মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব কি কেবল মুসলিমদের দ্বারাই হওয়া উচিত? এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি অনেক সময়ই আইনসভায় মুসলিম এমপি আর এমএলএ-দের ক্রমহ্রাসমান সংখ্যা নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্নের নিচে চাপা পড়ে যায়। এই বিষয়ে জনপ্রিয় সাংবাদিক ভাষ্য সাধারণত ভারতীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রান্তিকীকরণকে জনসমক্ষে আনার জন্য আইনসভায় ঠিক কত জন মুসলিম সদস্য আছেন, তার উপর তাঁদের সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে থাকেন। অন্যদিকে, শুধুমাত্র “বর্ণনামূলক প্রতিনিধিত্ব” নামক প্রাচীন ধারণাটিকে প্রতিপন্ন করতে, মুসলিমদের নিম্ন-প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি ব্যবহার করা হয়, এবং তা প্রমাণ করার জন্য বিশেষজ্ঞদের লেখাগুলি ভীষণভাবে পরিসংখ্যান থেকে পাওয়া তথ্যের উপর নির্ভর করে। বর্ণনামূলক প্রতিনিধিত্বের দাবি, রাষ্ট্রের “প্রতিবিম্ব” হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য আইনসভাগুলিকে ভারতের সামাজিক-ধর্মীয় বৈচিত্র্যকে প্রতিমূর্ত করতে হবে। আরও বিস্তৃতভাবে দেখলে, এই যুক্তিগুলি উঠে আসে এমন একটি একটি প্রচলিত ধারণা থেকে, যা দাবি করে যে একমাত্র আইনসভার মুসলিম সদস্যরাই একটি সমজাতীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের যৌথ স্বার্থকে নিরাপত্তা দিতে পারেন। এই অতিসরল ধারণাকে অতিক্রম করতে হলে আমাদের তিনটি প্রাথমিক বিষয়কে গুরুত্ব দিতে হবেঃ একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠী হিসেবে মুসলিম সম্প্রদায়ের গঠন; একটি সমষ্টিগত মুসলিম স্বার্থের সংকলনের কল্পনা; এবং এই যৌথ স্বার্থকে সুরক্ষা দিতে মুসলিম নেতৃবৃন্দ (বা আনুষ্ঠানিক অর্থে, আইনসভার সদস্য)-দের প্রত্যাশিত ভূমিকা।
সম্প্রদায়
এ ব্রিফ হিস্ট্ররি অফ দি প্রেজেন্টঃ মুসলিমস ইন নিউ ইন্ডিয়া (পেঙ্গুইন-র্যান্ডম হাউজ, ২০২৪) নামের আমার সাম্প্রতিক বইতে আমি “প্রকৃত মুসলিমত্ব” এবং “প্রকৃত মুসলিমত্ব নিয়ে আলোচনা”-র মধ্যে একটি বিশ্লেষণমূলক প্রভেদ করার চেষ্টা করেছি। “প্রকৃত মুসলিমত্ব” স্থানীয় ও আঞ্চলিক স্তরে মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতাকে ধরার চেষ্টা করে। মুসলিম পরিচয় ও এবং একটি নির্দিষ্ট সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে যৌথ স্ব-উপলব্ধির নির্মাণের ক্ষেত্রে জাতি-পরিচয়, ভাষা, অর্থনৈতিক অবস্থান, উপসম্প্রদায় এবং অঞ্চলের মত বিষয়গুলি নিরূপক উপাদান হয়ে ওঠে। “প্রকৃত মুসলিমত্ব নিয়ে আলোচনা” মুসলিম পরিচয়ের আরেকটি সমান জোরালো অভিব্যক্তি যা, যতগুলি পন্থায় ভারতের মুসলিম যৌথ উপস্থিতি অনুভূত, বর্ণিত