কোভিডের কারণের আমার ক্ষেত্রসমীক্ষার কাজ থেকে বিরতি নেওয়ার পর, ২০২২ সালের গ্রীষ্মে আমি যখন কালিম্পং যাই, তখন সেখানকার সমস্ত অধিবাসী বলেন যে, “চাষবাসের কাজ আর আগের মত নেই।” এর আগে সকলেই কৃষিকাজকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলে দাবি করতেন। কৃষিকাজই হিমালয়ের পাদদেশের জেলা কালিম্পংকে বিশিষ্ট করে তুলেছিল। কৃষিকাজ আর জমির উপর স্বল্পমেয়াদী অধিকার নেপালি, এবং লেপচা ও ভুটিয়াদের মত কালিম্পং-এর আদি বাসিন্দাদের মধ্যে একটি ভিন্নতর রাজনৈতিক চেতনার জন্ম দিয়েছিল। আমাকে তাঁরা এও জানান যে, কালিম্পং-এ স্বাক্ষরতার হার অনেক বেশি এবং তাঁদের স্বাস্থ্য তিস্তার অপর পারের চাবাগান নির্ভর দার্জিলিং-এর বাসিন্দাদের চেয়ে অনেক ভাল। এর মানে যদিও, কালিম্পং-এ কৃষিকাজ ও, সাধারণভাবে এখানে থাকার বিষয়টি সব সময়ই খুব যে সুবিধাজনক ছিল এমন নয়। কিন্তু কিছু একটা যেন বদলে গেছিল। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই এই অঞ্চলের বাসযোগ্যতা, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের দিকে, সংশয়াপন্ন হয়ে উঠেছে।
কালিম্পং-এর অনেক কৃষকই তাঁদের জমিতে চাষ করা বন্ধ করে দিয়েছেন। বিশেষ করে চালসহ অন্যান্য শস্যের উৎপাদনের খরচ বাজারদরের থেকে অনেক বেড়ে গেছে। তাঁরা বলেন যে, শুধু যে কোনও বাজার নেই তা নয়। তার পাশাপাশি চাষের জন্য প্রয়োজনীয় জলও নেই। অনেক গ্রামবাসীই, বিশেষ করে কমবয়সীরা, পরিষেবা শিল্পকেন্দ্রিক কাজের খোঁজে ভারতের অন্যান্য শহরে বা বিদেশে চলে যাচ্ছেন। অতিমারীর সময় কি এমন কিছু ঘটেছে, যার কারণে এতটা পরিবর্তন এসেছে? তা সম্ভবত নয়। এই সমস্যার জমি আদতে অনেক ধরেই তৈরি হচ্ছে।
দার্জিলিং ও ডুয়ার্স – কালিম্পং-এর প্রতিবেশী এই দুই অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে আছে চাবাগান। কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসকরা কালিম্পংকে চা বাগানের জন্য তৈরি করেন নি। এর মানে এই নয় যে, কালিম্পং ঔপনিবেশিক বা পুঁজিবাদী নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। বরং তার উল্টোটাই ঘটেছিল। এর বদলে, ব্রিটিশ প্রশাসন কালিম্পংকে “সরকারি তালুক” হিসেবে নির্দিষ্ট করে। ব্রিটেনে যদি জমিদারী তালুকের অস্তিত্ব আগে থেকেই না থাকত, তাহলে ঔপনিবেশিক বাংলায় তা গড়ে উঠত না। এই জমিদারী তালুকগুলিতেই জমির ভাগাভাগি, জমির খাজনা আদায় এবং সামাজিক স্তরায়ণের কৌশলগুলিতে শান দেওয়া হত। পরে কালিম্পং সহ ঔপনিবেশিক ভারতের দখলীকৃত বিস্তৃত অংশে সেই কৌশলগুলির প্রয়োগ করা হত।
