মিডিয়া তার নানা রূপের মাধ্যমে সামাজিক আচার-আচরণকে প্রভাবিত করতে সক্ষম বলে, তাকে নিয়ে উদ্বেগই তাকে নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টার প্রধানতম কারণ। এর উদাহরণ হিসেবে আমরা সমসাময়িক ভারতে, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের প্রকাশিত সর্বশেষ নির্দেশিকাটি যে “অনলাইন কিউরেটেড কনটেন্ট প্ল্যাটফর্মস” বা ওটিটি (ওভার-দ্য-টপ) -এর প্রতি নির্দেশ করে, তার কথা উল্লেখ করতে পারি। এই প্ল্যাটফর্মে দেখান অশ্লীল বিষয়বস্তুগুলি নিয়ে অনেক অভিযোগ তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকে আসে বলে, তথ্য প্রযুক্তি (ইন্টারমিডিয়ারি গাইডলাইন অ্যান্ড ডিজিটাল মিডিয়া এথিকস কোড) আইন, ২০২১-কে মেনে চলার প্রয়োজনীয়তা এই নির্দেশিকায় বর্ণনা করা হয়। তবে মিডিয়াতে বিষয়বস্তুকে নিয়ন্ত্রণের দাবি নতুন কিছু নয়। ১৯৯০-এর দশকের উদারীকরণের পর স্বত্বাপহরণ (পাইরেসি), মিডিয়া ইমপোর্ট, ভিডিও প্রযুক্তি, কেবল টেলিভিশন এবং বিদেশী মিডিয়া নিয়ে যে প্রবল উদ্বেগ দেখা দিয়েছিল, তার সঙ্গে এর অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। আসলে, ভিডিও, কেবল টেলিভিশন এবং স্টিমিং প্ল্যাটফর্মের মত প্রতিটি প্রযুক্তিগত রূপান্তরের পরেই রাষ্ট্র-পরিচালিত মিডিয়ার ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত বিধিনিয়মগুলির পারস্পরিক সমন্বয় ও ভারসাম্যের স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়ে যেতে দেখা যায়। যখন ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে তার অর্থনীতিকে মুক্ত করে, তখন উদারীকরণের অগ্রদূত হিসেবে প্রবাসী ভারতীয়দের হাত ধরে এমন একটি ভোক্তাকেন্দ্রিক অর্থনীতির উত্থান হয়, যা এমনকি, আশির দশকেও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এর সঙ্গে ছিল, ভিসিআর আর ভিএইচএস টেপের দ্রুত বেড়ে চলা জনপ্রিয়তা। এর পাশাপাশি, প্রথমে বৈধভাবে আমদানি করা ও পরে দক্ষিণপূর্ব এশিয়া ও গালফ অঞ্চল থেকে চোরা চালান করে আনা ক্যাসেট ইত্যাদির প্রবাহ রুখতে স্থানীয়ভাবে তৈরি ভিডিও ক্যাসেট সহজলভ্য হয়ে ওঠে। এই পরিবর্তনগুলির প্রভাব কেবলমাত্র অর্থনৈতিক বা প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছিল এমন নয়। ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে প্রবাসী ভারতীয় বা নন-রেসিডেনশিয়াল ইন্ডিয়ান (এনআরআই) শ্রেনী যে সরকারের মিডিয়া নীতির একটি মূল স্তম্ভ হয়ে উঠেছিলেন, সেই ঘটনার মধ্যেও দেখা গিয়েছিল।