এবং বিতর্কিত হয়েছে, সেগুলির সঙ্গে যুক্ত। সম্পূর্ণ ধর্মের প্রেক্ষিতে, একটি “ধর্মবিশ্বাস-কেন্দ্রিক সম্প্রদায়” (অর্থাৎ, একত্রে বা কাছাকাছি বসবাসকারী একই ধর্মে বিশ্বাসী গোষ্ঠী) হিসেবে মুসলিমদের সঙ্গে ব্যবহার, তাঁদের ধর্মীয় বৈশিষ্ট্যকে আইন ও সংবিধানের আলোচনায় “সংখ্যালঘু” হিসেবে চিহ্নিত করা, আদমশুমারীর পরিভাষায় তাঁদের জনসংখ্যাকে মাপা, মধ্যযুগীয় “ইসলামী শাসন”-কে মুসলিম সম্প্রদায়ের নিজস্ব ইতিহাস হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া, “বিশ্বব্যাপী জেহাদ” ও মৌলবাদ নিয়ে মিডিয়াতে আলোচনা – এই সমস্ত বিষয় পরিচয় নিয়ে একটি জোরালো বিতর্ক তৈরি করে। পরিণামে, কয়েকটি মহান ব্যাখ্যা নির্মাণের জন্য ব্যক্তি মুসলিমকে প্যান-ইসলামীয় কল্পনার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। মুসলিম পরিচয়ের এই সহজলভ্য টেম্পলেটটি তৃণমূল স্তরে মুসলিম সম্প্রদায়ের স্ব-য়ের উপলব্ধিকেও প্রভাবিত করে।
প্রকৃত মুসলিমত্ব এবং প্রকৃত মুসলিমত্ব নিয়ে আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ মধ্যবর্তী পর্যায়টিই আদতে ভারতের মুসলিম পরিচয়ের যথার্থ প্রতিনিধিত্বকে নির্ণয় করে। এই দিক থেকে দেখলে, মুসলিম পরিচয় নির্মাণের বিষয়টি একটি দোলকের মত কাজ করে। প্রকৃত মুসলিমত্ব নিয়ে আলোচনা এবং ভারতের একক একটি মুসলিম সম্প্রদায় এই দোলকের দোলনের একটি চরম প্রান্ত, এবং যে অব্যবহিত সাংস্কৃতিক-স্থানীয় বিবেচনার দ্বারা মুসলিমত্ব গঠিত হয়, তা অন্য প্রান্তটি।
স্বার্থ
সিএসডিএস-লোকনীতি প্রি-পোল সার্ভে ২০২৪ (যা জাতীয় নির্বাচনের কয়েক মাস আগে ১৯টি রাজ্যের ১০,০১৯ জন নমুনা উত্তরদাতার মধ্যে পরিচালনা করা হয়) থেকে, মুসলিম সম্প্রদায়ের সমষ্টিগত আকাঙ্খার প্রকৃতিকে পরীক্ষা করার জন্য “মুসলিম প্রশ্ন”-এর ধারণাকে বোঝার উপযুক্ত পন্থা পাওয়া যায়। আমরা দেখতে পাই যে, ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, উন্নয়নের অভাব, মূল্যবৃদ্ধি এবং আয়ের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বৈসাদৃশ্য ইত্যাদি বিষয়গুলিই মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রধান দুশ্চিন্তা। প্রায় ৬৭ শতাংশ মুসলিম জোরের সঙ্গে বলেন যে, বর্তমান অর্থনৈতিক আবহাওয়ায় কর্মসংস্থান অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে। ৭৬ শতাংশ মুসলিম মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে আরও বেশি উদ্বিগ্ন। তফসিলি জাতির যে তালিকাটির অংশ হলে নানা ইতিবাচক সহায়তা পাওয়া সম্ভব হয়, সেই তালিকায় দলিত মুসলিমদের যুক্ত করার বিষয়ে অভিমতটি আরেকটি আরেকটি জরুরি তথ্যকে তুলে ধরে। বৈষম্যের বহু প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও, এই