জি-২০-র সদস্য দেশগুলির নিয়মিত সম্মেলন এবং ভারতকে পালা করে সভাপতিত্ব করার সুযোগ দেওয়ার ঘটনাটিকে নরেন্দ্র মোদীর সরকার যে একটি উৎসবের ঘটনা করে তুলেছেন, তা থেকে এই সম্মেলনের গুরুত্বের চেয়ে বেশি প্রমাণিত হয় যে, বিজেপি রাজনীতি বিষয়টিকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে।, তা ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে সারা বিশ্বের মধ্যে অতুলনীয় মর্যাদাসম্পন্ন নেতা হিসেবে যে বিজেপি তুলে ধরার চেষ্টা করে চলেছে, তার সঙ্গে জি-২০ নিয়ে যে ব্যাপক উল্লাসের বাতাবরণ তৈরি করার এই প্রয়াসটি খাপ খায়। এখন প্রশ্ন হল, ভারতের জন্য কি জি-২০ সম্মেলনের সামষ্টিক অর্থনীতিকেন্দ্রিক কোনও গুরুত্ব আছে? বিশেষত, জি-২০-র সদস্য দেশসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলির সঙ্গে ভারতের প্রধান অর্থনৈতিক উদ্বেগ এবং সমস্যার তুলনা না করলে এই প্রশ্নটির উত্তর পাওয়া যাবে না।
এই আলোচনাটি শুরু করতে হলে, বিশ্বের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিবেশকে পুনর্মূল্যায়ন করা জরুরী। অতিমারী, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও উন্নত পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলিতে মুদ্রাস্ফীতির ঢেউ – পর পর এই তিনটি ধাক্কা আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে চরম বিশৃঙ্খলা তৈরি করেছে। যদি দরিদ্র শ্রেণীর প্রতি ক্রমবর্ধমান অসাম্য এবং তাদের উপার্জনের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টি নিয়ে যদি বিবেচনা নাও করা হয়, অর্থনৈতিক শৃঙ্খলার স্থিতিশীলতার উপর আগ্রাসী আর্থিক বাঁধন এবং বৃদ্ধির জন্য মিডিয়াম-টার্ম ব্যয় নিয়ে বিশ্বঅর্থনীতির বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উদ্বিগ্ন হয়েই আছেন। বহুপাক্ষিক বাণিজ্যের নকশাটি কার্যত ধ্বংস হওয়ার পরই এই অবস্থাটি তৈরি হয়েছে এবং চাকরীর সুযোগ বাড়ানর জন্য বিকল্পের আমদানি করার মনোভাব গ্লোবাল নর্থে ক্রমশ বাড়ছে। এর অর্থ হল, ভারত একটি নেতৃত্বস্থানীয় ভূমিকা নিয়েছিল যে দোহা রাউন্ড অফ দ্য ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনে (ডাবলিউটিও), সেখানে আগেকার উন্নয়নের কার্যাবলীতে ফিরে যাওয়াকে সুনিশ্চিত করার জন্য যে আলোচনা হয়েছিল, সেরকম অর্থবহ কথোপকথনের সুযোগ জি-২০-র মত সমাবেশের হাতে খুবই কম।
নিঃসন্দেহে, জি-২০-র মত বহুপাক্ষিক সমাবেশে, দুই দশকের পুরনো উন্নয়নমূলক কার্যাবলীতে ফিরে যেতে যে সমাবেশের সভাপতি হিসেবে ভারতের খুব একটা আগ্রহ ছিল, তা নয়। অসংখ্য ভারতীয় যখন নিম্ন-মধ্যবিত্ত আয়, বা এমনকি একটি নিম্নআয়ের দেশের পরিস্থিতি থেকে তৈরি হওয়া নানা উপসর্গে ভুগে চলেছেন তখন, ডলারের প্রেক্ষিতে, সামষ্টিক অর্থনীতি বিশ্বে তৃতীয় স্থানেই থাকে যাবে, যা বিশ্ব-অর্থনীতির প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণে আগ্রহী একটি উল্লেখযোগ্যভাবে অগ্রসরমান ও গভীর পুঁজিবাদী ভিত্তির উপস্থিতি ঘোষণা করে। আশ্চর্যজনক নয় যে, পাশ্চাত্যে যে শিল্পনির্ভর নীতি ও সুরক্ষাবাদে ফিরে যাওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়েছে, ভারতেও তার অনুরূপ অবস্থা দেখা গেছে।
