ভারতের অর্থনৈতিক বিকাশ, পরিকাঠামোগত পরিবর্তন, ও মহিলাদের রোজগার

01/01/2024
IiT English Page

ভারতের পরিকাঠামোগত পরিবর্তনের কারণে মহিলাকেন্দ্রিক শ্রমশক্তির গড়নে একটা সুবিশাল পরিবর্তন এসেছে। বেশি বয়সের, কম শিক্ষিত মহিলারা শ্রমের বাজার থেকে বেরিয়ে গেছেন, এবং তার বদলে কমবয়সী ও বেশি শিক্ষিত মহিলারা সেই জায়গা নিয়েছেন। শ্রমশক্তিতে মহিলাদের অংশগ্রহণের ক্রমশ নিম্নগামী হারের বিষয়ে বিতর্কে এই প্রথম ঘটনাটি অনেক বেশি মনোযোগ পেয়েছে। ১৯৮৩ সালে, ৩৩ শতাংশ কর্মক্ষম গ্রামীণ মহিলা বৈতনিক কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২০১৭ সাল নাগাদ এই হার কমে ২০ শতাংশ হয়ে যায়। তারপর থেকে গ্রামীণ ভারতে মহিলাদের কর্মসংস্থানের হার বেড়েছে। তবে, গঠনগত পরিবর্তনের দ্বিতীয় দিকটিও একই রকম গুরুত্বপূর্ণ। এই দ্বিতীয় বিষয়টি স্পষ্ট হয় নিয়মিত বেতনভিত্তিক কাজে মহিলাদের যোগদানের হার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অনিয়মিত শ্রমে তাঁদের অংশগ্রহণের হার কমে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে। স্টেট অফ ওয়ার্কিং ইন্ডিয়া রিপোর্ট ২০২৩-এর নির্বাচিত বিবৃতিগুলি, কর্মসংস্থান সংক্রান্ত সরকারি নিরীক্ষা থেকে পাওয়া বিভিন্ন নজির ব্যবহার করে মহিলাদের উপার্জন ও লিঙ্গভিত্তিক উপার্জনের মধ্যে বৈসাদৃশ্যের উপর এই দ্বিতীয় দিকটির প্রভাব কি হতে পারে, তার উপর মনোযোগ দেয়।  

বিভিন্ন ধরনের বৃত্তির বেতনের মধ্যে বৈসাদৃশ্য
অনিয়মিত মজুরিভিত্তিক শ্রমের বদলে নিয়মিত বেতনভিত্তিক কাজের গুরুত্ব বাড়ার মত একটি গঠনগত পরিবর্তনের ফলে উপার্জনের ক্ষেত্রে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য অনেকটাই কমে যায়, কারণ এই ধরনের বৈষম্য প্রথম উদাহরণটির ক্ষেত্রেই বেশি ঘটে। একজন বৈতনিক পুরুষ কর্মীর মাসিক উপার্জন গড়ে প্রায় ১৭,৯১০ টাকা, এবং একজন বৈতনিক মহিলার উপার্জন মাসিক আয় মোটামুটি ১৩,৬৬৬ টাকা। অনিয়মিত মজুরিভিত্তিক শ্রমের ক্ষেত্রে, যেখানে এই বৈষম্য অনেক বেশি, সেখানে মহিলা কর্মীরা পুরুষ কর্মীদের চেয়ে ষাট শতাংশ কম রোজগার করেন।

দুর্ভাগ্যক্রমে, সংস্কার-পরবর্তী কালে স্বনির্ভর হওয়ার ক্ষেত্রে, মহিলাদের অংশগ্রহণ অচলাবস্থাতেই রয়ে গেছে (যা কোভিড এবং কোভিড-পরবর্তী সময়ে এই অবস্থা আরও বেড়ে গেছে) । এই বিষয়টি দুশ্চিন্তাজনক, কারণ স্বনির্ভর কাজের ক্ষেত্রে উপার্জনের বৈষম্য আরও বেশি। স্বনির্ভর মহিলাদের রোজগার, স্বনির্ভর পুরুষদের আয়ের মাত্র ৪০ শতাংশ। 