রকম একটি ধারণা আছে যে ভারতীয় মুসলিম ও খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ে অস্পৃশ্যতার চর্চা হয় না। এর ফলে, এই মুহূর্তে ওই গোষ্ঠীদুটি তফসিলি জাতির তালিকার অংশ নন । মুসলিম সম্প্রদায়ের একটা বিশাল অংশ (৭৬ শতাংশ) বিশ্বাস করেন যে মুসলিম দলিতদের তফশিলি জাতির তালিকায় যুক্ত করা উচিত। এই জাতীয় তথ্য, পরিচয়-কেন্দ্রিক “মুসলিম প্রশ্ন”-এর প্রচলিত ধারণা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। ধর্মনিরপেক্ষতার শর্তে তাঁদের নাগরিকত্বের পুরোনুদ্ধার করার জন্য প্রকৃত মুসলিমত্ব এক রকম ভাবে মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে একটি সুবিশাল
তবে, এর মানে এই নয় যে, হিন্দুত্ব-আধিপত্যময় আবহাওয়া সমষ্টিগত মুসলিম সম্প্রদায়ের সমষ্টিগত কল্পনাকে প্রভাবিত করে না। মুসলিম ধর্মীয় পরিচয় এবং ভারতীয় সংবিধানের স্বীকৃত সংখ্যালঘু গোষ্ঠী হিসেবে তার সমষ্টিগত অস্তিত্বকে বর্তমান পরিবেশে যে সমস্যাজনক বলে বিবেচনা করা হচ্ছে, তা নিয়ে আশঙ্কা ক্রমশ বাড়ছে। মুসলিম লিডারশিপ ২০২৪-এর উপর আমাদের সায়েন্স-পিও-সিএসডিএস-লোকনীতি সার্ভে (যা, সমসাময়িক ভারতের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নিয়ে মুসলিমদের ধারণা ও মতামত সংগ্রহের করেছে যে এনইএস প্রি-পোল সার্ভে ২০২৪, তার পাশাপাশি পরিচালিত হয়েছে) থেকে জানা যায় যে, মুসলিম উত্তরদাতাদের মধ্যে একটা বড় অংশ (৪৩ শতাংশ) মনে করেন যে, রাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষ মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করেন। বাস্তবিকই, “মুসলিম নিরাপত্তা”-র প্রশ্নটি এখন অনেকটাই গুরুত্ব পাচ্ছে। ৫৪ শতাংশ মুসলিম উত্তরদাতা দাবি করেন যে, তাঁরা অন্যান্য সম্প্রদায়ের মত সুরক্ষিত বোধ করেন না (এর মধ্যে ১১ শতাংশ মনে করেন তাঁরা একেবারেই নিরাপদ নন)। দেখা গেছে, মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ বর্তমানে এতটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে যে, অনেক মুসলিমই মনে করেন যে, সেই ব্যবহার নিয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগও জানান সম্ভব নয়। সেই দিক থেকে দেখলে আমরা বুঝতে পারি যে, মুসলিম সম্প্রদায় মেনে নিয়েছেন যে হিন্দুত্বের আদর্শ দ্বারা চালিত প্রশাসন ব্যবস্থার বর্তমান প্রথাই তৃণমূল স্তরে তাঁদের নতুন বাস্তব। এই জন্যেই মুসলিমরা সরকারি সংগঠনের সঙ্গে কার্যকর সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী। বলা যেতে পারবে, সম্ভাব্য দ্বন্দ্ব ও বিতর্ক এড়িয়ে নানা স্তরে রাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার জন্য স্ব-প্রতিনিধিত্বের বিকল্প বেছে নেওয়া আদতে টিঁকে থাকার একটি কৌশল।