জি-২০-র এই সামষ্টিক অর্থনীতির উপাদানগুলি কি এই তথ্যগুলির মাধ্যমে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়? একটি বিশেষ বিষয়ের উপস্থিতি ছাড়া তা ঘটতেই পারত। সম্ভাবনা আছে যে, এই বিষয়টি খুব দ্রুত আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সহযোগিতার কার্যনীতিতে আধিপত্য করবে। জলবায়ু পরিবর্তনকে মোকাবিলার জন্য চিরচরিত নকশা অনুসরণ করলে এই পৃথিবীর জলবায়ুতে যে একটি ভয়াবহ পরিবর্তন আসবে আজকাল তার যথেষ্ট বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ পাওয়া যায়। এই সমস্যাকে মেনে নেওয়া এর সঙ্গে লড়াই করার পন্থা নয়। বরং, এই পরিস্থিতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বাস্তবসম্মত উপায় হল জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবকে প্রশমিত করার প্রচেষ্টাকে আর্থিকভাবে সাহায্য করার উপায় নিয়ে ভিন্নমতের পরিসর তৈরি করা। এই বিতর্কের কেন্দ্রে আছে সবুজায়নকে আর্থিক সাহায্য দেওয়ার সামর্থ্য ও এই ধরনের সাহায্যের প্রয়োজনীয়তার মধ্যে একটি অসাম্য। জলবায়ুর অবস্থাকে সহায়তা করার জন্য উন্নত দেশগুলির দিক থেকে যতটা আর্থিক সাহায্য আসা উচিত বলে গ্লোবাল সাউথ মনে করে, ওই দেশগুলি সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে রাজি নয়। জলবায়ুর অবস্থাকে আর্থিক সহায়তা দানের বিষয়ে আলোচনার প্রথম দিন থেকেই এই সমস্যাটি বিদ্যমান থাকলেও, ভবিষ্যতে তা যে আরও ভয়াবহ দিকে যাবে, তা মনে করার কারণ আছে। যখন ভর্তুকিকৃত শিল্পকেন্দ্রিক নীতির মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করার জন্য অর্থনৈতিক নীতিগুলিকে পুনর্নির্মাণ করার একটি জনমত তোষণকারী চাপ তৈরি হচ্ছে, তখন অধিকাংশ বিশেষজ্ঞই অগ্রসর অর্থনীতিতে ঘাটতি ও দেনার পরিমাণে বৃদ্ধি দেখতে পাচ্ছেন। যে অর্থনৈতিক সম্পদকে জলবায়ুর অবস্থাকে আর্থিক অবলম্বনের প্রয়োজনীয়তা মেটানর জন্য ব্যবহার করা যেত, তাকে এই ঘাটতি ও দেনা থেকে তৈরি হওয়া চাহিদা সম্ভবত গ্রাস করে নেবে
এই পরিপ্রেক্ষিতেই, সবুজায়ন এবং ব্যাপকার্থে দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়নের ভবিষ্যতের জন্য, বিশেষ করে ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক ও আইএমএফ – এই দুই ব্রেটন উড দৈত্যের মত বহুপাক্ষিক অর্থনৈতিক সংগঠন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। এবং ঠিক এই দিক থেকেই ভারত, তার জি-২০ সভাপতিত্বের সময় কিছু বিষয় নিয়ে এগোনোর আশা করছে। বলাই বাহুল্য, আইএমএফ/ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের সংস্কারের দাবী নতুন নয়, এবং চিন ও ভারতের মত দেশের অর্থনৈতিক প্রভাবের উত্থানের প্রেক্ষিতে এই দাবীগুলি পুরোপুরি ন্যয়সঙ্গত। তবে, প্রাক্তন ইউএস ট্রেজারি সচিব লরেন্স সামারস ও ভারতের পনেরতম অর্থনৈতিক আয়োগের প্রাক্তন সভাপতি এন. কে. সিং-এর যুগ্ম আহ্বানে বহুপাক্ষিক উন্নয়নমূলক ব্যাঙ্ককে শক্তিশালী করে তোলার জন্য বিশেষজ্ঞদের দল তৈরি করার পদক্ষেপ থেকে মনে হচ্ছে যে ভারত নতুন আগ্রহ ও কর্মশক্তি নিয়ে সংশোধনের পন্থা