“বিশ্বের এআই ইউজ কেস রাজধানী” হিসেবে ভারতঃ এআই-কেন্দ্রিক অতি-প্রচারণা হিসেবে আর্থসামাজিক উন্নয়ন

28/04/2025
IiT English Page

২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নাগরিকদের আহ্বান করে বলেন “সমাজের এমন দশটি সমস্যাকে চিহ্নিত করতে হবে যা, এআই-এর দ্বারা সমাধান করা যায়।” ২০২৪ সালে, আইটি-সম্রাট নন্দন নিলেকানি, যিনি গত পনের বছর ধরে, ভারতের ভারতের ডিজিটাল যাত্রার পিছনের শক্তি হিসেবে কাজ করে চলেছেন, ঘোষণা করেন যে, ভারত শীঘ্রই “পৃথিবীর এআই ইউজ কেস ক্যাপিটাল” হয়ে উঠবে।” ২০২৫ সালের জানুয়ারী মাসে ইলেক্ট্রনিক্স অ্যান্ড ইনফর্মেশন টেকনোলজি মন্ত্রক-এর ইন্ডিয়াএআই মিশন সমসাময়িক জেনারেটিভ এআই উন্নয়নকে সামনে আনে, এমন একটি সফটওয়্যারের ভিত্তিমূলক নমুনা নির্মাণের জন্য প্রকল্প জমা দেওয়ার আহ্বান করেন। এই প্রকল্পের একটি নির্ণায়ক হল, “বহু সংখ্যক সামাজিক সমস্যাকে সম্বোধন করে এমন ইউজ কেসকে চিহ্নিত ও বিশদে বর্ণনা করে।” এবং গত মাসে, “উন্নততর শস্য, দৃঢ়তর স্বাস্থ্যপরিষেবা, সক্ষম শিক্ষাব্যবস্থা ও স্থিতিস্থাপক পরিবেশ” নিয়ে গেটস ফাউন্ডেশন ও ইন্ডিয়াএআই মিশন একটি অংশীদারিত্বের ঘোষণা করে।   

সামাজিক উন্নয়নের জন্য এআই ইউজ কেস নিয়ে আলোচনা, ভারতের এআই বিষয়ক নীতির বিশিষ্ট উপাদানগুলির মধ্যে অন্যতম। কৃষি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মত উত্তর-সাম্রাজ্যবাদ উন্নয়নের পরিষরের নানা কঠিন সমস্যার “সমাধান” করবে বলে এটি প্রতিশ্রুতি দেয়। এই আলোচনা, কিছুটা অসংলগ্নভাবে, গ্রামীণ ভারতের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সঙ্গে বিশ্বব্যাপী উন্নততর এআই প্রযুক্তির শিল্প কৌশলের সঙ্গে সংযুক্ত করে। যদিও, রাজনৈতিক অর্থনীতির বিবৃতির অনুপস্থিতিতে, এই “ইউজ কেস” পন্থাটি একটি ত্রুটিপূর্ণ নীতিবিষয়ক প্রকল্প হয়ে দাঁড়ায়। তার পরিবর্তে, এই লোভনীয় চিত্রটি চটকদার প্রচারণার যন্ত্র হিসেবে কাজ করে ও উন্নয়নের বুলি আউড়ে, ভূরাজনীতির ক্ষেত্রে নেতৃত্বদানের অবস্থান থেকে শুরু করে নতুন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের খোলা বাজারীকরণের মত, অন্য অনেক হস্তক্ষেপকে বৈধতা দান করে।    