এই দুটি আবিষ্কার থেকে বোঝা যায় যে, মুসলিম সম্প্রদায়ের স্ব-এর বোধ অবশ্যই আর্থ-সামাজিক বিবেচনা, যাকে আমরা প্রকৃত মুসলিমত্ব বলে থাকি, তার দ্বারা নির্ধারিত হয়। একই সঙ্গে, মুসলিমত্ব নিয়ে আলোচনায় হিন্দুত্বের আধিপত্য একটি নির্ধারক হয়ে দাঁড়িয়েছে, যাকে মুসলিম সম্প্রদায় একটি অস্তিত্বের প্রশ্ন হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন। সুতরাং, এটা স্পষ্ট যে, ভারতীয় মুসলিমদের জটিল, বহুস্তরীয় ও এলোমেলো গঠনের প্রেক্ষিতেই এই সম্প্রদায়ের “সমষ্টিগত স্বার্থ”-কে অর্থপূর্ণভাবে বোঝা যাবে।
নেতৃত্ব
সামাজিক কার্যকলাপের জন্য রাজনীতি, বিশেষ করে নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতিই মুসলিম সম্প্রদায়ের পছন্দের পরিসর বলে চিহ্নিত করা যায়। আমাদের পাওয়া তথ্য থেকে দেখতে পাই, ৫১ শতাংশ মুসলিম মনে করেন যে, তাঁদের ভোট সত্যি পরিবর্তন আনতে পারে। ২০২৪ সালের নির্বাচনে মুসলিমদের ব্যাপকহারে অংশগ্রহণ (৬২ শতাংশ) প্রমাণ করে যে, ব্যক্তি নাগরিক এবং বিপন্ন সংখ্যালঘু গোষ্ঠী - দুই পরিচয়েই সুরক্ষা পেতে মুসলিম সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার উপর তাঁদের বিশ্বাস রাখেন। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার উপর মুসলিম সম্প্রদায়ের এই গভীর বিশ্বাসের থেকে তিনটি প্রশ্ন উঠে আসে। প্রথমত, ভোটদান নিয়ে মুসলিমদের মধ্যে যে প্রবল উৎসাহ, তার সঙ্গে কি নির্বাচনপ্রার্থীর সামাজিক-ধর্মীয় পরিচয়ের কোনও পারস্পরিক সম্পর্ক আছে? দ্বিতীয়ত, যদি থেকে থাকে, তাহলে লোকসভা, বিধানসভা বিভিন্ন নাগরিক সংগঠন সহ সমস্ত নির্বাচনের ক্ষেত্রেই কি তা প্রযোজ্য? তৃতীয়ত, মুসলিমরা কি মুসলিম নেতাদের বিশ্বাস করেন? যদি করে থাকেন, তবে এই নেতাদের থেকে তাঁদের প্রত্যাশা ঠিক কি?
“মুসলিম নেতৃবৃন্দ” – এই শব্দগুচ্ছ তিন ধরণের রাজনৈতিক অভিনেতাকে বর্ণনা করার জন্য ব্যবহার করা হয়, যাঁদের ভিন্ন ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে নির্দিষ্ট ও নিজস্ব দায়িত্ব আছে। এই তিন অভিনেতা হলে, পেশাদার মুসলিম রাজনীতিবিদ, অভিজাত মুসলিম শ্রেণী এবং মুসলিম অ্যাক্টিভিস্ট/ইনফ্লুয়েন্সার। পেশাদার রাজনীতিবিদরা যে রাজনৈতিক দল ও যে গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করেন বলে দাবি করেন, তার মধ্যে তিনি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ হিসেবে কাজ করেন। মুসলিম অভিজাত গোষ্ঠী একটি বিস্তৃততর শ্রেণী, যাঁরা তাঁদের ধর্মীয়/শিক্ষাগত/জাতি/শ্রেণী পরিচয়ের কারণে নেতৃত্বের মহত্তর অবস্থানের দাবি করেন। একটি উদ্বিগ্ন মুসলিম সম্প্রদায়ের আভ্যন্তরীণ ক্ষমতার কাঠামো বজায় রাখার ক্ষেত্রে এই অভিজাত মুসলিম গোষ্ঠীর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। মুসলিম ইনফ্লুয়েন্সার/অ্যাক্টিভিস্টরা গণ-আলোচনা ও বিতর্কে অংশগ্রহণ করেন ও মুসলিম অংশীদার হিসেবে মিডিয়ার দ্বারা চালিত বিতর্ক ও আলোচনায় নিজেদের জায়গা তৈরি করে নেন।