আপাতদৃষ্টিতে সামান্য ভিন্নমুখী হলেও, চলচ্চিত্র প্রযোজনা ও পরিবেশনা সংস্কৃতি এবং ইরোটিক ভিডিও ও সফট পর্ন চলচ্চিত্রের উপর ভারতের ভিডিও প্রযুক্তির প্রসার ও প্রবাসী ভারতীয় শ্রেণীর ক্রমবর্ধমান উপস্থিতির অনিচ্ছাকৃত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছিল। ভিডিও পাইরেসি নিয়ে উদ্বেগ এবং প্রবাসী ভারতীয়দের থেকে অর্থপ্রাপ্তির প্রচেষ্টার একটি বিপরীত প্রতিক্রিয়া দেখা যায় – ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিদেশী এক্সপ্লয়টেশন ফিল্ম (একটি নির্দিষ্ট দর্শক শ্রেণীর জন্য যৌনতা, হিংস্রতা বা মাদকের অপব্যবহারের মত চলতি প্রবণতা বা নিষিদ্ধ বিষয় নিয়ে দ্রুত মুনাফার আশায় কম খরচে নির্মিত চলচ্চিত্র) আমদানি বৃদ্ধি। এই ছবিগুলিই পরবর্তীকালে আমরা আজকে যাকে আজকের মালায়ালম “সফট পর্ন চলচ্চিত্র” ধারা বলে জানি, তার নির্মাণের ক্ষেত্রে একটি মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল।
ভিডিও প্রযুক্তি ও ঘরে বসে দেখার সুবিধা
১৯৯০-এর দশকে, ভারতের কেন্দ্রসরকার ৯০০,০০০-এর বেশি ভিসিআর/ভিসিপি তৈরির অনুমতি দেওয়ার পর, ভিডিওকন, বিপিএল ও কল্যাণী শার্প বাড়িতে বসে দেখার জন্য ভিসিআর ও ভিডিও ক্যাসেট প্লেয়ার (ভিসিপি) বানাতে শুরু করে। দেশীয় ভিসিপি নির্মাতার সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, ভিএইচএস টেপের উপরেও জনগণের আগ্রহ বেড়ে যায়। ১৯৯০-এর দশকে, অন্যান্য জিনিসের মধ্যে, ডিরেক্ট-টু-ভিডিও ইরোটিক থ্রিলারের পাশাপাশি পে টিভি, যা গালফ অঞ্চলবাসী ভারতীয়দের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল, তার ব্যবহার বহুগুণ বেড়ে যায়। গালফ অঞ্চল থেকে পর্নোগ্রাফি যার প্রচলিত ভারতীয় নাম “ব্লু ফিল্ম”, তার পাইরেটেড ভিএইচএস টেপ ভারতে ঢুকতে শুরু করে এবং, সঙ্গে সঙ্গে, বাণিজ্যিক জাহাজের নাবিকরা যে সব ব্লু ফিল্ম ফেলে যান, সেগুলিকে দেশীয় কালো বাজারে বিক্রি করাও শুরু হয়। বাড়িতে বসে দেখার ফলে গোপনীয়তার যে সুবিধা পাওয়া যায়, তার কারণে দর্শকরা নিজেদের শোয়ার ঘরের নির্জন নিরাপত্তার মধ্যে বসে ইরোটিক চলচ্চিত্র দেখার সুযোগ পান। বাইরে থেকে আমদানি করা ব্লু ফিল্ম ঘষে মেজে থুন্ডু হিসেবে দেখান হত, অর্থাৎ স্বদেশে নির্মিত ব্লু ফিল্মের প্রদর্শনী চলাকালীন, বিদেশী ব্লু ফিল্মের অংশ জুড়ে দেওয়া হয়। ১৯৯০-এর দশকে ভারতে ভিডিওর প্রসার ও সুবিশাল বিস্তারের পাশাপাশি চোরাচালান ও পাইরেসির হাত ধরে যে ছায়া অর্থনীতির নির্মাণ হয়েছিল, তাকে নিয়ে উদ্বেগের খবর মিডিয়াতেও জায়গা পায়। ১৯৯১ সালে আর. শ্রীনিবাসন দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া-তে লেখেন, বাহকদের ব্যবহার করে হং কং-এর মত দেশ থেকে চোরাচালান করে আনা ভিডিও টেপ বোম্বে-র সান্টা ক্রুজ ইলেকট্রনিক্স এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোনে বাজেয়াপ্ত করা হত। তিনি আরও লেখেন যে, এক্স-রে স্ক্যানে ধরা পড়া এড়াতে কার্বনযুক্ত কাগজের ব্যবহার, শুল্ক বিভাগের আগে থেকে ঠিক করে রাখা ব্যক্তিদের ব্যবহার করার মত পরিচিত কৌশল প্রয়োগ করা হত। এবং তার পাশাপাশি, বাহকরা ভিসিআর আর স্টিরিও-র জন্য নির্ধারিত শুল্ক দিয়ে দিতেন, যাতে আলাদা ব্যাগে রাখা বেআইনী দ্রব্য থেকে আধিকারিকদের মনোযোগ সরে যায়। তাঁদের এই পরিকল্পনা অনুযায়ী, আধিকারিকরা ভাববেন যে, যে ব্যক্তি শুল্ক হিসেবে এত পরিমাণে টাকা দিতে পারেন, তিনি কখনওই নিষিদ্ধ পণ্য লুকিয়ে নিয়ে যাবেন না।
