ভারতীয়রা বিশ্বাস করেন যে, সরকারী কর্মচারীদের মধ্যে দুর্নীতি একটি দেশব্যাপী ঘটনা এবং তা রাষ্ট্রের কার্যপ্রণালীর স্বচ্ছতার অভাবের বিষয়ে অভিযোগকে সামনে আনে। এই পটভূমিতে, টোব্যাকো বোর্ড অর্থাৎ ভারতের যে নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ সিগারেটের তামাকের নিলামে মধ্যস্থতা করে, তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির পৌনঃপৌনিক অভিযোগ কোনও বিস্ময়কর ব্যাপার নয়। ২০১৬ সালে, অন্ধ্রপ্রদেশের বোর্ড-নিয়ন্ত্রিত নিলামঘরে আমার ফিল্ডওয়ার্কের সময়, বাজারে রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত নিলামগুলিকে প্রশ্ন করার সময়, এই ধরনের অভিযোগকে বেসরকারী সেক্টরের তামাক ব্যবসায়ী ও তামাক চাষী, দুই পক্ষ থেকেই বারংবার ব্যবহৃত হতে দেখেছি। এমনকি, যাঁরা বাজারের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে কোন ভূমিকা দিতে তৈরি নন, তাঁরাও ইঙ্গিত করেন যে, বোর্ডকে উদ্ধার করার কোন পথ নেই এবং এর ডানা ছেঁটে দেওয়ার আশু প্রয়োজন আছে।
তবে, দুর্নীতির অভিযোগ আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্যের সাধন করে। ভারতীয় তামাকের বাজারের ক্ষেত্রে, টোব্যাকো বোর্ডের কর্মচারীদের বিরুদ্ধে যে নালিশগুলি আছে, সেগুলিকে ব্যবহার করা হচ্ছে নিয়ন্ত্রণ-কেন্দ্রিক কার্যাবলীর বিষয়ে রাষ্ট্র বৃহত্তরভাবে যে অভিমুখে যাচ্ছে, তা নিয়ে তামাক চাষী ও ব্যবসায়ীদের অসন্তোষকে প্রকাশ করার জন্য। সেগুলি ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে, এই জাতীয় অভিযোগ বিভিন্ন আগ্রহী গোষ্ঠী, যারা রাষ্ট্রের প্রতিকারমূলক কাজকর্মকে এমন ভাবে পরিচালনা করে যাতে তা তাদের স্বার্থের সঙ্গে মিলে যায়, সেগুলিকে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় করে তুলতে সাহায্য করে। একই সঙ্গে, বাজারের যে অন্তর্নিহিত পরিস্থিতিগুলি কৃষি খামারের টিঁকে থাকার উপায়কে বিপদে ফেলে সেগুলিকে প্রশ্ন না করেই, রাষ্ট্র দুর্নীতি দমনের জন্য যে প্রতিকারগুলি বেছে নেয়, সেগুলি বড় জোর বৃহত্তর সমস্যার আংশিক সমাধান।
আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে টোব্যাকো বোর্ড সিগারেটের তামাকের নিলাম করা শুরু করার আগে, ভারতীয় কৃষকরা তামাকের মান অনুযায়ী শ্রেণীবিন্যাস ও দাম নির্ধারণের জন্য বেসরকারী সেক্টরের ব্যবসায়ীদের উপর নির্ভর করত। এই নির্ভরতার কারণে ব্যবসায়ীরা নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী তামাকের মান ও মূল্য নির্ধারণ করত। নির্ধারিত মূল্য প্রদানের প্রতিশ্রুতি খেলাপ করা যেমন এই জাতীইয় শোষণের জঘন্যতম উদাহরণের একটি। এই রকম ঘটনার পর বোর্ড রাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় সিগারেটের তামাকের নিলাম চালু করে। নিলামের এই নতুন পদ্ধতির পাশাপাশি, যাতে কৃষকরা নিজেরাই তাদের উৎপাদিত তামাকের মান নির্ধারণ করতে পারে, তার জন্য বোর্ড একটি সহজ আলফা-নিউম্যারিক প্রণালীরও প্রচলন করে। বোর্ড ঘোষণা করে যে, নিলামে অংশ গ্রহণের আগে সমস্ত ব্যবসায়ী ও কৃষককে বোর্ডের সঙ্গে নাম নথিভুক্ত করতে হবে। এর ফলে বোর্ড চিগারেটের তামাকের ব্যবসায় মধ্যস্থতা করতে পারবে ও প্রতিটি লেনদেনের লিখিত নথি রক্ষা করা যাবে।
