সেন্টারের বিরুদ্ধে ইউনিয়নঃ ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয়ত্বের রাজনৈতিক ভাষা

27/02/2023
IiT English Page

২০২১ সালের মে মাসে দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাঝাগামের নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন তামিলনাড়ুর সরকারের প্রাথমিক পদক্ষেপগুলির মধ্যে একটি ছিল সরকারি বার্তা ইত্যাদিতে “সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট” শব্দটি বর্জন করা। ভারত সরকারকে সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের (মাথিয়া আরাসু) বদলে ইউনিয়ন গভর্নমেন্ট (ওন্দ্রিয়া আরাসু) বলে অভিহিত করার তামিলনাড়ুর এই সিদ্ধান্তটির উদ্দেশ্য স্পষ্টতই ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ক্ষয়ীভবন থামান। লেখন ও তামিল অ্যাক্টিভিস্ট আঝি সেন্থিলনাথন যেমন মন্তব্য করেছেন যে, রাজ্যের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ও সার্বভৌমত্বের অধিকার বিপদের মুখোমুখি হয়েছে, যা এই নামকরণে পরিবর্তন আনার কারণ। 

অনেকটা ১৯৩০ ও ১৯৪০-এর দশকের মতই, ভারতীয় রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রীয়ত্ব একটি বুনিয়াদি ধারণাতে পরিণত হয়েছে। ধারণার অর্থ শুধু কয়েকটি শব্দের সমাহার মাত্র নয়। যা এক গুচ্ছ শব্দ থেকে ধারণাকে আলাদা করে তা হল তার অস্পষ্টতা। রেইনহার্ট কোসেলেকের মতে, এই বুনিয়াদি ধারণাগুলি “যে কোন সময়ের সর্বাপেক্ষা জরুরী প্রশ্নের বিন্যাসের ক্ষেত্রে অপরিহার্য।” এছাড়াও, সেগুলি “অতীব জটিল, সর্বদা অনিবার্য, অস্পষ্ট ও বাদপ্রতিবাদের কেন্দ্র।” যুক্তরাষ্ট্রীয়ত্ব আজ আমাদের রাজনৈতিক ভাষা ও বিতর্ককে এমনভাবে রূপদান করেছে, যার ফলে যুক্তরাষ্ট্রীয়ত্ব – এই শব্দের অর্থটি কেন্দ্র এবং অন্যান্য এককের মধ্যে চলা ক্ষমতার লড়াইয়ের কেন্দ্রে চলে আসে। এই ঘটনাটি এককেন্দ্রিকতার উপাদনগুলির অভুতপূর্ব বৃদ্ধিকে ব্যাহত করে এবং আরও গুরুত্বপূর্ণভাবে, এমন একটি রাজনৈতিক ভাষার নির্মাণ করে, যা ভারতের রাজ্যগুলির সার্বভৌমত্বের অধিকারকে সম্মান করে ও তার পুনরুদ্ধার করে যে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, তার ঐতিহ্যকে স্মরণ করায়। 

তামিলনাড়ুর এই শব্দের অর্থকেন্দ্রিক প্রতিরোধের ঘটনাটি থেকে একটি বৃহত্তর প্রকল্পের উঠে আসা উচিত, যা এমন একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার রাজনৈতিক ভাষার নির্মাণ করবে, যা ভারতীয় রাজ্যগুলির অধিকারকে নিরাপদে রাখবে। কিন্তু, যা ভাবা হয় এই বিতর্কের শর্তগুলি তার থেকে অনেক বেশি জটিল। ইউনিয়ন বা ফেডারেল গভর্নমেন্ট এবং সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের মধ্যে যে পার্থক্য, তা ঐতিহাসিক এবং ১৯৩০ ও ১৯৪০-এর দশকে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে। ১৯৫০ সালে ভারতকে একটি ফেডারেশানের বদলে একটি “ইউনিয়ন”-এ পরিণত করার ঘটনাটি ইউনিয়ন ও সেন্টারের মধ্যে পার্থক্যের গুরুত্ব কমিয়ে দেয়। ফেডারেশানের বদলে, ইউনিয়ন হিসেবে ভারতের নির্মাণ হয়েছিল এই বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে যে, অঙ্গরাজ্যগুলির মৌলিক সার্বভৌমত্ব ছিল না।    

সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের ইতিহাস 
ঔপনিবেশিক সরকার এবং ভারতীয় জননায়ক দুই পক্ষই “সেন্টার” এবং “সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট” এই শব্দগুলি প্রায়শই ব্যবহার করতেন। ১৯১৯ সালের গভর্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়া আইনটি কেন্দ্রীয় আইনসভা এবং সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের বিষয়ে আলোচনা করে, কিন্তু স্থানীয় সরকার ও আইনসভাকে নিয়ে কোনও কথা বলে না। যতদিন পর্যন্ত ব্রিটিশরা ভারত শাসন করেছিল, ততদিন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকার বলতে গভর্নর-জেনারেল-ইন-কাউন্সিল, এবং আঞ্চলিক ও স্থানীয় সরকার বলতে গভর্নরস-ইন-কাউন্সিলকে বোঝাতে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল যে আজকাল, “স্থানীয়” শব্দটি কোনভাবেই রাজ্য সরকারকে বোঝায় না, বরং পৌরসভা বা পঞ্চায়েত সরকারকে বোঝায়। ঔপনিবেশিক ভারতে “কেন্দ্র” বলতে ব্রিটিশ ভারতের সরকারের আসনকে বোঝাত। ব্রিটিশ ভারতীয় রাষ্ট্র একটি অতীব এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র যার নিয়ন্ত্রণ ছিল কেন্দ্রীভূত, এবং সেই কারণে সাম্রাজ্যবাদী সাংবিধানিকতার দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ ছিল কেন্দ্র ও কেন্দ্রীয় সরকার।        

ভারতীয় জাতীয়তাবাদীরাও এমন একটি সাংবিধানিক ভাষায় কথা বলতেন যা ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার অন্তর্নিহিত অর্থ ও যুক্তিকেই স্বীকার করে নিত। নেহরু রিপোর্ট (১৯২৮), ভারতীয় সংবিধানের প্রধান জাতীয়তাবাদী বিবরণ, অকৃপণভাবে “কেন্দ্রীয় সরকার” – এই শব্দগুচ্ছকে ব্যবহার করে। এই বিবৃতির লেখকরা এমনকি কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে অসম্ভব কিছু ক্ষমতা তুলে দেওয়ার দাবি জানান। এই ক্ষমতাগুলির মধ্যে একটি ছিল প্রাদেশিক সরকার সংক্রান্ত আইনগুলি বাতিল করে দেওয়া, কারণ “কোনও কেন্দ্রীয় সরকারই এই ধরনের ক্ষমতা ছাড়া এগিয়ে যেতে পারে না।”   

