২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আসামের দারাং জেলার ঢোলপুর চর এলাকায় শাসকদল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)-র নের্তৃত্বে যে গণউচ্ছেদের ঘটনা ঘটে তার শেষ হয়েছিল পুলিশের হাতে দুজনের মৃত্যুতে। পূর্বতন পূর্ব বাংলা থেকে আসা মুসলিম জনগোষ্ঠীর অংশ, তথাকথিত মিঞারা এই জায়গা বেআইনীভাবে দখল করেছেন বলে অভিযোগ করা হয় যাকে আসামের অন্যান্য জায়গায় উচ্ছেদ চালিয়ে যাওয়ার অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ঢোলপুর চর এলাকার ক্ষেত্রে প্রশাসনের দাবী ছিল, এই দখলীকৃত জমি আসলে পেশাদার পশুচারণের জন্য সংরক্ষিত এলাকা বা প্রোফেশানাল গ্রেজিং রিজার্ভ (পিজিআর) ও গ্রামের পশুচারণের জন্য সংরক্ষিত এলাকা বা ভিলেজ গ্রেজিং রিজার্ভ (ভিজিআর) হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ এবং এই "বেআইনী" দখলকারীরা তাই আদি বাসিন্দাদের হাত থেকে তাঁদের জীবননির্বাহের সুযোগ কেড়ে নিচ্ছেন। তবে, সরকারের এই দাবি যথেষ্ট বিভ্রান্তি তৈরি করে। আদতে ব্রহ্মপুত্র নদের চরগুলি আংশিক বা তুলনামূলকভাবে স্থায়ী স্থলভাগ। ব্রহ্মপুত্রের বয়ে আনা পলি সাধারণত আট থেকে দশ বছর ধরে জমে জমে এই চরগুলি গড়ে ওঠে। এক বা, খুব বেশি হলে, দুই প্রজন্ম এই চর ব্যবহার করার সুযোগ পায় এবং তারপর এগুলি আবার জলে ডুবে যায়। আসামের মোট জনসংখ্যার ৪.৫ শতাংশ এখানে বসবাস করে।
১৯৫০ সালের আসামের ভূমিকম্পের ফলে উপনদী ও শাখানদী সহ ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথ বদলে যায়। ভূমিকম্পের ফলে নদীর খাত উঁচু হয়ে যাওয়ায় বন্যা ও নদীতীরের ভাঙন ধরা শুরু হয়। রাস্তা, সেতু ও নদীতে বাঁধ নির্মাণের মত উপনিবেশ-পরবর্তী উন্নয়নমূলক প্রকল্পগুলি এই অবস্থাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। এই ধরণের নির্মাণের প্রয়োজনে নদীর জলস্রোতকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়, যার ফলে নদীর পাড়ের অসংখ্য জায়গায় ক্ষয়ে যেতে থাকে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় বন্যা এবং নদীর ভাঙনের ফলে ঘর ও জীবিকানির্বাহের উপায় হারিয়ে উপদ্রুত অঞ্চলের বাসিন্দাদের আভ্যন্তরীণ পরিযান। এই রাজ্যে জাতি ও ধর্মকেন্দ্রিক সংঘর্ষ এবং পরিচয় নিয়ে যে বিতর্ক ইতিমধ্যেই বিদ্যমান ছিল তা এই জলবায়ু ও উন্নয়নমূলক পরিবর্তনের কারণে সংঘটিত পরিবেশগত ঘটনাগুলির কারণে আরও গভীরতর হয়ে উঠেছে। বিজেপি সফলভাবে ভূমিহীনতা ও জীবনধারণের সুযোগের অভাব সংক্রান্ত সমস্যার মূল কারণ হিসেবে মিঞাদের এই "জমি জিহাদ"-কে একটি রাজ্যব্যাপী সমস্যা হিসেবে সামনে এনে সাম্প্রতিক গণউচ্ছেদের প্রচেষ্টাকে এই পরিচয়কেন্দ্রিক বিতর্কের অংশ করে তুলেছে।
আসাম সরকারের ২০১৮ সালের একটি বিবৃতিতে প্রস্তাব দেওয়া হয় যে, ১৯৫০ সাল থেকে নদীর ভাঙনের কারণে ৪২৭,০০০ হেক্টর ভূমি নষ্ট হয়েছে। অর্থাৎ যে রাজ্যে খুব কম মানুষেরই জমির মালিকানা সংক্রান্ত নিরাপত্তা আছে, সেই রাজ্যের মোট ভূমির ৭.