১৮৭০-এর দশকে বাংলা ও বিহার সহ সারা ভারতে যে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা যায়, তার ফলে সরকারি তালুকের বিস্তারে বাধা পড়ে। এর উত্তরে, ঔপনিবেশিক প্রশাসন তার অসংখ্য দুর্ভিক্ষ কমিশনের মধ্যে প্রথমটি স্থাপন করে। ১৮৮৬ সালে এই কমিশনটি, একটি নতুন বেঙ্গল এগ্রিকালচার ডিপার্টমেন্ট স্থাপনের পদক্ষেপ নেওয়া সহ অনেকগুলি প্রস্তাবনা রাখে। একই বছর, এই কমিশনের নবনিযুক্ত পরিচালক বলেন যে, দুর্ভিক্ষ সমস্যার একটি প্রায়োগিক সমাধান সম্ভব। এই সমাধানটি হল, কৃষির উন্নততর উপায় ও সেগুলির বিস্তৃত প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন, কৃষি সংক্রান্ত পরিসংখ্যান এবং “অর্থনৈতিক তথ্য” সংগ্রহের কাজের প্রতি আরও মনোযোগ।
দুর্ভিক্ষ-পরবর্তী সময়ে, কালিম্পং-এর মত সরকারি তালুকের বাসিন্দাদের মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে যে আমলাতান্ত্রিক পরিকল্পনা ছিল, তা তাঁদের কাজের সুযোগ নিশ্চিত করার মত অর্থনৈতিক প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত। দার্জিলিং-এর মত উঠতি পাহাড়ি শহরের পাশাপাশি কলকাতা সহ অঞ্চলের প্রয়োজনীয় খাদ্যের উৎপাদক হিসেবে কালিম্পংকে প্রস্তুত করা হয়েছিল। ১৮৮০-র দশকের শুরুতে, নেপালি, লেপচা ও ভুটিয়াদের ব্যক্তিগত জমিতে বসতি করান হয় এবং তাঁদের তালুকের ভাড়াটে কৃষক হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। আপাতদৃষ্টিতে, এর লক্ষ্য দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ হলেও, স্পষ্টতই এই পদক্ষেপের উদ্দেশ্য ছিল, চাবাগানের আওতার বাইরের জমি থেকে ভাড়া আদায় করে ওই জমিকে লাভজনক করে তোলা। খাদ্য সরবরাহের সঙ্গে জড়িত কৃষকদের উৎপাদনশীলতায় সক্রিয় বিনিয়োগের বিষয়টিকে খুঁটিয়ে দেখলে সেখানে সমগ্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে জৈবরাজনীতিকে কেন্দ্র করে যে যুক্তিগুলি উঠে আসছিল, তার ছায়া দেখা যায়।
অতীতের ঘটনা থেকে এগিয়ে বর্তমানে আসা যাক। ক্ষুদ্রায়তন খামার এখন আর জীবনধারণের উপযোগী আয় আনতে সক্ষম নয়। কৃষকরা নিজেদের জমি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। কেন? তার কারণ বহু ও বিবিধ। হিমালয় পর্বতের ঢালে চাষ করা সহজ নয়। এই ভূখণ্ডে যান্ত্রিক পদ্ধতি ব্যবহার করে চাষ করা কেবল ব্যয়বহুলই নয়, তার উপযুক্তও নয়। অন্যান্য কারণগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য, কালিম্পং-এর পাহাড়ে ধস। সমতল থেকে পাহাড়ে খাদ্য সরবরাহের হার ক্রমশ বেড়ে চলেছে। তিস্তা নদীতে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের যন্ত্রপাতি স্থাপন করার কারণেও অনিশ্চয়তা অনেক বেড়েও গেছে। কালিম্পং-এর কৃষকররা জোর দিয়ে বলছেন যে, জলকষ্ট ও ঋতু পরিবর্তনের চরিত্রে অনিশ্চয়তা আসার জন্য এই বাঁধগুলিই দায়ী।