দারিদ্রের খোলা বাজারীকরণ ও শিল্পকৌশল
ভারতে আধার নামের ডিজিটাল পরিচয়পত্র চালু হওয়ার পর থেকেই এই দেশে উন্নয়নের ক্ষেত্রে যে ডিজিটালাইজেশানের উদ্দীপনা দেখা দিয়েছিল, তা থেকেই ভারতে এআই ইউজ কেস নিয়ে চর্চার পূর্বাভাস পাওয়া গেছিল। ভারতের অধিকারভিত্তিক জনকল্যাণমূলক যন্ত্রকে দক্ষ করে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে, ২০০৯ সালে আধার পরিচয়পত্রের প্রচলন হয়, যা কোটি কোটি ভারতবাসিকে ডিজিটাল প্রক্রিয়ার অন্তর্গত করে। সফটওয়্যার শিল্পে সক্রিয় যে ব্যক্তিরা এই প্রক্রিয়ার প্রচারক, তাঁরা, বিশেষ করে ২০১৫ সালের ইন্ডিয়াস্ট্যাক প্রকল্পের প্রতিষ্ঠার পর,  আর্থিক অন্তর্ভুক্তির অঙ্গীকারকেব্যবহার করে ভারতীয় সফটওয়্যার ও অর্থনীতিকেন্দ্রিক শিল্পকে ডিজিটাল পরিষরে উপস্থিত ভারতীয়দের ক্রেতা হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ করে দেওয়াকে বৈধতা দান করেন। নিজস্ব আমানতের সুবিধা পাওয়ার ফলে, দরিদ্র ভারতীয়রা এখন, আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ভাষায়, “নিজস্ব উদ্যোগের মাধ্যমে নিজেদের দারিদ্র দূরীকরণে সক্ষম হবেন।”    

দারিদ্র একটি সুবিশাল সমস্যা হিসেবে রয়ে যাওয়া সত্ত্বেও, সরকারী-বেসরকারী পরিকাঠামোতে রাষ্ট্রের বিনিয়োগের ঘটনা সফটওয়্যার শিল্পের সম্প্রসারণের ভিত্তিকে দৃঢ়তর করেছে, যার থেকে জন্ম নিয়েছে, উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি নতুন ফিনটেক শিল্প। আধার ও অনুরূপ পদ্ধতির হাত ধরে বিজেপির “নব্য জনকল্যাণবাদ”-এর উত্থান হয়েছে, যা জনস্বাস্থ্য ও প্রাথমিক শিক্ষার মত ক্ষেত্রে সরকারী সহায়তার বদলে গ্যাসের সিলিন্ডারের মত ব্যক্তিগত উপাদানের জন্য টাকা হস্তান্তরের দিকে গেছে। “ডিজিটাল পাবলিক ইনফ্রাস্ট্রাকচার” হিসেবে রিব্র্যান্ড করা করার পর, এই পদ্ধতিটিকে উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রযুক্তি ব্যবহারের আদর্শ হিসেবে বাকি দুনিয়ার সামনে তুলে ধরা হচ্ছে। এই পদক্ষেপের উপর ভিত্তি করে, এবং রাষ্ট্র ও শিল্প – দুই ক্ষেত্রেই সমতুল্য খেলোয়াড়ের দ্বারা প্রচারিত হওয়ার পর, এআই “ইউজ কেস” বিষয়ে আলোচনাটি ভারতের নানা সামাজিক সমস্যাকে ব্যবহারযোগ্য সম্পদ হিসেবে সফটওয়্যার পুঁজিবাদীদের সামনে তুলে ধরছে।        

ব্যবহারের সময়, এই ক্ষেত্রগুলিতে এআই ইউজ কেসগুলি মূলত অনুমানমূলক। যেমন, কৃষিক্ষেত্রে, ডজন ডজন চ্যাটবট, স্থানীয় ভাষায় আবহাওয়ার অবস্থা ও বীজ রোপনের বিষয়ে কৃষকদের হাতে উত্তমতর তথ্য তুলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা পরিষেবার ক্ষেত্রে এআই-এর প্রতিশ্রুতি মূলত পরিচালনাকেন্দ্রিক, যেমন স্বাস্থ্যসংক্রান্ত তথ্যাদিকে ডিজিটাল করা, যা নাকি দক্ষতা বাড়ানোর পাশাপাশি হাসপাতাল ও জীবনবিমা সরবরাহকারীদের হাতে বিশাল পরিমাণের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্য সহজেই তুলে দিতে পারবে। 

