ভারতের পররাষ্ট্র নীতির বৃহত্তর প্রেক্ষিতে, ভারতের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তাকেন্দ্রিক সম্পর্ক, ঐতিহাসিকভাবে, সর্বদাই মনোযোগ আকর্ষণ করে। যদিও, গত দুই দশক ধরে, মাত্রা ও মানের দিক থেকে, ভারত-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা-বিষয়ক পারস্পরিক নির্ভরশীলতা অনেক বেশি পরিণত হয়েছে, কিন্তু ভারত-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক অবসানের শোকবার্তা লেখার জন্য ভাষ্যকারদের শুধুমাত্র প্রয়োজন কিছু উত্তেজনাহীন মুহূর্তের। “সুদৃঢ় বন্ধন” ও “হিমশীতল সম্পর্ক” – এই দুই চরম অবস্থার মধ্যে দোলাচলের কারণে, বাস্তব পৃথিবীর জটিলতা বা যে অন্তর্নিহিত ঘটনাবলী এর পিছনে কাজ করে, তা উপলব্ধি করা কঠিন হয়ে পড়ে। সমসাময়িক ভারত-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা বন্ধনের ধাপগুলিকে সত্যিই বুঝতে হলে, ইন্টারন্যাশনাল রিলেশান্স রোল থিওরির দুটি ধারণার যুগপৎ পারস্পরিক ক্রিয়াকে উপলব্ধি করা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। এই দুটি বিষয় হলঃ সিকিওরিটি রোল কনসেপশানের ধারণা তৈরির ক্ষেত্রে সঙ্গতি ও কনভার্জেন্স-ডাইভার্জেন্স ডায়নামিক্স।
ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রোল কমপ্যাটিবিলিটি
বৃহত্তর আন্তর্জাতিক প্রণালীতে নীতিনির্মাতারা অন্যান্য দেশের প্রেক্ষিতে নিজের দেশকে কি ভাবে দেখেন (সেলফ-কনসেপশান) এবং তার সঙ্গে সঙ্গে, বাইরের দেশগুলি আলোচ্য দেশটির থেকে কি আশা করে (রোল প্রেস্ক্রিপশান) - রোল কমপ্যাটিবিলিটি (আরসি)-র ধারণাটি তার দিকে নির্দেশ করে। সংক্ষেপে এর অর্থ হল, একটি রাষ্ট্রের সেলফ-কনসেপশান এবং বাহ্যিক প্রত্যাশার মধ্যে পারস্পরিক ক্রিয়া। প্রতিটি রাষ্ট্রই অসংখ্য পররাষ্ট্র নীতি এবং নিরাপত্তা-সংক্রান্ত আরসি অনুসরণ করে, যা তার পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ক আচরণ ও নির্বাচনকে রূপদান করে। একটি দেশের সেলফ-কনসেপশানের উপর নির্ভর করে, সে আরেকটি দেশ থেকে কি আশা করবে তা নির্ধারিত হয়। একজন অংশগ্রহণকারীর সেলফ-কনসেপশান এবং অন্য একটি দেশের প্রত্যাশার মধ্যে সমতা থাকলে, তাকে দুই দিকের মধ্যে রোল কমপ্যাটিবিলিটি বলে বর্ণনা করা হয়।
ভারত-মার্কিন যুক্তরাষ্টের কৌশলগত সম্পর্কের নির্দিষ্ট গতিপথকে এই ধারণাটি ব্যাখ্যা করে। এই শতকের শুরু থেকেই, ফার্স্ট রেসপন্ডার ও ভারত মহাসাগর অঞ্চল বা ইন্ডিয়ান ওশান রিজিয়ন (আইওআর)-এ একজন নিরাপত্তা সরবরাহকারী হিসেবে, নতুন দিল্লী নিজেকে একটি প্রধান শক্তি হিসেবে দেখতে শুরু করেছে। এই ধারণাগুলি এর বিশ্বব্যাপী ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা-বিষয়ক আচরণের রূপদান করে। এই সময়ই, এই অঞ্চলে চিনের প্রভাবে ভারসাম্য আনতে, ওয়াশিংটন ভারতকে গুরুত্ব দিতে উৎসাহী হয়ে ওঠে এবং এর ফলে, তাদের আগ্রহ ও স্বার্থের আরও বেশি করে সংমিশ্রণ হতে শুরু করে। ভারতের থেকে আমেরিকার প্রত্যাশা অনেক কিছুর দ্বারাই প্রভাবিত হয়ঃ চিনের সামরিকবাহিনীর উত্থান, বিদেশে আমেরিকার সুদুরপ্রসারী সামরিক অঙ্গীকার এবং তার আভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সমস্যা, এবং এশিয়া মহাদেশের একজন সম্ভাব্য নিরাপত্তা সরবরাহকারী হিসেবে ভারতের অবস্থান। আইওআরে নিরাপত্তা দেওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের সম্ভাব্য ভূমিকা, এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে নিরাপত্তার দায়িত্ব ভাগ করে নেবে এমন একটি সমমনস্ক অংশীদার দেশের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে সন্ধান, সেখানে মানানসই হয়ে ওঠে