এছাড়াও, প্রান্তিককরণ, রেসিয়ালাইজেশান (যে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কোনও জাতি, সম্পর্ক বা সামাজিক রীতি উপর সামাজিক আধিপত্য বিস্তার বা ওই জাতিকে সামাজিকভাবে বর্জন করার জন্য তার উপর একটি জাতিপরিচয়-কেন্দ্রিক বৈশিষ্ট্যের ধারণা চাপিয়ে দেওয়া হয়, যার সঙ্গে ওই গোষ্ঠী কোনভাবেই নিজেদের শনাক্ত করে না) এবং শ্রমের ইতিহাসকে বিবেচনা করা হক। ঔপনিবেশিক ব্রিটেনের শ্রমের শ্রেণীবিভাগের ধারণা অনুসরণ করে, নেপালীদের “সামরিক জাতি” হিসেবে নির্দিষ্ট করা হয়, যা তাঁদের সৈনিকবৃত্তির উপযুক্ত বলে নির্দিষ্ট করে। “আনুগত্য” ও “সাহসিকতা”-র মত আরোপিত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ধারা অনুযায়ী তাঁদের ঝোঁক পরিষেবামূলক কাজের উপর বলেই ধরে নেওয়া হয়। আজও, এই ধরনের চাপিয়ে দেওয়া জাতিগত বৈশিষ্ট্য ও লিঙ্গভিত্তিক আখ্যান ভারতের নাগরিক পরিসরে ছড়িয়ে আছে। এই আখ্যান পাহাড় থেকে সমতলে নেমে আসা জনগোষ্ঠীকে ভালো সেবক হিসেবে দেখে – তাঁরা সৈন্য হিসেবে ভাল, এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা বিশ্বাসী আয়া, পরিচারিকা ও পাচকও বটে।
আমি যখন কালিম্পং-এর বাসিন্দাদের সঙ্গে জিজ্ঞেস করি, পাহাড়ের পরিবেশ যেভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে, সেখানে আর থাকার চেষ্টা করার অর্থ কি, তাঁরা তখন এই অবস্থার জন্য দায়ী সমস্ত গুণককেই আমার সামনে তুলে ধরেন। সেগুলি একসঙ্গে যোগ করলে, তা থেকে যা প্রকট হয়ে ওঠে তা হল, পাহাড়ের সবচেয়ে পুরনো শিল্প, অর্থাৎ পর্যটনের পুনরুজ্জীবন।
পশ্চিমবঙ্গের হিমালয় পর্বতের পাদদেশের অঞ্চলগুলি বহু বছর ধরেই একটি আশ্রয়, সমতলের একটি শীতল পার্বত্য পরিপূরক হিসেবে কাজ করছে। দার্জিলিং-এর মত পাহাড়ের শহরগুলি ছিল স্বাস্থ্যনিবাস, আরোগ্যের পরিসর এবং ইউরোপবাসী ও সমাজের উচ্চশ্রেণীর ভারতীয়দের তাদের উচ্চ সামাজিক অবস্থানের পুনঃপুন চর্চার জায়গা। আজও যখন সমতলের শহরের তাপমাত্রা বাড়তে থাকে, তখন তা থেকে পালিয়ে যাওয়ার ঠিকানা হিসেবে পাহাড়ের ভূমিকা অগ্রগণ্য। নাগরিক মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সমতলের তাপমাত্রা থেকে রেহাই পাওয়ার আশ্রয় হিসেবে পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়ার হার আরও বেড়েছে। এমনকি, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি অনেক সময়ই হিমালয়কে সুইজারল্যান্ড আর কলকাতাকে লন্ডনের সঙ্গে তুলনা করে পাহাড়ের প্রতি স্থাপিত ঔপনিবেশিক দৃষ্টিটিকেই পুনর্নিমাণ করেন ও সেই আকর্ষনীয় চিত্রগুলিকে এক দ্রুতবর্ধমান ভোক্তা গোষ্ঠীর সামনে তুলে ধরেন।
বাংলার পাহাড়কে বাংলার নাগরিক কেন্দ্র কি চোখে দেখে তা বোঝার জন্য প্রয়োজন “গ্রাম ও শহর” জুড়ির ধারণাটি পরীক্ষা করা প্রয়োজন। এই জুড়িকে রেমন্ড উইলিয়ামস অংশত ব্রিটিশ জমিদারি তালুকের আনন্দময়, কাল্পনিক বর্ণনা ও কাহিনীগুলিকে পড়ে বিশ্লেষণ করেছেন। পাহাড়ি গ্রামের যে সরল, স্থিথিশীল ও অপরিবর্তিত চিত্র উইলিয়ামস দেখিয়েছেন, তার আড়ালে প্রচ্ছন্ন থাকে আদায় ও পুঁজি সঞ্চয়ের হিংস্র বাস্তব।