পরীক্ষিত প্রয়োগের অভাব সত্ত্বেও, দরিদ্র নাগরিকরা সংখ্যাগতভাবে  যে সুবিশাল খোলা বাজারের নির্মাণ করেন, সেটিকে বিশ্বব্যাপী এআই পদ্ধতির উন্নয়ন ও প্রয়োগের প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে এআই বিষয়ে আলোচনাগুলি একটি জাতীয় সম্পদ্দ হিসেবে দেখেন। ডেটাবেস, আদর্শ এবং কম্প্যুটিং-এর ক্ষমতার দ্বারা নির্মিত এআই সরবরাহ শৃঙ্খলটি আমেরিকার কয়েকটিমাত্র বিগ টেক সংস্থার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া দেখা যায় বিভিন্ন রাষ্ট্রের দ্বারা নির্মিত শিল্পকেন্দ্রিক নীতির মধ্যে। ভারতের দারিদ্রভিত্তিক খোলা বাজার, যেখানে দরিদ্র জনগোষ্ঠী ডেটার ব্যবহারকারী ও, একই সঙ্গে, সরবরাহকারী, সেটিকে দেশের উন্নয়নের কাণ্ডারী হিসেবে দেখা হয় এবং দ্রুত সমন্বিত বিশ্বব্যাপী এআই বাজারের প্রতিযোগিতায় ভারতকে অতিরিক্ত সুবিধা দিতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, ভারতের এআই শিল্পনীতি, সেমিকন্ডাক্টার নির্মাণের দেশীয় সামর্থ্য তৈরির জন্য সুবিশাল আর্থিক প্রণোদনা দান, ক্লাউড সম্পদ ও আদর্শের সহ অন্যান্য চিরাচরিত পন্থাও অনুসরণ করে। কিন্তু “ইউজ কেস” বিষয়ক আলোচনার ক্ষেত্রে ভারতের এআই-কেন্দ্রিক অর্থনীতির জাতীয় প্রবক্তারা আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য ব্যবহৃত সফটওয়্যার অ্যাপ্লিকেশনগুলি থেকে উঠে আসছে বলে কল্পনা করা হয়। “এআই-এর ক্ষেত্রে ভারতের সম্ভাবনার উদ্ঘাটন করার জন্য,” নিলেকানি বলেন, “প্রযুক্তির দিকে অতিরিক্ত মনোযোগ দেওয়ার বদলে দেখতে হবে, ইতিমধ্যে ব্যবহৃত প্রযুক্তিগুলি কোন কোন সমস্যার সমাধান করতে পারে নি।”  

অন্যভাবে বলতে গেলে, ইউজ কেস দারিদ্রের খোলা বাজারীকরণ এমন উন্নততর প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ভারতকে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার অংশ করে তোলার আশা করে, যে জাতীয় শিল্পনীতি তার সীমারেখাকে অস্পষ্ট করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। 

ইউজ কেসের রাজনৈতিক অর্থনীতি
এই ভাবনাটি, অবশ্যই সত্যি হওয়ার জন্য একটু বেশিই ভাল। ইউজ কেসের এই আলোচনা এআই শিল্প ও উন্নয়ন, উভয়েরই রাজনৈতিক অর্থনীতিকে উপেক্ষা করে। 

