ইউরোপ আর মধ্যপ্রাচ্যে যে নির্মম সামরিক সঙ্ঘাত চলছে, তার কারণে সাইবার-নিরাপত্তা সম্পর্কিত আচরণের আদর্শের বিষয়ে ইউনাইটেড নেশনস ওপেন-এন্ডেড ওয়ার্কিং গ্রুপের বহুপাক্ষিক বৈঠকের উপর বিশ্বের মনোযোগ খুবই কম ছিল। তাদের তুলনামূলক গুরুত্বহীনতা সত্ত্বেও, এই সম্মেলনে একটি নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য সাইবার পরিসরের জন্য নিয়ম ও আচরণের ধারা নির্মাণের বিষয়ে যে আলোচনা হয়েছে, তার গুরুত্ব আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে অপরিসীম। যুদ্ধ এবং শান্তি, দুই সময়ের জন্যই অপরিহার্য ডিজিটাল পরিকাঠামোর উপর আপত্তিকর সাইবার আক্রমণের ঘটনা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। তা সত্ত্বেও, সাইবার পরিষরে প্রবেশের নিয়ম প্রতিষ্ঠার জন্য ইউএন যে পদ্ধতিগুলির নকশা তৈরি করেছিল, দশকের পর দশক ধরে সেগুলি অব্যবহৃত অবস্থাতেই আছে। এর একটা বড় কারণ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং তাদের মিত্রদেশ, যাদের অনেক সময়ই “উদারপন্থী” শিবির বলে আখ্যা দেওয়া হয়, তারা “স্বৈরাচারী” শিবির ও চিন আর রাশিয়ার সঙ্গে আদর্শগত মেরুকরণের কারণে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে।
এই অচলাবস্থার আবহাওয়ায়, একটি গুরুত্বপূর্ণ “ডিজিটাল নির্ণায়ক” হিসেবে, ভারত অনেক সময়ই মতাদর্শগত বিতর্ককে হয় সীমিত রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও মৌলিক অধিকার সুরক্ষার বলিষ্ঠ উপায় সহ একটি “মুক্ত” ইন্টারনেট অথবা চিন ও রাশিয়ার মত একটি রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত ও কেন্দ্রীভূত ইন্টারনেটের পক্ষে নিশ্চিতভাবে নিয়ে যেতে পারে।
ভারত কিভাবে সাইবার-নিরাপত্তার ব্যবস্থাপনা করে
তবে, এখনও পর্যন্ত ভারত দুই-এর কারোরই পক্ষে বা বিপক্ষে সে রকম কোনও প্রস্তাবনা পেষ করা থেকে বিরত থেকেছে। সক্রিয় গোষ্ঠী অংশ হিসেবে ভারতের কৌশল হল, খুঁটিনাটির দিকে না গিয়ে বিতর্কিত বিষয়গুলির সমস্ত দৃষ্টিকোণকেই বেছে বেছে স্বীকৃতি দেওয়া। এই প্রশ্নগুলির বিষয়ে কোনও অবস্থান না নিলেও, ভারত সক্রিয়ভাবে একেবারেই বিতর্কিত নয় এমন সব বিষয় বেছে নিয়েছে, যা কৌশলগত স্বার্থের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।