৪ শতাংশ এইভাবে ধ্বংস হয়েছে। কিন্তু, সরকারের জমি সংক্রান্ত নীতি এখনও চর এলাকা সহ সমস্ত জমিকে একটি স্থায়ী এবং অপরিবর্তনীয় পণ্য হিসেবেই দেখে। নদীর অবস্থা বদলানর সঙ্গে সঙ্গে যখন বাস্তবের জমির আকার ও অবস্থান নিত্যই বদলে যাচ্ছে, তখন পিজিআর ও ভিজিআরের সীমানা নির্ধারণের অসংখ্য পুরনো নথি জমি দপ্তরে নিরাপদে রাখা আছে। তাই, ভূমিক্ষয়ের ফলে জমি হারানো চরের বাসিন্দারা হয় বিশাল জমির খোঁজে অন্যত্র চলে গেছেন অথবা কৃষির সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ করে দিনমজুরে পরিণত হয়েছেন। যখন এই অধিকারচ্যুত মানুষরা কাজের খোঁজে আসামের উপরের অংশে (এই এলাকাকে রাজ্যের আদি বাসিন্দাদের সুরক্ষিত দুর্গ বলে ধরা হয়) যান তখন তাঁদের বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী বলে দেখা হয়। এই ধারণাটি আসামের রাজনৈতিক বিতর্কের গভীরে ঢুকে গেছে। লাচিত সেনা, জাতীয়িতাবাদী যুব ছাত্র পরিষদ এবং অল আসাম স্টুডেন্ট ইউনিয়নের মত আসামের রাজনীতির মূলস্রোতের দলগুলির হাতে তাঁদের এমনভাবে অপমানিত হতে হয় যেন তাঁরা আদি বাসিন্দাদের জমি বেআইনীভাবে জবরদখল করেছেন।
অন্যদিকে, কোন রকম সরকারী প্রক্রিয়ার সাহায্য ছাড়া এই ছিন্নমূল জনতা ঘুরে বেড়াবে আর শেষে বসতি স্থাপনের জন্য আরেকটি নতুন চরে বা সংরক্ষিত অরণ্য অথবা অভয়ারণ্যের অনেক ভিতরে বসতি স্থাপন করবে। সেখানে যখন আবার তাঁদের উচ্ছেদ করার কাজ শুরু হয় তখন এই জনগোষ্ঠী অন্য কোন জায়গায় সরে যান। আসামের নিচের ও উপরের অংশ থেকে সেই অঞ্চলের আদি বাসিন্দা ও অভিবাসীদের এই সুবিশাল পরিযান গত ত্রিশ বছর ধরে আসামের রাজনীতির একটি অন্ধকার অধ্যায়। কৃষক শ্রেণীর আদি বাসিন্দারা ভূমিচ্যূত হলে তাঁরা নিজেদের সংগঠিত করে স্থায়ী মেয়াদের জমির অধিকার বিষয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনার প্রক্রিয়া শুরু করতে পারেন। কিন্তু, যে কৃষকরা পূর্ব বাংলা থেকে আসামে এসেছেন তাঁদের জন্যে এই সমস্যা দ্বিগুণ কঠিন। তাই, তাঁদের পরিক্রমণের পুনরাবৃত্তি হতে থাকে, কখনও নদীর ভাঙনের জন্য আর কখনও বা ক্ষমতাসীন সরকারের হস্তক্ষেপে। এর ফলে এই ছিন্নমূল ও চলিষ্ণু অভিবাসী জনগোষ্ঠীকে এমন এক জমি-লোলুপ যাযাবর গোষ্ঠী বলে চিহ্নিত করা হয় যাঁরা সুতীব্র "জমি-জিহাদ"-এর জন্য তৈরি হয়ে আছেন এবং জাতি ও ধর্মকেন্দ্রিক সংঘর্ষের প্ররোচক। এইভাবে কৌশলী রাজনৈতিক পদক্ষেপের জমি তৈরি করা হয়। আসামের জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন বা ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেনশিপের সাম্প্রতিক পরিগণনা থেকে ১৯ লক্ষের বেশি মানুষ বাদ পড়েছেন এবং এই এন আর সি পরিকল্পনাটি অংশত এই বাস্তবতার দাবী থেকেই উঠে এসেছে।
এই প্রেক্ষিতে, কৃষির সঙ্গে বাজারের ক্রমশ বাড়তে থাকা পারস্পরিক সম্পর্কের কারণে আরেকটি নতুন পর্যায় শুরু হয়েছে যেখানে জমির চাহিদা আরও বেড়ে গেছে যার ফলে জাতি ও ধর্মগত দাবী ও সংঘর্ষ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থনৈতিক ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় প্রসূত দাবী সামলাতে যে সাধারণ বা যৌথ ভূমিকে ব্যবহার করা হয়, নদীর ভাঙন সেগুলিকেও ক্রমশ গ্রাস করে নিচ্ছে। এমনিতেও, ঔপনিবেশিক সময় থেকেই চা বাগান ও তেল কোম্পানীগুলি যে বিশাল পরিমাণ জমি দখল করে রেখেছে তার ফলে চলাচল ও বসতি তৈরির পরিসর আরও কমে গেছে। তবে, ১৯৭০-এর দশক থেকে, বিশেষ করে আসামের উপরের অংশে, ক্ষুদ্র চা বাগান বিপ্লব শুরু হয় এবং তাতে এই বাস্তুহীন