সারণী ১: কর্মসংস্থানের বিন্যাস জুড়ে পুরুষ ও মহিলাদের রোজগার

উৎস: পিএলএফএস ২০২১-২২। স্টেট অফ ওয়ার্কিং ইন্ডিয়া ২০২৩ থেকে ৬.১ সংখ্যক সারণী থেকে সংগৃহীত

উপার্জনের বন্টনের সমগ্র পরিসর জুড়ে এই বৈষম্যগুলি কিভাবে প্রকাশিত হয়? উপার্জনের সিঁড়ি বেয়ে মহিলারা যত উপরে উঠছেন, তাঁরা কি পুরুষকর্মীদের রোজগারের কাছাকাছি পৌঁছতে পারছেন, নাকি বৈষম্য আরও বেড়ে যাচ্ছে? নকশা ১ (নীচে দেওয়া হয়েছে) থেকে এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়। প্রত্যেক ধরনের কাজের ক্ষেত্রে, আমরা উপার্জনের মোট পরিমাণকে নিম্নতম উপার্জন (ডেসিল ১) থেকে উচ্চতম উপার্জনকে (ডেসিল ১০) দশটি অংশে ভাগ করেছি। সারণী ১ থেকে আমরা জানতে পারি যে, উপার্জন বন্টনের সম্পূর্ণ পরিসরে, স্বনির্ভর কাজের মাধ্যমে উপার্জন করেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে রোজগারের বৈষম্য সর্বাধিক। এর বিপরীতে, বৈতনিক কাজের ক্ষেত্রে উপার্জনের বৈষম্য অনেকটাই কম এবং বাস্তবিকই, বিভিন্ন স্তরের উপার্জনের সিঁড়ি বেয়ে একজন যত উপরে ওঠেন, এই বৈষম্য ততই কমে যেতে থাকে। বেতন উপার্জনকেন্দ্রিক কাজের বিন্যাসের শীর্ষস্থানে পৌঁছে, মহিলাদের গড় আয় পুরুষদের উপার্জনের ৯০ শতাংশ। অন্যদিকে, স্বনির্ভর কাজের ক্ষেত্রে উপার্জনের মধ্যে বৈষম্য এখনও অনেক বেশি। এই ক্ষেত্রে মহিলারা পুরুষদের আয়ের ষাট শতাংশ রোজগার করেন। যদিও, স্বনির্ভর কাজের ক্ষেত্রেও রোজগারের বন্টনের সিঁড়ি বেয়ে একজন যত উপরে উঠতে থাকেন, লিঙ্গভিত্তিক উপার্জনের বৈষম্য তত কমতে থাকলেও, দুই গোষ্ঠীর উপার্জনের মধ্যে একটা বড় পার্থক্য থেকেই যায়।     

নকশা ১: ডেসিল অনুসারে লিঙ্গভিত্তিক রোজগারের মধ্যে বৈষম্য 

উৎস: পিএলএফএস ২০২১-২২। স্টেট অফ ওয়ার্কিং ইন্ডিয়া ২০২৩ থেকে ৬.১ সংখ্যক সারণী থেকে সংগৃহীত

বিভিন্ন সময়ে উপার্জনের লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের প্রবণতা
স্বনির্ভর কাজ থেকে উপার্জনের সরকারি শুমার মাত্র ২০১৭ সাল থেকে শুরু হয়েছে। অথচ, বেতনজাত উপার্জনের বিষয়ে ১৯৮০-র দশক থেকে তথ্য পাওয়া যায়। বিভিন্ন সময়ে প্রতিটি কোয়ার্টাইল অংশের মধ্যে বেতনভুক কর্মীদের উপার্জনের বৈষম্যের নানা দীর্ঘস্থায়ী প্রবণতার চিত্র আমরা নকশা ২-তে দেখতে পাই।   

নকশা ২: বিভিন্ন সময়ে বেতনজাত উপার্জনের লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের নানা প্রবণতা

উৎস ও টীকা: এনএসএস আনএমপ্লয়মেন্ট এবং পিএলএফএস-এর বিভিন্ন দফা। এই নকশাটি স্টেট অফ ওয়ার্কিং ইন্ডিয়া ২০২৩-এর ৬.৪ নকশার অনুরূপ