এআই-এর সার্বভৌমত্ব, যা কিনা ভারতের প্রযুক্তিগত মতবাদের একটা প্রধান লক্ষ্য, তার প্রেক্ষিত থেকে দেখলে,  যতক্ষণ পর্যন্ত সেমিকন্ডাক্টর, ক্লাউড সম্পদ ও নমুনা আমেরিকার বিগ টেকের হাতেই থেকে যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত ভারতের পক্ষে “বিশ্বে ইউজ কেস কেন্দ্র” হয়ে ওঠা সম্ভব না। আজকের জেনারেটিভে এআই-এর জন্য সেমিকন্ডাক্টরের প্রয়োজন অন্যান্য ডিজিটাল প্রযুক্তির চেয়ে অনেক বেশি এবং এই সেমিকন্ডাক্টর এনভিডিয়া বলে এনটি মাত্র সংস্থা বিক্রি করে ও তাইওয়ানের টিএসএমসি নামের একটি মাত্র কারখানায় তা নির্মিত হয়। এছাড়াও এই সেমিকন্ডাক্টর তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানগুলি এএসএমআই নামের একটি ডাচ সংস্থার দ্বারা নির্মিত হয়। ওদিকে, এআই-এর জন্য অতিপ্রয়োজনীয় ক্লাউড কম্প্যুটিং ডেটা মূলত নিয়ন্ত্রণ করে অ্যামাজন, মাইক্রোসফট ও গুগল। 

এআই ইউজ কেসগুলি দেশীয় স্টার্টআপ শিল্পের উন্নয়নেও সহায়তা করে বলে ভাবা হয়, কিন্তু এআই শিল্পের ও অন্যান্য পরিষরে সক্রিয় স্টার্টআপগুলি দারিদ্রকেন্দ্রিক বাজার নিয়ে খুব একটা আগ্রহী নয়। ২০২৪ সালে পরিচালিত একটি সমীক্ষা থেকে জানা যায় যে, ভারতের ১২০টির বেশি জেনারেটিভ এআই স্টার্টআপ, যেগুলি, গত পাঁচ বছরে, যৌথভাবে ১.২ বিলিয়ন ডলার অর্জন করেছে, তাদের মধ্যে ৭০ শতাংশই উদ্যোক্তা ক্রেতার সমস্যা সমাধানের কাজ করে। উদ্যোগ পরিষেবার প্রতি ভারতীয় প্রযুক্তির পক্ষপাতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, এই শিল্প মূলত শিল্পে ব্যবহৃত ব্যাকএন্ড সফটওয়্যার উপাদানের উপরেই মনোযোগ দেয়। আর্থসামাজিক উন্নয়ন-কেন্দ্রিক ইউজ কেস তো নয়ই, এমনকি উপভোক্তামুখী সফটওয়্যার পণ্যকেও তাঁরা বাদ দিয়ে যান।    

বিভাগীয় ডেটাতেও এর প্রতিফলন দেখা যায়। অনেক কথা বলা হলেও, জেনারেটিভ এআই স্টার্টআপের প্রথম পাঁচটি আগ্রহের বিষয়ের মধ্যে কৃষি কোনও ভাবেই উপস্থিত নয়। মধ্য ও উচ্চবিত্ত শ্রেণির জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্যপরিষেবা বাজার হিসেবে লাভজনক বলে, এই দুটিই প্রথম পাঁচের উপর উপস্থিত। কিন্তু তাহলেও, এই ক্ষেত্রগুলিতে সক্রিয় স্টার্টআপগুলির এই দুটির জন্য কোনও উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা আছে বলে মনে হয় না (যদিও এই বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার মত যথেষ্ট তথ্য আমাদের কাছে নেই)। এই মনোভাবের কারণেই স্টার্টআপগুলির অর্থনৈতিক বোধ ও উদ্যোগকে ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট বলা যায়। ঘোষিত এআই ইউজ কেসের লক্ষ্য হিসেবে যে ভারতীয় নাগরিকদের দেখা হয়, তাঁরা অতি দরিদ্র ও স্টার্টআপ ব্যবসা শুরু করার মত অর্থ তাঁদের হাতে একেবারেই নেই। একটি সাম্প্রতিক ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট বিবৃতি যেমন বলেছে, লক্ষ্ লক্ষ দরিদ্র ভারতীয় স্টার্টআপ তৈরির জন্য “আর্থিক বিনিয়োগের উপযুক্ত নন।”   