১৯২০ সালের শেষদিকে, ব্যাপকভাবে স্বীকার করে নেওয়া হয় যে ভারতের ভবিষ্যতের সংবিধানকে যুক্তরাষ্ট্রীয়ই হতে হবে। ভারতের ভবিষ্যৎ সংবিধানের মূল নীতিটি কি হতে পারে, তা সুপারিশ করার জন্য সাইমন কমিশনকে (১৯২৭-১৯২৯) নিযুক্ত করা হয়। এই কমিশনটি তার বিবৃতিতে ব্রিটিশ ভারত ও দেশীয় রাজ্য, এই দুইকে মিলিয়েই ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র নির্মাণের পক্ষে আলোচনা করে। সামনে যে প্রধান কাজটি ছিল তা হল একটি এককেন্দ্রিক ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকে যুক্তরাষ্ট্রে পরিণত করা। এইভাবে, কেন্দ্রীয়ের বদলে “যুক্তরাষ্ট্র” নামক একটি নতুন সাংবিধানিক বিভাগ পরের দিককার ঔপনিবেশিক ভারতের রাজনীতিতে আধিপত্য করতে শুরু করে। ১৯৩০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের যে নকশাগুলির আভাস দেওয়া হয়, সেগুলিতে কেন্দ্রীয় ও যুক্তরাষ্ট্রীয়ের মধ্যে সতর্কভাবে পার্থক্য করা হতে দেখা যায়। কেন্দ্র সংক্রান্ত বিষয়/কেন্দ্রীয় সরকার যখন ব্রিটিশের দখলীকৃত প্রদেশের সাধারণ ঘটনাগুলি নিয়ে কাজ করত, তখন তাদের ভারত সরকারের উপর নির্ভর করতে হত। সর্বভারতীয় বিষয়ের ক্ষেত্রে, অর্থাৎ যে ঘটনাগুলি প্রদেশ ও দেশীয় রাজ্য, উভয়কেই প্রভাবিত করে, সেগুলির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রীয় বিষয়/যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের উপর নির্ভর করতে হত।  

এই একই ধারণার প্রেক্ষিতে, ১৯৩০ সালের অক্টোবর মাসে, লন্ডনের প্রথম গোল টেবিল বৈঠকের ঠিক আগে, হায়দ্রাবাদের প্রধানমন্ত্রী আকবর হাইদারী, তাঁর “ফেডারেল স্কিম ফর ইন্ডিয়া”-কে সামনে আনেন। দেশীয় রাজ্যগুলির বিষয় নিয়ে যে রাজনৈতিক বিভাগটি কাজ করত তাদের সম্পর্কিত সংরক্ষণাগারে ১৯৩০এর দশকের  এমন অনেক নথিপত্র পাওয়া যাবে যা যুক্তরাষ্ট্রী ও কেন্দ্রীয়ের মধ্যে পার্থক্যকে নিয়ে আলোচনা করে। ১৯৩০-এর দশকে ভারতের পরিবর্তনশীল সাংবিধানিক কাঠামোর যুক্তরাষ্ট্রীয় উপাদান ছিল দেশীয় রাজ্যগুলি, কারণ একমাত্র সেগুলির প্রেক্ষিতেই, সাংবিধানিক বিভাগ হিসেবে, কেন্দ্রীয়ের বদলে, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রতিষ্ঠা সম্ভব ছিল।    

ওয়েস্টমিনিস্টারের ধরনের সংসদীয় সরকারের অনুকরণ করার আকাঙ্ক্ষায়, ভারতীয় জাতীয়তাবাদীরা একটি ক্ষমতাশালী কেন্দ্রীয় সরকারের অকুন্ঠ সমর্থক হয়ে ওঠেন। এই বিষয়টি জাতীয়তাবাদী, রাজপুত্র এবং সংখ্যালঘুদের মধ্যে বিভেদের একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত তৈরি করে। মুসলিম লীগের দিক থেকে দেখলে, একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকারের বিষয়ে তাঁরা বহু দিন ধরেই সন্দিহান ছিলেন। নেহরু রিপোর্টের প্রতিক্রিয়ায় এম. এ. জিন্নার ফোরটিন পয়েন্টস, এই উৎবৃত্ত ক্ষমতাকে কেন্দ্রের বদলে রাজ্যের হাতেই তুলে দেওয়ার দাবি জানায়। ১৯৩০ ও ১৯৪০-এর দশক জুড়েই প্রাদেশিক সার্বভৌমত্ব ও একটি সীমাবদ্ধ কেন্দ্রের ধারণা মুসলিমদের যুক্তরাষ্ট্রীয় কল্পনার একটি উপাদান হিসেবে থেকে যায়। 

