এ কথা সত্যি যে ভারত একটি সুবিশাল রূপান্তরের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে দেশের প্রতিটি নাগরিকই তার জন্য সমৃদ্ধির মুখ দেখছেন। দ্রুত বাড়তে থাকা অসাম্য এবং দারিদ্র ও শিশুদের মধ্যে অপুষ্টির মত অন্যান্য অর্থনৈতিক বঞ্চনা থেকে নাগরিকদের উদ্ধার করতে সরকারের বিফলতা ভারতের উন্নয়নের কাহিনী চিহ্নিত করছে। স্বাধীন ভারতের ইতিহাস জুড়েই কিছু না কিছু দারিদ্র-বিরোধী জনকল্যাণমূলক প্রকল্পের অস্তিত্ব থাকলেও, তাদের প্রভাব ছিল সীমাবদ্ধ। সার্বজনীন উন্নয়নের জন্য পুনর্বন্টনের গুরুত্ব সামাজিক নীতিকেন্দ্রিক কার্যাবলীকে অগ্রাধিকার দেওয়ার বিষয়টি মাত্র গত দুই দশকে ঘটেছে। ২০০০-এর দশকের প্রথমদিককার খাদ্য, কর্ম ও শিক্ষার মত “অধিকার-কেন্দ্রিক” আইন পুনর্গঠনের পাশাপাশি রাজ্যসরকারগুলির পক্ষ থেকে বিভিন্ন স্বাধীন পদক্ষেপ, সমাজকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলিকে দেশের সরকারি নীতি নিয়ে আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসে। সামাজিক পেনশনের সম্প্রসারণ, মাতৃত্বকালীন সুবিধা, গৃহনির্মাণ ও রান্নার গ্যাসে ভর্তুকির সঙ্গে সঙ্গে কৃষকদের শর্তহীন আর্থিক সহায়তা এই সমাজকল্যাণমূলক পদক্ষেপগুলির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এবং নির্বাচনের ফলাফলের ক্ষেত্রেও এগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
আমি প্রভু পিঙ্গালির সঙ্গে একত্রে দ্য ফিউচার অফ ইন্ডিয়া’জ সোশ্যাল সেফটি নেটসঃ ফোকাস, ফর্ম অ্যান্ড স্কোপ নামের যে বইটি লিখেছি, তাতে আমরা ভারতের স্বাধীনতার গত ৭৫ বছরের ইতিহাসে নানা সামাজিক সহায়তার প্রবর্তন, বাতিল এবং পুনঃপ্রবর্তনের মাধ্যমে বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা-জাল প্রদানের ক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকার মূল্যায়ন করেছি। এর সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক নীতির নকশা তৈরির ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ সমস্যাগুলিকেও অনুমান করার
আমাদের বক্তব্যের মূল ভিত্তি হল, সমাজকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলিকে এমন একটি একজন ব্যক্তির জীবনচক্র জুড়ে সহায়তা দানের “প্রণালী” হিসেবে দেখা উচিত। এইভাবে, ওই ব্যক্তির নিজেকে উন্নত করার যে ক্ষমতা, তা যাতে তাঁর নিয়ন্ত্রণের বাইরে আছে এমন বাহ্যিক শক্তির কারণে অসম্পূর্ণ থেকে না যায় তা নিশ্চিত করা সম্ভব। একটি অর্থনীতির পরিবর্তনশীল অর্থনৈতিক পরিকাঠামো ও বর্তমান উন্নয়নকেন্দ্রিক সমস্যাগুলির কথা মাথায় রেখে, সমাজকল্যাণমূলক নীতিগুলিকে তাদের লক্ষ্য (উদ্দিষ্ট সহায়তাপ্রার্থী), গঠন (অর্থ ও খাদ্যের মত সাহায্যের হাতিয়ার), এবং