কালিম্পং-এর পূর্বতন সরকারি তালুকের খামারগুলি একের পর এক দেউলিয়া হয়ে যেতে শুরু করলেও, পুঁজি এখনও হাল ছাড়ে নি। তার বদলে, পুঁজির সঞ্চয় এখন আরও ঘনিষ্ঠ পরিসরে চলে এসেছে, বিশেষ করে পুনরুৎপাদনের কাজে। ক্ষুদ্র কৃষকদের মধ্যে পরিযাণের ঘটনা কমাতে (এবং, তর্কসাপেক্ষে, উপজাতিদের দাবিগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে) পশ্চিমবঙ্গের সরকার এখন প্রবলভাবে হোমস্টে-কেন্দ্রিক পর্যটনের প্রচার ও প্রসার শুরু করেছেন। মনে হচ্ছে যেন পাহাড়ি অঞ্চলে একটি সক্রিয় কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির আর প্রয়োজন নেই। কৃষক পরিবারগুলি, রাজ্য উন্নয়নের কর্তৃপক্ষ ও জমিজমার দালালদের সাহায্য নিয়ে, সরকারি তালুককে আকর্ষনীয় মলাটে সাজিয়ে জলবায়ুর পরিবর্তন নিয়ে ক্রমবর্ধমানভাবে ভীত একটি চলমান ভারতীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সামনে হাজির করতে শিখছে। চাবাগানগুলিও এই উঠতি বাজারের অংশ হয়ে উঠলেও, বিস্তারের প্রেক্ষিতে দেখলে, কালিম্পং-এ এখন শুধুমাত্র নিবন্ধভুক্ত হোমস্টের সংখ্যাই সুবিশাল।
কৃষিশিল্পের ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গে দেখা যাচ্ছে যে, জমি আইন সংশোধনের মাধ্যমে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন সম্ভব করার থেকে অনেক বেশি সহজ মধ্যবিত্ত ভারতীয় নগরবাসীদের কাছে পাহাড়ের “স্থানীয়” ও “পরম্পরাগত” অভিজ্ঞতা বিক্রি করা। উপরের স্তর থেকে বিন্দু বিন্দু চুঁইয়ে পড়া উন্নয়নের ধারণা পাহাড়ে নতুন কিছু নয়। এ যুক্তি রিসোর্স ফ্রন্টিয়ারের (দেশের সম্পদের পুরনো ও সহজগম্য উৎসটি নিঃশেষিত হয়ে যাওয়ার পর নতুন সম্পদ আহরণের দেশের প্রান্তের নিকটস্থ কোনও অঞ্চলকে খুলে দেওয়া) এবং ধ্বংসের উৎস।
শীতল বাতাস এবং পাহাড়ের প্রকৃতি বহু যুগ ধরেই ভ্রমণপিপাসুদের এই অঞ্চলে টেনে এনেছে। কিন্তু ২০২৩ সাল নাগাদ, পাহাড়ের পথ নিয়মিতভাবে গাড়ির ভিড়ে ভিড়াক্রান্ত হয়ে থাকছে। এত সংখ্যক মানুষ পাহাড়ের দিকে ছুটছেন যে, যা এক সময় ছিল দশ মিনিটের পথ, তা এখন এক ঘন্টা ধরে শম্বুকগতির চলনে পরিণত হয়েছে। প্রতিবার, বর্ষাকালের পর রাস্তাগুলিতে ধস নামছে। একদিকে, ভারতের সমতলের পর্যটকরা পাহাড়ে ভিড় জমাচ্ছেন আর অন্যদিকে, কালিম্পং-এর বাসিন্দারা পাহাড় ছেড়ে পালিয়ে আসছেন।