গণপরিষদ
গণপরিষদে একটি শক্তিশালী কেন্দ্রের পক্ষে ও বিপক্ষে বিভিন্ন যুক্তিতর্কের উপস্থাপনা করা হয়। বি. আর. আম্বেদকরের নেতৃত্বে পরিচলিত খসড়া সমিতি নিরলসভাবে একটি ক্ষমতাশালী কেন্দ্রীয় সরকারের সমর্থন করেন। ১৯৫০ সালে জারি হওয়া সংবিধানে কোনও জায়গা না পেলেও, “কেন্দ্র” ও “কেন্দ্রীয় সরকার” – এই শব্দগুলি এই বিতর্ক জুড়ে ছড়িয়ে আছে। বিশেষ করে আম্বেদকর, এই বিতর্কের গুরুতর মুহূর্তগুলিতে “কেন্দ্র” শব্দটি ব্যবহার করেছেন। যা এখন ধারা ৩৫৬ (খসড়া সংবিধানে ধারা ২৭৮) বলে অভিহিত তার বিষয়ে আলোচনার সময় আম্বেদকর বলেন, “প্রাদেশিক সরকার ভালো কি মন্দ, তা স্থির করা কেন্দ্রের কাজ।” এই বক্তব্যটি তাঁর চিন্তাধারার সূচক এবং গণপরিষদে ডক্টর লোকনাথ মিশ্রের করা মন্তব্যটিকে স্পষ্ট করে, “ডক্টর আম্বেদকর সমস্ত কিছুকেই কেন্দ্রের দিকে নিয়ে গেছেন।” হসরত মোহানি এবং দামোদর স্বরূপ শেঠের মত নেতারা দৃঢভাবে কেন্দ্রীকরণ ও রাজ্যের স্বার্বভৌমত্বের অনুপস্থিতির বিরোধিতা করেন। স্বরূপ এমনকি এই আশঙ্কাও প্রকাশ করেন যে, অত্যাধিক কেন্দ্রীকরণের ফলশ্রুতি “টোটালিটেরিয়ানিজম।”   

গণপরিষদের এই বিতর্ক থেকে আমরা দেখতে পাই যে, ভারতের যদিও ইউনিয়ন অফ স্টেটস হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তার মানে এই নয় যে দেশীয় রাজ্য ও সংখ্যালঘুরা যেমন যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সুপারিশ করেছিলেন, তা সম্ভব হত। আঞ্চলিকতা ও প্রাদেশিক স্বশাসনের বিষয়ে সুদৃঢ বোধের দ্বারা উদ্দীপিত দেশীয় রাজ্য ও সংখ্যালঘুদের কল্পনায় কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে ক্ষমতা ছিল যৎসামান্য এবং অধিকাংশ বিষয়ই কেন্দ্র এবং প্রদেশের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল। কনকারেন্ট লিস্ট, যেখানে কেন্দ্র ও রাজ্য যুগপৎ ভাবে আইনগত এখতিয়ার পেয়েছে, তার আকারে খুবই ছোট হওয়ার কথা ছিল। ১৯৩০ ও ১৯৪০-এর দশকে অনেকেই যেমন ভেবেছিলেন, ভারত তার চেয়ে অনেক বড় একটি কনকারেন্ট লিস্ট হাতে পেয়েছিল এবং এর থেকেই আন্দাজ করা যায় যে, যে জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারাটি স্বাধীন ভারতেও ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের এককেন্দ্রিক কাঠামোটিই নকল করতে চাইছিল, সেই চিন্তাধারাটির আধিপত্য ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছিল। ১৯৪৯ সালের ২ আগস্ট গণপরিষদে আম্বেদকর ও জওহরলাল নেহরুর বিরুদ্ধে হসরত মোহানি এই অভিযোগটিই রাখেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, কেন্দ্রের ক্ষমতাকে বাড়িয়ে তুলে তাঁরা একটি “এককেন্দ্রিক ভারতীয় সাম্রাজ্য” গড়ে তুলেছেন, যা প্রায় “আগেকার এককেন্দ্রিক ব্রিটিশ ভারতীয় সাম্রাজ্য”-এরই সমতুল্য। 

