ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) – ভারতের বর্তমান শাসকদল – আশা করছে যে, ২০১৯ সালে সংঘটিত নির্বাচনে তারা যে বিপুল জয় লাভ করেছিল, ২০২৪ সালের এপ্রিল-মে মাসে ঘটতে চলা সাধারণ নির্বাচনে তারা তা ছাড়িয়ে যেতে না পারলেও, অন্তত সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করতে পারবে। আগের নির্বাচনে এই রাজনৈতিক দল ও তার মিত্র দলগুলি সমস্ত ভোটের ৪৫ শতাংশ সংগ্রহ করেছিল এবং লোকসভার ৫৪৩টি সদস্য আসনের মধ্যে ৩০০টিতে জয়ী হয়েছিল। এই বিপুল মাত্রার জয় যে ঘটবে, খুব কম নিরীক্ষকই তা পূর্বানুমান করতে পেরেছিলেন এবং তাঁরা এই জয়ের পিছনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ব্যক্তিত্ব থেকে শুরু করে বিজেপি-র অতি উচ্চমানের সাংগঠনিক ক্ষমতা, প্রচুর অর্থের যোগান ও হিন্দুত্ব, জাতীয়তাবাদ এবং জনকল্যাণ পরিকল্পনার সুদক্ষ মিশ্রণ পর্যন্ত নানা কারণের উল্লেখ করেছেন। ২০২৪ সালের নির্বাচনে বিজেপি ৪০০ আসনের লক্ষ্য অতিক্রম করার সংকল্প করেছে, যার ভিত্তি ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে অযোধ্যার রামমন্দিরের উদ্বোধনকে ঘিরে প্রবল উত্তেজনা।
আমরা অনুমান করতে পারি যে, নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, বিশ্লেষকরা ততই গভীরভাবে একই প্রশ্ন নিয়ে চিন্তা করে চলেছেন। দেশের নাগরিকরা যেভাবে ভোট দেন তার কারণ কি? কিসের প্রণোদনায় ভারত এবং অন্য দেশের ভোটদাতারা অন্যান্য দলকে উপেক্ষা করে, অপ্রতিরোধ্যভাবে একটি নির্দিষ্ট দলকেই নির্বাচন করেন? ভোটদাতারা বিচারশক্তিসম্পন্ন প্রাণী না ভাবপ্রবণ? যদিও, প্রতিবাদ রাজনীতি, সামাজিক আন্দোলন এবং দাঙ্গার প্রেক্ষিতে আবেগের ভূমিকা নিয়ে আমাদের বোধ এবং জ্ঞান বাড়ছে, আমাদের একটা প্রকাণ্ড ভ্রান্ত ধারনা আছে যে, নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতিতে আবেগের ভূমিকা গুরুত্বহীন।
ভারতীয় ভোটদাতাদের বোঝার পাণ্ডিত্যপূর্ণ প্রয়াস অনেক সময়ই অর্থনীতি, বেকারত্ব, জনকল্যাণমূলক পরিকল্পনার মত প্রশ্নে ওই ভোটদাতাদের প্রতিক্রিয়ার পরিমাপ বা জাতি, সামাজিক অবস্থান এবং ধর্মবিশ্বাসের দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁদের পরিচয়ের রাজনীতির ধারণাগুলিকে পরীক্ষা করে দেখার উপরেই সীমাবদ্ধ থাকে। লোকনীতি ন্যাশনাল ইলেকশন স্টাডিজের মত মর্যাদাপূর্ণ সমীক্ষাগুলি যেমন ভারতের রাজনৈতিক উন্নয়ন নিয়ে ভোটদাতাদের জ্ঞান, সচেতনতা ও উপলব্ধি, যা তাঁদের রাজনৈতিক আচরণকে প্রভাবিত করে, সে বিষয়ে ব্যাপকভাবে নথি তৈরি করেন, কিন্তু তা করার সময় নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতি যে অনুভূতি ও প্রবল আবেগের জন্ম দেয়, তার উপর ওই সংস্থা খুব বেশি মনোযোগ দেয় না।
নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতিতে আবেগের ভূমিকাকে অগ্রাহ্য করে চলার ফলাফল হিসেবে, সমাজবিজ্ঞানীরা, ভারতীয় গণতন্ত্রের অন্যতম যে মূল স্তম্ভটি, অর্থাৎ নির্বাচনের ক্ষেত্রে আবেগের ভূমিকাকে উপেক্ষা করে চলেছেন। এদিকে, আবেগ বিষয়টি নিয়ে চর্চা থেকে নির্বাচনের ক্রমশ পরিশীলিত হতে থাকা বিশ্লেষণ অনেকই উপকৃত হতে পারে। গতে বাঁধা নির্বাচনী রাজনীতির বিষয়ে পাণ্ডিত্যের পরিসরে আবেগের চর্চার স্থান ঠিক কোথায়?