এছাড়াও, আর্থসামাজিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সমস্যার জন্য এআই ইউজ কেস সমাধান হিসেবে ভুল। কৃষি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নয়নের ক্ষেত্রে যে সমস্ত মজ্জাগত সমস্যা আছে, সেগুলির জন্য প্রয়োজন, এআই-এর তাৎক্ষণিক প্রযুক্তিগত সমাধান নয়, বরং আমূল পরিকাঠামোগত সংস্কার। বাস্তবিকই, গত এক দশকে পাওয়া প্রমাণ থেকে জানা যায়, উন্নয়নগত সমস্যার সমাধান করার জন্য আধার পরিচয়পত্রের মত ডিজিটাল প্রক্রিয়ার উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কোনও রকম উপকারে আসার পরিবর্তে বরং অনেক ক্ষতি করেছে। সম্ভবত সবচেয়ে সমস্যাজনক বিষয়টি হল সফটওয়্যারের মত যে সমস্ত ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের হার নিম্ন, সেখানেই কয়েক দশক ধরে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘনীভূত হইয়েছে। ভারতীয় নাগরিকদের প্রয়োজন ব্যাপক চাকরির সুযোগ এবং যা এআই ইউজ কেসের পক্ষে সরবরাহ করা সম্ভব নয়।    

অতি-প্রচারণার উপায় হিসেবে ইউজ কেস
তাই, আমাদের প্রয়োজন ইউজ কেসের উপর এই অতিরিক্ত মনোযোগকে প্রযুক্তি-সংক্রান্ত অতি-প্রচারণার একটি নির্দিষ্ট ভারতীয় সংস্করণ, এমন একটি স্ফীত অঙ্গীকার যা নাকি সবকিছু সম্ভব করে, সেই হিসেবে বোঝা। আমেরিকাতে, এআই বিষয়ক অতি-প্রচারণাকে একটি অকল্পনীয়, মানবিকতাকে হুমকি প্রদানকারী ক্ষমতাসহ একটি “আর্টিফিশিয়াল জেনারেল ইন্টেলিজেন্স” যার আবির্ভাব অবশ্যম্ভাবী – এর উপরেই ভিত্তি করে অনেক সময় নির্মাণ করা হয়। এই অতি-স্ফীত অঙ্গীকারের জন্যই এই ক্ষেত্রে অনুমানমূলক বিনিয়োগের একটি সুবিশাল ঢেউ উঠেছে, এবং তার ফলে, এই প্রযুক্তির অতিরিক্ত চাহিদা নিয়ে প্রমাণ খুব বেশি পাওয়া না গেলেও, এআই সংস্থাগুলির বাজারী মূল্য একটি নতুন উচ্চতায় পৌঁছে গেছে। 

এর উলটোদিকে, উন্নয়ন হিসেবে এআই সম্পর্কে অতি-প্রচারণা একটি যুক্তিযুক্ত ও আর্থসামাজিকভাবে মজবুত বিকল্প সরবরাহ করে বলে মনে হয়। ভবিষ্যতমুখী হওয়ার পাশাপাশি, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার চৌহদ্দি অভিমুখী এই এআই-কেন্দ্রিক অতি-প্রচারণা, যাঁরা এতদিন অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রান্তে অবস্থান করেছেন, তাঁরা এখন থেকে ডেটার উৎস ও এআই অ্যাপ্লিকেশনের বাজার হিসেবে কাজ করতে পারবেন বলে কথা দেয়।  

এই আলোচনামূলক পরিকাঠামোটি হয়ত ইউএস-এর এআই সংক্রান্ত অতি-প্রচারণা যেমন করতে পেরেছে, সেরকম সুবিশাল বিনিয়োগ সম্ভব করতে পারে নি, কিন্তু বেশ কিছু শক্তিশালী উপাদানকে পরিষেবা দান করেছে। 