২০০৪ সালের ভারত মহাসাগরের সুনামি একটি সুবিশাল সন্ধিক্ষণ ছিল। এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পর পরই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে একটি অপরিকল্পিত অংশীদারিত্ব গড়ে ওঠে। এই দেশগুলির সম্পদ ও প্রচেষ্টার মধ্যে একটি সহযোগিতার সম্পর্কের সাফল্যই কোয়াডের বীজ রোপন করে। বিশেষ করে চিনের দিকটি বিবেচনা করার পর, যাবতীয় আঞ্চলিক সমস্যার মুখোমুখি হওয়ার ক্ষমতা যে এই চারটি গণতান্ত্রিক দেশেরই আছে – এই বিশ্বাসটি তৈরি হয়েছে। নিরাপত্তার বিষয়ে নতুন দিল্লীর ধারণা ও ভারতের প্রেক্ষিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রোল পার্সেপশানের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সমতা ছিল। ওয়াশিংটন, তার মিত্রশক্তি জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ভারতের উন্নত বন্ধনকে আনুকূল্য দেয়। এই ক্রমবর্ধমান মৈত্রী থেকেই কোয়াড ১.০ উঠে আসলেও, তা নিয়ে নতুন দিল্লী ও ক্যানবেরা স্পষ্টতই অনীহা প্রকাশ করে, কারণ এই ধরনের অংশীদারিত্ব বেইজিংকে উত্তেজিত করবে এবং তার ফলে দ্বিদেশীয় সমস্যার ছায়া আরও ঘনীভূত হয়ে উঠবে। অস্ট্রেলিয়া বেরিয়ে যাওয়ার পর এই গোষ্ঠীটি ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যায়।
তা সত্ত্বেও, পরবর্তী দশকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ভারতের দ্বিদেশীয় সম্পর্কের উন্নতি যথেষ্ট উন্নতি ঘটে। চিনের উত্থানের কারণে আঞ্চলিক সমস্যাগুলির মাত্রা ও তীব্রতা যে কতটা বাড়তে পারে, চিনের সামরিক অবতার যত বেশি জোরাল হয়ে উঠতে থাকে, নতুন দিল্লী, ওয়াশিংটন, ক্যানবেরা ও টোকিয়ো তা তত বেশি করে বুঝতে শুরু করে। নেতৃত্বের ভূমিকায় যাঁরা আছেন তাঁরা এও উপলব্ধি করেন যে, চিন যে ধরনের বিপদের প্রতীক, তা একটি দেশের পক্ষে একা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।
২০০৭ সালে, ভারত ও চিনের মধ্যে ঘটা ঢোকলাম সঙ্ঘর্ষের পরেই, কোয়াডের মত একটি বন্দোবস্তের প্রতি ভারতের আগেকার অনীহা চলে যায়। একদিকে, ভারত কোয়াডকে সাগ্রহে গ্রহণ করার ফলে, ২০২৭ সালে তার (কোয়াডের) পুনর্জন্ম ঘটে, এবং ২০১৭ সালের সহকারী সচিব স্তরে যোগাযোগ থেকে শুরু করে ২০১৯ সালের মন্ত্রীত্বের স্তর পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া পর্যন্ত গোষ্ঠীটি ধাপে ধাপে বিবর্তিত হয়ে চলে। অন্যদিকে, তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক যাতে কিছুটা অন্তত স্থিতিশীলতা, তা নিয়ে নতুন দিল্লী বেইজিংকে উৎসাহ দিতে থাকে। ভারত-চিন সম্পর্কের পুনঃস্থাপন এবং রাষ্ট্রের মাথাদের মধ্যে মতবিনিময়ের মত বিষয়গুলি থেকে এই বিষয়টি স্পষ্ট হয়। ২০২০ সালের রক্তাক্ত সীমান্ত সংঘর্ষটি এই প্রচেষ্টায় একটি মোড় আনে এবং চিনের প্রেক্ষিতে ভারতের অবস্থান আবারও