জলবায়ুর পরিবর্তন বিভিন্ন দেশ, অঞ্চল এবং সম্প্রদায়কে প্রবলভাবে প্রভাবিত করে। যে সমস্ত অঞ্চল এবং জনগোষ্ঠী ইতিমধ্যেই আর্থসামাজিকভাবে দুর্বল, সেগুলিকেই বিশ্ব উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে সবচেয়ে বেশি সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। ভারতের ক্ষেত্রে, সাম্প্রতিক নানা গবেষণা থেকে জানা যায় যে এই দেশের পঁচাত্তর শতাংশ জেলাই জলবায়ুর চরম পরিবর্তনের শিকার হতে পারে। আন্তর্জাতিকস্তরে জলবায়ু সমস্যা মীমাংসা নিয়ে আলাপ আলোচনার ক্ষেত্রে ভারত যে ভূমিকা নেয় তার থেকে বোঝা যায় যে, জলবায়ু পরিবর্তনের পরিণতি সম্বন্ধে এই দেশ যথেষ্ট সচেতন। ২০১৫ সালে প্যারিসে রাষ্ট্রপুঞ্জ আয়োজিত ক্লাইমেট চেঞ্জ কনফারেন্স বা ইউএন ক্লাইমেট চেঞ্জ কনফারেন্স ইন প্যারিস (সিওপি21) চলাকালীন ভারত সরকার এই অঙ্গীকার করে যে ২০৩০ সালের মধ্যে ভারত সমস্ত উৎপাদিত বিদ্যুতের মধ্যে অন্তত চল্লিশ শতাংশের জন্য অ-জীবাশ্ম বা নন-ফসিল উৎস ব্যবহার করবে। তবে, নবায়নযোগ্য তাপশক্তি ব্যবহার এবং যে জীবাশ্ম উৎস থেকে তাপশক্তি উৎপাদিত হয় সেগুলির পরিবর্তে অ-জীবাশ্ম উৎস ব্যবহারের কথা মুখে বললেও ভারতে কয়লার ব্যবহার ক্রমশ বেড়েই চলেছে এবং এই দেশ জীবাশ্ম থেকে উৎপাদিত তাপশক্তির ব্যবহার থেকে সরে না গিয়ে এই জাতীয় জ্বালানীশক্তির জোগানদারদের সঙ্গে গাঁটছড়া আরো জোরালো করে তুলছে।
২০২৩-২৪ সালের মধ্যে ভারত বছরে এক বিলিয়ন টন করে কয়লা খনি থেকে ওঠাতে চলেছে। এর মধ্যেই দেশের নানা বেসরকারি সংস্থাকে একচল্লিশটি কয়লা খনি অঞ্চলে খননকার্যের অনুমোদন দেওয়ার জন্য নিলাম ডাকা হয়েছে। আর এই খনিগুলির অবস্থান এমন সব জীববৈচিত্রপুর্ণ এবং প্রাচীন অরণ্যসহ অঞ্চলে যেখানে আদিবাসীরা বসবাস করেন। এর সঙ্গে সঙ্গে আরও পঞ্চান্নটি নতুন খনি থেকে কয়লা তোলার অনুমোদন দিতে নিলাম ডাকার এবং আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে এর সঙ্গে আরও একশো তিরানব্বইটি কয়লাখনি যোগ করার পরিকল্পনা আছে। ২০১৭ সালে, ভারত ছিল পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম কয়লা উৎপাদক ও আমদানিকারী দেশ।
এর যুক্তি হিসাবে বলা হয় যে, শিল্পের প্রসার, অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় পরিষেবা ও কর্মসংস্থান, বিদ্যুৎ ব্যবহারের সুযোগ, এবং “জ্বালানীশক্তি ব্যবহারের সুযোগ নেই যাদের” তাদের হাতে রান্নার পরিচ্ছন্ন জ্বালানী তুলে দেওয়া ইত্যাদি নানা উন্নয়নের জন্য কয়লার প্রয়োজন। কিন্তু ভারতে বিদ্যুতের বৃহত্তম গ্রাহক আসলে কলকারখানা ও নানা শিল্পোদ্যোগ এবং এই জাতীয় গ্রাহকদের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে চলেছে। এই কলকারাখানাগুলি উৎপাদিত বিদ্যুতের চল্লিশ শতাংশ ব্যবহার করে যেখানে বসতবাড়িগুলিতে এই ব্যবহার পঁচিশ শতাংশেরও কম (গৃহস্থবাড়িতে বিদ্যুতের ব্যবহারের মধ্যেও আছে সুবিশাল বৈষম্য)।
