গ্লোবাল ভ্যালু চেইনে শিল্প নীতির ভূমিকাঃ ভারতের আখ্যান

23/10/2023
IiT English Page

শিল্প নীতি, অর্থাৎ নানা উদ্দেশ্যে, অর্থনীতির কিছু অংশ নির্মাণের ক্ষেত্রে সরকার একটি বিশেষ ভূমিকা নিতে পারে – এই ধারণাটি সারা বিশ্বেই ফিরে এসেছে। এর একটি মুখ্য উদাহরণ হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইনফ্লেশান রিডাকশান অ্যাক্ট। এই আইন অনুযায়ী, যে শিল্পগুলিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগত বলে মনে করে, সেগুলির পৃষ্ঠপোষকতা করা জন্য সরকারের তরফ থেকে ভর্তুকি, আয়করে ছাড়, ঋণ ও নানা অনুদান দেওয়া হচ্ছে। ভারতের কাছে এই বিশেষ প্রবণতাটি অপরিচিত নয়। ২০২০ সালে ভারতে প্রোডাকশান লিঙ্কড ইনসেন্টিভের প্রচলন হয়, যার মাধ্যমে যে ব্যবসাগুলি দেশের অভ্যন্তরে তাদের উৎপাদনকে প্রসারিত করেছে, তাদের আর্থিক সহায়তা দান করা হয়। যে তিনটি শিল্প দিয়ে এই পদক্ষেপটি শুরু হয় তা হল, ফার্মাসিউটিক্যাল, ইলেকট্রনিক্স ও চিকিৎসা-সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি নির্মাতা, এবং পরে সেগুলিকে সম্প্রসারিত করে অন্যান্য শিল্পকেও যুক্ত করা হয়।  

কিন্তু এই দেশের আভ্যন্তরীণ বিকাশমুখী নীতি কিভাবে “গ্লোবাল ভ্যালু চেইন” (জিভিসি)-তে একীভূত হওয়ার বৃহত্তর প্রচেষ্টা এবং ভারত যে “বৈচিত্রপূর্ণ, গণতান্ত্রিক” পুনঃ-বিশ্বায়নের জন্য আহ্বান জানিয়েছে, তার সঙ্গে খাপ খায়?

এই বিষয়টিকে বুঝতে হলে, আমাদের ফিরে যেতে হবে কোভিড-19 অতিমারীর সময়, যখন জিভিসি-র বিষয়ে আলাপআলোচনা শুরু হয়, সেই সময়ে। অতিমারীর কারণে তৈরি হওয়া বিশৃঙ্খলার তরঙ্গায়িত প্রভাব থেকেই সকলের হঠাৎ এই উপলব্ধি হয় যে, বিশ্বায়নে অভ্যস্ত এই বিশ্ব তার ভোগের অনেক উপাদানকেই জিভিসি-র মাধ্যমে অর্জন করে। সেই সময়ই, এই শৃঙ্খলের সঙ্গে জড়িত ঝুঁকি ও সেগুলির সহনশীলতার বিষয়টি মূল প্রশ্ন হিসেবে উঠে আসে।   

কিছু দিন আগে পর্যন্ত, রাষ্ট্রগুলি চেষ্টা করত বিদ্যমান জিভিসি-র সঙ্গে একীভূত হতে। জিভিসি-তে অংশগ্রহণ সাধারণত, বর্ধিত উৎপাদনশীলতার মত অর্থনৈতিক সুবিধার পাশাপাশি রপ্তানির ক্ষেত্রে বৃহত্তর পরিমার্জন ও বৈচিত্র এনে দেয়। ফলত, জিভিসি-তে অংশগ্রহণের বিষয়টি ঠিক কিসের দ্বারা নিশ্চিত হতে পারে, তা উপলব্ধির দ্বারা নীতি নির্মাণের প্রক্রিয়াটি প্রভাবিত হয়। কিন্তু, ভ্যালু চেইনে অংশগ্রহণের ফলে যে লাভ হয়, তা রাষ্ট্র বিশেষে ভিন্ন ভিন্ন হয়।  

