৯ টাকা দিয়েছেন। জনকল্যাণমূলক পরিকল্পনাগুলির বিষয়ে জানার পর তাঁরা এই দলকে আরো আঠাশ পয়সা (০.২৮ টাকা) বেশি দিয়েছেন। এই টাকার অঙ্কটি উপলব্ধ বাজেটের আন্দাজ ২.৮ শতাংশ।
এই ফলাফল থেকে কি জানা যায়? প্রথমত, ভোটদাতারা যেন বিজেপিকে অনুকূলভাবে মূল্যায়ন করছেন এমনকি তখনও, যখন তাঁদের মনোযোগ রয়েছে ক্ষুদ্র অর্থনীতির খারাপ অবস্থার উপর। এর থেকে আমরা ভোটদাতাদের উপর কাজকর্ম-কেন্দ্রিক আবেদনের সীমাবদ্ধতার প্রভাবের বিষয়ে কিছু জিনিস জানতে পারিঃ এগুলি অবশ্যই কাজ করে, কিন্তু তারা একমাত্রা বিষয় নয় যা রাজনৈতিক দলের অনুকূলে কাজ করে। দ্বিতীয়ত, সমীক্ষাতে বিজেপিকে সমর্থন করাকে অতিরঞ্জিত করা হতে পারে, এবং আচরণ নির্ভর মাপকাঠি থেকে অনেক বেশি যথাযথ চিত্র পাওয়া যায়।

কার্যকরী বাস্তবায়নের দিক থেকে দেখলে, কি ভাবে সুবিধাগুলি তাঁদের হাতে পৌঁছচ্ছে, সে বিষয়ে কি ভোটদাতারা আদৌ মাথা ঘামান? এর উত্তর পাওয়ার জন্য, অতিরিক্ত তথ্য যা দুর্নীতি ও গোপনীয়তা কমানর জন্য সরকার যে পদক্ষেপগুলি নিয়েছেন তার উল্লেখ করে আমি সেগুলিকে তুলনা করেছি। এই অতিরিক্ত তথ্যগুলিকি করে? খুব বেশি কিছু না। সরকারের কার্যাবলীর মূল্যায়ন ০.১৯ বিন্দু বা সম্পূর্ণ মানদণ্ডের সামান্য দুই পার্সেন্টেজ পয়েন্ট বেড়েছে। শাসকদলের উদ্দেশ্যে অনুদান উনত্রিশ পয়সা বা উপলব্ধ বাজেটের আন্দাজ তিন পার্সেন্টেজ পয়েন্ট বেড়েছে।
একত্রে, জনকল্যাণমূলক কাজের সুবিধা বন্টনের রাজনৈতিক ফলাফল উত্তম, কিন্তু এই বন্টন “দক্ষতার সঙ্গে” ঘটলেও, অন্তত দর্শকের কাছে, তার ফলাফল আধিক্যহীন। বস্তুত, আমি একটি পৃথক গবেষণায় দেখেছি যে, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার প্রকৃত সুবিধাভোগীদের সঙ্গে এই ঘটনাটিই ঘটেছে।
তাৎপর্য
এই বিশ্লেষণ থেকে যা জানা গেল তা হল, বিভ্রাট, গোপনীয়তা ও পক্ষপাতের ঘটনা কমানর উদ্দেশ্যে শাসনব্যবস্থা সংক্রান্ত যে সংশোধনগুলি হয়, তার মধ্যে অনেকগুলিই রাজনৈতিকভাবে কার্যকর হয় একমাত্র তখনই, যখন ভোটদাতারা প্রক্রিয়াকে (অর্থাৎ, একটি সুবিধা ঠিক কী উপায়ে জনগণের হাতে পৌঁছয়) মূল্য দেন। বর্তমানে, দুর্নীতি নিয়ে জনগণের মধ্যে আলোচনা কেবলমাত্র উচ্চপদস্থ বা উচ্চশ্রেণীর ব্যক্তিদের উদাহরণগুলিতেই সীমাবদ্ধ এবং যে ক্ষমতাবান ব্যক্তিরা দুর্নীতি বা স্বজনপোষণের সঙ্গে জড়িত, একমাত্র তাঁদের শাস্তিদানের মাধ্যমে দৃষ্টান্ত তৈরির উপরেই তাঁদের মনোযোগ আবদ্ধ। কিন্তু, এই আলোচনাকে আরও গভীরে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। দাতা ও বিশেষজ্ঞ, যাঁদের মনোযোগ পড়ে রয়েছে নীতি নির্মাণ এবং জনকল্যাণমূলক কার্যক্রমের সুবিধাকে গ্রহীতার হাতে পৌঁছে দেওয়ার শেষ ধাপটির উপর, তাঁদের প্রয়োজন নাগরিকরা দক্ষতা বৃদ্ধিকারী পদক্ষেপগুলিকে কী ভাবে দেখছেন এবং তাঁরা আদৌ সেগুলিকে কোনও রকম মূল্য দেন কিনা, তার গুণগত মূল্যায়ন করা। সর্বসাধারণের মধ্যে তথ্য এবং সচেতনতার প্রচার ও প্রসারের জন্য যে অভিযানগুলি পরিচালিত হয়, সেগুলিতে পক্ষপাত ও দুর্নীতির ক্ষতিকর প্রভাবের উপর আরও স্পষ্টভাবে জোর দিতে হবে এবং দক্ষ বাস্তবায়নের সুফলগুলিকে চিহ্নিত করতে হবে। দক্ষতাকে শুধুমাত্র কল্পনা করে নিলে হবে না, বরং তাকে একটি নজির হিসেবে তুলে ধরতে হবে। ভোটদাতাদের দিক থেকে কোনও রকম চাপ তৈরি না হলে, শাসনব্যবস্থার উন্নতি এবং তার সংশোধনের উদ্দেশ্যে নেওয়া পদক্ষেপগুলি নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক অনুপ্রেরণা দুর্বলই রয়ে যাবে।