সুযোগ (উন্নয়নের লক্ষ্যবস্তু)-র প্রেক্ষিতে খুব সাবধানে ও সযত্নে তৈরি করতে হবে (সারণী ১ দেখুন)। সুতরাং, মানুষের বর্তমান বঞ্চনা ও তার ভবিষ্যৎ বঞ্চনার সম্ভাবনা আগে থেকেই অনুমান করে, সেগুলিকে সম্বোধন করার মাধ্যমে একটি “সামাজিক ন্যুনকল্প” সুনিশ্চিত করতে সহায়তা করতে পারে এমন পদক্ষেপের একটি তালিকাকে ঘিরে জনকল্যাণমূলক নীতিগুলির নকশা করা উচিত। ঐতিহাসিকভাবে, ভারতের দারিদ্র নিয়ে আলোচনা খাদ্যে নির্দিষ্ট মাত্রায় ক্যালোরির পরিমাণকে কেন্দ্র করে ঘটে ও ওই পরিমাণ ক্যালোরিযুক্ত খাদ্য তা ক্রয় ও প্রস্তুত করার জন্য ন্যূনতম যে খরচ হয়, তাকে মানদণ্ড হিসেবে দেখা হয়। এই ধরণের মনোভাব মানবের উন্নতির প্রসারের মাপকাঠি হিসেবে অত্যন্ত সীমিত। আমরা দাবি রাখি যে, , বিভিন্ন বিপদ ও দুর্বলতা থেকে রক্ষা করার উপায় হিসেবে এবং সামাজিক ক্ষমতায়নের সাহায্যে সামাজিক নিরাপত্তা-জালের পক্ষে সম্ভব ব্যক্তিকে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বঞ্চনা থেকে মুক্ত করার, এবং এর ফলে দেশের দারিদ্র কমানোর সুযোগ আরও বেড়ে যায়।
সারণী ১: ভারতের প্রধান কয়েকটি সমাজকল্যাণমূলক প্রকল্প

গঠন, লক্ষ্য ও সুযোগ
এই বইতে আমরা দেখিয়েছি যে, সমাজকল্যাণমূলক নীতির লক্ষ্য, গড়ন ও সুযোগগুলি, ঐতিহাসিকভাবে, নানা জরুরী অবস্থা (দুর্ভিক্ষ সবুজ বিপ্লব থেকে জাত উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য, অর্থনৈতিক প্রতিশ্রুতি, অথবা নাগরিক সমাজের প্রবল দাবি) থেকে উঠে আসে, মানুষের বঞ্চনার কারণকে সম্বোধন করার জন্য সমবেত পদক্ষেপ নেওয়ার মধ্যে দিয়ে নয়।
সারণী ১-তে আমরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পাবলিক ডিসট্রিবিউশন সিস্টেম (পিডিএস)-এর মাধ্যমে শহরে শহরে খাদ্যবন্টন ব্যবস্থা প্রবর্তন দিয়ে কেন্দ্রের পৃষ্ঠপোষকতায় যে সমাজকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলি শুরু হয়েছিল, তার একটি ঐতিহাসিক সময়সারণী দেখিয়েছি। প্রথমদিকে, পিডিএস তার “শহরের প্রতি পক্ষপাত” নিয়ে সমালোচিত হলেও, সবুজ বিপ্লব প্রযুক্তির আগমনের ফলে ভারত খাদ্যোৎপাদনের ক্ষেত্রে স্বনির্ভর হয়ে ওঠার পর, ক্রমশ গ্রামাঞ্চলেও তার কর্মকাণ্ড বাড়তে থাকে (এবং, সঙ্গে সঙ্গে, শহরাঞ্চলে কমতে থাকে)। এই সময়ই, দেশের অনেক অংশে পৌনঃপৌনিক অনাবৃষ্টি ঘটার পর, গ্রামাঞ্চলের বাসিন্দাদের জীবিকার সুযোগ তৈরি করতে, ১৯৭৩ সালে মহারাষ্ট্র এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি স্কিম (ইজিএস) তৈরি করা হয়। ১৯৭০-এর দশকের শেষদিকে, দেশের খাদ্যশস্যের অতিরিক্ত উৎপাদনের ফলে ইজিএস (যার উপর ভিত্তি করে ২০০৪ সালে মহাত্মা গান্ধী ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারেন্টি