ভারতের তামাক সেক্টরের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের এই ক্রমবর্ধমান হস্তক্ষেপের বিষয়টি আগের অবস্থার সম্পূর্ণ বিপরীত। আগে তামাক ব্যবসায়ীরা প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করলে তবেই রাষ্ট্রকে হস্তক্ষেপ করতে ডাকা হত। এখন তামাক ব্যবসায়ীরাই রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘনের ঘটনা দমন করার চেষ্টা করে চলে। সিঙ্ঘাইয়া গারু, তামাক ব্যবসায়ীদের সংগঠনের একজন প্রতিনিধি নিজের দায়িত্বের বিষয়ে কথা বলার সময় আমাকে বোঝান যে, তাঁর দলের কাজ হল টোব্যাকো বোর্ডের কর্মচারীরা তামাকের গাঁটের যে মান নির্ণয় করেন তার তদারকি করা। সিঙ্ঘাইয়াহ গারুর মতে, তামাকের মান ভুলবশত বাড়ানর এবং কমানর প্রণোদনা বোর্ডের কাছে আছে। যদি বোর্ড কোনও তামাকের গাঁটের সঠিক মানের থেকে উচ্চতর মান নির্ধারণ করে এবং ক্রেতারা বোর্ডের মুখের কথায় বিশ্বাস করে তাহলে, ওই গাঁটটি অনেক বেশি দামে বিক্রয় হবে। ওই গাঁটের মালিক যে কৃষক, তিনি নিম্নতর মানের তামাকের জন্য অনেক বেশি দাম পাবেন। একই সঙ্গে বোর্ড একটি গাঁটের মান কম করে নির্ধারণ করতে পারে এবং কেবলমাত্র নিলামের ডাক শুরু হলে, সে বিষয়ে ক্রেতাদের সতর্ক করতে পারে। ক্রেতাদের তখন যে গাঁটের মান কম বলে নির্দিষ্ট হয়েছে, তার জন্য অতিরিক্ত মূল্য দিতে হবে এবং যে গাঁটের মান কম ধরা হয়েছে, নিলামের নথিতে তার মূল্য বেশি বলে নিবন্ধভুক্ত হবে। দুই ক্ষেত্রেই, বোর্ড কেন্দ্র সরকারের তরফ থেকে উচ্চতর মূল্যে তামাক বিক্রয়ের জন্য বাহবা পাবে।
যে টোব্যাকো বোর্ড তামাক চাষীদের আনুকূল্য দিচ্ছে বলে তামাক ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন, তার বিরুদ্ধে তাঁদের ঠিক কতটা অসন্তোষ জমা হয়ে আছে তা সিঙ্ঘাইয়া গারুর আখ্যান থেকে জানা যায়। সিঙ্ঘাইয়া গারু যেমন বলেন, “কখনও কখনও কৃষকরা টোব্যাকো বোর্ডের কর্মচারীদের প্রভাবিত করবে…[কৃষকরা বলবেন] ‘স্যার, ভালো মান দিন”…কিন্তু বোর্ডের কর্মচারীরাই আবার আমাদের সুপারিশ বা নীতি মেনে নেবেন না…আমরা টোব্যাকো বোর্ডকে প্রভাবিত করতে পারি না।” নিলামঘরে আমি যে দুর্নীতির অভিযোগগুলি শুনেছিলাম, তার অধিকাংশই উড়ো খবর আর অনুমান। আর সমস্ত রটনার মতই, সেগুলি দাবানলের মত চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