আমাদের সমীক্ষা থেকে দেখা যায় যে, মুসলিম ভোটদাতাদের মধ্যে ৫০ শতাংশ জানান যে, ভোটপ্রার্থী নেতার ধর্মীয় পরিচয় তাঁকে নির্বাচনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে তাঁরা বিবেচনা করেন না। তবে ৩০ শতাংশ এই মতামতের পক্ষপাতী নন। তাঁদের মতে, একমাত্র তাঁদের নিজের সম্প্রদায়ের থেকে উঠে আসা নেতাই কার্যকরভাবে তাঁদের স্বার্থ ও উদ্বেগকে তুলে ধরতে পারবেন। মুসলিমদের নিজেদের মধ্যেই এই বিচিত্র মতামত থেকেই তাঁদের ভোটদানের নকশার মধ্যে তাঁদের প্রকৃতির দীর্ঘদিনের ভিন্নতাকে সামনে আনে। সহজে বলতে গেলে এর অর্থ একজন পেশাদার মুসলিম নেতার ধর্মীয় পরিচিতি এমন একটি বিষয় যা নির্দিষ্ট প্রেক্ষিতের উপর নির্ভর করে, বিশেষ করে লোকসভা বা বিধানসভার ক্ষেত্রে, যেখানে নির্বাচিত প্রতিনিধির সহজলভ্যতা বিবেচনার মূল বিষয় নয়।
তা সত্ত্বেও, মুসলিম নেতৃত্বের বিষয়ে মুসলিম সম্প্রদায় সব সময় যে একটি স্বার্থ ও প্রয়োজন কেন্দ্রিক পন্থা আনুসরণ করেন, এমন নয়। আমাদের সমীক্ষা দেখায় যে, বর্তমান মুসলিম নেতাদের নিয়ে মুসলিমদের মতামত যথেষ্ট ইতিবাচক। ৬৪ শতাংশ মুসলিম উত্তরদাতার মতে, মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে সৎ ও দায়িত্ববান নেতা আছেন। অপর দিকে, একই সংখ্যক মুসলিম উত্তরদাতাদের (৬৪ শতাংশ) মতে ভারতে আরও বেশি স্পষ্টবক্তা মুসলিম নেতার প্রয়োজন আছে। দৃশ্যত আপাতবিরোধী মনে হলেও, এই এই দাবিদুটি একটি জটিল মুসলিম প্রতিক্রিয়াকে সামনে আনে। একজন নেতার সততা একটি ব্যক্তি-নির্ভর বিষয়। হিন্দুত্ববাদের আধিপত্যের কারণে মুসলিম নেতারা রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের কাছে কোনও রকম মর্যাদা বা দরাদরির ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। বিজেপি ছাড়া অন্যান্য দলগুলির মধ্যে, অন্যদিকে, পেশাদার মুসলিম রাজনীতিবিদদের একত্রিত করার কোনও উৎসাহ নেই। তাঁরা নিশ্চিত যে, মুসলিম ভোটের উপর তাঁদেরই একচেটিয়া এবং এই কারণেই মুসলিম নেতাদের দিক থেকে কোনও রাজনৈতিক পরিষেবার খুব বেশি প্রয়োজন তাঁদের নেই। এই পটভূমিকায়, খুবই স্বাভাবিক যে, মুসলিম নেতারা চাইবেনই তাঁদের নিজের সম্প্রদায়, যার প্রতিনিধিত্ব তাঁরা করছেন, তার সঙ্গে তাঁদের জৈব সম্পর্ককে দৃঢ়তর করতে। এই প্রক্রিয়াটি অবশ্যই মুসলিম রাজনীতিবিদ ও ইনফ্লুয়েন্সারদের সম্পর্কে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে, সামান্য হলেও, ইতিবাচক ধারণা তৈরি করেছে। তবে, মুসলিম নেতৃত্বের বর্তমান রূপ নিয়ে এক ধরণের অস্বাচ্ছন্দ্য