যেমন, ব্যবস্থাপনার বিন্যাস ও মূল মতাদর্শগত নীতির বিষয়ে রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে পরস্পরবিরোধী সঙ্কল্প নিয়েছে, ভারত তার দুই পক্ষকেই সমর্থন করেছে। আন্তর্জাতিক আইন সাইবার পরিসরেও প্রযোজ্য কিনা সে বিষয়ে “উদারপন্থী” ও “স্বৈরাচারী” দুই শিবিরের যে বিবাদমান মতামত আছে, তা ইউএন প্রক্রিয়ায় ভারত তার আনুষ্ঠানিক উপস্থাপনায় স্বীকার করে নিয়েছে। এই প্রশ্নটি সুদীর্ঘ কাল ধরে বিতর্কিত, কারণ রাশিয়া ও চিন সাইবার পরিসরের জন্য নতুন আইন তৈরি করতে চায় কারণ তারা বিশ্বাস করে যে, প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক আইনগুলি অত্যন্ত প্রাচীন ও পাশ্চাত্যকেন্দ্রিক। বিদ্যমান আন্তর্জাতিক আইনগুলি সাইবার পরিসরেও যে প্রযোজ্য, তা ভারত স্বীকার করে নিলেও, ঠিক কিভাবে এই আইনগুলি কাজ করবে সে বিষয়ে কোনও বিস্তারিত বিবৃতি দেওয়া থেকে ভারত বিরত থেকেছে, যদিও অন্যান্য অনেক দেশই এই পদক্ষেপটি নিয়েছে। এছাড়াও, “তথ্যের সার্বভৌমত্ব”, অর্থাৎ একটি রাষ্ট্রের নিজস্ব এলাকায় উদ্ভূত তথ্য নিয়ে সার্বভৌমত্বের দাবির লিখনকে সমর্থন করে বৃহত্তর ধারণাটি তা নিয়ে মুক্তকন্ঠ হলেও, দেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতির আলাপে, ইউএনের সার্বভৌমত্ব বিষয়ক বিতর্কে কোনও দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া থেকে ভারত বিরত থেকেছে। সার্বভৌমত্বের যে দিকগুলি নিয়ে অন্যান্য দেশ সহমত হয়েছে, একমাত্র সেই দিকগুলির বিষয়েই ভারত তার মতামত দেওয়াকে সীমিত রেখেছে।
অন্যদিকে, নিরাপত্তা-বিষয়ক সরবরাহ শৃঙ্খল ও গুরত্বপূর্ণ পরিকাঠামো নিরাপদ করার বিষয়ে ভারত অনেক বেশি সোচ্চার ও অবিচলিত, এবং সাইবার-নিরাপত্তা বজায় রাখার সামর্থ্য তৈরি করার জন্য যা প্রয়োজন তার সূক্ষাতিসূক্ষ্ম দিকগুলির গভীরে প্রবেশ করেছে। বিশেষত, ভারত একটি গ্লোবাল সিকিওরিটি কোঅপারেশন পোর্টালের উন্নয়নের অবিচল সমর্থক। তথ্যের আদানপ্রদান, প্রাসঙ্গিক নথির সংরক্ষণ এবং প্রাসঙ্গিক আলোচনাসভা ও কর্মশালার তারিখ ক্রমানুসারে সাজিয়ে রাখা ইত্যাদির জন্য একটি সহজলভ্য ভাণ্ডার ও মঞ্চ হিসেবে এই পোর্টালটি কাজ করবে। ভারত খুবই স্পষ্টভাবে জানিয়েছে যে, এই পোর্টালটি বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলিকে সাহায্য করবে, যা গ্লোবাল সাউথের উদ্বেগ ও চিন্তাকে প্রকাশ করার যে উদ্দেশ্য নতুন দিল্লির আছে, তার সঙ্গে মিলে যায়।
সাইবার-নিরাপত্তা বিষয়ক ব্যবস্থাপনাকে যেভাবে দেখা হচ্ছে তাকে, কিভাবে আরও ম্মজবুত করা হচ্ছে? অন্যান্য বহুপাক্ষিক সম্মেলনের প্রতি ভারতের মনোভাবকে “অসহিষ্ণু” “অবিশ্বস্ত”, বা “অসহযোগমূলক” বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। তবে, নাচিয়াপ্পানের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতামূলক গবেষণা যেমন ইঙ্গিত দেয়, এই ধরনের সাধারণীকরণের অভ্যাস “ঠিক ততটাই গোপন করে, যতটা এগুলি প্রকাশ করে।” নাচিয়াপ্পান বলেন যে, প্রতিটি সম্মেলন বা শাসনপ্রক্রিয়া সংক্রান্ত সমস্যার প্রতি ভারতের আচরণকে তিনটি গুণকের নির্দিষ্ট পরিপ্রেক্ষিত-নির্ভর অভিজ্ঞতামূলক মূল্যায়নের মাধ্যমে নিরীক্ষা করে দেখা উচিত। এই গুণক তিনটি হল – কৌশলগত স্বার্থ, সরকারের মধ্যে আমলাতান্ত্রিক সামর্থ্য ও সমন্বয়, এবং অনেক অংশীদারের যোগদান ও প্রতিটি অংশীদার গোষ্ঠীর ঘোষিত প্রভাব।