সাধারণত, জিভিসি-র সঙ্গে একীভূত হওয়ার বিষয়টি ধরা পড়ে ব্যাকোয়ার্ড ও ফরোয়ার্ড লিঙ্কেজের মধ্যে দিয়ে। একটি অর্থনীতি কিভাবে তার নিজস্ব রপ্তানি যোগ্য পণ্যের উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ হিসেবে মধ্যবর্তী পণ্য (যে পণ্যকে ব্যবহার করে উৎপাদিত বস্তুর চূড়ান্ত রূপটির নির্মাণ হয়) বা পরিষেবাকে আমদানি করে তা পরিমাপ করে ব্যাকোয়ার্ড লিঙ্কেজ এবং ফরোয়ার্ড লিঙ্কেজ হল, যখন একটি রাষ্ট্র, অপর একটি রাষ্ট্রকে কোনও দ্রব্য উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদের যোগান দেয়, যার সাহায্যে উৎপাদিত ভোগ্যপণ্য আবার তৃতীয় একটি দেশে রপ্তানি করা হয়।   

সাম্প্রতিককালে, অনেক দেশই কয়েকটি নির্দিষ্ট বাণিজ্যিক অংশীদারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য শিল্প নীতির আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু, ভারতের প্রেক্ষিতে আমরা কিভাবে এই উৎপাদনকেন্দ্রিক সম্পর্কজালগুলি বোধগম্য হয়? 

জিভিসি একীকরণ
জিভিসি-র সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয় লিড ফার্মের মাধ্যমে, এবং এই লিড ফার্মগুলি সাধারণত বিশিষ্ট বহুজাতিক সংস্থা হয়ে থাকে, যারা এই ভালু চেইনের নির্মাণে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করে। একটি দেশের প্রেক্ষিতে দেখলে, এই শৃঙ্খলগুলির অংশভুক্ত হতে পারলে, তা নেটওয়ার্ক ও রপ্তানির কাজে সহায়তা করে। একটি দেশের আয়তন ও অবস্থান, জিডিপিতে (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট বা মোট দেশজ উৎপাদন) তার উৎপাদনের অংশ, এবং বাণিজ্য ও বিনিয়োগ নীতির মত অনেকগুলি উপাদানের উপর জিভিসিতে অংশগ্রহণ নির্ভর করে। বাণিজ্যের প্রকৃতি, যা ১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই ক্রমবর্ধমানভাবে মধ্যবর্তী পণ্য, অর্থাৎ যে কাঁচামালগুলি ব্যবহার করে পণ্যের চূড়ান্ত রূপটি নির্মিত হয়, তার সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছে এবং সেই কারণে, জিভিসির সঙ্গে একটি দেশের একীভূত হওয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। পরিবহনের খরচ, শুল্কের ভার হ্রাস করা এবং পরিবহনের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত প্রযুক্তির উন্নয়নের মত কিছু পরিবর্তনের কারণে মধ্যবর্তী পণ্যের ব্যবসাতে বৃদ্ধি হতে দেখা গেছে এবং ভিন্ন ভিন্ন দেশে অবস্থিত কারখানাতে, প্রতিটি স্তরেই অতিরিক্ত মূল্য সংযোজিত হচ্ছে। এর ফলে, কিছু অঞ্চল বা দেশে বিশেষ বিশেষ দ্রব্যের উৎপাদন ও বিশেষীকরণ করছে এবং, বিশেষত বৈদ্যুতিক পণ্য উৎপাদনের কারণে, “ফ্যাক্টরি এশিয়া” জাতীয় নামের জন্ম হয়েছে। অন্য দিক থেকে, কোনও দেশ যদি এই শৃঙ্খলের সঙ্গে যুক্ত না হয়, তাহলে রপ্তানির বাজারে জায়গা পাওয়া তার জন্য মুশকিল হয়ে উঠছে।   

লিড ফার্ম
এর পাশাপাশি, লিড ফার্মগুলির ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। লিড ফার্ম বলতে সেই সব ছোট, মাঝারি বা বড় বাণিজ্যিক সংস্থাকে বোঝায়, যাদের সঙ্গে অসংখ্য অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারী আয়তনের উদ্যমের (মাইক্রো, স্মল, মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ বা এমএসএমই) ফরোয়ার্ড বা ব্যাকোয়ার্ড লিঙ্কেজের সম্পর্ক আছে। একটি লিড ফার্ম একাই একটি সম্পূর্ণ ভ্যালু চেইনকে নিয়ন্ত্রণ করে।