বেড়ে চলেছে। মুসলিম উত্তরদাতারা জোরের সঙ্গে জানান যে, মুসলিমদের যা অবশ্যই প্রয়োজন তা হল, উত্তমতর, সুবক্তা ও সৎ নেতার। ৫০ শতাংশের বেশি মুসলিম মনে করেন যে, দায়িত্বশীল ও সমর্পিত মুসলিম নেতার অভাব তাঁদের প্রতিনিধিত্বের জন্য হানিকর। এই তথ্যটি থেকে বোঝা যায় যে, মুসলিম সম্প্রদায় রাজনীতির একটি বাস্তব চিত্রে বিশ্বাস করেন। তাঁরা নিজেদের এমন ভোটদাতা হিসেবে বিবেচনা করেন, যাঁরা ধর্মনিরপেক্ষ হলেও ইসলামের অনুসরণকারী হিসেবে তাঁরা নিজেদের সমষ্টিগত পরিচয় ত্যাগ করেন নি।
প্রতিনিধিত্ব
মুসলিম রাজনৈতিক পরিচয়ের এই বহুমুখী নির্মাণ প্রতিনিধিত্বের তিনটি অর্থকে সামনে আনে। প্রথমত, আনুষ্ঠানিক ভাবে, সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ পরিভাষায় প্রতিনিধিত্ব সংজ্ঞায়িত হয়। মুসলিম উত্তরদাতারা যথেষ্ট দৃঢ়ভাবে নিশ্চিত যে, একজন নেতার ধর্ম বিবেচনার প্রধান বিষয় নয়। অন্য ভাবে বলতে গেলে, শুধুমাত্র প্রতিনিধিত্বের খাতিরে পেশাদার মুসলিম রাজনীতিবিদদের অগ্রাধিকার দেওয়ার কোন প্রবণতা দেখা যায় না। মুসলিম সম্প্রদায়ের আর্থ-সামাজিক অনগ্রসরতা এবং প্রান্তিকীকরণ নিয়ে মুসলিমদের নিজেদের মতামত একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রত্যাশার কথা তুলে ধরে। এই দিক থেকে দেখলে, প্রতিনিধিত্ব “সাংগঠনিক অন্তর্ভুক্তি”-র একটি রূপ। “পাসমান্দা”, অর্থাৎ ঐতিহাসিকভাবে নিপীড়িত মুসলিম জাতি-সম্প্রদায়ের হাতে ইতিবাচক পরিষেবা তুলে দেওয়ার জন্য, তফসিলি জাতির তালিকায় তাঁদের যুক্ত করার দাবি, এই গতিপথের একটি স্পষ্ট প্রকাশ। ভারতে একটি সুরক্ষিত পরিবেশের সন্ধান এবং স্ব-ঘোষিত এক অপ্রতিরোধ্য দেশাত্ববোধের ধারণা দেখায় যে, মুসলিম সম্প্রদায় বুঝতে পেরেছেন ক্ষমতাশালী মিডিয়ার দ্বারা চালিত মুসলিম-বিরোধী প্ররোচনামূলক প্রচারণা প্রকাশ্য পরিসরে তাঁদের অস্তিত্ব নিয়ে ঠিক কি ভাবে কুৎসা রটনা করেছে। এই ক্ষেত্রে, ভারতীয় সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক জীবনে তাঁদের নিজস্ব পরিসরের পুনরুদ্ধার করার জন্য তাঁরা প্রতিনিধিত্ব বিষয়টিকে “সমষ্টিগত উপস্থিতি” হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। এই নকশাতে মুসলিম নেতাদের “প্রতিনিধি” হিসেবে দেখা হয় না, বরং প্রত্যাশা করা হয় যে বিভিন্ন স্তরের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ তৈরির জন্য তাঁরা সহায়তাকারী হিসেবে কাজ করবেন।
লেখক স্বীকৃতিঃ এই সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধটি হেনরি লুস ফাউন্ডেসনের আর্থিক সহায়তায় পরিচালিত “মুসলিম ইন ইন্ডিয়া (এমআই)” প্রকল্পের ফলশ্রুতি। এই গবেষণা উদ্যমের পিছনে অবিচলিত বৌদ্ধিক সমর্থনের জন্য আমি ক্রিস্টফ জ্যাফ্রেলটের কাছে কৃতজ্ঞ।