কোভিড-19 নিয়ে ভারতে বার্তা ও তথ্যের আদানপ্রদানঃ আমরা কি প্রতিষেধকের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি?

15/02/2021
IiT English Page

২০২১ সালের ১৬ জানুয়ারী ভারতে প্রায় তিনশ মিলিয়ন ফ্রন্টলাইন ওয়ার্কার অর্থাৎ যে যাঁরা সামনের সারিতে থেকে দাঁড়িয়ে করোনা অতিমারীর মোকাবিলা করছেন তাঁদের টিকাদান প্রক্রিয়ার প্রথম পর্ব শুরু হয়েছে। এই সংখ্যক কর্মীকে টিকা দেওয়ার প্রস্তুতি সম্ভবত পৃথিবীর বৃহত্তম টিকাদান উদ্যম। এই রোলআউটের মধ্যে আছে ভারতের নিজের তৈরি কোভ্যাক্সিন (ভারত বায়োটেক/ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ) ও দেশীয়ভাবে উৎপাদিত কোভিশিল্ড (সেরাম ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া/অক্সফোর্ড-আস্ট্রাজেনেকা) এই প্রতিষেধকগুলির দরুন অতিমারীরর কারণে এগারো মাস জুড়ে চলা লকডাউনের অবরোধকাল সম্ভবত শেষ হতে চলেছে। 

গত এক বছরে, আন্তর্জাতিক ও দেশীয় দুই স্তরেই কার্যকরী জনস্বাস্থ্য নীতি ও প্রস্তুতির অবস্থা কি অবস্থায় আছে, অতিমারী তার লিটমাস টেস্ট হিসেবে কাজ করেছে। অসম্পূর্ণ এবং অনেক সময়ই জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে অনুপযুক্ত প্রতিক্রিয়ার কারণে পৃথিবী জুড়ে জীবন এবং জীবিকাহানির পাশাপাশি অতিমারী অবস্থা থেকে তৈরি হওয়া এক ধরনের অবসাদ এবং রোগের বিস্তার আটকাতে যে বাধানিষেধগুলি প্রয়োগ করা হয়েছে সেগুলিকে প্রতিহত করার ঘটনা ঘটে চলেছে। এর থেকেই বোঝা যায় যে জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত কোন জরুরি অবস্থার মুখোমুখি হলে তার ঝুঁকি ঠিক কতটা সে সম্বন্ধে জনসাধারণকে সচেতন করতে জোটবদ্ধভাবে কাজ করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। ইউএসের মত উচ্চআয়ের দেশগুলির প্রাথমিক প্রয়াস যখন ছিল জরুরি চিকিৎসা পরিষেবার পরিধি বাড়ানো তখন ভারত সহ নিম্ন থেকে মধ্যম আয়ের দেশগুলি তাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার উপর বাড়তে থাকা চাপ সহ্য করার অক্ষমতা স্বীকার করে নেয়। এর ফলে, ওই জাতীয় পরিষেবা বৃদ্ধির বদলে কোভিড-19 রোগকে কেন্দ্র করে ব্যাপক নজরদারি ও এই রোগের বিপদ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর প্রচার করতে শুরু করে। 

বিপদ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করার পন্থা জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে বা ভারতের জন্য নতুন কোন বিষয় নয়। বিভিন্ন সময়ে আঞ্চলিকস্তরে মহামারী অবস্থার মোকাবিলা করে প্রশিক্ষিত হওয়ার পর ভারতের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার হাতে যে হাতিয়ারগুলি আছে তার মধ্যে অন্যতম হল সামাজিক ক্ষেত্রে ও আচরণব্যবহারের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন আনার জন্য প্রচার চালান। উদাহরণ হিসাবে উল্লেখ করা যায়, ২০১৮ পোষণ অভিযান (জাতীয় পুষ্টি মিশন বা বা ন্যাশনাল নিউট্রিশন মিশন)-এর একটি প্রধান উপাদান ছিল জন আন্দোলন। এখন কোভিড-19 সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে এই ব্যবস্থাকে অবলম্বন করে যে পদক্ষেপগুলি নেওয়া হচ্ছে সেগুলি হল, ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত মাধ্যমের সাহায্যে নানা সচেতনতামূলক বার্তা সমস্ত সামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যে প্রচার এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থার সমস্ত অংশীদারকে নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে নানা জবানী নির্মাণ। উল্লেখযোগ্য, দুই মিলিয়নের বেশি অ্যাক্রেডিটেড সোশাল হেলথ অ্যাক্টিভিস্ট (আশাকর্মী) অঙ্গনওয়াড়ী কর্মী ইতিমধ্যেই মা এবং শিশুস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে তাঁদের যে ভূমিকা তাকে বিস্তৃত করেছেন কোভিড-19 সম্পর্কে গোষ্ঠীসচেতনতা বাড়ানোর কাজের মধ্যে। 