উদারীকরণের বেশ কিছু বছর আগে, ১৯৮৬ সালে চলচ্চিত্রশিল্পের সঙ্গে জড়িত গোষ্ঠীগুলি পূর্ণদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রের সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে বক্স-অফিসে ভিডিওর আক্রমণকে উল্লেখ করে। এর ফলশ্রুতি একটি ডমিনো এফেক্ট, অর্থাৎ চলচ্চিত্রের দর্শক সংখ্যায় পতনের ধাক্কায় চলচ্চিত্র প্রযোজনায় বিনিয়োগের লাভজনকতায় পতন। ভিডিও পাইরেসিকে ঘিরে একটি উদ্বেগের ভাব বরাবরই ছিল, যার আঘাত চলচ্চিত্রের বিতরণকেও প্রভাবিত করেছিল। এই সময় আর্থিক ক্ষতির পরিমাণও অনেক বেড়ে যায়, সুবিশাল পরিমাণে ভিসিআরের বেআইনীভাবে আমদানির কারণে আমদানি শুল্ক হিসেবে সরকার বিশাল অঙ্কের অর্থ প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছিলেন। ১৯৮৬ সালে ফিল্ম ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়া তার একটি বিবৃতিতে, ভারতীয় চলচ্চিত্রের রিল ও সরকারীভাবে নির্মিত ভিসিআর প্রিন্টের রপ্তানীকে ভিডিও পাইরেসি কিভাবে প্রভাবিত করেছিল, তার কথা উল্লেখ করে। ইতিমধ্যে, অসংযতভাবে যত্রতত্র ভিডিও পার্লার গজিয়ে ওঠা বন্ধ করতে, রাজ্যসরকারগুলি একটি নিয়ন্ত্রক প্রক্রিয়ার পরিকল্পনা বের করেন। অনুমতিপত্রহীন ভিডিও লাইব্রেরী, গোপনে ভাড়া দেওয়া সেক্স ভিডিও, নতুন বেরনো চলচ্চিত্রের অবৈধ কপি এবং বেআইনীভাবে তৈরি ৩৫ এমএম চলচ্চিত্রের কপি – এই সবকিছুকেই আশু উদ্বেগের কারণ হিসেবে দেখান হতে থাকে। ১৯৮৪ সালের মে মাসে সিনেমাটোগ্রাফ অ্যাক্ট অফ ১৯৫২-এর সংশোধন করে, সমস্ত ভিডিও ক্যাসেটকে একটি নতুন সেন্সর শংসাপত্র বহন করতে হবে, এই মর্মে একটি শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। যেহেতু বিনোদন কর আদায়ের দায়িত্ব রাজ্যসরকারেরই, তাই ভিডিও পাইরেসি নিয়ন্ত্রণের পন্থা বের করা নিশ্চিত করার দায়িত্বও তারই।
প্রবাসী ভারতীয় প্রকল্প
ভারতের মিডিয়াকে ঘিরে তৈরি হওয়া বাস্তুতন্ত্রটির পাশাপাশি, দেশের বৃহত্তর আর্থসামাজিক বিকাশের দিকটিরও একটি ভূমিকা ছিল। এবং এই পথ দিয়েই প্রবাসী ভারতীয়দের প্রবেশ ঘটে। ১৯৯০-এর দশকে প্রবাসী ভারতীয়দেরকে প্রথমে সম্পদের এমন অব্যবহৃত উৎস হিসেবে চিহ্নিত করা হয় যা, বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি দেখা দিলে, অর্থের যোগান দিয়ে ভারতের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে পারবে। চলচ্চিত্রশিল্পের ক্ষেত্রে, ১৯৯১ সালের ভারতের মুদ্রার মূল্যহ্রাসের একটি অভূতপূর্ব প্রভাব