১. দেশের অভ্যন্তরে এই পরিকাঠামোটি ভারতের সরকারের একটি হিতৈষী টেকনোক্র্যাটিক উন্নয়নবাদের চিত্র তুলে ধরে। হিন্দু জাতীয়তাবাদের পাশাপশি, এই হাই-টেক চেহারাটি বর্তমান সরকারের আবেদনের একটি মূল উপাদান। এআই ইউজ কেস হল চ্যাটবট – এমন একটি ব্যক্তিগতকৃত প্রযুক্তি, যা নির্দিষ্ট পরিষেবা নাগরিকদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য একটি ব্যক্তির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের ইন্টারফেস সরবরাহ করে। মোদির শাসনকালে, বিজেপির সঙ্গে এআই ইউজ কেসের সহযোগিতা, অন্তর্নিহিতভাবে, মৌলিক স্বাস্থ্য ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যের মত সরকারী সহায়তা থেকে সরে গিয়ে মনোযোগ দিয়েছে বেসরকারী সহায়তার টেকনো-প্যাট্রিমোনিয়াল ব্যবস্থার দিকে।

২. বিশ্বজনীনভাবে, “ইউজ কেস” বিষয়ে অতি-প্রচারণা, একটি সুবিশাল ক্ষমতা দখলের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাঝেই, ভারতকে বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠের হয়ে, নৈতিক নেতৃত্বের দাবি জানাতে সক্ষম করছে। একটি এনআইটিআই আয়োগ এআই কৌশল ভারতকে “বিশ্বের ৪০ শতাংশ এআই-এর গুদামঘর” বলে বর্ণনা করেছে এবং ইঙ্গিত দিয়েছে যে ভারতের অভ্যন্তরে যে সমস্ত এআই ইউজ কেস তৈরি হবে, তা   গ্লোবালসাউথে রপ্তানি হবে।

৩. গেটস ফাউন্ডেশনের মত বিশ্বজনীন উন্নয়নের পৃষ্ঠপোষকরা, যাঁরা এই ধরণের উদ্যোগকে এআই ফর ডেভেলপমেন্ট নামে বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় নিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের জন্য এআই ইউজ কেসের ব্যবহা্রের পদক্ষেপ আসলে উন্নয়নের ক্ষেত্রে ডিজিটাল হস্তক্ষেপের একটি দীর্ঘ সারির অন্যতম। দারিদ্রের সমস্যার সমাধান হল খোলা বাজারীকরণ – এই দানশীল-পুঁজিবাদী বা ফিল্যান্থ্রোক্যাপিটালিস্ট মতবাদের সঙ্গে এই পদক্ষেপটি যথেষ্ট মানানসই।

৪. দেশের আভ্যন্তরীণ সফটওয়্যার শিল্পের ক্ষেত্রে, ইউজ কেস সংক্রান্ত আলোচনাটি ভারতের নতুন ডিজিটাল জনগোষ্ঠীর রাষ্ট্র-সমর্থিত খোলা বাজারীকরণকে আইনি বৈধতা দান করে। উন্নয়নের ছদ্মবেশে এই আলোচনাটি, তাঁদের নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য আদায় করার ক্ষমতা দেয়, যদিও এই তথ্য ও ক্রেতার অর্থনৈতিক মূল্য যথেষ্ট সন্দেহজনক। পণ্যের সম্প্রসারণের জন্য দরিদ্র ব্যক্তিদের এদের হাতে তুলে দেওয়া হয় এবং, সঙ্গে সঙ্গে, অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশে সম্ভাব্য রপ্তানির বাজারও নির্মিত হয়।