স্কিম বা এমজিএনআরইজিএস তৈরি করা হয়েছে) ক্রমশ তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। ক্রমে ক্রমে, ১৯৮০ এবং ‘৯০-এর দশক নাগাদ মাত্রাতিরিক্ত দুর্নীতি এবং ভ্যালু চেইনে ফাটল দেখা যায়, এবং সঙ্গে সঙ্গে, পিডিএস-এর কর্মকান্ডের মানেরও পতন হয়। ১৯৯৭ সালে দরিদ্র ব্যক্তিদের আনুকূল্য দেয় এমন একটি প্রকল্প হিসেবে এর পুনর্নিমাণ করা হয়।
ভারতীয় শিশুদের মধ্যে অপুষ্টির প্রবল প্রকোপ দেখা গেলেও, তাদের জন্য উন্নততর পুষ্টির ব্যবস্থা নীতির বিষয়ে আলোচনাসূচিতে ঠাঁই পেয়েছে মাত্র ১৯৭০-এর দশকের মধ্যভাগে। ইন্টিগ্রেটেড চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট স্কিম (আইসিডিএস) হল একমাত্র প্রকল্প যা পুষ্টির বিষয়টিকে সম্বোধন করে, সেটিকে পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয়েছিল ১৯৭৫ সালে, এবং তাও দেশের কয়েকটি মাত্র ব্লকে। কিন্তু ত্রুটিপূর্ণ বাস্তবায়নের কারণে এর প্রভাব সীমিতই থেকে যায়। ২০০০-এর দশকে, যখন ভারতের অর্থনীতির দ্রুত উন্নয়ন হতে শুরু করে, শিশুদের পুষ্টির বিষয়ে পদক্ষেপের ক্রমাগত ঘাটতিপূর্ণ ফলাফলের উপর রাজনীতিবিদদের নজর পড়ে এবং এর ফলে, শেষ পর্যন্ত, আইসিডিএস আরও বিস্তৃত ও উন্নত করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়। একইভাবে, ১৯৯৫ সালে ন্যাশনাল প্রোগ্রাম অফ নিউট্রিশনাল সাপোর্ট টু প্রাইমারি এডুকেশন (এনপি-এনএসপিই) চালু হওয়ার আগে পর্যন্ত খালি পেটে স্কুলে আসা ছাত্রছাত্রীদের বিষয়টি নিয়ে কোনও চর্চা হয় নি। পরে এই প্রকল্পটির নাম বদলে মিড-ডে মিল স্কিম (এমডিএমএস) করা হয় এবং সরকারী বিদ্যালয়গুলিতে বাধ্যতামূলক দুপুরের খাবারের বন্দোবস্ত করা নিয়ে আদালতের একটি নির্দেশের পর এমডিএমএস-এর অনেক উন্নতি হয়।
নকশা ১: ভারতের সামাজিক সুরক্ষা-জালের বিবর্তন – গঠন, লক্ষ্য ও সুযোগ

১৯৯০-এর দশক পর্যন্ত, সমাজকল্যাণমূলক নীতিগুলিকে খাদ্য-নিরাপত্তার ধারণাকে ঘিরে তৈরি করা হত। এমনকি, দারিদ্রসীমার ধারণাও “নিম্নতম প্রয়োজনীয় ক্যালোরি”-র মাধ্যমে প্রকাশিত হত। অপুষ্টি, জীবিকার অনিশ্চয়তা, এবং স্বাস্থ্যের পরিণতির উপর মনোযোগ না দিয়ে গ্রামাঞ্চল এবং খাদ্য-নিরাপত্তার উন্নতিকরণের সীমিত সুযোগকে এই এই নীতির লক্ষ্য হিসেবে উপস্থিত করা - যার পিছনে আছে ভারতে বারংবার ঘটা দুর্ভিক্ষের ইতিহাস (ঔপনিবেশিক কাল থেকে) - অর্থনৈতিক পরিকল্পনার একটি গুরুতর ত্রুটি। নাগরিক দারিদ্রের কারণকে অগ্রাহ্য করার এই বিষয়টিই আসলে সামাজিক নীতির সীমিত সুযোগকে আরও স্পষ্ট করে।