দেখা গিয়েছিল। এই সময় ব্যবহারের উপযুক্ত ৩৫ এমএম আমদানি কমে যায় ও চলচ্চিত্রের স্টকের মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়। এছাড়াও, ন্যাশনাল ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন থেকে অর্থসাহায্য পেতেন যে চলচ্চিত্র-নির্মাতারা, তাঁদের ৩৫ এমএম-এর বদলে, অপেক্ষাকৃত কমদামী ১৬ এমএম-এ চিত্রগ্রহণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। ১৯৭০-এর দশকের শেষদিক থেকেই, ভারতীয় চলচ্চিত্রে শিল্পের উদ্বেগের মূল বিষয় ছিল বেআইনীভাবে টাকার যোগান, গোপন মজুতদারী এবং ফাটকা খেলা। কৌতুহলের বিষয় হল, মজুতদারদের চিহ্নিত করার প্রচেষ্টাকালীনই জানা যায় যে, ভারতীয় চলচ্চিত্রশিল্প ক্ষেত্রটি নিজেই আইন এড়ানর মুখ্যতম পরিষর হয়ে উঠেছে। তারকাদের পারিশ্রমিক থেকে শুরু করে চলচ্চিত্র-প্রদর্শকদের প্রাপ্য অগ্রিম অর্থ দানের জন্যও “কালো টাকা”-র বহুল ব্যবহার হতে শুরু করে। অধিকন্তু, ১৯৮০-র দশক নাগাদ, রপ্তানির বৃদ্ধি হওয়া সত্ত্বেও, সুদ পরিশোধ ও আমদানিও বেড়ে যায়, যার ফলশ্রুতি এক্সটারনাল পেমেন্ট ক্রাইসিস ও ব্যালেন্স অফ পেমেন্ট (অর্থাৎ, বিদেশী মুদ্রার ঘাটতির কারণে, একটি রাষ্ট্রের যখন আমদানির জন্য অর্থমূল্য দানে বা বিদেশী ঋণ শোধ করতে সমস্যা হয়)। দেশের সরকারকে তখন বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহের পুনর্নির্মাণের নানা উপায় খুঁজে বের করতে হয়, এবং প্রবাসী ভারতীয়রা এই সময়ই ওই সমস্যার সমাধান হিসেবে দেখা দিয়েছিলেন। এনআরআই বন্ডের প্রবর্তন, অর্থাৎ, কিছু লক-ইন ও রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার অন্তর্নিহিত জামিনসহ, তিন থেকে পাঁচ বছর সময়কালে আকর্ষনীয় মূল্যে প্রবাসী ভারতীয়দের থেকে বৈদেশিক মুদ্রার আমানত সংগ্রহ করার পদক্ষেপটির ফলে প্রবাসী ভারতীয়রা ভারতের আর্থিক আশাভরসার একটি সুদৃঢ় উৎস হয়ে ওঠেন। এই বৃহত্তর অর্থনৈতিক প্রেরণা ও চলচ্চিত্রের প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাসের প্রেক্ষিতেই “প্রবাসী ভারতীয় প্রকল্প”-এর উত্থানক চিহ্নিত করা যায়।
১৯৮৪ সালে, প্রবাসী ভারতীয়দের প্রদত্ত অর্থ হাতে আসার পর, ভারত সরকার “প্রবাসী ভারতীয় প্রকল্প” নামে একটি চলচ্চিত্র আমদানির নকশা ভেবে বের করেন। এই প্রকল্প অনুযায়ী, অভিবাসী ভারতীয়রা একটি ক্যানেলাইজেশন মূল্যের বিনিময়ে বিদেশী চলচ্চিত্র ভারতে আমদানি করতে পারবেন। ন্যাশনাল ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (এনএফডিসি)-কে এই প্রকল্পটি পরিচালনা করার অনুমতি দেওয়া হয়, এবং সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ফিল্ম সার্টিফিকেশন (সিবিএফ)-এর প্রশাসনিক কর্মকর্তা ক্যানেলাইজেশন প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত হন। শর্ত ছিল যে, এই প্রকল্পের