ঐতিহাসিক স্মৃতি ও ভাষার আশ্বাস 
ইতিহাসের এই ঘুরপথ ধরে এগিয়ে গিয়ে আমরা দেখতে পাই যে, ইউনিয়ন গভর্নমেন্ট ও সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট দুইই ভারত সরকারকে অভিহিত করার জন্য উপযুক্ত পরিভাষা। দেশের বাইরে ভারত সরকারই একমাত্র আইনসম্মত ও সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান; সেন্ট্রাল বা ইউনিয়ন গভর্নমেন্ট অভিধাকে শুধুমাত্র দেশের অভ্যন্তরেই গুরুত্ব দেওয়া হয়। ভারতীয় জাতীয়তাবাদী চিন্তার ইতিহাস এবং উপনিবেশ-পরবর্তী ভারতীয় রাষ্ট্রের নির্মাণে তার মৌলিক ভূমিকা এই দুটি আখ্যার মাধ্যমেই সূচিত হয়। লিখিত সংবিধানে “কেন্দ্রীয় সরকার” শব্দগুচ্ছের অনুপস্থিতি থেকে বোঝা যায় যে, সংবিধানের পাঠটি, যে রাজনৈতিক ভাষার মাধ্যমে বিকশিত ও আলোচিত হয়েছে, সেই ভাষার নিবন্ধক হিসেবে সন্তোষজনক নয়।

 

ও. ভি বিজয়নের কার্টুন, তারিখ উল্লেখ করা নেই 

রামা সুন্দর ও ন্যান্সি হাডসন-রোড (সম্পাদিত) ট্র্যাজিক ইডিয়মঃ ও. ভি. বিজয়ন’স কার্টুনস অ্যান্ড নোটস অন ইন্ডিয়া (কোট্টায়মঃ ডি.  সি. বুকস, ২০০৬) বইটি থেকে নেওয়া।

তামিলনাড়ুর বিরোধিতা রাজনৈতিক ভাষার একটি সম্পূর্ণ নতুন পৃথিবী আমাদের সামনে খুলে দেয়। হেরে যাওয়া লড়াই এবং রাজনীতির বিকল্প গতিপথ স্মরণ করার ঘটনাগুলি নির্ভর করে ধারণা ও বাকপ্রণালীর উপর, যা অবস্থান আমাদের প্রাত্যহিক ভাষায় বহু দূরে বলেই মনে হয়। অনেক ভারতীয় ভাষাতেই “ইউনিয়ন” আর “সেন্ট্রাল” এই শব্দদুটির মধ্যে কোনও রকম পার্থক্য করে যাওয়া খুবই কঠিন, এবং তা আসলে ইউনিয়ন ও সেন্টারের সংযুক্ত অবস্থানের দিকেই নির্দেশ করে। এর বিপরীতে আছে যুক্তরাষ্ট্র যা, অধিকাংশ ভাষাতেই, একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক ও আইনি ভাবনা। যেহেতু জন্মের সময় থেকেই সেন্টারের সঙ্গে ইউনিয়ন ঘনিষ্ঠভাবে আবদ্ধ, তাই হয়ত রাজনৈতিক পরিভাষা ও আলোচনার ক্ষেত্রে উপযুক্ত শব্দের এই অভাবটি দেখা যায়। যেমন ধরা যাক, মালায়ালাম ভাষায়, সেন্টার এবং ইউনিয়নের মধ্যে তফাৎ খুবই ক্ষীণ, কিন্তু এই ভাষায় যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার (সমযুক্তবরণম) এবং ইউনিটারি গভর্নমেন্ট (ঐক্যবরণম) দুটি সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। সেন্টারের অর্থ কেন্দ্রম এবং ইউনিয়নের অর্থ ঐক্যম/একতা। কিন্তু কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ও ইউনিয়ন টেরিটোরির মধ্যে পার্থক্য করার মত কোন শব্দ মালায়ালামে নেই এবং দুইয়ের অর্থই কেন্দ্র বরনা প্রদেশম (অনেকটা হিন্দির মতই)। যাঁরা তামিলনাড়ুর এই পদক্ষেপের সমালোচনা করেছে তাঁদের অভিযোগ,ওন্দ্রিয়া আরাসু শব্দটির অর্থ আদপেই ইউনিয়ন গভর্নমেন্ট নয়, এর অর্থ বরং উপজেলা বা নিচুস্তরের কাঠামো। যে ভাষাগুলিতে এই জাতীয় যথাযথ ধারণার অভাব দেখা যায়, অথচ আজকের ভারতে নানা দাবি জানানর জন্য যার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম, হয়ত সেই ভাষায় যুক্তরাষ্ট্রীয় ধারণার পুনরুজ্জীবনের প্রচেষ্টার সমস্যাগুলির প্রতিই উপরের এই বক্তব্যটি নির্দেশ করে।  