১৯৯০-এর দশকের অর্থনৈতিক সংশোধনের কারণে আগে ভারতের নাগরিকদের হাতে সীমিত সামাজিক নিরাপত্তার যে উপায়গুলি ছিল, তা আরও সংকুচিত হয়ে যায়। অর্থনৈতিক বিচক্ষণতার ধারণার দ্বারা চালিত হওয়ার ফলে পিডিএস এমন একটি প্রকল্প হিসেবে পুনর্নিমিত হয়, যার নির্দিষ্ট লক্ষ্যটি দরিদ্র-অনুকূল। এর ফলে, ১৯৯৭ সালে, প্রথমবার, কিছু পরিবারকে দারিদ্রসীমার নিচে বা বিলো পভার্টি লেভেল (বিপিএল) ও কিছু পরিবারকে দারিদ্রসীমার উপরে বা অ্যাবভ পভার্টি লেভেল (এপিএল) - এই দুই শ্রেণীতে ভাগ করা হয় এবং রেশন কার্ডেও তাঁদের এই হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এর পর থেকেই, কয়েকটি রাজ্য বাদে এই এপিএল/বিপিএল বিভাজনটি, , সারা দেশের জন্য নীতির লক্ষ্যের চিহ্নকে পরিণত হয়েছে। ২০১৩ সালের ন্যাশনাল ফুড সিকিওরিটি অ্যাক্ট (এনএফএসএ), পিডিএস-এর বিস্তার বাড়িয়ে “অগ্রাধিকারী” ও “অনাগ্রাধিকারী” এমন পরিবারগুলিকেও যুক্ত করে।
আশ্চর্যজনকভাবে, স্বাধীনতার পরের প্রথম পাঁচ দশক ধরে, সরকারি চাকরি করেন এমন সামান্য কিছু সংখ্যক ব্যক্তি ছাড়া, বৃদ্ধ বয়সের পেনসন বা আর্থিক সুরক্ষার কোন ব্যবস্থাও অধিকাংশ ভারতীয় নাগরিকদের ছিল না। ১৯৯৫ সালে ন্যাশনাল সোশ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স প্রোগ্রাম (এনএসএপি)-এর হাত ধরে বয়স্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধীদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নন-কনট্রিবিউটরি স্যোশাল পেনসন দেওয়ার উদ্দেশ্যে কল্যাণমূলক প্রকল্পের গঠন ও সুযোগকে আরও বিস্তৃত করা হয়। তবে, টিপিডিএস-এর মত এনএসএপি একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য-নির্ভর প্রকল্প হিসেবেই থেকে যায় (বিপিএল পরিবারগুলিই এর লক্ষ্য) যার বাস্তবায়নে বেশ কিছু ত্রুটি দেখা গেছিল। ওই পেনসনভোগীদের জন্য কল্যাণমূলক আর্থিক সহায়তা হিসেবে মাসে মাত্র ২০০ টাকা ধার্য করা হয়। কয়েকটি রাজ্যে খুব সাম্প্রতিককালে, এই পেনসনের পরিমাণ সংশোধিত হলেও, দেশের অধিকাংশ রাজ্যেই দরিদ্র শ্রমিকদের পক্ষে অবসর বা অবসর-পরবর্তী জীবন সম্মানের সঙ্গে যাপন করা কঠিন।
দেশের একটি অংশে, অনাবৃষ্টির কারণে অনাহার থেকে ব্যাপক হারে মৃত্যুর ফলশ্রুতি হিসেবে ২০০১ সালে, পিপলস্ ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিজ (পিইউসিএল) ভারত সরকারের বিরুদ্ধে একটি লিখিত আবেদন জানায় এবং তার পরই, নীতি সংশোধনের একটি নতুন ঢেউ ওঠে, এবং ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ভারত সরকারকে তিরস্কার করে এবং এমডিএমএস ও আইসিডিএস-এর উন্নয়নসাধন করে শিশু অপুষ্টির বিষয়টির উপর অবিলম্বে মনোযোগ দিতে নির্দেশ দেয়। “খাদ্যের অধিকার”-এর মত অন্যান্য নানা বস্তুগত সহায়তার সঙ্গে সঙ্গে এনএফএসএ এই প্রকল্পগুলিকেও প্রতিষ্ঠা করেছে। এক্ষেত্রে এনএসএফএ ২০০৫ সালের রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি অ্যাক্ট (এনআরইজিএ), যা “কর্মের অধিকার”-কে আইনি প্রতিশ্রুতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিল, তার পদক্ষেপ অনুসরণ করেছে।