কঠোর হয়ে ওঠে। ২০২০ সালের শেষের দিকে, ভারত শুধু যে অস্ট্রেলিয়াকে মালাবার নৌবাহিনী অনুশীলনের (যাতে আগে শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও ভারতকে অন্তর্ভুক্ত ছিল) অংশ হিসেবে স্বীকার করে নি, উচ্চতম নেতৃত্বকে জড়িয়ে কোয়াডের পারস্পরিক যোগাযোগকে চরম সীমাতেও নিয়ে গেছে। ২০২১ সালের কোয়াড সমাবেশ প্রথমবার একটি যুগ্ম বিবৃতির সম্প্রচার করে এবং কোয়াডের লক্ষ্য সম্প্রসারিত হয়ে, টিকা সংক্রান্ত কূটনীতি, পরিকাঠামোগত উন্নয়ন, সামুদ্রিক নিরাপত্তা এবং জটিল প্রযুক্তির মত আরও উচ্চাশাপূর্ণ পরিকল্পনাকে যোগ করে। আরেকটি প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ২০২৩-এর কোয়াডের যুগ্ম বিবৃতিটি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কথা উল্লেখ করে ও “পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার বা ব্যবহারের হুমকি দেওয়াকে” নিরুৎসাহিত করে।
রোল কম্প্যাটিবিলিটি থেকে বিচ্যুতিঃ একটি উভয়সঙ্কটের কাহিনী
কোয়াড ২.০ যত বিবর্তিত হতে থাকে, এর দলবদ্ধতা, যাকে অনেক সময়ই অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য বা ইউনাইটেড কিংডম এবং ইউএস বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মৈত্রীবন্ধনের ফলে গঠিত এইউকেইউএস-এর সঙ্গে তুলনা করা হয়, তাকে পর্যবেক্ষকরা অনেক সময়ই খুব একটা ফলপ্রসূ নয় বলেই বর্ণনা করেন। আনুষ্ঠানিকভাবে মিত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত তিনটি দেশের এই দলে ভারত একমাত্র দেশ যে কিনা মিত্র হিসেবে যোগদান করে নি এবং কোয়াডের জন্য একটি কঠোরতর নিরাপত্তাদাতার ভূমিকা নিতে অনিচ্ছুক ছিল। এই কারণে ভারতকে অনেকেই “দুর্বলতম সংযোগ”" হিসেবে চিহ্নিত করেছে ও তার বাহ্যিক আচরণকে অসঙ্গত বলে বর্ণনা করা হয়েছে। ২০২২ সালে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ নিয়ে নতুন দিল্লীর মূক সমালোচনা, প্রত্যাশিতভাবেই, পশ্চিমের দেশগুলিকে নিরাশ করে এবং তার ফলে নিরাপত্তার বিষয়ে অংশীদার হিসেবে ভারতের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। রোল কমপ্যাটিবিলিটির বৃহত্তর সমীকরণের মধ্যে বিচ্যুতির এই এলাকাগুলি দ্বিদেশীয় ও ক্ষুদ্রতর অংশীদারিত্বের ক্ষেত্রে বাস্তব পৃথিবীর জটিলতাকে চিহ্নিত করে।
রোল কম্প্যাটিবিলিটির বৃহত্তর ছাতার নিচে, দেশ বা অভিনেতাদের মধ্যে অভিন্ন স্বার্থ এবং ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ/অগ্রাধিকার দানের ঘটনা একই সঙ্গে ঘটে চলে। এই জটিল ঘটনাটিকে কনভার্জেন্স-ডাইভার্জেন্স ডাইনামিক্স বলে আখ্যা দেওয়া হয়। অংশীদারদের (বা এমনকি, মিত্র দেশগুলির) মধ্যে সমরূপ বা ভিন্ন স্বার্থ থাকা একটি অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা এবং এই দুইয়ের অনুপাত, যে কোনও একটি নির্দিষ্ট সময়ে, সম্পর্কের শক্তি বা দুর্বলতাকে প্রতিফলিত করে।