লিড ফার্ম আর জিভিসি-তে অংশগ্রহণ করার বিষয়টি নির্ভর করে এমন সব উপাদানের উপর, যা একটি অনুকূল বাণিজ্যিক পরিবেশ সৃষ্টিতে, বিদেশী পুঁজি আকর্ষণে ও দেশীয় ব্যবসায়িক সংস্থাগুলির আন্তর্জাতিকীকরণে সাহায্য করে। দেশীয় ব্যবসায়িক সংস্থাগুলির আন্তর্জাতিকীকরণ সম্ভব হয় আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের পণ্য রপ্তানি করে এবং দেশজ পণ্যের অন্তিম রূপটির উৎপাদনকারীদের দ্বারা মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানির মাধ্যমে। উৎপাদনের ক্ষেত্রে জিভিসি-র উপস্থিতি কর্মসংস্থান, দক্ষতার উন্নতিকরণ এবং উৎপাদন-কেন্দ্রিক শিল্পায়নের সঙ্গে জড়িত অন্যান্য ক্ষেত্রেও অবদান রাখে। এই বাস্তুতন্ত্র জুড়ে আছে এমন একটি পরিবেশ তৈরির আকাঙ্ক্ষা, যা স্থানীয় উৎপাদনকারী, যাঁরা নিজেদের উৎপাদনের ক্ষমতাকে উচ্চতর স্তরে নিয়ে যেতে ও প্রতিযোগিতার মনোভাব তীব্রতর করতে চেষ্টা করে চলেছেন, তাঁদের সাহায্য করে।   

তবে, অনেক উন্নয়নশীল দেশের দেশীয় বাণিজ্যিক সংস্থা, বিশেষ করে অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারী আয়তনের উদ্যমগুলি খুব সহজে জিভিসি-র অংশ হতে পারে না, এবং জিভিসি-তে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে সমস্যার মুখোমুখি হয়। দক্ষিন-দক্ষিণ বাণিজ্যের (অর্থাৎ উন্নয়নশীল দেশগুলির পরস্পরের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক) উত্থানের ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলির পক্ষে স্থানীয় ও আঞ্চলিক ভ্যালু চেইনের গুরুত্ব অনেক বেড়ে গেছে।

স্বল্প উন্নত দেশগুলির উৎপাদকদের শিক্ষা ও নতুন উদ্ভাবনমূলক কাজকর্মে পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্য, তাদের সরবরাহকারীদের জ্ঞানদান করার মাধ্যমে লিড ফার্মগুলি (যেমন আন্তর্জাতিক ক্রেতারা) যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তার উপর জিভিসি-র ইস্তেহারগুলি জোর দেয়। তবে, লক্ষ্য করা গেছে যে, এই লিড ফার্মগুলি সাধারণত “পণ্য তুল্য” কার্যকলাপগুলি, যা খুবই সামান্য মূল্য যোগ করে, সেগুলিকে বাইরের কারও হাতে তুলে দিলেও, উচ্চ মান যোগ করে যে কাজগুলি, সেগুলির উপর নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতেই রেখে দেয়। তাই, জ্ঞানের হস্তান্তর অধিকাংশ সময়ই ঘটে কিছু নির্দিষ্ট কাজ বা শ্রম ও কিছু নির্দিষ্ট শিল্পের মাধ্যমে।   

উচ্চমূল্য যুক্ত কার্যকলাপে উন্নীত হওয়ার পর, তা দেশীয় শ্রমের উৎপাদনশীলতা ও দক্ষতাকে আরও উন্নত করলেও, উন্নয়নশীল দেশগুলি অধিকাংশ সময়ই অতি সামান্য বা একেবারেই শূন্য প্রযুক্তিগত জ্ঞানের আদানপ্রদান ছাড়াই নিম্নমান যুক্ত কাজে আটকে থাকে। এই উন্নীত হওয়ার সংজ্ঞা হল, “এমন কৌশল যার প্রচলনের মধ্যে দিয়ে কোনও বাণিজ্যিক সংস্থা, রাষ্ট্র বা অঞ্চল উচ্চমান যুক্ত কার্যকলাপ ও আরও বর্ধিত ভ্যালু ক্যাপচারের (অর্থাৎ, প্রতিটি লেনদেনের মূল্য থেকে কিছু শতাংশ রেখে দেওয়া) দিকে এগিয়ে যাওয়া যায়।” এই পরিপ্রেক্ষিতে লিড ফার্মের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।  

নীতির প্রেক্ষিতে, জিভিসি ঠিক কিভাবে অর্থনীতির সঙ্গে একীভূত হয়, তা একটি জরুরী বিষয় এবং লিড ফার্মের সঠিক ভূমিকাটিও গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও, জিভিসি-র সঙ্গে সংযুক্ত হওয়া ও উন্নয়নে উৎসাহদানের ক্ষেত্রে শিল্প ও অন্যান্য নীতি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। 