২০০৮ সালে দারিদ্রসীমার নিচে অবস্থিত পরিবারগুলিকে ভর্তুকি দিয়ে স্বাস্থ্যবীমার সুবিধা দেওয়ার জন্য ভারত সরকারের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বীমা যোজনা (আরএসবিওয়াই) নামের একটি নতুন কল্যাণমূলক কর্ম-পরিকল্পনা চালু করা হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল দ্রুত বাড়তে থাকা অসংগঠিত শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা প্রদান। ২০১৮ সালে, আরএসবিওয়াই-এর নাম বদলে প্রধান মন্ত্রী জন আরোগ্য যোজনা (পিএম-জেএওয়াই) করা হয় এবং আরও বেশি সংখ্যক ব্যক্তিকে এই প্রকল্পের আওতায় আনা হয়। ২০১৮ সালে পিএম-কিষান নামে কৃষকদের শর্তহীন ভাবে অর্থসাহায্য করার প্রকল্পটি দেশের সমাজকল্যাণ্মূলক নীতির ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক। এই সময়ই, সমাজকল্যাণের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যায় (যাকে নব্য সমাজকল্যাণবাদও বলা হয়ে থাকে)। এই পরিবর্তনটি হল রান্নার গ্যাস, বিদ্যুৎ, গৃহনির্মাণ ইত্যাদি ব্যক্তিগত পণ্যে ভর্তুকির জন্য প্রযুক্তির সাহায্যে অর্থের সরাসরি হস্তান্তর বা ডিরেক্ট বেনিফিট ট্র্যান্সফার (ডিবিটি)।
এই ঐতিহাসিক তত্ত্বানুসন্ধানের ফলে, বিবর্ধিত লক্ষ্য (দারিদ্রসীমার নিচে থাকা পরিবার ও দারিদ্রকে সমাজকল্যাণের একমাত্র উদ্দেশ্য হিসেবে দেখার অভ্যাস বদলান), গঠন (খাদ্য ও জীবিকা-ভিত্তিক সহায়তার বদলে সরাসরি আর্থিক সহায়তা প্রদান) এবং সুযোগ (খাদ্যের নিশ্চয়তা বা পুষ্টি ও জীবিকা-বিষয়ক সহায়তার মত দারিদ্রের উপসর্গ থেকে বেরিয়ে স্বাস্থ্যহানি জাতীয় সর্বনাশা কোনও ধাক্কার মত ঘটনাকে দারিদ্রের চালক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দিকে এগিয়ে যাওয়া)-কে মূল্য দেওয়া হয়। অনেক রাজ্যসরকারই ঐতিহাসিকভাবে, লক্ষ্য, গঠন ও সুযোগ – এই তিনটিকে আরও প্রসারিত করেছ ও সেগুলির উপর ভিত্তি করে আরও নতুন নতুন উদ্ভাবন সম্ভব হয়েছে। এই ভাবে এই রাজ্যগুলিতে সমাজকল্যাণের নিজস্ব কৌশল তৈরি হয়েছে, যা জাতীয় নীতিকেও বিভিন্ন জিনিস জানতে ও বুঝতে সাহায্য করে।
“প্রকল্প” থেকে “প্রক্রিয়া”
ভারত অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে তার নাগরিকদের একটা বিশাল অংশের জন্য সামাজিক সুরক্ষাকবচগুলির প্রসারের উদ্দেশ্য একটি সুবিশাল ইমারত তৈরি করে ফেললেও, তার বিচ্ছিন্ন কল্যাণমূলক প্রকল্পগুলি আদতে এ দেশের বহুমাত্রিক উন্নয়নমূলক সমস্যার সাময়িক সমাধান। অর্থনৈতিক বিকাশ ও, আমাদের প্রত্যাশার থেকে ধীর গতি হলেও, ক্রমশ জোরাল হতে থাকা