৫. বিশ্বের সুবিশাল টেক সংস্থাগুলির ক্ষেত্রে, ভারতে তাদের কাজকর্মকে বৈধতাদানের একটি উপায় এই আলোচনা। এআই ইউজ কেসের সবচেয়ে উৎসাহী সমর্থক, মাইক্রোসফটের সিইও সত্য নন্দেলা, সম্প্রতি (নিলেকানির কথার প্রতিধ্বনি করে) বলেছেন, ভারত “এআই বিশ্বের ইউজ কেসের রাজধানী” হয়ে উঠেছে। আর্থসামাজিক উন্নয়নের কাজে সক্রিয় এআই-এর সর্বাধিক ব্যবহৃত উদাহরণ হল মাইক্রোসফট ও আইআইটি মাদ্রাজের দ্বারা নির্মিত যুগলবন্দী নামের চ্যাটবট। ২০২৩ সালে জাঁকাল প্রচারের মাধ্যমে চালু হওয়া এই চ্যাটবট যা সরকারী পরিষেবার বিষয়ে নানা তথ্য স্থানীয় ভাষায় ব্যবহারকারীদের জানায়। এই চ্যাটবট গ্রহণ ও ব্যবহারের বিষয়ে কোনও তথ্য পাওয়া যায় না, শুধু নয়, ২০২৩ সালের পরে এর বিষয়ে কোনও খবর বেরয় নি এবং এই প্রকল্পের ওয়েবসাইটটিও বর্তমানে নিষ্ক্রিয়।

এআই ইউজের আলোচনাটি লোভনীয় কারণ, এটি একটি অসাধারণ প্রশ্নকে সামনে আনেঃ বিশ্বের উন্নততম প্রযুক্তিটি কেন দরিদ্র জনসাধারণের কাজে আসবে না? দুর্ভাগ্যক্রমে, বর্তমানে যে আর্থসামাজিক উন্নয়নমূলক ইউজ কেস সমন্বিত হয়েছে, সমসসাময়িক কাঠামোর মধ্যে সেগুলির সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম। এই অতি-প্রচারণা ভারতের দরিদ্র জনগণ বা এআই-কেন্দ্রিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার কোনও উপকারেই লাগবে না। বরং, এর হাত ধরে প্রভাবশালী ক্ষমতার কাঠামো নিরুপ্বদ্রবে থাকবে এবং বিগ টেকের নেতৃত্বাধীন এআই-এর ভিত্তি আরও সুদৃঢ় করে যে সমস্ত একচেটিয়া ও নিষ্কাশনমূলক কাজকর্ম, সেগুলি কোনও প্রশ্নের সম্মুখীন হবে না। অর্থাৎ, এর দ্বারা ইতিমধ্যে শক্তিশালী অংশগ্রহণকারীরাই আরও ক্ষমতা পাচ্ছেন। 

এই এআই-এর যুগে বিগ টেক সংস্থাগুলিকে প্রশ্নের সামনে ফেলে দরিদ্র ও প্রান্তিক জনতাকে কেন্দ্রে আনলে কেমন দেখতে লাগবে? সব চেয়ে আগে, জনগণকে শুধুমাত্র এন্ড-ইউজার, তথ্যের উৎস ও গবেষণার গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করা বন্ধ করে, এর ব্যবহারকারী ও মালিক হিসেবে দেখা শুরু করতে হবে। বর্তমান ব্যবস্থার বাস্তব বিকল্প এখনও মোটামুটি অনুমানের পর্যায়ে থাকলেও, এআই-কে সাধারণ সম্পদ হিসেবে কল্পনা করে, তা অর্জন করার জন্য কাজ শুরু করার উদ্যোগ হয়ত এআই-এর উন্নয়ন ও আর্থসামাজিক ন্যায্যতা একই সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারবে এমন একটি পরিবর্তন আনার অনুপ্রেরণা যোগাবে।

মিলা টি. সামডুব

Author

মিলা টি. সামডুব ভারতের ডিজিটাল পরিকাঠামোর নান্দনিক ও রাজনৈতিক অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা করে। সামদুব ইয়েল ল স্কুলের ইনফর্মেশন সোসাইটি প্রোজেক্টের একজন ভিজিটিং ফেলো, সেন্টার ফর টেকনোলজি অ্যান্ড সোসাইটি ফান্ডাকাও গেতুলিও ভার্গাসের সাইবারব্রিক্স ফেলো ও একজন ওপেন ফিউচার ফেলো।

(Bangla Translation by Sritama Halder) 
অনুবাদঃ শ্রীতমা হালদার