ইন্দো-প্যাসিফিকের ক্ষেত্রে ভারত-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত স্বার্থ অভিন্ন হলেও, ওয়াশিংটন ও নতুন দিল্লী কি ভাবে এই বিষয়টিকে দেখে এবং এই অঞ্চল সংক্রান্ত সমস্যাকে কি ভাবে সমাধানের চেষ্টা করে, তার মধ্যে পার্থক্য আছে। প্রথমত, চিনের জোরাল উত্থান ও এমনকি রাশিয়ার তর্জনের প্রেক্ষিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইন্দো-প্যাসিফিককে এমন একটি অঞ্চল হিসেবে দেখে, যেখানে নিয়ম-নির্ভর উদারনৈতিক আন্তর্জাতিক বিন্যাসের সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। এর বিপরীতে, ভারত ইন্দো-প্যাসিফিককে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের কিছু বিশেষ অভিনেতার সমষ্টি হিসেবে দেখে না, যা যে কোনও দেশের (অর্থাৎ চিনের) বিরোধী। নতুন দিল্লী একে একটি “অন্তর্ভুক্তিমূলক” এলাকা হিসেবে দেখে ও বেশ কয়েকবার, তার ইন্দো-প্যাসিফিকের সংজ্ঞায়, চিন ও রাশিয়াকে যুক্ত করার সংকেতও দিয়েছে। এর থেকেই বোঝা যায় যে, ভারত কেন সুনিশ্চিতভাবে বলে যে, কোয়াড কোনও একটি দেশের বিরুদ্ধে চালিত নয়, কারণ কোয়াডকে চিন-বিরোধী একটি দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার বিষয়ে ভারত সব সময়ই খুবই সতর্ক থাকে।
দ্বিতীয়ত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিজের স্বার্থের ক্ষেত্রে চিন যে খুবই বিপজ্জনক, সে বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যথেষ্টই সরব এবং চিনকে নিরস্ত করতে, এমনকি প্রয়োজনে যুদ্ধ করতেও প্রস্তুত তারা। ভারত, অন্য দিকে, চিনের সঙ্গে সরাসরি সম মানের ভারসাম্য বজায় রাখার বিষয়ে খুবই সতর্ক থাকে, এবং তার বদলে, ভারত বরং চিনের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা-সহযোগিতা নকশা বা কমপিটিশান-কোঅপারেশান মডেলটি অনুসরণ করে। কোয়াডের সঙ্গে নতুন দিল্লীর সম্পর্ক কতটা গভীর বা মৃদু হবে তা নির্ভর করে ভারত, যে কোনও নির্দিষ্ট সময়ে চিনের সঙ্গে কি ব্যবহার করবে বলে ভারত কল্পনা করে। এই ব্যবহারগুলি একটি স্থিতিশীল সমীকরণের সন্ধান থেকে শুরু করে কোনও একটি বিশেষ আচরণের বিরুদ্ধে চাপ দেওয়া পর্যন্ত হতে পারে। চিনের প্রেক্ষিতে একটি লাভক্ষতির সাময়িক বিশ্লেষণ, কোয়াডের সঙ্গে ভারতের নিরাপত্তা-বিষয়ক সহযোগিতা বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অন্যান্য যুগ্ম কর্মকাণ্ডকে নির্ধারণ করে।
তৃতীয়ত, নতুন দিল্লী গত দুই দশক ধরে পশ্চিমের দেশগুলির দিকে ঝুঁকলেও, পাশাপাশি সে আরও অনেকগুলি অংশীদার দেশের সঙ্গেই সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রেখে চলছে এবং কিছু সময় আবার এই সহযোগী দেশগুলি পরস্পরের প্রতি ঠিক মিত্রভাবাপন্ন নয়। এই বিষয়টি, কোয়াডের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদেশগুলির সঙ্গে ভারতের সহযোগিতা ও চিন এবং রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের বন্ধন বজায় রাখার জন্য অন্য বন্দোবস্ত করার মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে (এর থেকে ইউক্রেনে রাশিয়ার কার্যকলাপ নিয়ে ভারতের নৈঃশব্দের কারণও বোঝা যায়)। “কৌশলগত স্বশাসন”-এর প্রতি ভারতের অমোঘ আকর্ষণ এবং এক বা একাধিক প্রতিযোগী রাষ্ট্রের উপর কোনভাবেই নির্ভর না করার তার যে ঐতিহ্য, তার সঙ্গে ভারতের এই বহু-জোটবদ্ধতার অবস্থানের সম্পর্ক আছে। এখনও পর্যন্ত, ভারত খুবই কার্যকারী ভাবে তার এই অদ্ভুত সঙ্গীদের সঙ্গে ভারসম্য বজায় রেখে চলতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু, বিশেষ করে, ভবিষ্যতে যদি চিন আরও বিপজ্জনক হয়ে ওঠে, তাহলে শেষ পর্যন্ত এই পদক্ষেপ কতটা স্থায়ী ও সফল হবে, তা তর্কসাপেক্ষ।