গণতন্ত্রের দ্বারা এই জনকল্যাণমূলক কাঠামোটি নির্মিত হলেও, আমরা জানি যে সামাজিক গণতন্ত্র অর্জন করা যায় একমাত্র তখনই, যখন দেশের নাগরিকরা রাষ্ট্রের দায়িত্বে সুরক্ষা পাওয়া নিয়ে নিশ্চিন্ত হবেন ও দরিদ্র নাগরিকরা সরকারের থেকে সম্মানজনক ব্যবহার পাবেন। সুতরাং, সামাজিক নিরাপত্তার প্রকৃত সম্ভাবনা উদ্ঘাটিত হবে, যখন সমাজকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলি্র পরিপূরক হিসেবে নাগরিক-কেন্দ্রিক সরকারি প্রক্রিয়া, কল্যাণমূলক প্রকল্পের উন্নততর নকশা ও অর্থনৈতিক বিকাশের উপস্থিতি থাকবে। একটি জীবনচক্র জুড়ে যে সম্ভাব্য বঞ্চনা দেখা যেতে পারে, স্বাধীন প্রকল্পগুলি তার বিরুদ্ধে ক্ষণস্থায়ী সহায়তা দিতে পারলেও, উন্নততর সুযোগ ও ক্ষমতায়ন সম্ভব করে এমন প্রতিষ্ঠানই পারে গৃহকেন্দ্রিক সহনশীলতাকে উজ্জীবিত করতে (নকশা ২ দেখুন)।
নকশা ২: বর্তমান কল্যাণমূলক “প্রকল্প” থেকে একটি সহনশীল আর্থিক নিরাপত্তামূলক “পদ্ধতি”-র নির্মাণ

লক্ষণীয় যে, যে সহায়তা-প্রাপকদের এই সমাজকল্যাণের সুরক্ষা-জালের প্রয়োজন, তাঁদের সংখ্যা হ্রাস হওয়াই সমাজকল্যাণ প্রক্রিয়ার সাফল্যের চিহ্নক। ভবিষ্যতের দিকে তাকালে বোঝা যাবে যে, দেশের অর্থনৈতিক বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে, ভারত অসংখ্য সমস্যারও সম্মুখীন হতে চলেছে। খাদ্য-বিষয়ক অনিশ্চয়তা ক্রমবর্ধমানভাবে রোজগারের অনিশ্চয়তার দ্বারা নিরূপিত হবে। নাগরিক জনতা (ও দরিদ্রশ্রেণী) তাঁদের গ্রামীণ পরিপূরকদের ছাড়িয়ে যাবেন। নাগরিক জীবিকাকেন্দ্রিক প্রকল্প ও স্বাস্থ্যবীমা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এমজিএনআরইজিএস-এর মত গতানুগতিক প্রকল্পগুলি তাদের প্রাসঙ্গিকতা হারাবে। ২০৫০ সাল নাগাদ, ভারতের জনসংখ্যার পাঁচ ভাগের একভাগ মানুষের বয়স হবে ষাট বছর বা তার বেশি। এর মানে, এই সময় থেকে সামাজিক পেনশন পাওয়ার যোগ্য ব্যক্তির সংখ্যা আরও বেড়ে যাবে। একই ভাবে, জল ও শৌচালয় নিয়ে সরকারের প্রধান প্রকল্পগুলির ব্যাপক প্রসার সত্ত্বেও, পুষ্টি-বিষয়ক বঞ্চনা হ্রাসের ক্ষেত্রে তার প্রগতি নির্ভর করছে লিঙ্গ ও জাতিপরিচয়কে ঘিরে নির্মিত সামাজিক প্রথাগুলি ঠিক কতটা “সমস্যাজনক” এবং জনজীবন থেকে সেগুলির ক্রমে ক্রমে মুছে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা, তার উপর। অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোতে বদলের জন্য তাই প্রয়োজন গুপ্ত ও অপেক্ষমাণ প্রতিকূলতার মুখে (দরিদ্র ও অ-দরিদ্র) নাগরিকদের মধ্যে সহনশীলতা গড়ে তোলার জন্য অর্থনৈতিক সুরক্ষাদানের প্রক্রিয়ার লক্ষ্য, গঠন ও সুযোগের ক্ষেত্রে ক্রমাগত সংশোধন। নীতিতে প্রত্যাশিত বদল আনলে তবেই অতীতের বোকামোর পুনরাবৃত্তি বন্ধ করা যাবে।