অন্যদিকে, কৃষকরা বিশ্বাস করেন যে, বোর্ডের আরও বেশি করে তাঁদেরই পক্ষ নেওয়া প্রয়োজন। বাজারের পরিস্থিতি বিচার করলে বোঝা যাবে যে, তাঁদের অসন্তোষের উপযুক্ত কারণ আছে। ভারতে সিগারেটের তামাকের বাজার অলিগোপ্সনি বা তা এমন একটি বাজার যেখানে একটি বিশেষ পণ্যের ক্রেতা সংখ্যায় খুবই কম। হাতে গোনা কয়েকটি দেশীয় প্রতিষ্ঠান ও রপ্তানিকারী গোষ্ঠীই সারা বাজারে আধিপত্য করে, যা তাদের হাতে মূল্য নির্ধারণের অপরিমিত ক্ষমতা তুলে দেয়। বোর্ডের হাতে দাম বাড়ানর ক্ষমতা সীমিত এবং তা ন্যায্য মূল্যের বিষয়ে কৃষকদের ক্রমাগত আশ্বাস দিয়ে যেতে পারে না। এর ফলে, কৃষকরা বাধ্য হন কম দামে তাঁদের উৎপাদন বিক্রি করতে বা সহজে বিনষ্ট হয় এমন ফসলও তাঁরা বিক্রি না করে, অপেক্ষা করে থাকেন ন্যায্য মূল্য দেবেন এমন একজন ক্রেতার জন্য – যা ঘটতেও পারে, আবার নাও ঘটতে পারে। তাঁদের পারিশ্রমিক ক্রমশ কমে যাওয়ার ক্ষেত্রে তামাক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলি ঠিক কী ভূমিকা পালন করেন, কৃষকরা সে বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন হওয়া সত্ত্বেও, তাঁদের অসন্তোষকে তাঁরাও রাষ্ট্র – কৃষকদের পরিসেবা দেওয়া যার দায় - তার প্রতিই চালিত করেন।
তামাক ব্যবসায়ী ও কৃষক, এই দুই গোষ্ঠীই, বোর্ডের প্রতি তাঁদের সমকক্ষদের অসন্তোষকে ব্যবহার করছেন রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হয়ার জন্য, যাতে তাঁরা রাষ্ট্রের মধ্যস্থতাকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারেন। কয়েক বছর অন্তর, তাঁদের এই রকম কাজকর্মের ফলে, বাজারের একক অংশীদারের পক্ষে অনুকূল ফলাফল ঘটতে দেখা যাচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, ১৯৮০-র দশকে, ব্যাবসায়ীদের শোষণের বিরুদ্ধে কৃষকদের অভিযোগের উত্তরে বোর্ড যেমন হস্তকৃত নিলামের ব্যবস্থা করেছিল, তেমন ভাবেই, ২০১১ সালে দুর্নীতির বিষয়ে তামাক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ও কৃষকদের প্রতিবাদের উত্তরে বোর্ড ই-নিলামের প্রচলন করে। তাদের আশা ছিল যে, এই সংশোধনটির ফলে নিলামের সময় বোর্ডের আচরণের স্বচ্ছতার বিষয়ে তাদের অংশীদাররা নিশ্চিত হবেন। এর পর থেকেই, ব্যবসায়ী ও বোরডের কর্মচারীরা হাতে ধরা বৈদ্যুতিক যন্ত্রের সাহায্যে ডাবল-ব্লাইন্ড নিলাম পরিচালনা করছেন। এই প্রক্রিয়াতে, ব্যাবসায়ী বা কৃষক, কারও নামই উদ্ঘাটিত হয় না, এবং নিলামের চূড়ান্ত ডাকটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে নথিভুক্ত হয়ে যায়, যাতে কর্মচারীরা বিক্রয়ের নথি কোনও ভাবেই বদলাতে না পারেন। অনেক প্রযুক্তিগত ত্রুটি স্বত্বেও, বোর্ডের কর্মচারী সহ, যতজন অংশীদারের সঙ্গে আমি কথা বলেছি তাঁরা সকলেই একমত হয়েছেন যে, ই-নিলাম রাষ্ট্রের দুর্নীতি অনেকটাই কমাতে সক্ষম হয়েছে।