চতুর্থত, চিরকালই ভারতের আগ্রহ ভারত মহাসাগর এলাকার প্রতি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনোযোগ প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের উপর।। ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্টের নিজের নিজের অঞ্চল এবং আগ্রহের বিষয়গুলি ক্রমশ আরও বেশি করে মিশে যেতে শুরু করলেও, যে সমস্ত এলাকায় চিনের কার্যকলাপ সরাসরি ভারতের নিরাপত্তার স্বার্থে আঘাত করে না (যেমন, তাইওয়ান বা, এমনকি বর্তমান প্রেক্ষাপটে স্পষ্টতই ইউক্রেন) নতুন দিল্লী সম্ভবত সেগুলির সঙ্গে লিপ্ত হতে চায় না, বা সেগুলির বিষয়ে খুব একটা উৎসাহী নয়। ভারতের এই অবস্থানটি চিরাচরিত নিরাপত্তার বিষয়ে কোয়াডের হস্তক্ষেপের নির্দিষ্ট গতিপথকে স্বাভাবিকভাবেই প্রভাবিত করবে।
অংশীদারদের মধ্যেও পার্থক্য থাকাটা কোনও অস্বাভাবিক কিছু নয়, এবং সব সময় এর অর্থ দুই পক্ষের মধ্যে সুতীব্র বিরোধিতা নয়। তার পরিবর্তে, যদি একটি দীর্ঘস্থায়ী রোল কম্প্যাটিবিলিটি থাকে তাহলে, নীতিনির্ধারক/কূটনীতিবিদরা এমন সমস্ত উপায় তৈরি করতে পারেন, যার ফলে, সমস্যা থাকা সত্ত্বেও দুটি সহযোগী দেশ পরস্পরের সঙ্গে কাজ করে যেতে পারে এবং/অথবা কোন একটি বিষয় নিয়ে বেশ কিছু সময় ধরে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতে পারে। একটি উদাহরণ দিয়ে এই বিষয়টিকে বোঝান যেতে পারে – “সামুদ্রিক অঞ্চল সংক্রান্ত শৃঙ্খলা” ও “নৌবহর পরিচালনার স্বাধীনতা” – এই দুই বিষয়ে ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে আকাশপাতাল পার্থক্য আছে। ভারত ইউনাইটেড নেশন্স কনভেনশান অন দি ল অফ দা সি (ইউএনসিএলওএস)-কে অনুমোদন করলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তা করে নি এবং এই আইনটির বিষয়ে দুটি দেশেরই নিজস্ব ব্যাখ্যা আছে (চিন আইনটিকে যেভাবে বোঝে, ভারতের ব্যাখ্যাটি তার কাছাকাছি যায়)। ভারতীয় আইন তার নিজের একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চলে নৌচালনার স্বাধীনতার বিরুদ্ধে এবং কূটনৈতিক স্তরে এই পার্থক্যগুলিকে যথেষ্ট নিপুণভাবে চালনা করা হয়েছে এবং সেগুলি সামুদ্রিক এলাকায় সহযোগিতার বিষয়টিকে প্রতিকূলভাবে প্রভাবিতও করে না, যা অন্ধকারে একটি আলোর দিশা বলেই মনে হয়।
সামগ্রিকভাবে, ভারত-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত এবং নিরাপত্তা-বিষয়ক সম্পর্ক ত্রুটিহীন নয় এবং আসন্ন ভবিষ্যতে এই সম্পর্ক নিখুঁত হবে বলে মনে হয় না। যে রোল কম্প্যাটিবিলিটি এই দুই দেশই উপভোগ করে, তাতে এই ভিন্নতার ছায়া থেকেই যাবে। নিরাপত্তার দিক থেকে দেখলে, কোয়াডের অবস্থানকেও হয়ত এই বিষয়টি প্রভাবিত করবে। তবে, এই পার্থক্য হয়ত তাদের দ্বিদেশীয় সম্পর্কের ক্রমবর্ধমান উন্নতিকে, বা কোয়াডের বিন্যাসে অংশ নেওয়াকে ব্যাহত করবে না বিশেষ করে চিনের আচরণই যদি তাদের মধ্যে নিকট সম্পর্ক গড়ে তোলার একমাত্র কারণ হয়। সংক্ষেপে বলতে গেলে, ভারত-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং তাদের সহযোগিতার বিষয়টি কঠোরভাবে সাদা-কালো নয়, বরং তাতে ধূসরের নানা স্তর দেখা যায়।