প্যাশনেট পলিটিক্সঃ ডেমোক্রেসি, ডেভেলপমেন্ট, অ্যান্ড ইন্ডিয়া’জ ২০১৯ জেনারেল ইলেকশনস নামের আমার সম্প্রতি সম্পাদিত বইটিতে, মাত্র তিন বছর আগে উচ্চমূল্যের নোটের নোটবন্দীর মত সর্বনাশা অর্থনৈতিক নীতির মত নানা কারণে ভারতের নাগরিকরা যে গভীর অর্থকষ্টের মধ্যে দিয়ে গেছেন, তা স্বত্ত্বেও ওই বছরের নির্বাচনে মোদী ও তাঁর দলের প্রতি ভোটদাতাদের বিস্ময়কর সমর্থনের পিছনে যে গভীর আবেগ কাজ করেছে, তা আমি ও বইটিতে অংশগ্রহণকারী লেখকরা মিলে পাঠকের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
প্যাশনেট পলিটিক্স বইতে আবেগের উপর এই মনোযোগের অর্থ এই নয় যে ভোটদাতাদের বিচারবোধের অস্তিত্ব অস্বীকার করা হয়। আবেগ অযৌক্তিক নয়। এর সংজ্ঞাটিকে খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে যে, কোনও ঘটনা বা অবস্থাকে আমরা ক্ষতিকর বা হিতকর বলে মূল্যায়ন করি এবং আবেগ তা অনুমান করে নেয়। স্নায়ুবিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন যে, যৌক্তিকতার ভিত্তি আবেগ এবং তা যৌক্তিকতাকে বৈশিষ্ট্য ও অভীষ্ট দান করে।
অন্যান্য পণ্ডিতরাও দক্ষিণ এশিয়ার আবেগ এবং তার প্রভাব নিয়ে চর্চা করতে শুরু করেছেন। ঐতিহাসিক মার্গারিট পেরনউ ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, আবেগ তিনটি ভিন্ন ভিন্ন স্তরে কাজ করে। প্রথমত, মানবজাতি তার চারপাশকে কিভাবে অনুভব করে, তা আবেগের দ্বারা প্রভাবিত হয়। দ্বিতীয়ত, একজন ব্যক্তি (এবং সামাজিক গোষ্ঠী) যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাঁর অভিজ্ঞতাকে অর্থবহ করে তোলেন ও তাঁর পারিপার্শ্বিককে বোঝেন সেই প্রক্রিয়াকে আবেগই রূপদান করে। তৃতীয়ত, আশেপাশের পরিসরের অর্থ খুঁজে বের করার বদলে, সেই পরিসরে কাজ করার উদ্দীপনা যোগায় আবেগ। আবেগপ্রবণ ও যুক্তিপূর্ণ বিশ্লেষণ এবং আবেগ ও যুক্তির মধ্যে কোনও রকম বৈপরীত্য তৈরি করার বিষয়ে এই জাতীয় উপলব্ধি আমাদের সতর্ক করে। বাস্তবিকই, যুক্তিসম্মত কৌতুহলের সাধনা যেমন কখনই আবেগ-নিরপেক্ষ নয়, অনেক সময় আবেগেরও সহজাতভাবে নিজস্ব যৌক্তিকতা থাকে। দক্ষিণ এশিয়ার আবেগের বিষয়ে নৃতত্ত্ববিদ আমিলি ব্লম ও স্টেফানি তাওয়া লামা-রেয়াল, তাঁদের গভীর অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ ভাষ্যে আবেগের চিত্ররূপ, যেভাবে তাকে অনুভব করা হয় এবং তার অভিব্যক্তির মধ্যে পার্থক্যগুলিকে চিহ্নিত করেন। একজন ব্যক্তির আবেগকে অন্যরা কিভাবে প্রকাশ করে তা ব্যাখ্যা করে আবেগের চিত্ররূপ। বাচনিক ও অ-বাচনিক চিহ্নকের থেকে আবেগের অভিব্যক্তি উঠে আসে, যার মধ্যে আছে উত্তরদাতা কি অনুভব করছেন সে বিষয়ে তাঁর নিজের বর্ণনা। ব্যক্তি নিজে যে আবেগ অনুভব করছেন তা হল আবেগের অভিজ্ঞতা