গ্রহণ করেছে। যাঁদের নাম এখানে উল্লেখ করা হল, সেই দুইজনেরই তাঁদের নিজের নিজের দেশের “ডিপ স্টেট” অর্থনৈতিক নীতির বিষয়ে অভিজ্ঞতা আছে। ভারত ইতিমধ্যেই বহুপাক্ষিক উন্নয়নমূলক ব্যাঙ্কের মূল লক্ষ্যের তালিকাতে বিশ্বজনীন জনসম্পদের বন্দোবস্ত করার বিষয়টিকে যুক্ত করার জন্য চাপ দিতে শুরু করেছে এবং এখনও পর্যন্ত কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছনো না গেলেও, এই সমস্যাগুলি নিয়ে কাজ শুরু হবে বলে আশা করছে। বিশ্বজনীন জনসম্পদ বলতে জলবায়ু থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য ও সংস্কৃতিসহ ডিজিটাল ডোমেইন পর্যন্ত সব কিছুকে বোঝায়।
নিঃসন্দেহে, এখনও পর্যন্ত এমন কিছু ঘটে নি, যা থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, এই প্রশ্নগুলি নিয়ে যে আলোচনাটি চলছে তার ফলাফল যে ভারত বা গ্লোবাল সাউথের জন্য অনুকূল হবে। তবে, সেগুলি থেকে অন্তত এই সঙ্কেত পাওয়া যায় যে, ভারতের অর্থনৈতিক এবং ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব সব চেয়ে ভালোভাবে ব্যবহৃত হতে পারে এমন একটি প্রশ্নের উপর যাকে ভবিষ্যতের প্রধান লড়াই হিসেবে ব্যাপকভাবে বিবেচনা করা হয়। এই গুরুত্বপূর্ণ লড়াইটি হল, পরিবেশকেন্দ্রিক বিষয়ের জন্য আর্থিক সহায়তা, যদিও আমরা দীর্ঘস্থায়ী চাকরীর সুযোগ এবং সাধারণের জন্য উচ্চমানের জনকল্যাণমূলক পরিষেবার মত আগেকার উন্নয়নকেন্দ্রিক সমস্যাগুলির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে চলেছি। দ্বিতীয় বিষয়টিকে খুব সহজে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়, কারণ ভারতের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনী ক্ষেত্রে দেশীয় রাজনৈতিক সক্রিয়তার ফলাফলকে রূপ দিতে এই উদ্বেগগুলি বেশ বড় ভূমিকা নেয়। আশ্চর্যজনকভাবে, বিশ্বঅর্থনীতিতে ভারতের অর্থনৈতিক শক্তির বৃদ্ধির (মূলত মোট জিডিপি বা গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট বা মোট দেশজ উৎপাদনের যোগফলের কারণে) সঙ্গে সঙ্গে, অসম উন্নয়নের প্রভাবকে উপশম করতে আরও বেশি করে সমাধানমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য রাজস্বের ভাঁড়ারের উপর দাবী কমার বদলে যেন আরও বেড়ে চলেছে।
বাস্তবিকই, যে পরিমিত বাস্তববোধের দ্বারা জি-২০কে কেন্দ্র করে সামষ্টিক অর্থনীতিকেন্দ্রিক সংলাপটিকে চালিত হবে তা হল, কোন সহজলভ্য পরিণতি আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সহযোগিতার ভবিষ্যতে অপেক্ষা করে নেই। বরং দেশের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অর্থনীতিকেন্দ্রিক ভাবনা এবং সেই সংক্রান্ত ব্যয়ের কারণে কোনও দেশের পক্ষেই, এমনকি মিডিয়াম-টার্মের জন্যও, উচ্চাকাঙ্খী উদ্যোগ নেওয়া মুশকিল হবে।এছাড়াও, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে মতভেদ জি-২০-র ঐকমত্যকে বিভ্রান্ত করতে পারে – এই বিষয়টি এমন একটি নির্মম বাস্তবকে সামনে আনে, যেখানে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতিগুলির মধ্যে ভূ-রাজনীতিকেন্দ্রিক পারস্পরিক সমস্যার কারণে অর্থনৈতিক সহযোগিতার স্তরে পৌঁছনো আরও কঠিন হয়ে উঠবে।