এই যুক্তিতেই এই বছরের শুরুতে একচল্লিশটি কয়লা খনি অঞ্চলকে বাণিজ্যিক নিলামে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই বিষয়টি যখন শুরু হয় তখন হিসাব দেওয়া হয়েছিল যে এর ফলে ২.৮ লাখ চাকরি এবং ২০,০০০ কোটি টাকা আয় তৈরি হবে। তবে, লেখক ও জ্বালানীশক্তি বিষয়ক গবেষক সন্দীপ পাই কোন বিবরণী বা হিসাবের উপর ভিত্তি করে এই বক্তব্য রেখেছেন তা যখন তথ্যের অধিকার বা রাইট টু ইনফরমেশন (আরটিআই)-এর মাধ্যমে সন্ধান করা হয় তখন পাই-এর এই দাবির সমর্থনে কোন তথ্যই পাওয়া যায় নি। এর পর আরো খোঁজাখুঁজি করে তিনি এই বিষয়ে আরও যে সমস্ত তথ্য পান সেগুলি আসে টুইটার থেকে, কোনো সরকারী বার্তার থেকে নয় । এর থেকে বোঝা যায় যে, কি ভাবে, কোনো রকম বাস্তব পরীক্ষানিরীক্ষা ছাড়াই এই কর্মসংস্থান ও আয় তৈরি হবে বলে দাবি করা হয়েছে আর তার ফলে খুব সহজেই সেই দাবিকে প্রশ্ন করা যায়।
কয়লা ব্যবহারের জন্য সমাজ ও এবং পরিবেশকে যে মূল্য দিতে হয়
একই সঙ্গে, কয়লার সম্পূর্ণ সরবরাহ ব্যবস্থাটির ফলশ্রুতি হিসাবে সমাজ ও পরিবেশকে যে উচ্চমূল্য দিতে হয় সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কয়লা তোলা থেকে শুরু করে পরিবহন ও দহন পর্যন্ত কয়লা একটি বিতর্কিত কাঁচামাল এবং এমন একটি পণ্য যা ভারতের দারিদ্র (অর্থনৈতিক ও জ্বালানীশক্তি উভয়ত) ও বেকারত্ব, প্রাকৃতিক পরিবেশের অবক্ষয়, এবং জলবায়ুর সংকট সংক্রান্ত যে সব পরষ্পরসংযুক্ত সামাজিক ও পরিবেশগত সমস্যা আছে সেগুলিকে একেবারেই সম্বোধন করে না।
সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কয়লার উৎপাদন হয় এবং পরিবেশ সংক্রান্ত নানা অবিচার এবং জমির অধিকার হারানো, সাধারণ মানুষের জীবন ও জীবিকার উপায় আত্মসাৎ করে নেওয়া, জল ও বায়ুদূষণ ইত্যাদি বিষয় এই উৎপাদনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কয়লাচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের আশেপাশে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর মধ্যে অকালমৃত্যুর হার বছরে আশি হাজার থেকে এক লাখ পনেরো হাজার। কয়লাখনির শ্রমিক ও খনির কাছাকাছি যারা বাস করেন তাঁরা নানা জটিল অসুখে ভোগেন। প্রশ্বাসের সঙ্গে কয়লার গুঁড়ো শরীরে ঢোকার কারণে নিউমোকোনিওসিস (সাধারণভাবে, যাকে ব্ল্যাক লাং ডিজিজ বলা হয়)-এর পাশাপাশি দূষিত জল পানের ফলে যে রোগগুলি হয় সেগুলি এই জাতীয় অসুস্থতার মধ্যে অন্যতম।
এই কারণেই কয়লা একটি তুমুল বিতর্কিত সম্পদ, যা দেশজোড়া অসংখ্য বিক্ষোভ ও সংঘাতের কারণ। এই সংঘাতগুলি ভারতের বৃহত্তর পরিবেশ আন্দোলনেরই অংশ । এই গ্রহ এবং সেখানে বসবাসকারী মানুষদের কল্যাণের জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলি সম্বন্ধে কোনো রকম মাথা না ঘামিয়েই দেশের উন্নয়নের যে রূপরেখা তৈরি করা হয়েছে তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এই আন্দোলন স্বাধিকার এবং সমাজ ও পরিবেশের কল্যাণের দাবি জানায়।
এই বিক্ষোভের মধ্যে অনেকগুলিই বহু দশক ধরে চলে আসছে। পূর্ব ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যের হাজারীবাগ জেলায় ২০০৪ সালে যে বিক্ষোভ শুরু হয় তা এখনো চলছে। এই বিক্ষোভের কারণ শুধু জীববৈচিত্রপূর্ণ স্থানীয় অরণ্য ও চাষের জমির উপর একটি সক্রিয় কয়লাখনির প্রতিকূল প্রভাবই নয়, এই অঞ্চলে প্রাগৈতিহাসিক যুগের যে পাথরের স্তম্ভগুলি আবিষ্কৃত হয়েছে সেগুলিকে রক্ষা করাও এই বিক্ষোভের লক্ষ্য। কয়লাখনির কাজে লাগানোর জন্য জমি বেদখল করে নেওয়ার বিরুদ্ধে এখনকার অধিবাসীরা, যাঁদের