মাধ্যমে যে মুনাফা হাতে আসবে, তাকে আবার ভারতেই বিনিয়োগ করতে হবে। কিন্তু “প্রবাসী চলচ্চিত্র”-এর আমদানি নিয়ে মিডিয়ায় যে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছিল, তার সমস্ত কারণই নেতিবাচক। দেখা গেল যে, প্রবাসী ভারতীয়দের দ্বারা আমদানি হওয়া চলচ্চিত্রগুলি দিয়েই বাজার ভরে গেছে এবং তার ফলে, ভারতীয় পূর্ণদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রগুলি তাদের বরাদ্দ সময় ধরে প্রেক্ষাগৃহে চলার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। চলচ্চিত্র আমদানির এই প্রকল্পের শুরুতে, মনে করা হয়েছিল যে, প্রবাসী ভারতীয়রা বিদেশী মুদ্রা আনার মাধ্যমে দেশের উন্নয়নে সহায়তা করতে চাইছেন; আদতে এই প্রকল্প কেবলমাত্র প্রবাসীদের দ্বারা চালিত ছিল না। এরকম অনেক উদাহরণই পাওয়া গেছে, যেখানে অনেক আগ্রহী ব্যক্তি যাঁরা ভারতেরই নাগরিক, তাঁরা, কোনও রকম নান্দনিকতা বা আনুষ্ঠানিকতার দ্বারা ভারাক্রান্ত না হয়ে, বিদেশে নিজেদের যোগাযোগকে কাজে লাগিয়ে বিদেশী ছবির আমদানি করেছেন।
অনেক সময়ই, এই ব্যবসায়িক লেনদেনগুলি, সিঙ্গাপুর আর মালয়েশিয়ার মত দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশে বসবাসকারী প্রতিনিধিদের দ্বারা সম্পন্ন হত। এই প্রতিনিধিরা প্রবাসী ভারতীয়দের সঙ্গে ভারতে বসবাসকারী চলচ্চিত্র সংগ্রাহকদের যোগাযোগ করিয়ে দিতেন, যাঁরা আবার নির্দিষ্ট কোনও ছবির জন্য পরিবেশক খোঁজায় সাহায্য করতেন। বোম্বের তারা সিং অ্যান্ড সন্স প্রবাসী ভারতীয়দের জন্য ছাড়পত্র যোগাড় করার কাজ করতেন ও ভারতীয় এয়ারপোর্টে বিদেশী ছবির চালান পৌঁছনোর পর তাঁরা প্রয়োজনীয় অনুমতিপত্র ইত্যাদির ব্যবস্থার কাজে সাহায্য করতেন। যে দেশ থেকে ওই চলচ্চিত্রগুলির আমদানি হচ্ছে, তার উপর ভিত্তি করে সেগুলির প্রভেদ করার বদলে, সেগুলিকে আমদানিকৃত সুইডিশ, ড্যানিশ আর ইংরাজি ছবির দোআঁশলা সংগ্রহ বলে প্রচার করা হত।
তবে এই আমদানি প্রকল্পের একটি অনিচ্ছাকৃত ফলশ্রুতি ছিল, অগণিত বিদেশী সেক্স ও এক্সপ্লয়টেশন ফিল্মের ভারতে প্রবেশ। ভিএইচএস-এর পথ ধরে “ব্লু ফিল্ম”-এর তুমুল জনপ্রিয়তা তো আগে থেকে ছিলই, কিন্তু সরকারের সক্রিয় সহযোগিতায় যে প্রকল্প চালু হয়েছিল, তারই সুযোগ নিয়ে ব্লু ফিল্মের আমদানির ঘটনা অনেককেই ক্রুদ্ধ করেছিল। এই বিষয়ে অভিযোগ আসতে শুরু হলে, ভারত সরকার একটি চলচ্চিত্র আমদানি পরিষদ স্থাপন করেন, যা শংসাপত্র পাওয়ার জন্য সিবিএফসি-তে পাঠানর আগে আমদানিকৃত ছবিগুলিকে অনুমোদন দিতেন। এই সময়ই প্রথমবার সিবিএফসি-র আধিকারিকরা লিখিত স্ক্রিপ্ট ও তার থেকে দর্শনের জন্য যা তৈরি হচ্ছে, তার মধ্যে যে আসলে সুবিশাল পার্থক্য আছে, তা লক্ষ্য করেন। মূলত, চলচ্চিত্র আমদানি পরিষদ যে ছবিগুলির উপর নজর রাখছেন, সেগুলিকে শংসাপত্র দিতে অস্বীকার করার মধ্যে দিয়ে সিবিএফসি এই ছবিগুলিকে নির্বাচন করার পিছনে যে যুক্তি, তাকেই প্রশ্ন করছিল।