এই তিনটি নির্ণায়কের প্রতিটিকে ব্যবহার করে বহুপাক্ষিক সাইবার-নিরাপত্তার প্রতি ভারতের মনোভাব ঠিক কী, তার মূল্যায়ন করা যাক। ভারতের জন্য সাইবার-নিরাপত্তা অবশ্যই একটি কেন্দ্রীয় কৌশলগত স্বার্থ। সাম্প্রতিক বিবৃতি থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় সাইবার-আক্রমণের ঘটনা সারা পৃথিবীতে ভারতেই সবচেয়ে বেশি ঘটেছে। শুধুমাত্র গত তিন বছরেই, ভারত সাইবার পরিসরকে ব্যবহার করে এমন সব ঘটনা ঘটেছে, যা বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং পারমাণবিক শক্তিকেন্দ্রগুলির উপর আঘাত এনেছে। ইউএন থেকে যে অমূলক নিয়মগুলি উঠে আসছে সেগুলি ভারতের সাইবার-প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কোনও বাস্তবিক উন্নতিসাধন করবে বা ভূ-রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের দিক থেকে আসা সাইবার-আক্রমণের উপর কোনও অর্থপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আনতে পারবে, এমন সম্ভাবনা কম। এর ফলে, ইউএনে কোনও মান-নির্নায়ক পরিণতিকেই ভারত অগ্রাধিকার দেয় না। তার বদলে অনেক অংশীদারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির পাশাপাশি কোয়াড্রিল্যাটারাল সিকিওরিটি ডায়লগ বা কাউন্টার র্যানসামওয়্যার ইনিশিয়েটিভের মত “মিনিল্যাটারাল” জোটের মাধ্যমে সাইবার-প্রতিরক্ষার উপরেই ভারত বেশি মনোযোগ দিচ্ছে। ইউএনে কোনও আদর্শগত তকরারে জড়িয়ে পড়ার বদলে ভারত সাইবার-নিরাপত্তার বিষয়ে চর্চার মত বাস্তব ও প্রত্যক্ষ ফলাফল বা কম্প্যুটার ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিমের (সিইআরটি) মত প্রধান সাইবার সংস্থাগুলির মধ্যে সহযোগিতা আবহাওয়া তৈরি করার জন্য কর্মপ্রক্রিয়া নিশ্চিত করার উপর বেশি মনোযোগ দেওয়ার পথটি বেছে নিয়েছে।
দ্বিতীয় নির্ণায়কটির ক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায় যে সাইবার-নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করছে এমন অসংখ্য সংস্থা ভারতে আছে। বহুপাক্ষিক পরিবেশে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রক বা মিনিস্ট্রি অফ এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্স (এমইএ)-ই যদিও মুখপাত্র হিসেবে উপস্থিত থাকলেও, কিন্তু ভারতের অবস্থান বোঝানর সময় ইলেট্রনিক্স ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় বা মিনিস্ট্রি অফ ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড ইনফর্মেশন টেকনোলজি (এমইআইটিওয়াই) এবং প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের মতামতও নিয়মিত বিবেচনা করা হয়। তবে, সাইবার পরসর সম্পর্কিত আদর্শের বিষয়ে আলাপআলোচনাকে কম কৌশলগত অগ্রাধিকার বলে একটি অনন্য যৌথ আখ্যান বা আন্তর্জাতিকভাবে নির্মিত বিবৃতিগুলির সঙ্গে দেশীয় নীতি আন্দোলনের যোগাযোগের সূত্র গড়ে তোলার প্রচেষ্টাভ খুবই কম। এর বিপরীতে আবার আছে, সীমান্ত দুই প্রান্তে যে তথ্যের স্রোত প্রবাহিত হয়, তার প্রতি ভারতের মনোভাব। ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন (ডাবলিউটিও) ও জি২০-এর মত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে দেশের ভিতরের বিভিন্ন সেক্টর জুড়ে চালু হওয়া আইনি অনুজ্ঞাগুলির ন্যায্যতা প্রমাণ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, এমইআইটিওয়াই এবং প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের আধিকারিকরা সেগুলির সমর্থনে সওয়াল করেছেন
সব শেষে, যখন সাইবার-নিরাপত্তার বিষয়ে আলোচনা নিয়ে ভারতের অবস্থানকে প্রভাবিত করার প্রশ্ন এসেছে, তখন নাগরিক সমাজ, একাডেমিয়া, মিডিয়া এবং বেসরকারী সেক্টরসহ এই প্রাণবন্ত বহু-অংশীদারী প্রযুক্তিগত নীতিকেন্দ্রিক ইকোসিস্টেম তুলনামূলকভাবে কৌতুহলশূন্যই থেকে গেছে। এই অংশীদাররা জনসাধারণের সঙ্গে যোগাযোগ অত্যন্ত সীমিত রেখেছে। প্রচারকারীর দল তাঁদের সময় ও সম্পদ দুইই বরং বেশি কাজে লাগিয়েছেন দেশের আভ্যন্তরীণ অবস্থার জন্য এমন সমস্ত জরুরী আইন প্রনয়ণের কাজে, যাদের আশু প্রভাব নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের উপর পড়ে, এবং তাঁরা হয়ত সঠিক পদক্ষেপই নিয়েছেন। একই ভাবে, ভারতের এবং বিদেশের প্রযুক্তিকেন্দ্রিক সংগঠনগুলি দূর-যোগাযোগ বা টেলিকম নিয়ন্ত্রণ, তথ্যের সুরক্ষা এবং সাইবার-নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় দেশজ পরিকাঠামোর মত এমন সব নীতিভিত্তিক প্রশ্নের উপর মনোযোগ দিয়েছে, যাদের আশু প্রভাব তাদের ব্যবসার উপর পড়তে পারে। সরকারের পক্ষ থেকে কোনও আনুষ্ঠানিক মনোযোগের অভাব বা শিল্প ও নাগরিক সমাজের থেকে উঠে আসা প্রভাবশালী কন্ঠের অনুপস্থিতির কারণে, ইউএনে ঘটা আলোচনা নিয়ে তেমন কোনও সমবেত প্রচার মিডিয়াতেও হতে দেখা যায় নি। যেহেতু বিভিন্ন দেশীয় নির্বাচনক্ষেত্রের ভিন্নমুখী আগ্রহ ও প্রয়োজনকে সম্বোধন করার কোনও উৎসাহ নেই, তাই বহু-অংশীদারিত্বের ইকোসিস্টেম সরকারের নিষ্ক্রিয় অবস্থানকে আরও সমর্থ করে তোলে।