মধ্যে অনেকেই আদিবাসী, এই বিক্ষোভের আয়োজন করেছেন। ২০০৪ সাল থেকে ভারতের বৃহত্তম কয়লা ব্যবসায়ী কোম্পানির (এনটিপিসি লিমিটেড) কয়লা তোলার উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিকল্পনার প্রতিবাদে করনপুরা বাঁচাও আন্দোলন সমিতি বা কমিটি ফর দা স্ট্রাগল টু সেভ করনপুরা মিছিল ও প্রদর্শনীর মধ্যে দিয়ে চাষের জমিকে রক্ষা করে চলেছে। তা সত্ত্বেও, ২০১৬ সালের ১৭ মে তারিখে, প্রবল প্রতিরোধের মধ্যেই, কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনীর আড়ালে খনি থেকে কয়লা তোলার কাজ শুরু হয়। এছাড়াও, আরো সাম্প্রতিককালের বিক্ষোভগুলির মধ্যে একটি হল গোয়াকে কয়লাব্যবসার কেন্দ্র করে তোলার প্রতিবাদে শুরু হওয়া আন্দোলনটি যা সংবাদমাধ্যমের থেকে প্রচুর মনোযোগ পায়। এই বছরের শুরুতেই, আসামের দেহিং পটকাই-এর অভয়ারণ্যের কয়লাখনির কাজ বন্ধ করার জন্য কোভিড-19 অতিমারীর মধ্যেও অনলাইনে ব্যাপক প্রতিবাদের আয়োজন লক্ষ্য করা গেছে।
কয়লা - বাতিল করার নানা ধাপ
পরিবেশ রক্ষার জন্য ভারতের যে নিজস্ব লক্ষ্য তাতে স্থির থাকা এবং জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবগুলির তীব্রতা হ্রাস করার জন্য কয়লার ব্যবহার বন্ধ করতে হবে এবং তার জন্য ধাপে ধাপে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া আশু প্রয়োজন। এই ব্যবহার ধীরে ধীরে বন্ধ করার জন্য ভারত সরকারের বর্তমান পরিকল্পনায় অনুপস্থিত দুটি সুনির্দিষ্ট বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে ।
প্রথমত, সরকারকে “খনির কয়লাকে খনিতেই” থাকতে দিতে হবে, “অর্থনৈতিকভাবে কার্যকর” হওয়া সত্ত্বেও কয়লার নিষ্কাশন বন্ধ করা দরকার এবং ভারতের উন্নয়নের সঙ্গে কয়লার যে গভীর সম্পর্ক তাকে শেষ করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, জনগণ, সরকার এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে একটা প্রচন্ড যুগ্ম উদ্যোগের মাধ্যমে শুধুমাত্র জীবাশ্মজাত জ্বালানী ও পারমাণবিক শক্তি থেকে পাওয়া তাপশক্তির ব্যবহার থেকে নবায়নযোগ্য জ্বালানীশক্তির ব্যবহারে রূপান্তরই নয়, তার সঙ্গে সঙ্গে মূলধনকেন্দ্রীক, কেন্দ্র সরকার নিয়ন্ত্রিত এই নীতি থেকে স্থানীয়ভাবে পরিচালিত, বিকেন্দ্রীভূত তাপশক্তি উৎপাদনের ব্যবস্থাতে রূপান্তর করাও প্রয়োজন।
জলবায়ুর এই উপস্থিত এবং প্রত্যাশিত সংকটের ক্ষেত্রে যে কয়লার সুবিশাল অবদান আছে, সেই কয়লা নিয়েই ভারতের উন্মাদনার ব্যাপ্তি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। মানুষের জীবন ও জীবিকার উপর এর প্রভাব অমঙ্গলজনক ও বিধ্বংসী আর সেই কারণেই আমরা এই প্রসারের বিরুদ্ধে স্থানীয় মানুষদের মধ্যে এমন তীব্র প্রতিরোধ গড়ে উঠতে দেখি। কিন্তু সমস্ত ক্ষেত্রেই স্থানীয় জনগণের দাবীর উপরে হিংস্রভাবে চাপিয়ে দেওয়া হয় ক্ষমতাশালীদের চাহিদার আধিপত্য।
তাপমাত্রা বেড়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে, তাপপ্রবাহ এবং বায়ুদূষণ ভারতের অধিবাসীদের জর্জরিত করে চলেছে। জীবাশ্মজাত তাপশক্তি দীর্ঘকালের জন্য ব্যবহারযোগ্য বা ন্যায়সঙ্গত কোনোটাই নয়। এই প্রণালী থেকে আরো টেঁকসই জ্বালানীর ব্যবহারের দিকে সরে যাওয়ার সামর্থ্য এই দেশের আছে।