সফট পর্ন ও যৌন শিক্ষা
১৯৮৫ থেকে ১৯৮৭ সালের মধ্যে, অনুমোদনের জন্য ৫৫৮টি চলচ্চিত্র জমা দেওয়া হয়। এর মধ্যে ২৯৬টি ছবিকে এই প্রকল্পের অধীনে আমদানি করা হয়। অনেক বাতিল হওয়া ছবির প্রিন্ট সরকারী গুদামে পড়েছিল, যা পরে কাবাড়িওয়ালার কাছে বিক্রি হয়ে যায় ও ১৯৯০-এর দশকের শুরুতে সেগুলিকেই আবার বিভিন্ন চলচ্চিত্র প্রদর্শনীতে বিদেশী ছবির সংগ্রহ হিসেবে হাজির করা হয়। শুধু যে চলচ্চিত্রের প্রিন্ট হিসেবেই সেগুলি সাধারণ দর্শকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এমন নয়, এগুলিকে পরে ভিএইচএস টেপেও পরিণত করা হয়েছিল বলে দেখা যায়। এই টেপগুলিকে ভিডিও পার্লার থেকে ভাড়া নেওয়া যেত ও কম সংখ্যক দর্শককে ভিএইচএস থেকে পর্ন দেখান হত যে পার্লারগুলিতে, এগুলি সেখানেও ছড়িয়ে পড়ে। তাই, যে বিদেশী ছবির সাহায্যে আমরা আমাদের দেশের অর্থনীতির উন্নয়ন করার পদক্ষেপ নিয়েছিলাম, তা আশ্চর্যজনকভাবে, ইতিমধ্যেই বিতর্কিত চলচ্চিত্র/মিডিয়া ক্ষেত্র, যেখানে পাইরেসি ও পর্ন নিয়ে উদ্বেগ একই গতিতে এগোয়, তার আশঙ্কাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল।
কিন্তু এই ঘটনাগুলির কিছু অপ্রত্যাশিত সৃজনশীল প্রভাবও আছে। এই ধারাটি এবং তার ইতিহাসই আমার রেটেড এঃ সফট-পর্ন সিনেমা অ্যান্ড মিডিয়েশনস অফ ডিজায়ার ইন ইন্ডিয়া (ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া প্রেস, জুবান বুকস, ২০২৪) নামের বইটির বিষয়। প্রবাসী ভারতীয় প্রকল্প এবং কাবাড়িওয়ালাদের হাত ধরে যে সেক্স ও এক্সপ্লয়টেশন ছবিগুলি ভারতে প্রবেশ করে, সেগুলিকেই ভারতীয় চলচ্চিত্রকাররা তাঁদের ছবিতে যৌন শিক্ষার অন্তর্ভুক্তির টেম্পলেট হিসেবে ব্যবহার করেন। এইভাবে চেন্সর বোর্ডের সতর্ক পরীক্ষা এড়ানর জন্য তাঁরা তাঁদের ছবিকে বিশেষজ্ঞ দর্শকের জন্য বিশেষভাবে নির্মিত বলে দাবি করে “এস” চিহ্নিত করতে সফল হন। প্রবাসী ভারতীয়দের দ্বারা সরবরাহ করা চলচ্চিত্রের সংগ্রহ মালায়ালাম সফট-পর্ন ছবির পূর্বসূরী। প্রবাসী ভারতীয় প্রকল্পের যুগে যে বিদেশী চলচ্চিত্রগুলি সহজলভ্য হয়ে উঠেছিল, নান্দনিকতা, বিষয়বস্তু এবং শিল্পের আদর্শের উদাহরণ পাওয়ার জন্য মালায়লম ছবি সেগুলির উপরেই গভীরভাবে নির্ভরশীল ছিল। প্রবাসী চলচ্চিত্রের দৌলতেই, কম খরচে ছবি তৈরির প্রান্তিক অর্থনীতি ক্রমশ বহুজাতিক হয়ে ওঠে এবং নিজেদের সৃষ্টিকে বাজারজাত করার জন্য, আমদানিকৃত “বিদেশী” ছবির পরিচয় বজায় রেখে, তার সঙ্গে দেশী দর্শকের কাছে ইতিমধ্যেই সুপরিচিত পাল্প ফিকশন ও ইরোটিকার স্থানীয় সংস্করণকে জুড়ে দেয়। তাই আমরা নিশ্চিন্তভাবে বলতে পারি যে, আমরা আজ যাকে মালায়ালম সফট-পর্ন হিসেবে জানি, হয়ত প্রবাসী ভারতীয় চলচ্চিত্রের সংগ্রহ ছাড়া তার অস্তিত্বই থাকত না।