ভারতের পণ্ডিতরা এখন দেশের আভ্যন্তরীণ আবেগের রাজনীতির দিকেও মনোযোগ দিচ্ছেন এবং সে বিষয়ে ঐতিহাসিক ও নৃতাত্ত্বিকদের থেকে মূল্যবান ও কর্কশ কিছু দৃষ্টিভঙ্গি পাওয়া যায়। ভারতীয় রাজনীতির ভূচিত্র জুড়ে ছড়িয়ে আছে আবেগ, ভাবপ্রবণতা ও অনুভূতির খোলা প্রদর্শনী। আবেগের উপর মনোযোগের চর্চা সাধারণত দেশভাগ ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মত সর্বনাশা বিপর্যয়ের ঘটনা, যা গণতন্ত্র হিসেবে ভারতের অবস্থানের বিষয়ে প্রশ্ন তোলে, গোরক্ষার বিষয়ে প্রচারণা, ইতিবাচক নানা কর্মসূচী প্রয়োগের বিরুদ্ধে আন্দোলন, নারী, শিশু ও নিপীড়িত সামাজিক গোষ্ঠীর উপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে যৌথ বিক্ষোভের মত বিষয়ের প্রতিই লক্ষ্য রেখেছে। বস্তুত, এই চিত্তাকর্ষক কাজের অনেকটা অংশই সামাজিক আন্দোলন, গোষ্ঠী-নির্মাণ এবং বিক্ষোভ, দাঙ্গার মত যৌথ উদ্যোগ এবং অত্যাচার, যন্ত্রণা এবং জঙ্গিবাদের প্রদর্শনীর উপর লক্ষ্য রাখে। দম্ভ, অপমান এবং জাতীয়তাবাদের মত বিষয় নিয়ে আমাদের দেশে কিছু চমৎকার কাজ হয়েছে।
কিন্তু, এখনও পর্যন্ত দৈনন্দিন গণতান্ত্রিক চর্চা সহ, নির্বাচনী রাজনীতিতে আবেগের ভূমিকা বিষয়ক সরাসরি প্রশ্নটি নিয়ে যথেষ্ট কাজ হয় নি। কংগ্রেস দল, একদা ভারতে সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী দল, তার ক্ষমতার তুঙ্গ মুহূর্তে হয়ত এই রকম আবেগপূর্ণ রাজনীতি থেকে উপকৃত হতে সক্ষম হয়েছে। ভারত একটি প্রজাতন্ত্রে পরিণত হওয়ার পর, ১৯৫১-৫২ সালে প্রথম যে সাধারণ নির্বাচন সংঘটিত হয় তাতে, দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বে, কংগ্রেস দল ভোটের ৪৫ শতাংশ সংগ্রহ করে ও সংসদের ৪৮৯টি আসনের মধ্যে ৩৬৪টিতে জয়লাভ করে। দ্বিতীয় সাধারণ নির্বাচনে, কংগ্রেস দলের প্রাপ্য ভোট (৪৭ শতাংশ) এবং জয়ী আসনের সংখ্যা (৩৭১) বৃদ্ধি পায়। ১৯৭১ সালে ইন্দিরা গান্ধী ৪৩ শতাংশ ভোট পেলেও, ৫৪৩টি আসনের মধ্যে ৩৫২টি কংগ্রেসের দখলে আসে। অর্থাৎ, মোদীর চেয়ে কম ভোট পেলেও, কংগ্রেসের অধিকৃত আসনসংখ্যা ২০১৯ সালে মোদী যত আসনে জয়ী হয়েছিলেন, তার থেকে অনেক বেশি ছিল। তিনটি উদাহরণের ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, ভোটদাতাদের সুগভীর আবেগই আসলে কংগ্রেস দলের প্রতি তাঁদের তুমুল সমর্থনে পরিণত হয়েছিল। দুঃখের বিষয়, ভোটদাতাদের যে প্রবল আবেগ কংগ্রেস দলকে এই সুবিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা উপহার দিয়েছিল, সে বিষয়ে আমাদের জ্ঞান অত্যন্ত স্বল্প।