কিন্তু, কৃষিশিল্পের ধ্বংসের ফলে হোমস্টে-কেন্দ্রিক পর্যটনশিল্পের উত্থান হয়েছে, বা হোমস্টের জন্য কৃষিশিল্প ধ্বংস হয়েছে, এমন নয়। এই পরিবর্তন নিয়ে কালিম্পং-এর বাসিন্দারা যখন কথা বলেন তখন তাঁরা গাড়ি, রাস্তা আর এর আগে যত ধস নেমেছে, পরে যৎ ধস নামতে চলেছে, সেগুলি নিয়েই কথা বলেন। আরও জলকষ্ট, প্রাথমিক প্রয়োজনের জিনিসপত্রের জন্য সমতলের ব্যবসায়ীদের উপর আরও নির্ভরশীল হয়ে ওঠা এবং অবশ্যই, আরও বেশি সংখ্যক হোমস্টে এই ভবিষ্যতের অংশ। হোমস্টে, সামাজিক পুনরুৎপাদন এবং ঘরের বন্দোবস্ত, রান্না এবং পর্যটকদের দেখাশোনার মত শ্রম, যা অবশ্যই বাড়ির মহিলাদের দায়িত্ব, সেগুলি এখন পুঁজি সঞ্চয়ের নতুন উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জলবায়ুর সমস্যার প্রেক্ষিতে অভিজ্ঞতা বিক্রির বিষয়টি কেবলমাত্র পাহাড়েরই বৈশিষ্ট্য নয়। কালিম্পং-এর এই হোমস্টেগুলি আদতে, অর্থনীতি ও পরিবেশ – এই দুই জোড়া সমস্যার ধাক্কায় মানুষের ভাবপ্রবণতাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা শ্রমের অভিমুখ পরিবর্তনের অংশ। হোমস্টেগুলি নতুন কোনও রিসোর্স ফ্রন্টিয়ার বা সম্পদ আহরণের প্রক্রিয়ায় নবতম কোনও সংযোজন নয়, বরং তার তীব্রতম একটি রূপ।
হোমস্টে-কেন্দ্রিক পর্যটন তাই সম্পদ নিষ্কাশনের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য গড়ে ওঠা একটি বিকল্প নয়। তার বদলে, এই জাতীয় পর্যটন ঔপনিবেশিক বিকাশের ক্ষতিকর প্রভাবের গভীরে জাত একটি সুদীর্ঘ ও সমস্যাসংকুল পথের অনেকগুলি উপাদানের মধ্যে একটি। জলবায়ুর পরিবর্তন এবং কৃষিক্ষেত্রে দ্রুত রূপান্তরের অর্থ, বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য, আরও শ্রম, যাঁরা, বিশেষত মহিলারা, এই জলবায়ুকেন্দ্রিক সমস্যার ধ্বংসাত্বক প্রভাবের কারণে সব চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
পরিকাঠামোর বিষয়ে পণ্ডিত যাঁরা, তাঁরা আমাদের সর্বদাই মনে করিয়ে দেন যে, প্রকৃতিগতভাবে ভঙ্গুর এই প্রকাণ্ড-প্রকল্পগুলি অনেক কারণে, এবং অনেক সময়ই, চোখের সামনে ভেঙে পড়ে। কালিম্পং এবং অন্যান্য সরকারি তালুক এক ধরনের ঔপনিবেশিক প্রকাণ্ড-প্রকল্প। এগুলিকে নির্মাণ করা এবং টেঁকসইভাবে ধরে রাখা বেশ আয়াসসাধ্য কাজ। এই আয়াসপূর্ণ শ্রম ঘটে চাষের মাঠে, নতুন দিল্লীর খাবারের দোকানের রান্নাঘরে আর কাজের সন্ধানে ইজরায়েল অভিমুখী ধাত্রীদের সে দেশের ভাষা শেখায় শিলিগুড়ির যে হিব্রু ভাষা প্রশিক্ষণের কেন্দ্র, তার অন্দরে। এই শ্রম ঘটে বাড়ির ভিতরে সংখ্যায় ক্রমশ বেড়ে চলা মধ্যবিত্ত ভ্রমণকারীদের দেখাশোনার মধ্যে, যে পর্যটকরা নেপালি, ভুটিয়া আর লেপচাদের থেকে খাঁটি পাহাড়ের অভিজ্ঞতা আশা করেন। যখন বিশ্বের পুঁজির সঞ্চয় উৎপাদন থেকে পুনরুৎপাদনের দিকে ঝুঁকছে তখন, প্রতিটি পর্যটক, প্রতিটি ধস এবং চাষবাসের মাধ্যমে আর জীবিকা উপার্জন করতে পারবেন না এমন প্রতিটি পরিবারের হাত ধরে, পাহাড়ের বাসযোগ্যতা তার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আরও সমস্যাসংকুল হয়ে উঠছে।