প্রবণতাগুলির ব্যাখ্যা
দেখা যাচ্ছে, বিশেষ করে দ্বিতীয় আর তৃতীয় কোয়ার্টাইলে, উপার্জনের মধ্যে বৈষম্য ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। এই বৈষম্য কমে যাওয়ার প্রবণতাকে দুটি সম্ভাবনা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। প্রথমত, শ্রমের বাজারে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য হয়ত সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমে গেছে এবং নিয়োগকর্তারা পুরুষ ও মহিলাকর্মীদের সঙ্গে সমান ব্যবহার করছেন। অথবা, মহিলাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, নিয়মিত বেতন দেয় এমন যেসব বৃত্তি ও শিল্পে যোগদান করার সুযোগ তাঁদের হচ্ছে, সেগুলির উন্নয়ন হওয়ায়, শ্রমের বাজারে মহিলাদের অংশগ্রহণের (পুরুষদের বিপরীতে) প্রকৃতি বদলে গেছে।

আগে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে, এই সময়কাল জুড়ে নারীকেন্দ্রিক শ্রমশক্তির গঠনে সুবিশাল পরিবর্তন এসেছে। বয়স্ক ও অল্পশিক্ষিত মহিলারা শ্রমের বাজার থেকে বেরিয়ে গেছেন, এবং কমবয়সী ও বেশি শিক্ষিত মহিলারা প্রবেশ করেছেন। কৃষিক্ষেত্রে মহিলাদের যোগদানের হার কমেছে এবং পরিষেবা শিল্পে তাঁদের উপস্থিতি অনেক বেড়ে গেছে।   

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উপার্জনের বৈষম্যের পরিবর্তনকে এই গঠনগত বদলগুলি ঠিক কতটা ব্যাখ্যা করতে পারে, তা বুঝতে আমরা একটি স্ট্যান্ডার্ড ডিকমপোজিশন টেকনিক বা প্রামাণ্য খণ্ডীকরণ কৌশল ব্যবহার করি। কিতাগাওয়া-ওক্সাকা-ব্লাইন্ডার খণ্ডীকরণ পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যে গড় আয়ের পার্থক্যকে বিবেচনা করে ও এই পার্থক্যগুলির মধ্যে কোনটিকে ঠিক কত দূর পর্যন্ত “ব্যাখ্যায়িত পার্থক্য”, অর্থাৎ দুই গোষ্ঠীর মধ্যে পর্যবেক্ষণযোগ্য বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য, এবং কোনটি “অ-ব্যাখ্যায়িত পার্থক্য”, অর্থাৎ, অ-পর্যবেক্ষণযোগ্য বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য। পর্যবেক্ষণযোগ্য বৈশিষ্ট্যের মধ্যে পড়ে শিক্ষা, বিবাহগত অবস্থা, সন্তানের সংখ্যা, শিল্প ও বৃত্তি। অ-পর্যবেক্ষণযোগ্য উপাদানকে অনেক সময়ই বৈষম্যের পরিমাপ হিসেবে দেখা করা হয়, কিন্তু বর্জিত বৈশিষ্ট্য যেগুলির বিষয়ে কোনও তথ্য পাওয়া যায় না, সেগুলির প্রভাবও এর সঙ্গে যুক্ত। 

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাখ্যায়িত এবং অ-ব্যাখ্যায়িত উপাদানের বিস্তৃতিকে সারণী ২-তে দেখা যায়। ১৯৮৩ সাল থেকে, ব্যাখ্যায়িত উপাদানগুলির অবিচলিতভাবে পতন হতে দেখা যাচ্ছে। এর থেকে দেখা যায়, কিভাবে শ্রমের বাজারে মহিলা ও পুরুষদের বৈশিষ্ট্যগুলি সমতুল্য হয়ে ওঠে, এবং তার ফলে লিঙ্গভিত্তিক রোজগারের বৈষম্যকে নারী ও পুরুষের মধ্যে বৈশিষ্ট্যগত ভিন্নতার সাহায্যে ব্যাখ্যা করা কঠিন হয়ে পড়ে। ২০২১-২২ সাল নাগাদ, উপার্জনের বৈষম্যের প্রায় ৮০ শতাংশের কারণ হিসেবে অ-ব্যাখ্যায়িত উপাদানগুলিকেই ধরা হয়।।     