এপ্রিল মাসে, স্বাস্থ্য এবং পরিবার কল্যাণ মন্ত্রক (এমওএইচএফডাবলিউ) কোভিড-19 রোগের ব্যাপক প্রাদুর্ভাব সংবরণের পরিকল্পনা বের করেন। এই পরিকল্পনায় প্রশাসনিক দপ্তরগুলির মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা, জাতীয় ও রাজ্যস্তরের প্রতিক্রিয়ার মধ্যে ঐক্যবিধানের নির্দেশ দেওয়া হয়। ন্যাশনাল রিস্ক কমিউনিকেশন প্ল্যানের উপর ভিত্তি করে তৈরি, এই পরিকল্পনায় জনসংযোগ মাধ্যম (গণ প্রচার, এসএমএস, সামাজিক মাধ্যম বা সোশ্যাল মিডিয়া, রেডিও, দূরদর্শন), ইতিমধ্যেই যাদের সঙ্গে কাজ করা হচ্ছে (যেমন, ইউনিসেফ), সক্রিয় হেল্পলাইন, সংবাদমাধ্যমে নিয়মিত ঘটনার সারসংক্ষেপ জানানো ইত্যাদির সাহায্যে রোগ সংক্রান্ত নানা তথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। 

মার্চ আর এপ্রিলের মধ্যে ভারতের জাতীয় টেলিভিশন চ্যানেল দূরদর্শনে হিন্দি ও ইংরাজিতে মোট ছত্রিশটি ভিডিও দেখানো হয়। তার পাশাপাশি, অতিমারীর প্রকোপ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আঞ্চলিক ভাষামাধ্যমেও এই বিষয়ে কথা বলা চলতে থাকে। প্রথম প্রচারগুলিতে রোগের লক্ষণ, ভ্রমণসংক্রান্ত সতর্কীকরণ এবং রোগপরীক্ষার উপর জোর দেওয়া হয়। পরবর্তী বার্তাগুলিতে মুখে আবরণের ব্যবহার, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার মত বিষয়কে সামনে আনা হয়। এর পর সামাজিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়া হয় এবং সব শেষে প্রতিষেধকের বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়। সরকারপক্ষ থেকে নিয়মিতভাবে জনসাধারণকে অতিমারী সংক্রান্ত সাম্প্রতিকতম তথ্যগুলি সরবরাহ করার পাশাপাশি সারা দেশের সাংবাদিকরাও একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন। তাঁরা ক্রমাগত আবিষ্কার হতে থাকা নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক তথ্যগুলিকে স্বাস্থ্য বিষয়ে মূলত অজ্ঞ সাধারণ মানুষের বোধযোগ্য ভাষায় ব্যাখ্যা করে চলেছেন। ভারতের যেকোনো আকারের শহর, শহরতলী এবং গ্রামে সোশ্যাল মিডিয়ার যে ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়েছে তার অর্থ হল কোভিড-19 নিয়ে, ঠিক বা ভুল, যেকোন রকম তথ্য বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে সেগুলি তাঁদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে।  স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিভিন্ন অংশীদাররা সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেদের উপস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বাসযোগ্য তথ্যাদি সরবরাহ করছেন (যেমন, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক, ভারত সরকারের চ্যাটবট)। 

কোভিড-19 ভাইরাসের টিকা হিসাবে প্রাথমিকভাবে যেগুলিকে ধরা হয়েছিল তাদের মধ্যে প্রথম টিকা তৈরির মত ঐতিহাসিক বিষয়ের পাশাপাশি, সম্ভাব্য টিকার জন্য গণদাবী তৈরি করতে আর সেগুলির প্রতি আস্থা বাড়াতে জনস্বাস্থ্য দপ্তর, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়ের সাংবাদিক, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ, ওষুধপ্রস্তুতকারী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা তাঁদের মতামত দান করেছেন। এই সহায়তাগুলি হল, টিকার উমেদারদের বর্ণনা, বিভিন্ন ধরনের প্রতিষেধক ও তারা কি ভাবে কাজ করে তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ আর সেগুলি নিয়ে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল এবং টিকার অনুমোদন এবং সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূচক, অর্থাৎ সেগুলির নিরাপত্তা ও কার্যকারিতা নিয়ে নানা আলোচনা।   