কোথায় শিল্প নীতি?
উন্নয়নমূলক নীতির কেন্দ্রে আছে শিল্প নীতি, এবং অনেক সময়ই এর অন্যান্য নামও আছে (যেমন, রপ্তানি সহায়ক, বিদেশী বিনিয়োগে উৎসাহদান বা মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল) । এই নীতি শুধু উৎপাদনকেন্দ্রিক শিল্পে যে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে, সেগুলিকে কেন্দ্র করেই নির্মিত হয় না, এর সঙ্গে আছে পরিষেবা ও কৃষিকেন্দ্রিক নীতিও।   

তাত্ত্বিক দিকে থেকে দেখলে, শিল্প নীতি নিয়ে যে বিতর্কগুলি দেখা যায় তার উৎস বাজারের ব্যর্থতা। অর্থনীতিবিদ ড্যানি রড্রিক বলেন যে, শিল্প নীতির প্রয়োজনীয়তা তাত্ত্বিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত ও সুবিন্যস্ত। এর পক্ষে বাজারের ব্যর্থতাকে সম্বোধন করা সম্ভব, কিন্তু এর বাস্তবায়ন খুবই কঠিন। তিনি যেমন ব্যাখ্যা করেছেন, শিল্প নীতির ক্ষেত্রে সাধারণ বিতর্কটি উঠে এসেছে ঋণ, শ্রম, উৎপাদন ও জ্ঞানের বাজারের ব্যর্থতা থেকে। 

রড্রিকের মতে, চর্চার দিক থেকে, শিল্প নীতির বিরুদ্ধে দুটি যুক্তি আছে। এর একটি হল, তথ্যের অসমতা এবং অন্যটি হল দুর্নীতি ও ভাড়া আদায়। প্রথমটির ক্ষেত্রে, ত্রুটিপূর্ণ বাজারের দ্বারা যে বাণিজ্যিক সংগঠন, সেক্টর বা বাজার প্রভাবিত হয়, তার মধ্যে ঠিক কারা জয়ী হয়েছে, তা চিহ্নিত করা সরকারের পক্ষে দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। তা সত্ত্বেও, শিল্প নীতি সরকারকে জোর করে ঠিক সেই কাজটিই করতে বাধ্য করে। দ্বিতীয়ত, অনেক সময়ই বলা হয়ে থাকে যে, শিল্প নীতির কারণে দুর্নীতি ও ভাড়া আদায়ের মত ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। শিল্প নীতির অভিজ্ঞতামূলক মূল্যায়নের বিষয়ে শিল্প নীতির পক্ষে ও বিপক্ষে যাঁরা আছেন, তাঁরা সকলেই নিজের নিজের যুক্তির উপস্থাপনা করে। যাঁরা পক্ষে, তাঁদের মতে অনেক ক্ষেত্রেই, বিশেষ করে জাতিপরিচয় ভিত্তিক উদাহরণগুলির ক্ষেত্রে, শিল্প নীতি সাফল্যের সঙ্গে কাজ করে।   

ভারতের জিভিসিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া ও শিল্প নীতি
ভারতের উৎপাদনের ক্ষমতা সুবৃহৎ হওয়া সত্ত্বেও, বিশেষ করে মাঝারি আয়তনের প্রযুক্তিশিল্পের ক্ষেত্রে, জিভিসি-তে এই দেশের অংশগ্রহণ সীমিত। তার উপর, জিভিসি-তে ভারতের অংশগ্রহণ কয়েকটি মাত্র শিল্পেই (যেমন, অটোমোবাইল শিল্প) সীমাবদ্ধ। এছাড়াও রপ্তানির দিক থেকে দেখলে, বিশেষ করে পোষাক শিল্পের মত শ্রমসাধ্য পণ্যের ক্ষেত্রে, ভারত পিছিয়ে পড়ছে। 