তুলনা করলে দেখা যাবে যে, একটা পর্যায়ে বিশ্বের ডিজিটাল বিতর্কের প্রতি ভারতের মনোভাব অনেকটাই আলাদা ছিল। যেহেতু ডাবলইউটিও-এর থেকে উঠে আসা ফলাফলগুলি ফলপ্রসূ এবং বাস্তবে সেগুলির আইনি ও নীতিগত তাৎপর্য ছিল, তাই ডাবলইউটিও-তে ভারতের অবস্থান সক্রিয়ভাবে সোচ্চার ছিল। এর ফলশ্রুতি হিসেবে, বাণিজ্যিক আলোচনার সময় ভারতের অবস্থানকে সমস্ত অংশীদারই সক্রিয়ভাবে এমন একটি রূপদানের চেষ্টা করেছে, যা তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থ বা নীতিকেন্দ্রিক পক্ষপাতকে সাহায্য করে।
সাইবার-নিরাপত্তায় বহুপাক্ষিকতার ভবিষ্যৎ
সাইবার-নিরাপত্তার বিষয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে ভারতের তুলনামূলক নিষ্ক্রিয়তার কারণে, নীতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ থাকে। যেমন, ২০২০ সালে গালোয়ান উপত্যকায় ভারত-চিন সংঘর্ষের পরে, ভারতের ফাইভজি পরীক্ষার সময় চিনের বিক্রেতাদের অংশগ্রহণ সীমিত করে তোলার বিষয়টি একটি চূড়ান্ত মোড় নেয়। তার আগে পর্যন্ত চিন তাদের ইওরোপীয় পরিপূরকদের চেয়ে অনেক কম দামে ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ করত বলে,, চিনের বিক্রেতাদের নাগাল ভারতের দূরসংযোগের পরিসরের অনেক গভীরে পৌঁছে যেতে পেরেছিল। ফাইভজি সংক্রান্ত এই সিদ্ধান্তের কারণ চিন বা পশ্চিমের দেশগুলির প্রতি আদর্শগত প্রতিশ্রুতি নয়, বরং অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাকেন্দ্রিক স্বার্থের প্রায়োগিক ও বাস্তবসম্মত মূল্যায়ন।
অবশ্যই আদর্শগত নিষ্ক্রিয়তার অর্থ, ইন্টারনেটে বাকি বিশ্বের মান-নির্নায়ক কার্যাবলীকে রূপদান করার সুযোগ ভারতকে ত্যাগ করতে হয়। বিশ্বের নেতৃত্বদানের যে আকাঙ্খা ভারতের তার অঙ্গ হিসেবে এই সুযোগটি, তর্কাতীতভাবে, ভারতের কার্যসূচীতে থাকা উচিত। ভারত তার নেতৃত্বের ভূমিকাকে অন্যভাবে দেখে। এখনও পর্যন্ত “ডিজিটাল পাবলিক ইনফ্রাস্ট্রাকচার”, যা সদ্য শেষ হওয়া জি২০ প্রেসিডেন্সির মধ্যমণি ছিল, সেই রকম সরকারের দৃষ্টিকোণ থেকে সফল নানা দেশজ চর্চাকে বাইরে রপ্তানির মাধ্যমে ভারত তার নেতৃত্বের অবস্থান প্রদর্শন করেছে। আগে উল্লিখিত গ্লোবাল সাইবার-নিরাপত্তা পোর্টালের সপক্ষে প্রচার এই মনোভাবটি, অর্থাৎ আদর্শ-সংক্রান্ত বিমূর্ত ও বিতর্কিত প্রশ্নের পরিবর্তে বিভিন্ন সক্রিয় ও কর্মক্ষম নকশার প্রস্তাব রাখার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