ভারতকে একটি যুক্তরাষ্ট্র বা ভারত সরকারকে কেন্দ্রীয় সরকার বলে অভিহিত করার বিষয়টিকে পাঠের বাইরে বলে মনে হতে পারে, কারণ যুক্তরাষ্ট্রীয়/যুক্তরাষ্ট্র বা সেন্ট্রাল, কোন অভিধাকেই সংবিধানে পাওয়া যায় না। কিন্তু, যুক্তরাষ্ট্র, যা অধিকাংশ ভারতীয় ভাষাতেই উপস্থিত, তা ভাষাগত এবং রাজনৈতিক দিক থেকে, নিজেই একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ শ্রেণীবিভাগ। শব্দটি নিয়ে সংবিধানে প্রবল নৈঃশব্দ থাকা সত্ত্বেও, শাসক ও বিরোধীদল উভয়েই ভারতকে একটি যুক্তরাষ্ট্র হিসেবে দেখে এবং সেই কারণে তামিলনাড়ু যে এমন একটি পরিভাষা ব্যবহা করবে বলে স্থির করেছে যা যথাযথভাবে সাংবিধানিক, তা তর্কবিতর্কের বিষয় হওয়া উচিত নয়। তামিলনাড়ুর এই অবস্থান থেকে আমাদের বোঝা উচিত যে, এমনকি আমরা যে ভাষায় কথা বলি তার যদি স্পষ্টভাবে এই ধরনের পার্থক্য করার ক্ষমতা নাও থেকে থাকে, তাহলেও এমন একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় ভাষার পুনরুজ্জীবনের আশু প্রয়োজনীয়তা আছে, যা ইউনিয়ন এবং সেন্টারের মধ্যে পার্থক্য করতে সক্ষম। ভারতের ক্রমবর্ধমান কেন্দ্রীকরণকে রুখে দিতে, কেন্দ্র এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিভাজনের জটিল ইতিহাস ও ভারতের জন্মলগ্নে ইউনিয়ন ও কেন্দ্রের সংযুক্ত অবস্থান এই কাজকে আরও অর্থবহ করে তোলে। 

শরথ পিল্লাই

Author

শরথ পিল্লাই সিএএসআই-এর একজন পোস্টডক্টরাল ফেলো। তাঁর প্রথম বই-এর পরিকল্পনাটি পরের দিকের ঔপনিবেশিক ভারতে যুক্তরাষ্ট্রীয় ধারণার উত্থান ও পতনের বিষয়টিকে পরীক্ষা করে। তিনি @i_sarathpillai ঠিকানা থেকে টুইট করেন। 

(Bangla Translation by Sritama Halder)
অনুবাদঃ শ্রীতমা হালদার