জনগোষ্ঠীর হাত থেকে এই সাধারণ জমি ব্যবহারের সুযোগও চলে গেছে। ছোট শিল্পোদ্যোগগুলি এই ধরণের জমিকে চা চাষের কাজে লাগানোর ফলে এই অঞ্চলে জমির ঘাটতির একটি নতুন ক্ষেত্র দেখ দিয়েছে। তবে, নিম্ন আসামের চরের বাসিন্দাদের গতিপথ ও বাজারের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ভিন্নতর। যখন এই চরবাসীরা নিজেদের জায়গা ছেড়ে বহুদূরের কোন চরে পৌঁছতেন তখন তাঁরা স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে জমি কিনে চাষবাসের জন্য সেগুলিকে তৈরি করতেন। বন্যায় চরটি ডুবে যাওয়ার আগে, গরমকালের শুরুতে, চার থেকে পাঁচ মাসের মত অতি অল্প সময়ের মধ্যেই সেখানে বিক্রির জন্য সর্ষে আর পাট জাতীয় ফসল ও কিছু পরিমাণে ধান চাষ হত। তবে, ১৯৮০-র দশক থেকেই তাঁরা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে বিভিন্ন শাকসবজি চাষ করার দিকে ঝুঁকেছেন এবং এইভাবে কৃষি ও বাজারের সঙ্গে সম্পর্কের একটা স্থায়ী নকশা গড়ে উঠেছেঃ ফুলকপি, বাঁধাকপি, লঙ্কা এবং বেগুনের পাশাপাশি নানা ধরণের শাকের চাষ হচ্ছে বলে দেখা যাচ্ছে।
ভুট্টা (ভারতীয় কর্ন) ফলাতে কম শ্রমদান প্রয়োজন ও ফলত দ্বিগুণ লাভ এবং তাই বাণিজ্যিক শস্য হিসেবে ভুট্টা সামনের সারিতে উঠে এসেছে। জীবনধারণের অনিশ্চয়তা ও জমি এবং তার উপর অধিকারের স্থিরতা না থাকলেও, বাজার তাঁদের কিছু মুনাফা অর্জন ও তার ফলে কিছুটা সমৃদ্ধির সুযোগ করে দিয়েছে। কিন্তু, ওই চরের জমি এই নতুন বাসিন্দারা কিনেছেন যে আদি বাসিন্দাদের থেকে, তাঁদের কাছে এই সামান্য উন্নতিও শত্রুতার কারণ হয়ে ওঠে। নিজেদের ব্যবহারের জন্য চাষ প্রায় সময়ই লাভজনক নয় এবং তাতে কোন রকম আর্থিক উন্নতি হয় না বলে, অসমীয়াভাষী আদি বাসিন্দারা আরও বেশি সংখ্যায় ভারতের মেট্রো নগরীগুলিতে চলে যেতে থাকেন ও চরের বাসিন্দারাও তাঁদের অনুসরণ করেন। অনেক সময় এর উল্টো ঘটনা ঘটে, অর্থাৎ চরের বাসিন্দারা জীবিকার সন্ধানে মেট্রো শহরগুলিতে চলে যান এবং আদি বাসিন্দারা তাঁদের অনুসরণ করেন। অভিবাসনের এই নতুন নকশার ফলে যে রোজগার হয় তার উদ্বৃত্ত অংশ আবার তাঁদের নিজেদের রাজ্যের কৃষিতে বিনিয়োগ করা হয়। এবং মূল ভূখণ্ডে নয়, বরং বাণিজ্যিক শস্য উৎপাদনের নকশা ইতিমধ্যেই যেখানে তৈরি হয়ে আছে সেই চর এলাকাতেই এই বিনিয়োগের ব্যবহার ও কার্যকারিতা অনেক বেশি।
ভারতের কোভিড-19 অতিমারীর কারণে দেশ জুড়ে লকডাউন শুরু হলে অভিবাসীরা সুবিশাল সংখ্যায় ঘরে ফিরে আসেন এবং এর পরেই "জমি জিহাদ" নিয়ে উদ্বেগ গণ আখ্যানে আরও বেশি করে জায়গা পেতে শুরু করে। ২০২১ সালের আসামের বিধানসভা নির্বাচনে, শাসকদল বিজেপি "আত্মনির্ভরতা"-র পক্ষে কথা বলে অনেক ভোট নিজের দিকে টেনে নিতে সক্ষম হয়। এই আত্মনির্ভরতার অর্থ আসলে আদি বাসিন্দাদের শিল্পোদ্যোগে উৎসাহ দেওয়া বলেই ধরে নেওয়া হয়েছে। ঢোলপুরের যে জায়গা থেকে সেখানকার বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করা হয়েছে সেই জমিতে বাণিজ্যিক শস্য উৎপাদনের জন্য একটি সরকারী কৃষি প্রকল্পকে দেওয়া হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিপদের পাশাপাশি আসামের বদলে যেতে থাকে গ্রামীণ রাজনীতির ফলাফল হিসেবে একটি নতুন জাতি ও ধর্মকেন্দ্রিক হানাহানি ও রক্তক্ষয়ের অধ্যায়ের বীজ রোপণ শুরু হয়েছে।