সারণী ২: লিঙ্গভিত্তিক রোজগারের পার্থক্যের খণ্ডীকরণ

উৎস ও টীকা: এনএসএস আনএমপ্লয়মেন্ট এবং পিএলএফএস-এর বিভিন্ন দফা। এই সারণীটি স্টেট অফ ওয়ার্কিং ইন্ডিয়া ২০২৩-এর ৬.৪ সারণীর অনুরূপ

এই বৃদ্ধিটি অনেক বেশি নাটকীয়ভাবে ঘটে গ্রামাঞ্চলের শ্রমশক্তির ক্ষেত্রে, যেখানে ২০২১-২২ সালে উপার্জনের লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের ৯০ শতাংশকে কর্মীদের বৈশিষ্ট্যের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যায় নি। কিন্তু যে সময়কালে বেতনভুক মহিলা শ্রমশক্তির দ্রুত উত্থান ঘটেছিল (১৯৯৯ থেকে ২০১৭), সেই সময়কালেই নাগরিক ভারতেও অ-ব্যাখ্যায়িত উপাদানের উত্থান হতে দেখা গিয়েছিল। তাই, এটিকে একটি সার্বজনীন ফয়সালা হিসেবে দেখা যায়। পরিশেষে, গ্রামীণ ভারতে এই বৈষম্য উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে গেলেও, শহরাঞ্চলে এই বৃদ্ধি অনেক কম উচ্চকিত। ব্যাপকতর সিদ্ধান্তটির উপর আরও জোর দেওয়া দরকার। যে সময়ে মহিলাদের মধ্যে নিয়মিত বেতন দেয় এমন বৃত্তিতে যোগ দেওয়ার মত ঘটনার উত্থান ঘটেছে, সেই একই সময়েই লিঙ্গভিত্তিক উপার্জনের বৈষম্যের অ-ব্যাখ্যায়িত অংশতেও বৃদ্ধি হতে দেখা গেছে, বৈষম্যকেই যার কারণ হিসেবে সাধারণত ধরা হয়।       

গত দুই দশকে ভারতীয় মহিলা শ্রমশক্তিতে একটা সুবিশাল বদল ঘটেছে। বেতনভুক কর্মচারী হিসেবে মহিলাদের অংশগ্রহণ যে বেড়েছে, তা সুসংবাদ। তবে, এই বৃদ্ধির ফলে উপার্জনের অ-ব্যাখ্যায়িত বৈষম্যে কোনও রকম পদ্ধতিগত হ্রাস হতে দেখা যায় নি। বরং, শিক্ষাগত যোগ্যতার উন্নতি, এবং কৃষিশিল্পের বাইরে অন্যান্য ক্ষেত্রে কাজের সুযোগ বাড়ার পরেও, মহিলারা পুরুষকর্মীদের চেয়ে কম রোজগারই করেন। কিন্তু আবারও, উপার্জনের সিঁড়ি বেয়ে কেউ যত উপরে ওঠেন, ততই যে এই বৈষম্য কমে তা উৎসাহব্যাঞ্জক। এই হ্রাস হয়ত অর্থনীতির অন্যান্য সংগঠিত ক্ষেত্রে মহিলাদের জন্য কম বৈষম্যমূলক অবস্থার প্রতিফলন। তাই, মেয়েদের শিক্ষার সুযোগের উন্নতি করে এমন সমস্ত নীতির প্রণয়ন, এবং সংগঠিত কাজের আরও প্রসার এই বৈষম্যকে আরও কমাতে সাহায্য করতে সক্ষম হবে ।     

অমিত বাসোল

Author

অমিত বাসোল আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অনুষদ সদস্য।

(Bangla Translation by Sritama Halder)
অনুবাদঃ শ্রীতমা হালদার

রোজা আব্রাহাম

Author

রোজা আব্রাহাম আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অনুষদ সদস্য।

(Bangla Translation by Sritama Halder)
অনুবাদঃ শ্রীতমা হালদার