যে উপায়গুলির মাধ্যমে নির্বাচনের মত রাজনীতির অন্যান্য দিকগুলিতে আবেগের সঞ্চারণ ঘটে তা বোঝাই এই বইটির উদ্দেশ্য। বইটিতে যে আবেগপূর্ণ রাজনীতির বর্ণনা করা হয়েছে, তা বিক্ষোভ, দাঙ্গা এবং সামাজিক আন্দোলনের সময় সে ধরনের আবেগ উপজাত হয়, তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তার বদলে, যে আবেগ নির্বাচনের আগে এবং পরে প্রদর্শিত হয়, তাকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা এবং ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনের প্রেক্ষিতে তার প্রাসঙ্গিকতা বোঝাই এই বইয়ের উদ্দেশ্য। একটিমাত্র অভিজ্ঞতাজনিত ঘটনার উপর লক্ষ্য রাখলে রাজনীতিতে আবেগের ভূমিকার বিষয়ে তত্ত্বগত দিকটি, অর্থাৎ আবেগ এবং যুক্তি যে পরস্পরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে বিজড়িত, তা বোঝার কাজও অনেকটাই এগিয়ে যায়। এর ফলে, আবেগ ও যুক্তির মধ্যে যে অনেক সময়ই যে কৃত্রিম বৈপরীত্য তৈরি করা হয়, তা বাতিল হয়ে যায়।
আমাদের বইতেও নৃতত্ত্ববিদ মুকুলিকা ব্যানার্জীর উদ্ভাবিত যে পথটি অনুসরণ করা হয়েছে, রাজনীতিতে আবেগের বিষয়টি গড়ে উঠেছে তার উপর ভিত্তি করেই। তিনি ভারতের ২০০৯ সালের সাধারণ নির্বাচন নিয়ে তাঁর অসাধারণ এথনোগ্রাফিটিতে তাঁর উদ্ভাবন করা এই পন্থার বর্ণনা করেন। তাঁর এই বইয়ের লক্ষ্য ছিল “সাধারণ ভারতবাসীর নির্বাচণের অভিজ্ঞতা ও তাঁদের কাছে নির্বাচনের অর্থ কি”, তা নিয়ে আলোচনা করা। এই বইতে বর্ণিত “ভোটদানের মত একটি অভিব্যক্তিপূর্ণ কাজ”, যা উঠে আসে নানা প্রশ্ন, সমস্যা ও রাজনীতিবিদদের প্রতি সাধারণ মানুষের অনুভব ও আবেগ থেকে, যার মূল্য বার্তাজীবী, পাণ্ডিত্যের পরিসরে ও সামাজিক আন্দোলনকারীদের কাছে মোদী ও হিন্দু জাতীয়তাবাদের থেকে অনেক কম। ভারতের নির্বাচনী গণতন্ত্রর ভিত্তিস্বরূপ এই আবেগের রাজনীতিকে আরও ভালভাবে বুঝতে হলে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী এবং নৃতত্ত্ববিদদের মধ্যে এমন আলোচনা শুরু হওয়া দরকার, যা আমাদের গণতান্ত্রিক চর্চার অত্যাবশ্যক কিন্তু প্রায় অনালোচিত উপাদানটিকে গভীরে গিয়ে বিশ্লেষণ করে।