একটি জাতীয় কোভিড-19 ভ্যাক্সিন কম্যুনিকেশন স্ট্র্যাটেজি এই টিকা সংক্রান্ত নানা বিষয়কে চালনা করার নানা পন্থাকে চিহ্নিত করে। এই পন্থাগুলি হল, কোভিড-19 টিকা বিষয়ক তথ্যের প্রচারে স্বচ্ছতা আনা, জনগণের মধ্যে টিকা নিতে দ্বিধা তৈরি হলে সেই সমস্যাকে সম্বোধন করা, টিকার উপর বিশ্বাস তৈরি করা, এবং টিকা রোলআউটের নড়বড়ে ব্যবস্থার ভিত্তিটির বিষয়ে জানানো।  টিকা সংক্রান্ত সঠিক তথ্য, টিকার উপকারিতা সম্পর্কে সামাজিক ও প্রচলিত যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন কনটেন্ট তৈরি, ভুল তথ্যের আধিক্য কমাতে ডিজিটাল মাধ্যমে নজর রাখা এবং টিকাবিরোধী গোষ্ঠীগুলিকে চিহ্নিত করে তাদের মধ্যে বিশ্বাস তৈরি ইত্যাদি কাজের জন্য আগে নিযুক্ত অংশীদাররা এখন মন দিয়েছেন গোষ্ঠীকে প্রভাবিত করতে পারবেন এমন সব ব্যক্তিত্ব এবং নেতাদের সঙ্গে একত্রে কাজ করার দিকে। 

ভারতের গণটিকা দানের যে অভিজ্ঞতা তার একটি বিশেষ মোড় হল ইউনিভার্সাল ইমিউনাইজেশন প্রোগ্রামকে সফলভাবে বাস্তবায়িত করতে সক্ষম হওয়ার ঘটনাটি। এই ইমিউনাইজেশন প্রোগ্রাম, টিকার উপর বিশ্বাস ও আস্থা বাড়াতে ক্রমাগত পরিবর্তনশীল গণযোগাযোগ মাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে। টিকার উপর এই বিশ্বাসের কথা সামনে এসেছে ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে পরিচালিত একটি সমীক্ষার পরে। এই সমীক্ষা অনুযায়ী, সাতাশি শতাংশ ভারতীয়, যখন কোভিড-19 টিকা পাওয়া যাবে, তখন তা নিতে ইচ্ছুক। তবে, বহু চেষ্টার পর টিকার উপর তাঁদের এই বিশ্বাস তৈরি হয়েছে, তাই আমাদের সতর্ক থাকতে হবে যাতে তাকে আমরা তুচ্ছ না করি। ২০২১ সালের ৩ জানুয়ারি ভারতের সেন্ট্রাল ড্রাগস কন্ট্রোল অরগানাইজেশন (সিডিএসসিও)-এর নেওয়া একটি পদক্ষেপ টিকা বিশেষজ্ঞ ও সাধারণ জনগণকে হতচকিত করে দেয়। “জনস্বার্থে, প্রচুর সাবধানতা অবলম্বন করার উদ্দেশ্যে, কেবলমাত্র আপৎকালীন অবস্থায় এবং ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের স্তরে, বিশেষত মিউট্যান্ট স্ট্রেনের কারণে সংক্রমণ ঘটলে তবেই সীমিতভাবে ব্যবহার হবে।” তৃতীয় পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল যা টিকার কর্মক্ষমতাকে স্পষ্ট করবে তার সম্পর্কে কোনোরকম তথ্যের অনুপস্থিতি এবং দ্বিতীয় পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল যার উদ্দেশ্য ছিল পরীক্ষামূলক অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে টিকার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা পরখ করা তার ফলাফল জনসমক্ষে প্রকাশ না করার কারণ্‌ বৈজ্ঞানিক গোষ্ঠী জুড়ে, বিশেষজ্ঞ্ররা সন্দেহ এবং উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। অনুমোদনের ভাষাটিও অনেকটাই গোলমেলে কারণ তা “ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল মোড” এই শব্দগুলি উল্লেখ করে। এর জন্য অবশ্যই প্রয়োজন স্বেচ্ছাসেবক এবং একটি প্লেসবো হাতের। এই মুহুর্তের যে রোলআউট তা এই দুই মানদন্ডের কোনটিকেই পূরণ করে না। তার বদলে যা করা হয়েছে তা হল কোভ্যাক্সিনের জন্য চিহ্নিত টিকাদান কেন্দ্রগুলিতে লোকজনকে টিকা দেওয়া হয় এবং প্রতিকূল প্রতিক্রিয়ার জন্য নজর রাখা হয়।  