তবে, বাজারে প্রতিযোগিতার অভাব, মূল্যের স্থবিরতা, এবং মূল্যকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সীমিত ক্ষমতার মত অন্তর্নিহিত সমস্যাগুলিকে সম্বোধন করার বদলে, বাজারের স্বচ্ছতা প্রমাণ করার জন্য প্রযুক্তির উপর নির্ভর করার মত ঘটনাগুলি ব্যবসায়ীদের অনুকূলেই কাজ করে এবং রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে খর্ব করে। বোর্ডের একজন অভিজ্ঞ কর্মচারী যেমন ব্যাখ্যা করেছেন, ডাবল-ব্লাইন্ড প্রক্রিয়াটি ব্যবহারের ফলে, কর্মচারীরা ক্রেতাদের পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দিয়ে কোনও রকম প্রতিযোগিতা নির্মাণে প্ররোচিত করতে পারেন না। রাষ্ট্রের তদারকি কমে যাওয়ায়, ক্রেতারা এখন হাতে ধরা যন্ত্রের আড়ালে লুকিয়ে থাকতে পারেন, এবং একজোটে নিলাম ডাকা থেকে বিরত হয়ে মূল্য কমিয়ে দিতে পারেন।
এই কারণে, সরকারী কর্মচারীদের মধ্যে দুর্নীতির অভিযোগের উদ্দেশ্যটি আদতে রাষ্ট্রের দায়িত্বের বিষয়টি সামনে আনার থেকেও আরও কিছুটা বেশি। এগুলির সাহায্যে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অসন্তোষকে একত্রিত করা যায় এবং সেগুলিকে আরও তীব্র করে তাকে একটি রাজনৈতিক সক্রিয়তায় পর্যবসিত করা যায়। এই সক্রিয়তা স্বচ্ছতার নামে রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত খেলোয়াড়দের নিয়ন্ত্রণ করে, রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে দমন করে এবং তার কাজের ক্ষমতাকে সীমিত করে তোলে। ভারতের তামাকের বাজারগুলির ক্ষেত্রে, এই ধরনের কাজকর্ম ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট (এফডিআই)-কে আহ্বানের অনুমতি দেওয়ার দাবিকে আরও দৃঢ় করে তোলে। দেশীয় তামাক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলি যদিও একটি কম সক্রিয় রাষ্ট্রের থেকে নিরাপত্তা পেতে ইচ্ছুক, অনেক কৃষক গোষ্ঠীই এফডিআই-এর এই বিষয়টি নিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। এফডিআই-কে জড়িত করার অর্থ, বোর্ড প্রতিষ্ঠার আগের এমন একটি সময়ে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনাতৈরি হয়, যখন কৃষক ও আন্তর্জাতিক ক্রেতারা পরস্পরের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতেন। এই পদক্ষেপটি নিলে, শরীর ও স্বাস্থ্যের উপর তামাকের হানিকর প্রভাবের প্রবক্তা, যাঁরা রাষ্ট্রকে তামাকের সেক্টর থেকে সমর্থন তুলে নেওয়ার জন্য তাড়না দিচ্ছেন, তাঁদেরই জয় হবে। কিন্ত এর পাশাপাশি, এরা বড় আকারের তামাক চাষী ও বহুজাতিক তামাক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলির সুবিধা করে দেবে। জল ও লাভজনক বিকল্প ফসলের অভাবে, অঞ্চলের ক্ষুদ্র তামাক চাষী ও ও কৃষিক্ষেত্রে কর্মরত শ্রমিকদের পরিস্থিতি কি হবে তা ভবিষ্যতই বলতে পারবে।
(এই নিবন্ধে যে ব্যক্তিদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তাঁদের নাম পরিবর্তিত)