এছাড়াও, ভারতের ক্ষেত্রে, যখন পণ্যের উন্নতিকরণ (অর্থাৎ, একটি জিভিসি-র অন্তর্গত উচ্চমান যুক্ত পণ্যের বন্ধনীতে উন্নীত হওয়া) এবং প্রক্রিয়ার উন্নতিকরণ (অর্থাৎ, একটি জিভিসি-র অন্তর্গত কার্যকলাপের উৎপাদনশীলতায় বৃদ্ধি আনা) ঘটলেও, কার্যকরী উন্নতিকরণ (অর্থাৎ, প্রযুক্তিগতভাবে অত্যাধুনিক বা সমন্বিততর উৎপাদন প্রক্রিয়ার উন্নীত হওয়া) এবং আন্তঃশিল্প উন্নতিকরণের সুযোগ সীমিত। পোষাক শিল্পের ক্ষেত্রে ঠিক এই ঘটনাটিই ঘটেছে। উচ্চতর মানযুক্ত সরবরাহ শৃঙ্খলের দিকে সরে গেলে, তবেই আন্তঃশিল্প বা শৃঙ্খলাবদ্ধ উন্নতিকরণ সম্ভব।  

ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট আকর্ষণ করার জন্য তাদের নীতিগুলিকে উপযুক্তভাবে প্রস্তুত করার মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশগুলি জিভিসি-তে তাদের অংশগ্রহণকে আরও ভালভাবে উদ্দীপিত করতে পারবে এবং তাদের অর্থনীতিতে বহুজাতিক বাণিজ্যিক সংস্থাগুলির কার্যকলাপের উন্নয়ন-কেন্দ্রিক সুযোগসুবিধাগুলিকে বাড়াতে পারবে। জিভিসি-তে অংশগ্রহণের সম্ভাবনা বাড়াতে শিল্প নীতির যে শ্রেণীবিন্যাসকে এই দেশগুলি অনুসরণ করতে পারে, তাতে তিনটি ধরনের নীতি দেখা যায়। আনুভূমিক নীতি যা গোটা দেশের অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে (যেমন, পণ্য ও পরিষেবা কর), উল্লম্ব নীতি যার লক্ষ্য নির্দিষ্ট সেক্টর বা শিল্প (যেমন, অটোমোবাইল শিল্পের জন্য অটোমোবাইল মিশন প্ল্যান ২০১৬-২৫), এবং সব শেষে জিভিসি-কেন্দ্রিক নীতি। এই শেষ নীতিটি উন্নতিকরণ এবং মূল্য শৃঙ্খলের ভিন্ন ভিন্ন অংশের সংযোগকে উন্নত করার সম্ভাবনাকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। অধিকাংশ সময়েই ভারত নীতিগুলিকে দেখে লজিস্টিকাল ও পরিকাঠামোগত সীমাবদ্ধতাকে সম্বোধন করতে এবং আয়াসহীনভাবে ব্যবসা করার ব্যবস্থাকে আরও উন্নত করার পন্থা হিসেবে, এবং এই মনোভাবকে আনুভূমিক বা উল্লম্ব হিসেবে শ্রেণীবিন্যস্ত করা যায়। তবে, বৃহত্তর অন্তর্ভুক্তির জন্য প্রয়োজন আরও বেশি সংখ্যক জিভিসি-কেন্দ্রিক নীতি। 

শিল্প নীতি ২.০
সাম্প্রতিককালে, শিল্প নীতির পুনরুত্থান হতে দেখা যাচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইনফ্লেশান রিডাকশান অ্যাক্ট, এবং ভারতের ক্ষেত্রে, প্রোডাকশান-লিঙ্কড ইনসেন্টিভ (পিএলআই)-এর মত হালের পরিকল্পনাগুলির কথা উল্লেখ করা যায়। আপাতত, এই পরিকল্পনাগুলি মোট চৌদ্দটি সেক্টরকে লক্ষ্য করে ঘোষণা করা হয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরও সেক্টরকে এদের আওতায় আনা হতে পারে। কিছু দিন আগে চালু হওয়া “মেক ইন ইন্ডিয়া” কার্যক্রমের পর, এগুলি ভারতের সবচেয়ে নতুন পরিকল্পনা। এগুলির সাহায্যে ভারত আরও বেশি এফডিআই আকর্ষণের ও “সেরা বাণিজ্যিক সংস্থা” সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে।