টিকার অনুমোদন এবং তার পরবর্তী উদবেগের সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পর কম বিতর্কিতভাবে অনুমোদিত কোভিশিল্ডসহ ভারতের সাম্প্রতিকতম টিকা উমেদারদের নিয়ে বেসরকারী অভিমত ছিল মিশ্র। তার ফলে, জনগণের মধ্যে ইতিবাচক মনোভাব থেকে শুরু করে বিভ্রান্তি ও অবিশ্বাস পর্যন্ত নানা রকম প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। প্রতিষেধকের ক্রমবিকাশ এবং অনুমোদন প্রক্রিয়ার অস্পষ্টতা নিয়ে সংবাদ মাধ্যমের প্রাত্যহিক তর্কবিতর্কিত সমস্ত দর্শকই মনোযোগ দিয়ে শুনে গেছেন এবং এখন তাঁরা, এমনকি, প্রতিষেধক বিজ্ঞানের উচ্চস্তরের ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও বোঝার মত অবস্থায় চলে এসেছেন। ঘটনা আরো জটিল হয়ে ওঠে যখন সেরাম ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়ার সিইও আর ভারত বায়োটেকের চেয়ারম্যান প্রকাশ্যে উত্তপ্ত বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। অবশেষে, তাঁরা এই বলে একটি যুগ্ম বিবৃতি দেন যে নিরাপদ ও কার্যকরী টিকা সরবরাহ করতে তাঁরা দুজনেই অঙ্গীকারবদ্ধ। কিন্তু তার আগেই, তাঁদের এই তরজার ফলে দুটি প্রতিষেধকেরই নিরাপত্তা, কর্মক্ষমতা এবং ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের সততা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়। কোভিড-19 নিয়ে মাসের পর মাস ধরে মূলত ঐক্যবদ্ধভাবে বার্তা আদান প্রদানের পরে, ভারতের টিকা উমেদারদের এই অসংযত ও বিশৃঙ্খল উপস্থাপনা হয়ত প্রাথমিকভাবে যে বিশ্বাস তৈরি হয়েছিল তাতে এবং জনগণের দিক থেকে প্রতিষেধকটিকে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে ঝুঁকি দেখা যেতে পারে।

ভারতে কোভিড-19 টিকা নিয়ে প্রচলিত মিথগুলি আবার জেগে উঠেছে এবং সেগুলি আসলে আগেকার নানা প্রতিষেধক নিয়ে যে মিথ ছিল সেগুলিরই পরিবর্তিত রূপ। এগুলি অনেক সময়ই ধর্মীয় ভাবাবেগকে কাজে লাগায় (যেমন, শূকরের দেহ থেকে তৈরি জেলাটিন ব্যবহারের অভিযোগ), বিজ্ঞান বিষয়ে অজ্ঞতা (যেমন, টিকা নিলে ডিএনএ বদলে যাবে বলে অভিযোগ), কর্তৃপক্ষের প্রতি অবিশ্বাস (টিকাতে ট্র্যাকার আছে বলে অভিযোগ)। ঐতিহাসিক গতিতে প্রতিষেধকের উন্নতিসাধন আর সারা পৃথিবীতেই প্রতিষেধকের এত দ্রুত অনুমোদনের সঙ্গে সঙ্গে সম্ভাব্য দুর্নীতির ভয়, এবং আমাদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠানগুলিতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে ভারতীয়দের মধ্যে প্রতিষেধকের উপর বিশ্বাসে ক্ষয় ধরার উর্বর জমি তৈরি হয়েছে। 

অতীতেও ভারতীয়দের মধ্যে টিকা নিয়ে অবিশ্বাস এবং দ্বিধা দেখা গেছে। ২০০৮ সালের হিউম্যান প্যাপিলোমাভাইরাসের পরীক্ষামূলক টিকাদানও স্বচ্ছতার অভাব, প্রাথমিক যোগাযোগের দুর্বল অবস্থা, টিকাদানের লক্ষ্য যে গোষ্ঠী সেগুলির মধ্যে বিজ্ঞান বিষয়ে অজ্ঞতা ইত্যাদি বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিল। পোলিওর টিকা নিয়ে ভুল তথ্য জানার কারণে কিছু গোষ্ঠীর মধ্যে বিশ্বাস ছিল যে, এই টিকা নিলে বন্ধ্যাত্ব ঘটে। এইসব প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ভারতে শৈশবে টিকাকরণের হার বেড়েই চলেছে। তার কারণ, অনেকাংশেই, টিকার উপকারিতা সম্পর্কে নিয়মিত বার্তাজ্ঞাপন এবং এ সম্পর্কিত ভয় কমাতে সঠিক তথ্যের সরবরাহ। ২০১৪ সালেই ভারতে পোলিও রোগ সফলভাবে নির্মূল করা হয় এবং এই ঘটনা আমাদের সমষ্টিগত স্মৃতিতে এখনো টাটকা। ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যাবে যে, এই দেশ তার শিশুদের রক্ষা করতে বরাবরই টিকার উপর বিশ্বাস রেখেছে। 