যে দেশগুলি সাইবার-নিরাপত্তা বা কৌশলকেন্দ্রিক প্রযুক্তির বিষয়ে ভারতের সঙ্গে অংশীদারীত্বের সম্পর্কে যেতে চায়, তাদের কাছে এই বিষয়টির সুবিশাল তাৎপর্য আছে। নির্বিচারে তকমা লাগিয়ে সাইবার-শাসনের প্রতি ভারতের মনোভাবকে মূল্যায়ণ বা আন্দাজ করার চেষ্টা, অথবা সাইবার-পরিসরে ভারতের মতামতগত অবস্থানের রহস্যোদ্ধার করার প্রচেষ্টা একেবারেই অনর্থক। ভারতের আদর্শগত অজ্ঞানবাদমূলক মনোভাবটিকে ইন্দোনেশিয়ার মত অন্যান্য তথাকথিত “ডিজিটাল-নির্নায়ক”-রাও গ্রহণ করেছে। দ্রুত-পরিবর্তনশীল অর্থনীতির উপর এই বাহ্যিক আদর্শগত নির্মাণকে চাপিয়ে দেওয়ার বদলে, যে সব প্রক্রিয়া, সমস্যা ও প্রতিক্রিয়া, যা আদতে দেশের কাজে আসে এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়াকে চালনা করে সেগুলিকে কদর করা উচিত। ভারতের স্বার্থে এই মুহূর্তেই কাজে লাগবে এমন বাস্তব প্রশ্ন ও প্রায়োগিক সমাধানকে চিহ্নিত করা ও সহযোগিতার সর্বোত্তম প্রণালীকে মূল্যায়ণ করলে বরং উপকার হবে – যা বহুপাক্ষিক বিন্যাসের মধ্যে দিয়েই ঘটবে এমন নয়।
ক্রমবর্ধমান আদর্শগত অজ্ঞানবাদকে ঠিক সাইবার-নিরাপত্তার বহুপাক্ষিকতার মৃত্যুদণ্ড বলে আখ্যা দেওয়া যায় না। তার বদলে, বাস্তবসম্মত ফলাফলের উপর মনোযোগ দিলে এই ভূ-রাজনৈতিক মেরুকরণের যুগে বহুপাক্ষিকতার প্রাসঙ্গিকতা বজায় থাকে। এমনকি আইনের দিক থেকে কার্যকর ফলাফলের অনুপস্থিতিতেও, বিশেষ করে প্রযুক্তিগত এবং ভূ-রাজনীতিগত দ্রুতগতির উন্নয়নের আলোতে দেখলে, সর্বোত্তম চর্চার আদানপ্রদান, নালিশ জানান, কোনও বিষয়কে স্পষ্টভাবে বোঝানর জন্য একটি বহুপাক্ষিক পরিসরই সবচেয়ে ভালো স্থান। উন্নয়নশীল দেশগুলিতে, যেখানে ডিজিটাল অর্থনীতি সদ্যোজাত হলেও দ্রুত-বর্ধমান, সেই সব দেশে এই কথোপকথন এবং যোগাযোগের বিন্দুগুলি বিশেষ করে অর্থবহুল। গুরুত্বপূর্ণভাবে, সাইবার-নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় নিয়মের প্রতি ভারতের মনোভাবটি বিশ্বের অন্যান্য সম্মেলনকে ভারত কিভাবে দেখে, তার উপর প্রযোজ্য নয়। ভারতের স্বার্থ, সংগঠন এবং রাজনৈতিক ইকোসিস্টেমের বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে প্রতিটি বিশ্বসম্মেলনেরই নিজের নিজের বিশিষ্ট তাৎপর্য ও প্রভাব আছে।
আদর্শগত লড়াইতে জয়লাভ করা এবং ধারাবাহিকতা বজায় রাখার বিষয়টি ভূ-রাজনীতিকে কেন্দ্র করে একত্রিত হওয়া রাষ্ট্র ও তাদের মৈত্রী দেশগুলির নেতাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। তবে, সুদীর্ঘ ও হিতকর যুদ্ধটি লড়ার বা লড়ে জেতার বদলে, এই জটিল ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণগুলি বরং আশু ও স্থূল প্রাপ্তির আশায় ভারতের মত দেশকে ক্রিটিকাল মাস অর্জন করতে (অর্থাৎ, একটি উঠতি ব্যবসায়িক সংগঠন যে পর্যায়ে পৌঁছলে স্বনির্ভর হয়ে ওঠে এবং আর্থিক দিক থেকে স্থিতিশীল থাকার জন্য অতিরিক্ত বিনিয়োগের প্রয়োজন অনুভব করে না) উৎসাহ দেয়।