এই বছরের শুরুতে যে নতুন বিদেশী বাণিজ্য নীতি ঘোষণা করা হয়, তার উদ্দেশ্য হল ভারতকে জিভিসি-র অঙ্গীভূত করা ও ভারতকে একটি ব্যস্ত রপ্তানি কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা। বাণিজ্যিক সংস্থাগুলির আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবের উন্নতিসাধন ও ভারতীয় শিল্পের আঞ্চলিকীকরণ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে নির্মিত পিএলআই পরিকল্পনাগুলিকে এর পরিপ্রেক্ষিতে দেখা দরকার। জিভিসি-র সঙ্গে ভারতের একীকরণের সুযোগ বাড়িয়ে তোলার জন্য পরিকল্পিত জিভিসি-কেন্দ্রিক নীতির প্রেক্ষিতেও এই পিএলআই পরিকল্পনাগুলিকে বিচার করা উচিত। সেরা বাণিজ্যিক সংস্থা নির্মাণ করতে গিয়ে এই পরিকল্পনাগুলি “বিজয়ী” বাছাই করার চেষ্টা করছে, যা শিল্প নীতির লক্ষ্যের সঙ্গে খাপ খায়। তবে, ভবিষ্যতে এই বাণিজ্যিক সংস্থাগুলি আদৌ লিড ফার্ম হয়ে উঠতে পারবে কিনা, সেটাই দেখার বিষয়।

নীতি বিষয়ে ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে, দেশজ উৎপাদনের পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্য, আমদানি করা কাঁচামালের উপর ধার্য শুল্ক বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে এই পদক্ষেপটি কাজ করলেও, যে সমস্ত সেক্টরের কোনও ক্যাপাসিটি বা, উৎপাদনের সর্ব্বোচ্চ পরিমাণ নেই (যেমন, সৌর প্যানেল, ইভি ব্যাটারি), সেখানে আশুকালে উৎপাদনের খরচ বেড়ে যাবে। পিএলআই পরিকল্পনা ও আমদানি করের সংমিশ্রণের মধ্যে দিয়ে ভারত দেশের অভ্যন্তরেই উৎপাদন শৃঙ্খলের একটি বড় অংশ তৈরি করার চেষ্টা করছে।

এই কাজে সফল হলে, পণ্য উৎপাদনের জন্য ভারত, দেশের মধ্যেই এমন একটি দেশীয় উৎপাদনকেন্দ্র গড়ে তুলতে সক্ষম হবে, যার মাধ্যমে রপ্তানিও সম্ভব। অন্যদিকে, কর সুরক্ষা সত্ত্বেও যদি কাঁচামালের উৎপাদন বিশ্বজনীন প্রতিযোগিতার যোগ্য না হয়ে ওঠে, তাহলে ভারত এমনকি ডাউনস্ট্রীম শিল্পকেও (তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস শিল্পের যে দিকটি পেট্রোলিয়ামজাত পণ্যের পরিশোধন, বিতরণ ও খুচরো বিক্রয়ের জন্য দায়ী) “ফ্যাক্টরি এশিয়া”-র মূল্য শৃঙ্খলের অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ হারাবে। শিল্প নীতি ও আমদানিকৃত দ্রব্যের বিকল্পের মধ্যে পার্থক্যটি বোঝা দরকার। যে সমস্ত জিনিস এতদিন আমদানি করা হত, দেশের মধ্যেই তার বিকল্প তৈরি হলে দেশীয়ভাবে উৎপন্ন মধ্যবর্তী পণ্যের উপর নির্ভরশীলতা বাড়বে এর ফলে দেশজ উৎপাদন অনেক বেশি পৃষ্ঠপোষকতা পেলেও, তার ফলাফল জিভিসি-র সঙ্গে ব্যাপকতর একীকরণ নাও হতে পারে। অতএব, পিএলআই পরিকল্পনার মাধ্যমে জিভিসি-র সঙ্গে ব্যাপক সংযুক্ত হওয়ার লক্ষ্যটি অনিশ্চিতই থেকে যায়। এই নীতিগুলি কি আদৌ ভারতের উৎপাদন সেক্টরকে এগিয়ে নিয়ে যাবে এবং “কর্মহীন উন্নয়ন”-এর সমাধান করতে ক্ষম হবে? এই প্রশ্নগুলির উত্তর এখনও ভবিষ্যতের গর্ভে।   

শাওন রায়

Author

শাওন রায় নতুন দিল্লির ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর রিসার্চ অন ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক রিলেশনস (আইসিআরআইইআর)-র অধ্যাপক। তিনি এ প্রাইমার অন ইলেকট্রিক ভিহেকলস ইন ইন্ডিয়াঃ এ মেশিন-জেনারেটেড লিটারেচার ওভারভিউ ২০২৫ এডিশন (স্প্রিঙ্গার, ২০২৪) বইটির সহসম্পাদক। 

(Bangla Translation by Sritama Halder)
অনুবাদঃ শ্রীতমা হালদার