এই মুহুর্তে কোভিড-19 রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমরা এমন এক জায়গায় আছি, যেখানে স্বচ্ছতা, সততা এবং জনস্বাস্থ্যের নানা তথ্যের উপর অবাধ অধিকার ইত্যাদি প্রয়োগ করে টিকার উপর জনগণের বিশ্বাস ও আস্থাকে আবার ফিরিয়ে আনা যাবে। পৃথিবী জুড়ে এই লড়াইতে যাঁরা সামনের সারিতে কর্মরত এবং যাঁদের এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি সেই মানুষরা যখন টিকা নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন তখন ভারতে, সর্বসাধারণের সতর্ক নজরের সামনে, সরকার, বিশেষজ্ঞ এবং সংবাদমাধ্যমকে ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে জটিল বৈজ্ঞানিক শব্দবন্ধগুলিকে সবচেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক আর সহজে বোঝা যায় এমন রূপে অনুবাদ করাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।  প্রতি পদক্ষেপে যে সব তথ্য আমরা জানি, যেগুলি আমরা জানি না সেগুলিকে তাঁদের বার বার বলতে হবে এবং প্রত্যেকবারই জানাতে হবে কিভাবে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নিজেদের সব চেয়ে ভালোভাবে রক্ষা করতে পারে। তথ্যের সত্যতা বিচার করার নানা পরিষেবার (যেমন, হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটবট) উত্থান হওয়ার বিষয়টি আশাপ্রদ এবং অনুকরণযোগ্য। সাংবাদিকতায় স্বাস্থ্য সম্পর্কে শিক্ষাদান ও বৈজ্ঞানিক এবং অ্যাকাডেমিক বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মিডিয়া কমিউনিকেশনের প্রশিক্ষণদান একে অন্যের পরিপূরক হতে পারে। এর ফলে, সাংবাদিকদের মধ্যে জনস্বাস্থ্য নিয়ে প্রমাণ নির্ভর প্রতিবেদন তৈরির ক্ষমতা যেমন বাড়বে তেমনই, বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণও বাড়বে। ভারত যখন কোভিড-19 অতিমারীর অবসানের জন্য, আশা করা যায়, চূড়ান্ত পদক্ষেপটিই নিচ্ছে, সেই সময় আমাদের উচিত টিকা ও কোভিড-19 রোগের সতর্কতা অবলম্বন নিয়ে বিচক্ষণভাবে ও অবিচলিত থেকে বার্তা আদানপ্রদান, যাতে এই সব চেয়ে শেষ পর্যায়ে এসে আমরা আবার পিছিয়ে না পড়ি। 

রামিয়া পিন্নামানেনি

Author

রামিয়া পিন্নামানেনি হারভার্ড টি.এইচ. চ্যান স্কুল অফ পাবলিক হেলথের একজন রিসার্চ ফেলো। এছাড়াও তিনি একজন চিকিৎসক যিনি ভারতে স্বাস্থ্যসংক্রান্ত বার্তা ও তথ্য বিনিময় ব্যবস্থা এবং মা ও শিশুস্বাস্থ্যের সঙ্গে জড়িত নানা প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত।

(Bangla Translation by Sritama Halder)
অনুবাদঃ শ্রীতমা হালদার

শ্রাবন্থী এম. শেষশায়ী

Author

শ্রাবন্থী এম. শেষশায়ী মেইনহেলথের একজন রিসার্চ অ্যানালিস্ট এবং এছাড়াও ভারতে তাঁর ডেন্টিস্ট হিসাবে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। বর্তমানে তিনি পরিবেশে রাসায়নিকের এক্সপোজার এবং শিশুস্বাস্থ্যে তার ফলাফল সংক্রান্ত জনস্বাস্থ্যমূলক গবেষণার সঙ্গে জড়িত।  

(Bangla Translation by Sritama Halder)
অনুবাদঃ শ্রীতমা হালদার